পৃথিবীর ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে টিকে থাকা সাম্রাজ্যগুলো একদিনে এত বিশালাকার ধারণ করেনি। বেশিরভাগ সময়ই এসব সাম্রাজ্যের উৎপত্তি হয়েছিল একেবারে তাৎপর্যহীন অবস্থায়। ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যের শাসকরা আশপাশের অঞ্চলগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। একসময় গিয়ে সাম্রাজ্য বিশালাকার ধারণ করে পরিপক্বতা পায়। কিন্তু খুব কম সময়েই বিশালাকার এসব সাম্রাজ্যের একেবারে শুরুর দিকের কান্ডারিদের কেউ তেমন মনে রাখে না। আজকের লেখায় তাই এরকম প্রভাবশালী কয়েকটি সাম্রাজ্যের গোড়ার দিকের মানুষগুলোর ব্যাপারে জানব, যারা ইতিহাসের নতুন গতিধারার সূচনা করেছিলেন।
১. অটোমান সাম্রাজ্য – প্রথম উসমান
অটোমান কিংবা উসমানীয় সাম্রাজ্য পৃথিবীর বুকে টিকে থাকা প্রভাবশালী এক ইসলামি সাম্রাজ্য ছিল, যার সূচনা করেছিলেন প্রথম উসমান। সেলজুকদের আনুকূল্য পেয়ে উসমান আনাতোলিয়ার শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন। খুব অল্প সময়ে রাজ্য পরিচালনার কাজে উসমানের দক্ষতা প্রকাশ পেতে থাকে। এর মাঝে সেলজুকদের ভেতরগত রেষারেষির কারণে ভেতর থেকে সেলজুক সাম্রাজ্য ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। একসময় উসমান বুঝতে পারেন, সেলজুকরা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারবে না। তাই শুরুর দিকে অনুগত থাকলেও সাম্রাজ্যের ক্রান্তিলগ্নে এসে ১২৯৯ সালে নিজেই স্বাধীন একটি সাম্রাজ্য গড়ার ঘোষণা দেন। এভাবেই উসমানীয় সাম্রাজ্যের সূচনা ঘটে, যদিও শুরুর দিকে সামান্য কিছু অঞ্চল নিয়েই উসমান শাসনকার্য চালিয়ে যেতে থাকেন।
উসমান-পরবর্তী ১৫০ বছরে অটোমান সাম্রাজ্য চারদিকে বিস্তৃত হতে থাকে এবং একটি বৈশ্বিক রূপ লাভ করে। সুলতান দ্বিতীয় মেহমুদ ১৪৫৩ সালে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল দখল করার পর অটোমানরা আঞ্চলিক পরাশক্তিতে পরিণত হয়।
ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীতে সুলতান প্রথম সুলেইমানের রাজত্বকালে অটোমানরা উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য ও আরব অঞ্চলগুলো নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। প্রথম উসমানের গড়ে তোলা অটোমান সাম্রাজ্য একসময় বিশালাকার লাভ করে। প্রায় ৬০০ বছর ধরে তাদের রাজত্বকালে প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যের যোগাযোগের কেন্দ্রভূমি ছিল অটোমান সাম্রাজ্য। নানা উত্থান-পতনের সাক্ষী হয়ে ১৯২৪ সালে খলিফা আবদুল মজিদের পতনের মাধ্যমে পরাক্রমশালী অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়।
২. মঙ্গোল সাম্রাজ্য – তেমুজিন
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ভয়ের রাজত্ব তৈরি করা চেঙ্গিস খানের শুরুটা হয়েছিল একেবারে সাদামাটাভাবে। মঙ্গোল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করা এই নেতার আসল নাম তেমুজিন, পরবর্তীতে চেঙ্গিস খান হিসেবেই বেশি পরিচিত হন।
কিন্তু তেমুজিনের শৈশবটা মোটেই স্বাভাবিক ছিল না। যখন তেমুজিনের বয়স মাত্র ১২ বছর, তখন গোত্রীয় শত্রুতার জেরে তার বাবাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়। বাবার মৃত্যুর পর বিধবা মা ও এতিম সন্তানদের সেই গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। মায়ের সঙ্গে নদীতীরের একটি বনে তেমুজিন থাকতে শুরু করেন। খাবার যোগাড় করতে মা এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতেন, আর ছোট্ট তেমুজিন ইঁদুর ও অন্যান্য প্রাণী শিকার করে আনতেন।
