আজ থেকে প্রায় ১২৫ বছর আগেকার কথা। ১৮৯২ সালের ১৯ ডিসেম্বর জাপানের ইয়ামাগুচি প্রিফেকচারের এক সামুরাই পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হাজী ওমর মিতা। জন্মগতভাবে তিনি মুসলিম ছিলেন না। তাই তখন তার নাম ছিল রায়োইচি মিতা। জন্মের পর থেকে বলতে গেলে নিয়মিতই অসুস্থ থাকতেন তিনি। এ অসুস্থতা তার শিক্ষাজীবনকেও দীর্ঘায়িত ও বন্ধুর এক যাত্রা করে তুলেছিলো। তারপরও মনের জোরে পড়ালেখা চালিয়ে যান তিনি। ১৯১৬ সালের মার্চ মাসে অবশেষে ইয়ামাগুচি কমার্স কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন মিতা। বর্তমানে অবশ্য সেই কলেজের অস্তিত্ব নেই। এটা এখন হয়ে গেছে ইয়ামাগুচি ইউনিভার্সিটি।
প্রথম সাইনো-জাপানীজ ওয়্যারের (১৮৯৪-১৮৯৫) জন্য অনেক আগে থেকেই চীন দেশের নামটির সাথে পরিচিত ছিলেন রায়োইচি মিতা। ছোটবেলা থেকে চীনের নাম তিনি এতবার শুনেছিলেন যে, তখন থেকেই দেশটি একবার হলেও স্বচক্ষে দেখার সাধ জাগে তার। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর যখন এই সুযোগটি পেয়ে গেলেন, তখন আর সেটি হাতছাড়া করলেন না, চলে গেলেন চীনে।
চীনে গিয়ে অনেক জায়গায় ঘুরেছিলেন তিনি। সেসব জায়গায় ভ্রমণ করতে গিয়ে নানা জাতের অজস্র মানুষের সাথে পরিচয় হয় তার, শিখে নেন চীনা ভাষাটাও। এভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষের সাথে মেলামেশা মিতার জীবনের অভিজ্ঞতার ঝুলিকে বেশ সমৃদ্ধ করেছিলো। পাশাপাশি চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান তাকে জনগণের আরো কাছে আসতে সাহায্য করেছিলো। এভাবেই একসময় তিনি পরিচিত হন মুসলিম সমাজ, তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি ও চিন্তাধারার সাথে। জাপানে এমনটা কল্পনাও করা যেত না। মুসলিমদের সম্পর্কে বলা চলে তখন থেকেই আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে তাঁর। এমনকি ১৯২০ সালে জাপানের ‘তোয়া কেইজাই কেনক্যু’ নামক সাময়িকীতে তিনি ‘চীনে ইসলাম’ নামে একটি প্রবন্ধও লিখে ফেলেন!
ততদিনে জাপানে ইসলাম প্রচারের পথ সম্প্রসারিত হতে শুরু করেছিলো, এর মূল কান্ডারী ছিলেন হাজী ওমর কোতারো ইয়ামাওকা। ১৯০৯ সালে জাপানী মুসলিমদের মাঝে তিনিই সর্বপ্রথম পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেন। সেই যাত্রায় তার সঙ্গী হিসেবে ছিলেন তৎকালে জাপানে বসবাসরত তাতার বংশোদ্ভূত তুর্কি মুসলিম নেতা মুফতি আবদুল রশিদ ইবরাহীম। ১৯১০ সালে হজ্ব শেষ করে জাপানে ফিরে আসেন হাজী ওমর কোতারো। এসে আর বসে রইলেন না, বরং ইসলামের পথে দাওয়াত দিতে শুরু করলেন জাপানের জনগণকে। এ লক্ষ্যে তিনি ছুটে বেড়াতে লাগলেন জাপানের দ্বীপ-দ্বীপান্তরে, দিতে লাগলেন নানা বক্তৃতা, মানুষকে শোনাতে লাগলেন মক্কা-মদীনা ও মুসলিম বিশ্বের গল্প। শুধু মুখে দাওয়াত দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না তিনি, শুরু করলেন লেখালেখিও। ১৯১২ সালে মক্কা ভ্রমণ এবং হজ্ব সম্পর্কিত বেশ কিছু বই প্রকাশিত হলো তাঁর।
