সভ্যতার শুরু থেকেই উৎসব মানবজাতির জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। উৎসব মানেই সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় ভাবধারার মিশেল। বর্তমান হোক বা পাঁচ হাজার বছর পূর্বে নীলনদের অববাহিকায় গড়ে ওঠা মিশর— উৎসবের রীতি সব জায়গাতেই বিদ্যমান। প্রাচীন মিশরে প্রতিবছর বহু উৎসব জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করা হতো। মিশরীয় দেবতাদের উৎসবের প্রধান অতিথি মেনে, একটি নির্দিষ্ট স্থলপথে বা জলপথে নৌকার মাধ্যমে শোভাযাত্রার আয়োজন সম্পন্ন করা হতো। উৎসবগুলো অনুষ্ঠিত হতো বিভিন্ন মৌসুমকে ঘিরে। যেমন: আখেত বা বন্যার মৌসুম, শেমু বা ফসল কাটার মৌসুম, পেরেট বা ক্রমবর্ধমান মৌসুম। এসব ছিল তৎকালীন মিশরে প্রচলিত ঋতু। প্রাচীন মিশরীয়দের এক বছরের পঞ্জিকা বারো মাসে বিভক্ত ছিল। প্রতি মাসে দিনের সংখ্যা ছিল ত্রিশটি। তবে, বছরের শেষ দিকে পঞ্জিকাতে অতিরিক্ত পাঁচ দিন যোগ করা হতো। তা কোনো নির্দিষ্ট মাসের অংশ ছিল না। প্রাচীন মিশরের জনপ্রিয় কিছু উৎসবই আজকের আলোচ্য বিষয়।
অপেত উৎসব
অপেত উৎসবের শুরু মধ্যবর্তী রাজবংশের সময়। নতুন রাজবংশ থেকে শুরু হয়ে এর পরবর্তী সময়গুলোতে অপেত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে আখেত মৌসুমের দ্বিতীয় মাসে, নীলনদের বন্যার সময়। বার্ষিক এই অনুষ্ঠান প্রতিবছর থেবসে ধুমধাম করে পালিত হতো। ফারাও ভেদে এই উৎসবের স্থায়িত্ব ছিল ভিন্ন। ফারাও তৃতীয় তুথমোসের আমলে এই উৎসব ১১ দিন চললেও, ফারাও তৃতীয় রামেসিসের সময় এটি ২৪ দিন স্থায়ী হতো।
এই উৎসবে পুরোহিতেরা দেবতা আমুনের মূর্তি সাফসুতরোর পর নতুন বস্ত্র পরিধান করিয়ে শোভাযাত্রায় বের হতেন। রাস্তাঘাট সাধারণ জনগণের কলতানে মুখরিত থাকত। তারা আগে থেকেই আমুনের মূর্তি দেখার জন্য রাস্তার দুই ধারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকত। তারপর সেটিকে নৌকায় করে লাক্সরের মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে ফারাও দেবতা আমুন-রা এর সাথে পবিত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতেন। তাদের বিশ্বাস ছিল, এতে করে ফারাও স্বর্গীয় জননশক্তি লাভের পাশাপাশি, মিশরকে শাসন করার ঐশ্বরিক অধিকার লাভ করতেন।
উপত্যকার সুশোভিত উৎসব
উপত্যকার সুশোভিত উৎসব পালিত হতো মধ্যবর্তী রাজবংশের আমলে। থেবসের জনগণ মহা সমারোহ ও জাঁকজমকপূর্ণভাবে এই উৎসবটি পালন করত। মৃতদের নিয়ে পালিত এই উৎসবে আমুনের মূর্তি দেখা যেত। মূলত আমুনের মূর্তি নেতৃত্ব দিত উৎসবের শোভাযাত্রায়। এই উৎসবে পবিত্র নৌকাতে করে আমুন, তার সঙ্গী মুট এবং তাদের পুত্র খোনসু থেবসের পূর্ব তীর থেকে পশ্চিম তীরে কবরস্থান পরিদর্শনের জন্য কারনাকের মন্দির ছেড়ে যেতেন।
সোকার উৎসব
প্রারম্ভিক রাজবংশের সময়ে সোকারকে কৃষি দেবতা হিসেবে মান্য করা হতো। প্রাচীন সাম্রাজ্যে দেবতা ওসাইরিসের স্মরণে খোয়াক নামে এক উৎসব পালন করা হতো, যা ওই আমলে সোকার উৎসবের সাথে মিশে যায়। প্রথমদিকে এই উৎসব আড়ম্বরপূর্ণ না হওয়ায়, তাতে তেমন জাঁকজমকের ছোঁয়া ছিল না। পালিত হতো সাদামাটাভাবে। কিন্তু এতে ওসাইরিসের পুনরুত্থানকে সংযুক্ত করা হলে, তখন থেকে এটি মাসব্যাপী উদযাপিত হতে থাকে। ঐসময় মিশরবাসী বাগান ও ফসল রোপণের মাধ্যমে দেবতাদের সম্মান জানাত।
হেব-সেদ উৎসব
