এই গল্পের মুখ্য চরিত্র এক বহুভাষাবিদ পণ্ডিত। নাম তার গটলিয়েব উইলহেম লেইটনার। জন্ম ১৮৪০ সালের ১৪ অক্টোবর, পেস্টে; যেটি বর্তমানে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের অংশ।
চাইল্ড প্রডিজি ছিলেন লেইটনার। ১৮৫০ সালে, বয়স দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছানোর আগেই, বেশ কিছু ইউরোপীয় ভাষায় অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করে ফেলেন তিনি। তাই তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় কনস্ট্যান্টিপোলে (বর্তমান ইস্তাম্বুল), তুর্কি ও আরবি ভাষা শিখতে। আর বয়স ১৫ অতিক্রমের আগেই, ক্রিমিয়ায় ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে দোভাষীর কাজ আরম্ভ করে দেন তিনি।
লেইটনারের ভাষাজ্ঞান যেমন ছিল অবিশ্বাস্য (মোট ১৫টি ভাষা নখদর্পণে ছিল), তার ধর্মীয় ইতিহাসও কিন্তু কম চমকপ্রদ নয়। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন একজন ইহুদি, কেননা তার পরিবার ছিল ওই ধর্মের। সৎ বাবার কাছ থেকে খ্রিস্টীয় পরিচয়ও পেয়েছিলেন তিনি, এবং শৈশবে বেড়েও উঠেছিলেন একজন প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান হিসেবে। অথচ সারাটা জীবন জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষকতার পাশাপাশি আরেকটি কাজ করে গেছেন তিনি। সেটি হলো: ইসলামের প্রচার।
কীভাবে জন্মাল ইসলামের প্রতি লেইটনারের এত টান? এক্ষেত্রে কনস্ট্যান্টিপোলে গিয়ে তুর্কি ও আরবি ভাষা শিক্ষা, তারপর বিভিন্ন মুসলিম দেশে ভ্রমণের একটা প্রভাব তো ছিলই। কথিত আছে, মুসলিম দেশসমূহে ভ্রমণকালে নাকি তিনি একটি মুসলিম নামও গ্রহণ করতেন: আব্দুর রশীদ সায়াহ (সায়াহ অর্থ ভ্রমণকারী)।
তাছাড়া বয়স যখন সদ্য বিশের কোঠায়, তখনই লন্ডনের কিংস কলেজে আরবি ভাষার অধ্যাপক বনে যান লেইটনার। সেখান থেকে তার পরবর্তী গন্তব্য হয় ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষ। বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরে একটি গণশিক্ষা কর্মসূচি পরিচালনা কিংবা পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কাজে যুক্ত হন তিনি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্মকর্তাদের নীতি-নির্ধারণী বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেন, এবং উর্দু ভাষায় ইসলামের ইতিহাস নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন।
তবে এই সবকিছুর পাশাপাশি, লেইটনার আকৃষ্ট হন আরেকটি বিষয়েও—আন্তঃসাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার একটি সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে।
১৮৮১ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন লেইটনার। লক্ষ্য স্থির করেন, ইসলাম ধর্ম ও ইসলামি সংস্কৃতির ব্যাপারে সাধারণ মানুষের জ্ঞানবৃদ্ধির চেষ্টা করবেন। তাই তিনি পরিকল্পনা করেন, এমন একটি জ্ঞানকেন্দ্র গড়ে তুলবেন, যেখানে প্রাচ্যদেশীয় ভাষা ও ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা হবে।
খুঁজতে খুঁজতে সারের ওকিংয়ে একটি মনমতো জায়গা পেয়ে যান তিনি। ১৮৬২ সালে ওকিং রেললাইনের পাশে নিও-গথিক শৈলীর একটি লাল ইটের দালান তৈরি করা হয়েছিল অবসরপ্রাপ্ত অভিনেতাদের জন্য। কিন্তু অনেক বছর ধরেই খালি পড়ে ছিল সেটি। তাই লেইটনার সেটিকে রূপান্তরিত করেন তার স্বপ্নের ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটে। দ্রুতই প্রতিষ্ঠানটি দারুণ সুনাম অর্জন করে বৃত্তি ব্যবস্থার কারণে। তাছাড়া এখান থেকে আরবি, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় জার্নাল প্রকাশিত হতে থাকে, এবং ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এসে ভর্তি হয় এই প্রতিষ্ঠানে।
১৮৯৯ সালের ২২ মার্চ লেইটনারের মৃত্যুর পর অবশ্য প্রতিষ্ঠানটি বেশিদিন টেকেনি। তহবিল ফুরিয়ে যাওয়ায় একসময় সেটি রূপান্তরিত হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিটে, এবং শত বছর পর সেখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন রিটেইল স্টোর।
তবে যেটি এখনো টিকে রয়েছে, তা হলো লেইটনারের নির্মাণ করে যাওয়া শাহজাহান মসজিদ। ১৮৮৯ সালে নির্মিত হয় মসজিদটি, যেন ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটের মুসলিম শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সেখানে নামাজ আদায় করতে পারেন। অবশ্য লেইটনারের পরিকল্পনা ছিল আরো সুদূরপ্রসারী। তিনি চেয়েছিলেন, তার আন্তঃধর্মীয় সংযোগ স্থাপনের অংশ হিসেবে মসজিদের পাশাপাশি একই জায়গায় খ্রিস্টানদের গীর্জা এবং হিন্দু ও ইহুদিদের মন্দিরও গড়ে তুলবেন। কিন্তু মৃত্যুর আগে কেবল মসজিদের কাজই সম্পন্ন করে যেতে পেরেছিলেন তিনি।
যা-ই হোক, ওকিংয়ে শাহজাহান মসজিদ নির্মাণের আগেই, ১৮৮৭ সালে লিভারপুলে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন আব্দুল্লাহ কুইলিয়াম। তারপরও, একদিক থেকে শাহজাহান মসজিদ এগিয়ে। কেননা, শাহজাহান মসজিদই হলো ব্রিটেনের প্রথম মসজিদ, যেটির দালান শুরু থেকেই মসজিদ নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে নির্মিত হয়। অন্যদিকে, লিভারপুলে মূলত ইতোমধ্যে বিদ্যমান একটি ভবনকে মসজিদে রূপ দিয়েছিলেন কুইলিয়াম।
শাহজাহান মসজিদের পরিকল্পনা করেন গিল্ডফোর্ডের এক খ্রিস্টান প্রকৌশলী, উইলিয়াম আইজ্যাক চেম্বার্স। মসজিদের ঘনাকৃতির খিলানের বহির্ভাগ অনেকটা ভারতীয় মুঘল শৈলী থেকে অনুপ্রাণিত। সাদা দেয়ালের উপর গম্বুজটা সবুজ। সব মিলিয়ে ব্রিটেনের প্রাক-বিংশ শতকের স্থাপত্যশৈলী হিসেবে মসজিদটির নকশা খুবই উঁচুদরের।
মসজিদটি নির্মাণের জন্য লেইটনার অর্থ সাহায্য পেয়েছিলেন ভারতের ভোপাল রাজ্যের শাসক, সুলতানা শাহজাহান বেগমের কাছ থেকে। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কেন মসজিদটির নাম শাহজাহান মসজিদ!
