মিশরের নাম শুনলে প্রথমেই কীসের কথা মনে পড়ে, বলুন তো? নিশ্চয়ই পিরামিড? আর এরপর যেটা মাথায় আসে সেটা হলো ফারাও বা মিশরের রাজাদের কথা, তাই না? হ্যাঁ, আজকে এক ফারাওয়ের কথাই আলোচনা করবো, তবে যিনি আসলে ছিলেন একজন নারী, অর্থাৎ রানী!
মিশরের রাজা বা ফারাওদের কথা বললে তৎক্ষণাৎ আমাদের চোখে নীল আর সোনালি মুকুট পরে সিংহাসনে বসে থাকা একজন পুরুষের অবয়বই ভেসে ওঠে। অথচ ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, মিশরের ৩০০০ বছরের ইতিহাসে ১৭০ জন ফারাওয়ের মাঝে ৭জন ছিলেন নারী। যদিও এই সংখ্যা নিয়ে ইতিহাসবিদদের সন্দেহ রয়েছে, কারণ অনেক নারী শাসকের নামই ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে বা মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে।
এই ৭ জন নারী শাসকের মধ্যে দ্বিতীয় হলেন হাতশেপসুত। তাকে বলা হত ‘মহৎ নারীদের প্রধান’। তিনি রাজা প্রথম থুতমোস এবং তার প্রধান স্ত্রী রানী আহমোসের কন্যা। ১৫০৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাদের ঘর আলো করে জন্ম হয় হাতশেপসুতের। রাজা প্রথম থুতমোসের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসার কথা হাতশেপসুতেরই। কিন্তু তিনি যেহেতু পুরুষ নন, তাই তাকে রাজা হিসেবে মিশরীয়রা কোনোভাবেই মেনে নিত না। তাই তার বদলে রাজা হন তার সৎভাই দ্বিতীয় থুতমোস। সৎভাই, কারণ প্রথম থুতমোসের দ্বিতীয় স্ত্রীর পুত্র হলেন দ্বিতীয় থুতমোস। পরে তার সাথেই হাতশেপসুতের বিয়ে হয়। ভাই-বোনের মাঝে বিয়ে শুনে অবাক লাগলেও প্রাচীন মিশরে এটা ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। তৎকালীন রাজপরিবার সবসময় চাইতো তাদের রাজরক্তে যেন বাইরের সাধারণ রক্ত প্রবেশ না করে। তাই নিজেদের একেবারে নিকটজনদের মাঝেই বিয়ের আয়োজন করতেন তারা।
দ্বিতীয় থুতমোসের সময় তার পাশাপাশি থেকে রাজ্য শাসন করেন হাতশেপসুত। এমনকি এটাও কথিত আছে যে, স্বামীর হাত দিয়ে রাজ্য শাসন করতেন মূলত হাতশেপসুত নিজেই। দ্বিতীয় থুতমোসের মৃত্যুর পর রাজপরিবারে আবার একই প্রশ্ন জাগে, এবার কে পরবে রাজার মুকুট?
হাতশেপসুত একদিকে ছিলেন একজন শক্তিশালী রাজার কন্যা, আরেকদিকে একজন রাজার স্ত্রী। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেনই শাসক হবার জন্য। সুতরাং তিনিই হবেন সবচেয়ে যোগ্য শাসক। কিন্তু সমস্যাটা দেখা দেয় যখন শাসকপ্রার্থী হিসেবে তৃতীয় থুতমোসের আবির্ভাব হয়। দ্বিতীয় থুতমোসের অপর স্ত্রীর সন্তান হলেন তৃতীয় থুতমোস অর্থাৎ হাতশেপসুত হলেন তৃতীয় থুতমোসের বিমাতা। সেই সময় তার বয়স মাত্র ৩ বছর। এত ছোট বয়সে রাজ্য শাসন তার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই তার হয়ে ১৪৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরের সিংহাসনে বসেন হাতশেপসুত। এর পরপরই তিনি এই দায়িত্বকে পাকাপোক্ত করে নেয়ার জন্য কাজ করতে থাকেন।