একদিন সৎভাইয়ের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে তাকে পাথরের আঘাতে হত্যা করেন তেমুজিন, তখন তার বয়স ছিল ১৪ বছর। এর কিছুদিনের মাথায় তাইচিউরা তেমুজিনকে বন্দি করে এবং তাদের ক্রীতদাস হিসেবে কাজ করাতে শুরু করে। তেমুজিন বারবার পালিয়ে যেতে গিয়েও ধরা পড়ে যান এবং অন্যান্য ক্রীতদাসদের সহায়তায় একসময় সফলও হন। পালিয়ে গিয়ে নদীর ওপারের অখ্যাত এক ব্যান্ড দলে নাম লেখান তিনি এবং সেখানে গিয়ে সুন্দরী বোর্তেকে বিয়ে করেন। কিন্তু মারকিডসরা তেমুজিনের স্ত্রীকে অপহরণ করলে তিনি নিজের একটা বাহিনী তৈরি করে বোর্তেকে উদ্ধার অভিযানে নামেন এবং সফল হন।
এভাবেই মূলত ভূপৃষ্ঠের ত্রাস মঙ্গোলদের আবির্ভাব ঘটে। ত্রয়োদশ থেকে চতুর্দশ শতকজুড়ে মঙ্গোলরা মধ্য এশিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে সাইবেরিয়া, ভারতীয় উপমহাদেশ, ইন্দো-চায়না এবং পশ্চিমদিকে আরব পর্যন্ত নিজেদের রাজত্ব কায়েম করেছিল।
৩. আফছারিদ সাম্রাজ্য – নাদের শাহ
মধ্য এশিয়ার বিজয়ী বীরদের ভেতর নাদের শাহ ছিলেন সর্বশেষ। পারস্যের কোনো এক অখ্যাত স্থানে নিচু শ্রেণীর এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই নাদের শাহ খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন এবং একদিন রাজ্য শাসনের স্বপ্ন দেখতেন। প্রথম জীবনে তিনি একজন দাস ছিলেন এবং পরবর্তীতে দস্যুদলের খাতায় নাম লেখান। দস্যু হিসেবে এমনই এক লড়াইয়ে যুদ্ধবাজ এক গোত্রকে পরাজিত করেন।
এভাবেই সেখানকার রাজপুত্র তাহমাসবের নজরে আসেন নাদের শাহ। তাহমাসব তাকে জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেন এবং খুব অল্প সময়ের ভেতর নাদের শাহ বেশ কিছু যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এতে করে নিজের উপর আত্মবিশ্বাস প্রবল হয়ে ওঠে নাদের শাহের। তিনি রাজপুত্র তাহমাসবকে হত্যা করে ক্ষমতা নিজের হাতে নেন। যার ফলশ্রুতিতে জর্জিয়া থেকে উত্তর ভারত ভেদ করে একটি নতুন সাম্রাজ্য জন্মলাভ করে।
নাদের শাহ একসময় পরাক্রমশালী মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং তাদের পরাজিত করে দিল্লির মসনদে বসেন। দিল্লির ক্ষমতা লাভ করার পর উচ্চাকাঙ্ক্ষী নাদের শাহ ধন-দৌলতের লোভে পড়েন।
মুঘলদের সংগৃহীত প্রায় সব দামি ধন-রত্ন নিজের করে নেন তিনি। একসময় উদ্দেশ্য হারিয়ে অলস হয়ে পড়েন কর্মচঞ্চল নাদের শাহ। তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেতে থাকে এবং অল্পতেই রাগান্বিত হতে শুরু করেন। তিনি এতটাই দিশেহারা আর রাগান্বিত হয়ে পড়েছিলেন যে, নিজের বড় ছেলের চোখ পর্যন্ত উপড়ে ফেলেছিলেন! যদিও পরবর্তীতে এর জন্য অনুশোচনা করতে থাকেন নাদের শাহ।
১৭৪৭ সালে তারই বিশ্বস্ত অফিসাররা তাকে হত্যা করে। তাকে হত্যা করার মধ্য দিয়েই মূলত আফসারিদ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। অথচ নাদের শাহই একসময় মুঘলদের বিশাল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন এবং দিল্লিকে নিজের করে নিয়েছিলেন।
৪. তৈমুরীয় সাম্রাজ্য – তৈমুর লং
ইতিহাসের বুকে আরেক রক্তাক্ত অধ্যায়ের নায়ক তৈমুর লং ছিলেন একজন সত্যিকার যুদ্ধবাজ। নাদের শাহর মতো তিনিও অখ্যাত এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং পেশা হিসেবে ডাকাতিকে বেছে নেন! একবার ভেড়া চুরি করতে গিয়ে রাখালদলের সম্মুখীন হন এবং তাদের আক্রমণে নিজের একটি পা হারান।