ফারাও জোসেরের পিরামিডের দক্ষিণ চত্বরের সমান্তরালে অবস্থিত একটি আয়তক্ষেত্রাকার স্থানকে বলা হয় হেব-সেদ চত্বর। মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে ফারাও যাতে হেব-সেদ উৎসব আড়ম্বরে পালন করতে পারেন, সেজন্য এই চত্বর বানানো হতো। হেব-সেদ উৎসবে মিশর সম্রাট তার মানসিক ও শারীরিক দক্ষতা প্রদর্শন করতেন। সিংহাসনে বসার পর পরই পঞ্জিকা ধরে এই উৎসব পালন করা যেত না। এর জন্য ফারাওকে ত্রিশ বছরের শাসনকাল পূরণ করতে হতো। এরপর প্রতি তিন বছর পর পর এই উৎসব পালনের নিয়ম ছিল। উৎসবটি কিছু অংশে বিভক্ত ছিল। প্রথম অংশে ফারাওকে দেবতাদেরকে তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে হতো, এরপর ঊর্ধ্ব মিশরের সাদা রাজমুকুট, এবং নিম্ন মিশরের রাজমুকুট পরিধান করতে হতো। রাজমুকুট পরিধানের পর্ব শেষ হয়ে গেলে বিশেষ এক পোশাক পরে তিনি শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতেন। এখানেই শেষ নয়। তার ভেতর যে এখনও শৌর্যবীর্য প্রতিনিয়তই ঢেউ খেলে যাচ্ছে, তিনি যে এখনও রাজ্যভার সামলানোর জন্য পুরোপুরিভাবে যোগ্য, তা প্রমাণের জন্য তিনি শোভাযাত্রা শেষে তরুণদের সঙ্গে কুস্তি লড়তেন, তীর ছুড়তেন। এই উৎসবের সারবস্তু ছিল— দেবতারা ফারাওকে জাদুর মাধ্যমে আবারও তরুণ বানিয়ে তুলেছেন। তার সকল ক্ষমতা পরবর্তী ত্রিশ বছরের জন্য আবারও পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।
ওয়েপেত-রেনপেত উৎসব
এই উৎসবকে নববর্ষ উৎসবের সাথে তুলনা করা যায়। তবে, এই উৎসব পঞ্জিকার সাথে মিল রেখে পালিত হতো না। উৎসবের দিনক্ষণ নির্ভর করত নীল নদের বন্যার উপর। ধারণা করা হয়, এই উৎসব চালু হয় প্রাচীন সাম্রাজ্যের সময় থেকে। দেবতা ওসাইরিসকে কেন্দ্র করে এই উৎসব উদযাপিত হতো। ওসাইরিসের মৃত্যু সম্পর্কিত আচার-অনুষ্ঠান পালনের পাশাপাশি তার পুনর্জাগরণ উদযাপনের জন্য নাচ-গান করা হতো। বেশ কয়েকদিন ধরে চলা এই উৎসবের বৃহৎ একটা অংশ ছিল ভোজ এবং মদ্যপান ঘিরে। উৎসবের শুরুর দিকে ‘The Lamentations of Isis & Nepthtys’ পাঠ করে দেবতা ওসাইরিসকে ভোজের জন্য আহবান করা হতো। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, ফারাও হাতশেপসুতের আমলে বছরের প্রথম দিনে মা’তের মন্দির সজ্জিত করে এই অনুষ্ঠান পালিত হতো। এই উৎসবের সাথে সেখমেতের কিংবদন্তিও সংযুক্ত ছিল।
বাস্ত উৎসব
মিশরীয় উপকথায়, দেবী বাস্তেত ছিলেন গৃহের অভিভাবক এবং শিশু, নারী, ও নারীর রহস্যময় অংশের রক্ষক। পরবর্তীতে তিনি বিড়াল-দেবী হিসেবে জনপ্রিয়তা পান। বিড়াল-দেবী ‘বাস্তেত’ এর পবিত্র ধর্মীয় স্থান বুবাস্তিতে উদযাপিত হতো বাস্ত উৎসব। ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের মতে, মিশরে বাস্ত উৎসবের বিস্তৃতি ছিল অন্য সকল উৎসবের চেয়ে বেশি। প্রায় সাত লক্ষেরও বেশি মানুষের কলতানে মুখরিত থাকত এই মেলা। তবে ব্যাপারটিকে বর্তমানে অতিরঞ্জিত হিসেবে ধরা হয়। এই উৎসবে নারীদেরকে সকল সীমাবদ্ধতার আবদ্ধ গণ্ডি থেকে মুক্তি দেওয়া হতো। তারা মদ্যপান করত, উদ্দামতার সাথে নাচত, বাদ্যযন্ত্র বাজাত, এবং তাদের গোপনাঙ্গ প্রদর্শন করত।
ওয়াগ উৎসব
ওয়েপেত-রেনপেত উৎসবের পর পালিত হতো ওয়াগ উৎসব। ওয়েপেত-রেনপেত উৎসবের মতো এই উৎসবও ছিল দেবতা ওসাইরিসকে ঘিরে। তবে শাশ্বত পরকালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা মৃতদের বিদেহী আত্মাকে সম্মানও জানানো হতো এই উৎসবে। এই অনুষ্ঠানের সময় মিশরীয়রা কাগজ দিয়ে ছোট ছোট নৌকা বানিয়ে তা ওসাইরিসের সমাধিকে উদ্দেশ্য করে পশ্চিমে ভাসিয়ে দিতেন।