১৮৯৯ সালে লেইটনারের মৃত্যুর পর শাহজাহান মসজিদের পরিণতিও প্রায় ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটের মতো হতে বসেছিল। ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট উঠে যাওয়ায়, এই মসজিদে নামাজ আদায়ের মতো যথেষ্ট লোকও ছিল না। অব্যবহারে, অনাদরে পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছিল মসজিদটি। তাই লেইটনারের ছেলে তো মসজিদটি বিক্রিই করে দিতে যাচ্ছিলেন।
শেষ রক্ষা হয় ১৯১৩ সালে পাঞ্জাব থেকে ব্রিটেনে আসা ভারতীয় আইনজীবী ও পণ্ডিত খাজা কামাল-উদ-দীনের বদৌলতে। তার কারণেই যেন অনেকটা নবজীবন লাভ করে এই “অমুসলিমের দেশের মসজিদ”। তৎকালীন প্রভাবশালী নাইট লর্ড হেডলিকে তিনি রাজি করান মসজিদটি টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে সাহায্য করতে। তাই সে যাত্রায় বেঁচে যায় মসজিদটি। এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত অনেকটা ধুঁকে ধুঁকে চললেও, এর কয়েক বছর পর স্বাধীন ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) থেকে অভিবাসীরা এসে ব্রিটেনে বসতি গড়ে তুললে, মসজিদটিরও প্রকৃত সদ্ব্যবহার শুরু হয়।
শাহজাহান মসজিদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ব্রিটেনের প্রথম মুসলিম গোরস্থানের নামও। সেটি হলো দ্য মোহামেডান সিমেট্রি। ১৮৮৪ সালে ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটের পাশাপাশি এটিও তৈরি করেন লেইটনার। মূলত ব্রুকউড সিমেট্রির (তৎকালীন ইউরোপের বৃহত্তম গোরস্থান, এবং এখনো যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম) একটি প্লট আলাদা করে রাখা হয় মুসলিমদের ব্যবহারের জন্য। কিন্তু সেখানে প্রথম দাফনকার্য সম্পন্ন হয় ১৮৯৫ সালে, যখন লন্ডন সফরকালে মৃত্যুবরণ করেন শেখ নুবি নামের এক ভারতীয় জাদুকর।
১৯১৫ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মাঝে, শাহজাহান মসজিদের তৎকালীন ইমাম মৌলভী সদর-উদ-দীন আরেকটি গোরস্থানের জমি আদায় করেন ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে। এই গোরস্থানটি ছিল নির্দিষ্টভাবে কেবল যুদ্ধে শহীদ হওয়া মুসলিম সৈন্যদের জন্য। হরসেল কমনে অবস্থিত, ওকিং মুসলিম ওয়ার সিমেট্রি নামে পরিচিত গোরস্থানটিকেও সাজানো হয় মুঘল শৈলীতে, শাহজাহান মসজিদের সাথে মিল রেখে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সেখানে মোট ১৮ জনকে দাফন করা হয়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ ও ফ্রি ফ্রেঞ্চ বাহিনীর হয়ে যুদ্ধে করে শহীদ হওয়া মুসলিম সৈন্যদেরও এখানেই দাফন করা হয়।
১৯৬৯ সালে কবরগুলোকে আকারে অপেক্ষাকৃত বড় ব্রুকউড মিলিটারি সিমেট্রিতে স্থানান্তর করা হয়, এবং ২০১৫ সালে জায়গাটি পুনরায় নামাঙ্কিত করা হয় মুসলিম ওয়ার সিমেট্রি পিস গার্ডেন হিসেবে।
শাহজাহান মসজিদ এবং গোরস্থানগুলো সবই এখন ব্রিটেন’স মুসলিম হেরিটেজ ট্রেইলসের অংশ, যার মাধ্যমে দর্শনার্থীরা ঘুরে ঘুরে দেখতে ও জানতে পারে ব্রিটেনে মুসলিম বসতি ও সভ্যতার ইতিহাস। বিশেষত ব্রিটেনের অভিবাসী মুসলিমদের জন্য এটি একটি দারুণ সুযোগ নিজেদের শিকড় সন্ধানের জন্য।