বিশ বছর বয়সী রায়োইচি মিতাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিলো সেই বইগুলো। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের এক স্তম্ভ সম্পর্কে, পবিত্র নগরী মক্কা-মদীনা সম্পর্কে জানতে পেরে তাঁর মনে অন্যরকম এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিলো। তবে আবেগের সেই চারাগাছ তখনও সেভাবে বিকশিত হয় নি। এই বিকাশের কাজটিই হয় চীনে গিয়ে।
১৯২১ সালে কিছুদিনের জন্য জাপানে আসেন রায়োইচি মিতা। তবে ছুটি কাটাতে আসেন নি তিনি। তাই তো এসেই অংশ নিতে থাকলেন হাজী ওমর কোতারোর নানা সেমিনারে, আরো ভালোভাবে পড়াশোনা করতে লাগলেন তাঁর লেখা বইগুলোর উপর। এ যাত্রাতেই টোকিওর কাছাকাছি অবস্থিত কামাকুরাতে প্রথমবারের মতো নিজের আইডলের সাথে দেখা করার সৌভাগ্য হলো মিতার। এ সাক্ষাতের উদ্দেশ্য ছিলো ইসলামের দাওয়াত দিয়ে বেড়ানো একজন সম্মানীত ব্যক্তির কাছ থেকে ধর্মটি সম্পর্কে আরো গভীরভাবে জানা। তখন পর্যন্ত মিতা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নি। তার বয়স তখন ২৯, হাজী ওমর কোতারোর ৪১।
এরপর একে একে বদল হলো বিশটি ক্যালেন্ডার, কেটে গেলো পৃথিবীর ইতিহাসের আরো বিশটি বছর। তখন চলছে ১৯৪১ সাল। ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সী রায়োইচি মিতা বিশ বছর ধরে ক্রমাগত বুঝতে চাইলেন ইসলাম ধর্মকে, চালালেন এ ধর্মবিশ্বাস নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা। শেষপর্যন্ত একটা সময় সিদ্ধান্ত নিলেন ধর্ম পরিবর্তনের। মিতার বাস তখনও চীনেই। দেশটির পেকিংয়ে অবস্থিত ন্যুচি মসজিদের ইমাম ওয়াং রেইলানের সাথে সাক্ষাৎ করে নিজের মনের গোপন আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত করলেন মিতা। অবশেষে এই ইমামের হাত ধরেই ইসলামের ছায়াতলে আসেন রায়োইচি মিতা। ধর্ম পরিবর্তনের সাথে সাথে তার নামও পাল্টে ফেলেন। মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা) এর নামের সাথে মিল রেখে তার নাম রাখা হয় ‘ওমর’, পুরো নাম ‘ওমর মিতা’। এরপরই পুরোপুরি ধর্মকর্মে মনোনিবেশ করেন তিনি। সেদিন ইমাম ওয়াং রেইলানের উপকারের জন্য আজীবন সশ্রদ্ধচিত্তে তাঁর কথা স্মরণ করেছেন ওমর মিতা।
চীনের মুসলিমদের সাথে বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো ওমর মিতার। এ সম্পর্কের খাতিরে তার চাকরিও ছিলো চীনের মুসলিম সমাজকে ঘিরেই। সুপ্রিম কাউন্সিলে চীনের বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করতেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আগপর্যন্ত এ চাকরিই করেছেন মিতা। যুদ্ধ শেষ হলে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তিনি ফিরে যান স্বদেশ জাপানে।
জাপানে যখন ফিরে এলেন, তখন ওমর মিতার বয়স তেপ্পান্ন বছর। জাপানে এসে চীনা ভাষার শিক্ষক হিসেবে চাকরি নিলেন তিনি। প্রথম ঢুকেছিলেন ওসাকার কানসাই ইউনিভার্সিটিতে। পরবর্তীতে চলে যান কিয়ুশু দ্বীপের কিতা-কিয়ুশু ইউনিভার্সিটিতে। এর বছরখানেকের মাঝেই জীবনের এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি হন মিতা, পরপারে পাড়ি জমান তার সহধর্মিনী। স্ত্রীকে হারিয়ে মারাত্মক ভেঙে পড়লেন তিনি। ১৯৫২ সালে তাই চাকরি থেকে ইস্তফা দিলেন, সিদ্ধান্ত নিলেন বাকি জীবনটা ধর্মকর্মের কাজে আরো একাগ্রতার সাথে ব্যয় করবেন। ওমর মিতার এ সিদ্ধান্ত যে জাপানের মুসলমানদের জন্য কতটা উপকারী এক সিদ্ধান্ত হয়ে এসেছিলো তা লেখার সামনের অংশেই বোঝা যাবে।