ভাগ্যের সন্ধানে নেমে মঙ্গোল নেতা চাগাতাই খানের রাজদরবারে ঠাঁই করে নেন তৈমুর। সেখান থেকেই ক্রমে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন তিনি। একসময় খানদের পরাজিত করে সিংহাসন দখল করে নেন এবং ঘোড়সওয়ারদের নিয়ে বিশাল এক বাহিনী গড়ে তোলেন। এই বাহিনীর সহায়তায় একে একে অনেকগুলো অভিযান পরিচালনা করেন তৈমুর লং। এভাবে একসময় দামেস্ক থেকে দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে যান এবং যাত্রাপথে যেখানে পেরেছেন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন।
তৈমুর লং বাগদাদ দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং মহাক্ষমতাধর অটোমান সুলতান বায়েজীদকে পরাজিত করে অটোমানদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিলেন। যে শহরেই তৈমুর লং এর পা পড়েছিল, রাতারাতি সে শহরে নীরবতা নেমে এসেছিল। মৃতদের মাথার খুলি দিয়ে পিরামিড বানাতো তার বাহিনী, আর বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো দাস হিসেবে বেঁচে থাকতে পারতো। ১৪০৫ সালে চীন দখল করতে গিয়ে যাত্রাপথে শীতের কবলে পড়ে মারা যান তৈমুর লং।
৫. পারসিয়ান সাম্রাজ্য – বাবাক খোরামদিন
পারসিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরবরা পারসিয়ানদের উপর বিজয়ী হয় এবং পারস্যকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে আসে। প্রায় ১৫০ বছর ধরে আরবরা পারসিয়ানদের শাসন করেছিল। এই সুদীর্ঘ সময়ে অনেক পারসিয়ানই আরব ভাবাদর্শ গ্রহণ করে নেয় এবং তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা ভুলতে শুরু করে। কিন্তু এরই মাঝে এক বীরের আবির্ভাব ঘটে যিনি আরবদের থেকে পারস্যকে মুক্তি করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর ছিলেন। বাবাক খোরামদিন এমনই একজন যিনি পারস্যের জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃত।
তবে তার দীর্ঘ এই যাত্রার সূচনা হয়েছিল একেবারে ভাগ্যচক্রে। খোরামিয়ান বিদ্রোহী দলের এক নেতা একদিন বাবাক খোরামদিনের বাড়িতে যাত্রাবিরতি করেন। তিনি বাবাককে নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন খামারের দেখভাল করার জন্য। কিন্তু বাবাক একসময় বিদ্রোহী দলটির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং একসময় সেই নেতার মৃত্যুর পর খোরামিয়ানদের নেতা নির্বাচিত হন।
নতুন নেতৃত্ব পেয়ে বাবাক আরবদের উপর চড়াও হন এবং ১৬ বছর ধরে চলমান যুদ্ধে আরব বাহিনীগুলোকে পরাজিত করতে থাকেন। যুদ্ধে তার কৌশলগত অবস্থানের কারণে আরবরা কখনোই সুবিধা করে উঠতে পারেনি। সর্বশেষ স্বজাতীয় এক আরব জেনারেলের বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হয়ে বাবাক আরবদের কাছে পরাজিত হন। পরাজিত বাবাক খোরামদিনের হাত-পা কেটে ফেলা হয় এবং ৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। লড়াইতে হেরে গেলেও তার এই লড়াইয়ের সূত্র ধরে পারসিয়ানরা একসময় মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি লাভ করেছিল।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
অটোম্যান সাম্রাজ্য সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ
১) দি অটোমান সেঞ্চুরিস : দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অব দ্য তার্কিশ এম্পায়ার
২) অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান
৩) অটোমান সুলতান ও তোপকাপি প্রাসাদ