ওয়াগ-থোথ উৎসব
এই উৎসব ছিল মূলত দেবতা থোথের সাথে ওয়াগ উৎসবের সমন্বয় সাধন। বছরের প্রথম মাসের আঠারোতম দিনে পালিত হতো এই উৎসব। পরকালে প্রতিটি আত্মার বিচারকার্যের সময় বিচারসভায় ওসাইরিসের সাথে উপস্থিত থাকবেন জ্ঞানের দেবতা থোথ। এই ভাবনা থেকেই ওয়াগ-থোথ উৎসবের উৎপত্তি। প্রাচীন সাম্রাজ্যের সময়ের শেষ দিকে শুরু হওয়া উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল থোথের জন্ম এবং ওসাইরিসের পুনর্জন্ম।
হাথোর উৎসব
প্রাচীন মিশরের গুরুত্বপূর্ণ এক দেবী হাথোর ছিলেন আকাশ-দেবতা হোরাস ও সূর্য-দেবতা রা-এর একাধারে মাতা ও পত্নী। দেবী হাথোরের জন্মদিন উপলক্ষে তার অনুসারীরা দেনদেরাতে প্রতি বছর এই উৎসব পালন করত মদ্যপান ও নৃত্যানুষ্ঠানের প্রথার মধ্য দিয়ে। হাথোরকে কেন্দ্র করে আরেকটি নথিবদ্ধ টলেমীয় উৎসবের সন্ধান পাওয়া যায়। এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সুন্দর পুনর্মিলনের উৎসব’। ১৪ দিনেরও বেশি সময় ধরে এই উৎসব পালিত হতো। এই উৎসবে হাথোরের মূর্তিকে দেনদেরা থেকে নৌকায় করে বিভিন্ন মন্দির ক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হতো, যাতে তিনি সে মন্দিরের দেবতাদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। এই যাত্রার গন্তব্য শেষ হোরাসের মন্দিরে গিয়ে। সেখানে হাথোরের মূর্তিকে হোরাসের মূর্তির সঙ্গে স্থাপন করা হতো। এটি ছিল প্রাচীন মিশরের বহুল প্রতীক্ষিত উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রচুর মানুষের সমাগম হতো এই উৎসবে।
প্রাচীন রাজবংশীয় শাসনামলে নেইথ ছিলেন রাজদরবারের অন্যতম প্রসিদ্ধ একজন দেবী। কিন্তু চতুর্থ রাজবংশে এসে সেই জায়গা দখল করে নেন দেবী হাথোর। পরবর্তীতে, ফারাও নেফেরু দেবী হাথোরের সম্মানে একটি মন্দির নির্মাণ করেন, এবং সেই মন্দিরে দেবী হাথোরের প্রথম পুরোহিত ছিলেন নেফেরুর কন্যা জেদেফ্রা।
তেখ উৎসব
মিশরীয় জনশ্রুতি অনুসারে, একবার মানবজাতিকে মদের মাধ্যমে ধ্বংসের পায়তারা করা হয়। তখন তাদের ধ্বংসের দোরগোড়া থেকে রক্ষা করেছিলেন দেবী হাথোর। ওই সময়ের কথা স্মরণ করে এই উৎসবে এত পরিমাণ মদ্যপান করা হতো যে, এই উৎসবকে ‘মাতালদের ভোজ’ও বলা হতো। মধ্যবর্তী সাম্রাজ্যের সময় শুরু হওয়া এই উৎসব সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল নতুন সাম্রাজ্যের প্রথমদিকে। হঠাৎ করেই এর জনপ্রিয়তা কমে গিয়ে আবার তার পুনরুত্থান ঘটে রোমান যুগে।
নেহেবকাউ উৎসব
নেহেবকাউ ছিলেন প্রাচীন মিশরীয় উপকথার সর্প দেবতা। শুরুর দিকে তিনি অপদেবতা হিসেবে বর্ণিত হলেও, পরবর্তীতে পরকালের জীবন সম্পর্কিত দেবতা হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই নিয়েছেন। দেবতা নেহেবকাউয়ের কাজ ছিল জন্মের সময় বিদেহী আত্মাকে শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া। এই দেবতাকে নিয়ে প্রাচীন মিশরে এক উৎসব প্রচলিত ছিল। এই উৎসবে দেবতা ওসাইরিসের পুনরুত্থান এবং তার আত্মাকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হতো। এটি পুনর্জন্ম এবং পুনরুজ্জীবনের সাথেও সম্পৃক্ত ছিল। মধ্য রাজবংশীয় সাম্রাজ্যের সময় থেকে এই অনুষ্ঠান পালিত হলেও নতুন রাজবংশীয় আমলে মোট ৩২ বার এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল বলে জানা গেছে।