মিতার স্ত্রী মারা যাবার কাছাকাছি সময়ে জাপানের মুসলিমরা এক চমৎকার কাজ করেছিলো। দেশটিতে বসবাসরত বিদেশী মুসলিমদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে তারা প্রতিষ্ঠা করলো ‘জাপান মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন’। ওদিকে ওমর মিতা যখন ত্রিশ বছর ধরে চীনে তার ধর্ম বিষয়ক গবেষণা চালিয়ে গেছেন, তখন জাপানেও ধীরে ধীরে প্রসার ঘটেছে ইসলাম ধর্মের শিকড়ের। এর পেছনে উল্লেখযোগ্য কারিগর ছিলেন হাজী ওমর কোতারো। পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম দেশগুলো থেকে জাপানে আসা উদ্বাস্তু, সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে জাপানে চলে আসা তুর্কি মুসলিম শরণার্থী এবং তাতার শরণার্থীদের প্রভাবেও জাপানের মুসলিমরা ইসলাম ধর্মকে আরো গভীরভাবে বুঝতে ও আলিঙ্গন করে নিতে সক্ষম হয়। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং স্থানীয় জাপানী নাগরিকদের সহযোগিতায় ১৯৩৫ সালে কোবে শহরে জাপানের প্রথম মসজিদ এবং ১৯৩৮ সালে টোকিওতে দ্বিতীয় মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৫২ সালে ওমর মিতা চলে আসলেন টোকিওতে, বয়স তাঁর ষাট, বার্ধক্যের ছাপ পড়তে শুরু করেছিলো ভালো করেই। যুদ্ধ-পরবর্তী জাপানের অবস্থাও তখন বেশ খারাপ। চারদিকে তখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল ধ্বংসস্তূপ। জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতেই তাদেরকে হিমশিম খেতে হতো। এমন দূরবস্থার মাঝে থেকেও ধর্মকর্ম ভুলে যান নি মিতা। বরং এ বয়সে এসে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আরবি ভাষা শিক্ষার! বিভিন্ন দেশ থেকে যখন তাবলীগ জামাতের সঙ্গীসাথীরা ইসলামের পথে মানুষকে দাওয়াত দিতে টোকিওতে আসতো, তখন বৃদ্ধ মিতাই যেতেন তাদের সাহায্যার্থে। ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানে যান তিনি, অংশ নেন তাবলীগ জামাতের বিভিন্ন কাজকর্মে। বয়স আস্তে আস্তে তার কর্মক্ষমতায় ছাপ ফেলছিলো। তবুও সব অগ্রাহ্য করেই তিনি কাজ করে যেতেন।
১৯৫৮ সালকে ওমর মিতার জীবনে ১৯৪১ সালের পর আরেকটি উল্লেখযোগ্য বছর হিসেবে ধরা যায়। কারণ এ বছরই পাকিস্তান থেকে আগত এক কাফেলার সাথে তিনি হজ্বযাত্রা করেন। সফলভাবে হজ্বব্রত পালনের মধ্য দিয়ে তার দীর্ঘদিনের লালিত আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়, তিনি হলেন ‘হাজী ওমর মিতা’। দেশে ফিরে এসে ছেষট্টি বছর বয়স্ক এ বৃদ্ধ আবার নব উদ্যমে কাজ শুরু করলেন। ১৯৬০ সালে জাপান মুসলিম অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম প্রেসিডেন্ট সাদিক ইমাইজুমী ইন্তেকাল করেন। এরপর অ্যাসোসিয়েশনের অন্যান্য সদস্যরা হাজী ওমর মিতাকেই তাদের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচন করেন। এ সময়কালে তিনি জাপানের মুসলিমদের জন্য বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বই লিখে যান। এর মাঝে রয়েছে ‘ইসুরামু রিকাই নো তামেনি (ইসলাম অনুধাবন)’ ও ‘ইসুরামু ন্যুমোন (ইসলাম পরিচিতি)’। পাশাপাশি মাওলানা মুহাম্মদ জাকারিয়া রচিত ‘হেকায়েত-ই-সাহাবা’ বইটির জাপানী অনুবাদ ‘সাহাবা মনোগাতারি’ নামে প্রকাশ করেন তিনি। ওমর মিতার জন্য বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিয়েছিলেন হাফিজ আব্দুর রশিদ আরশাদ।