তার প্রথম লক্ষ্য ছিল নিজেকে পূর্ণাঙ্গ এবং সার্বভৌম ফারাও হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আর এ কাজে মিশরীয় পুরাণই তার সহায় হয়। মিশরীয় পুরাণ অনুযায়ী রাজা প্রথম থুতমোস ছিলেন মহাদেবতা আমুনের সাক্ষাৎ বংশধর। রাজা প্রথম থুতমোসের সন্তান হিসেবে শুধুমাত্র দ্বিতীয় থুতমোসই নয়, হাতশেপসুতও সমানভাবেই দেবতার বংশধর। সুতরাং এবারে তার ফারাও হিসেবে প্রতিষ্ঠা হবার পথ সুগম হয়।
কিন্তু দাপ্তরিকভাবে রাজা হলেও একইসাথে মুকুট ধরে রাখা আর রাজ্যের সকলের শ্রদ্ধা পাওয়া তার জন্য কঠিন পরীক্ষার মতোই ছিল। বিশেষ করে একজন মহিলা হয়েও মিশরীয়দের মনে রাজার স্থান পাওয়ার জন্য ভালোই বেগ পেতে হয়েছে তাকে। সেই সময়কার মিশরীয়রা রাজা হিসেবে কোনো নারীকে মেনে নিতে রাজি ছিল না। হাতশেপসুত একদিকে যেমন ছিলেন অপরূপ সুন্দরী রমনী, তেমনি তার ছিল অসাধারণ বুদ্ধিমত্তাও। তিনি এই সমস্যারও সমাধান করে ফেললেন। তিনি পুরুষের বেশে রাজ্য শাসন করতে শুরু করলেন, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সভাগুলোতে তিনি পুরুষদের পোশাক আর নকল দাড়ি পরতেন। ধীরে ধীরে তিনি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলেন।
তবে হাতশেপসুত তার এই পুরুষালী বেশভূষা বা নকল দাড়ির জন্য ইতিহাসে বিখ্যাত হননি, হয়েছেন তার কর্মগুণে। তিনি ছিলেন মিশরের সবচেয়ে সফল শাসকদের একজন, আর অন্যান্য নারী শাসকদের চেয়ে তার রাজত্বকাল ছিল দীর্ঘতর। আধুনিক পণ্ডিতদের মতে, হাতশেপসুত প্রায় ২২ বছর রাজত্ব করেছেন। সে সময় নতুন নতুন রাজ্যজয়ের পরিবর্তে নিজ রাজ্যকে সমৃদ্ধ করাই ছিল তার লক্ষ্য। অবশ্য সেক্ষেত্রেও তার উল্লেখযোগ্য সফলতা ছিল। রাজকীয় স্থাপত্য, সমাধি, মন্দির তৈরীতেই তার মনোযোগ ছিল বেশি। তিনি অসংখ্য নতুন মন্দির, ভাস্কর্য, ওবেলিস্ক (লম্বা দৈত্যাকৃতির মূর্তি) নির্মাণ করেছিলেন।
তার সময়ে তৈরি স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো কর্নাক মন্দির। মিশরের লাক্সারে নীলনদের তীরে অবস্থিত এই মন্দিরে সুউচ্চ ওবেলিস্ক রয়েছে, সেই সময়ে পুরো মিশরের সবচেয়ে উচু ওবেলিস্ক ছিল এগুলোই।
মন্দিরের প্রবেশদ্বারের একজোড়া ওবেলিস্কের একটি এখনও হুবহু টিকে আছে। সুদীর্ঘ এই ওবেলিস্কগুলোতে বেশ দক্ষভাবে লাল গ্রানাইট পাথর দিয়ে খোদাই করা হয়েছে বিভিন্ন ছবি বা চিহ্ন।
হাতশেপসুতের তৈরি আরেকটি স্থাপনা হলো মা’আত মন্দির। কর্নাক কমপ্লেক্সের এই মন্দিরের দেয়ালে দেয়ালে অত্যন্ত চমৎকারভাবে খোদাই করা আছে হাতশেপসুত আর তৃতীয় থুতমোসের মূর্তি। আয়তাকার কমপ্লেক্সের ঠিক মাঝখানটাতে আছে সুবিশাল এক হল। তখনকার বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক কাজে ব্যবহৃত হত এটি।
হাতশেপসুতের তৈরি সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপনা হলো দের-আল-বাহরি উপত্যকায় অবস্থিত মন্দিরটি, যা হাজার বছর পরের গ্রিক স্থাপত্যকেও হার মানায়। এর আসল নামের বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘পবিত্রের মধ্যে পবিত্র স্থান’। একে পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য স্থাপত্য হিসেবে ধরা হয়। এখানেই হাতশেপসুতের সমাধিও রয়েছে। মন্দিরের দেয়ালে এই পরাক্রমশালী নারীর জন্মের সেই পৌরাণিক কাহিনী খোদাই করা আছে, যেখানে হাতশেপসুতকে বলা হয়েছে মহাদেবতা আমুনের কন্যা।