১৯৫৭ জাপানের বিখ্যাত এক প্রকাশনা সংস্থা থেকে কোরআন শরীফের জাপানী অনুবাদ বাজারে আসে। প্রচুর মানুষজন সেই অনুবাদটি কিনেছিলো। এখানে বলে রাখা ভালো, এর আগে ১৯২০, ১৯৩৭ এবং ১৯৫০ সালে কোরআনের তিনটি অনুবাদ জাপানী ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিলো। তবে এ চারটি অনুবাদের সমস্যা ছিলো একই জায়গায়। এগুলোর অনুবাদক ছিলেন বিভিন্ন অমুসলিম জাপানী পন্ডিত। ফলে কোরআনে বর্ণিত নানা ঘটনা একজন মুসলিম যেভাবে দেখে, তাদের অনুবাদে সেই দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ছিলো। পাশাপাশি তারা অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজি কিংবা অন্য কোনো ভাষা থেকে, সরাসরি আরবি থেকে নয়। ফলে তাদের অনুবাদে আগের অনুবাদের দোষত্রুটিগুলো থেকেই গিয়েছিলো। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাজী ওমর মিতা সিদ্ধান্ত নিলেন জাপানী ভাষায় কোরআন শরীফের এমন একটি অনুবাদ দরকার যা করবেন একজন জাপানী মুসলিম এবং কাজটি করা হবে সরাসরি আরবি ভাষা থেকেই। সত্যি কথা বলতে, তখন জাপানের মুসলিম সমাজে এমন কাজ যথাযোগ্যভাবে করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি আসলে তিনিই ছিলেন। মিতার বয়স ততদিনে ঊনসত্তরে গিয়ে ঠেকেছিলো। বয়স, ভগ্ন স্বাস্থ্য সবকিছু উপেক্ষা করে তিনি মনোনিবেশ করলেন কোরআন শরীফের জাপানী অনুবাদের মহাযজ্ঞে।
১৯৬১ সালে সত্তর বছর বয়সী ওমর মিতা চলে গেলেন পাকিস্তানে, লাহোরে গড়লেন নতুন ঠিকানা। সেখানে আরবি ভাষা ও কোরআন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি কোরআন শরীফের অনুবাদ করতে থাকলেন তিনি। কাছাকাছি সময়ে তার যোগাযোগ হয় মক্কা ভিত্তিক এনজিও ‘মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ (রাবিত্বাত আল-‘আলম আল-ইসলামী)’-এর সাথে। তাদের আমন্ত্রণে এবার মক্কায় যান তিনি। মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ অনুবাদকর্মের ব্যাপারে তাকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। মক্কা, মদীনা, জেদ্দা, তায়েফ, রিয়াদ প্রভৃতি অঞ্চলের কোরআন বিশেষজ্ঞদের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে ওমর মিতার। পাশাপাশি তার অনুবাদের কাজও চলতে থাকে বেশ ভালোভাবেই। হাফিজ আব্দুর রশিদ আরশাদের নির্দেশনা এক্ষেত্রে বেশ সহায়ক হয়েছিলো। জাপানী ভাষায় কোরআনের এ অনুবাদ রচনায় তাঁর অবদানের কথা ওমর মিতা সবসময় কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন। তবে সৌদিতে থাকাকালেই এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন আব্দুর রশিদ। সেদিন ওমর মিতাও মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। তবে ধীরে ধীরে তিনি আব্দুর রশিদের মতো একজন পথনির্দেশক হারানোর শোক ও শারীরিক আঘাত- সবই কাটিয়ে ওঠেন।
কিছুদিন পর জাপানে ফিরে আসলেন হাজী ওমর মিতা। দুর্ঘটনার ধকল কাটাতে নিয়মিত চিকিৎসা নিতে হচ্ছিলো তাকে। তবে এতকিছু সত্ত্বেও থেমে ছিলো না তার অনুবাদের মিশন। এ সময় শহরের কোলাহল থেকে দূরে থেকে একাগ্রচিত্তে কাজ করে যাওয়ার জন্য কখনো কিয়োশুর মিয়াজাকিতে, আবার কখনো ইয়ামানাশি প্রিফেকচারের ইনজানে এসে থাকতেন তিনি।
১৯৬৮ সালে অবশেষে অনুবাদ শেষ করেন ওমর মিতা। ততদিনে তার বয়স হয়ে গিয়েছে ছিয়াত্তর বছর। কেবল তো তাঁর কাজ হলো, এবার হবে এটার শুদ্ধি যাচাই। জাপান মুসলিম অ্যাসোসিয়েশনের এক কমিটি পুরো দেড় বছর ধরে যাচাইবাছাই করলো, হলো প্রয়োজনীয় সংশোধন। এই কপি নিয়ে এবার মিতা গেলেন সৌদি আরবে, সময়টা ১৯৭০ সালের মাঝামাঝির দিককার। সেখানে মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগের পক্ষ থেকে নিয়োগকৃত কমিটি ওমর মিতার অনুবাদের শুদ্ধিপরীক্ষা করতে বসলো। ছয় মাস ধরে পরীক্ষানিরীক্ষার পর মিললো কাঙ্ক্ষিত গ্রীন সিগনাল, শুরু করা যাবে ছাপানোর কাজ।
এরপর আর দেরি করলেন না হাজী ওমর মিতা। দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ও পরিশ্রমের বাস্তব রুপ দেখার জন্য তার মন ছটফট করছিলো। তাই দ্রুতই তিনি ফিরে আসলেন জাপানে। অনুবাদের খসড়া দেয়া হলো তাকুমি কোবো প্রিন্টিং কোম্পানির হাতে। হিরোশিমায় অবস্থিত এ কোম্পানির মালিকও ছিলেন আরেক জাপানী মুসলিম। অবশেষে ১৯৭২ সালের ১০ জুন সত্যি হলো হাজী সাহেবের স্বপ্ন, প্রেস থেকে বেরুলো জাপানী ভাষায় কোরআন শরীফের প্রথম ‘সার্থক’ অনুবাদ। কেন ‘সার্থক’ বিশেষণ জুড়ে দেয়া হলো। যে কারণে ঊনসত্তর বছর বয়সী মিতা আমজনতার দৃষ্টিতে প্রায় অসাধ্য এ কাজে হাত দিয়েছিলেন, ঠিক সেই কারণেই এমন বিশেষণটা দেয়া হলো।
একবার ভাবুন তো জাপানের মুসলিম সমাজের জন্য হাজী ওমর মিতার অবদানের মাত্রা আসলে কতটুকু গভীর ছিলো। মানুষটি পুরো ত্রিশটি বছর ধরে শুধু গবেষণা করে গেছেন আরেকটি ধর্ম নিয়ে, যে ধর্মে গেলে সম্ভাবনা ছিলো তার পরিবারের সাথে সম্পর্কছেদের। তবুও তিনি ধর্মান্তরিত হলেন সকল ভয়কে তুচ্ছজ্ঞান করেই। এরপর তিনি মনোযোগ দিলেন স্বদেশের নতুন স্বধর্মী ভাইদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তি মজবুতকরণে। এ কাজে ষাট বছর বয়সের এক বৃদ্ধ শুরু করলেন আরবি ভাষা শিক্ষা। এখানে বলা হয় নি ‘আরবি পড়া’, বলা হয়েছে ‘আরবি ভাষা শিক্ষা’। এ বয়সে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে যে কতটা সাহস আর ধর্মীয় বিশ্বাসের দৃঢ়তা লাগে, তা বুঝতে পারবে যেকোনো ব্যক্তিই। ঊনসত্তর বছর বয়সে এসে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন কোরআন শরীফ মাতৃভাষায় একেবারে ‘অনন্য’ভাবে অনুবাদ করার। এমন বয়সে এ ধরনের চিন্তা করারও সাহস দেখাবে না অধিকাংশ মানুষ। এরপর সেই অনুবাদ করতে গিয়ে তাকে কী পরিমাণ খাটতে হয়েছে তা তো সবাই জেনে গেছে এতক্ষণে। সড়ক দুর্ঘটনাও তাঁকে দমাতে পারে নি। অবশেষে যখন তিনি দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রুপায়িত হতে দেখলেন, ততদিনে কেটে গেছে প্রায় এক যুগ, বয়স ঠেকেছে আশির কোঠায়! জাপানের মুসলিম সমাজকে অনাগতকাল পর্যন্ত কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আটকে ১৯৮৩ সালের ২৯ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মহান এ ব্যক্তি।