হাতশেপসুতের সাফল্য যে শুধুমাত্র স্থাপত্যশৈলীতেই সীমাবদ্ধ ছিল এমনটাও কিন্তু নয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও তিনি সমানভাবে সফল ছিলেন। এক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ ছিল পান্ট যাত্রা। ২০০ বছর আগে ভেঙে যাওয়া বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে অষ্টাদশ রাজবংশের সম্পদ গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি করেন হাতশেপসুত।
পান্ট বর্তমান ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়ার কাছাকাছি লোহিত সাগরের উপকূলে অবস্থিত একটি স্থান। এরপর হাতশেপসুতের কল্যাণে পাণ্টের সাথে মিশরের বহু বছর বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। পান্ট থেকে লোবান, গন্ধরস, সোনাসহ অনেক দুর্লভ বাণিজ্যিক পণ্য মিশরে নিয়ে আসা হয়। হাতশেপসুতের অভিযাত্রীরা পান্ট থেকে ৩১টি গন্ধরসের গাছ নিয়ে আসেন। বিদেশ থেকে গাছ এনে রোপণের চেষ্টার এটাই প্রথম রেকর্ড। আর লোবান গুড়ো করে হাতশেপসুত তৈরি করতেন চোখের কাজল। হাতশেপসুত বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অন্য যেকোনো রাজার চেয়ে সফল ছিলেন। তার এই সফলতা মৃত্যুর আগপর্যন্ত বহাল ছিল।
হাতশেপসুতের মৃত্যু হয় সিংহাসনে আরোহণের প্রায় দুই যুগ পর। ততদিনে তৃতীয় থুতমোস বড় হয়েছেন। এবার তিনি রাজ্যের শাসনভার হাতে নেন। ইতিহাসবিদদের মতে, তৃতীয় থুতমোস সম্ভবত হাতশেপসুতের প্রতি হিংসাপরায়ণ ছিলেন, এর কারণ হতে পারে তার জায়গায় বসে রাজ্য শাসনের কারণেই। তাই ক্ষমতায় আসার পর তৃতীয় থুতমোস তার কীর্তিগুলো মুছে ফেলতে সচেষ্ট হন। তিনি এবং তার পুত্র দ্বিতীয় আমেনহোতেপ হাতশেপসুতের বিভিন্ন কীর্তিকে নিজের বলে চালিয়ে দিতেও চেষ্টা করেন। অনেকের মতে, এটা ছিল মিশরে নারীদের ফারাও হওয়া থেকে বাঁধা দেওয়ার এবং তাদের ক্ষমতা হ্রাসের ব্যর্থ চেষ্টা।
তবে তারা পুরোপুরি সফল হতে পারেননি, এর কারণ হাতশেপসুতের দূরদর্শীতা। এরকম কিছু যে হতে, হাতশেপসুত যেন আশা করেই ছিলেন। আর তাই তিনি সমস্ত স্থাপনা, সমাধি, ওবেলিস্কসহ বিভিন্ন জায়গায় নিজের কীর্তির অসংখ্য প্রমাণ রেখে গেছেন। এত এত নিদর্শন চাইলেও ইতিহাসের পাতা থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
উনিশ শতকে বিখ্যাত ইজিপ্টোলজি এবং হায়ারোগ্লিফিক কোডার জন ফ্রান্সিস শ্যাম্পলিয়ন হাতশেপসুতের নাম পুনরায় ইতিহাসের পাতায় ফিরিয়ে আনেন। হাতশেপসুতের স্থাপনাগুলো, বিশেষ করে কর্নাক মন্দির, দের-আল-বাহরির মন্দির এখন পৃথিবীজোড়া পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। চাইলে ঘুরে দেখে আসতে পারেন আপনিও।
মিশর সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো
১) প্রাচীন মিশর
২) মিশর দেখে এলাম
৩) মমির মিশর