২০১৭ সালের পর থেকে নতুন করে জনপ্রিয়তা পাওয়া ‘বেলা চাও’ গানটিকে অনেকেই হয়তো চেনেন নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় স্প্যানিশ সিরিয়াল ‘লা কাসা দে পাপেল’ এ ব্যবহৃত গান হিসেবে। ঐ সিরিয়ালে গানটি বেশ কয়েকবার ব্যবহৃত হয়েছে, যার মধ্যে দর্শকদের কাছে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে প্রথম সিজনের শেষ পর্বের একেবারে শেষ দৃশ্যে সিরিয়ালটির প্রধান দুই চরিত্র, দ্য প্রফেসর এবং বার্লিনের গলায় গাওয়া গানটি। কিন্তু বাস্তবে ‘বেলা চাও’ গানটির ইতিহাস আরও অনেক পুরানো।
বেলা চাও (Bella Ciao) গানটি ইতালির সবচেয়ে বিখ্যাত গানগুলোর একটি। কিন্তু ফ্যাসিবাদ এবং শোষণ বিরোধী গান হিসেবে দেশ ও ভাষার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে এটি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে সারা বিশ্বে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় গানটি অনুদিত হয়েছে, বিভিন্ন দেশের শিল্পীরা একে নিজেদের মতো করে গেয়েছেন এবং বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় গানটি বারবার নতুন করে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
বেলা চাও গানটি মূলত ইতালিয়ান ফোক সঙ্গীত। কিন্তু এটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে ইতালির গৃহযুদ্ধের সময়। ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের সময়, বিশেষ করে ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত একইসাথে ফ্যাসিস্ট ইতালিয়ান সোশ্যাল রিপাবলিক এবং নাৎসি জার্মানদের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া সংঘবদ্ধ সশস্ত্র আন্দোলন পরিচিত হয় পার্টিজান আন্দোলন নামে। এই পার্টিজানদের মধ্যেই বেলা চাও গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
ইতালিয়ান ভাষায় ‘বেলা’ শব্দের অর্থ সুন্দরী, আর ‘চাও’ শব্দের অর্থ বিদায়। সুতরাং ‘বেলা চাও’ শব্দের অর্থ বিদায় সুন্দরী। বেলা এখানে পার্টিজান আন্দোলনের যোদ্ধাদের মাতৃভূমি, ইতালির প্রকৃতি। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত পার্টিজান আন্দোলনের এক কর্মীর মৃত্যুর শেষমুহূর্তের আকুতি এটা, যেখানে শত্রুবেষ্টিত অবস্থায় সে তার বন্ধুদের কাছে অনুরোধ করছে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, অথবা সে যদি মারা যায়, তাহলে তাকে পাহাড়ের উপর কবর দিয়ে একটি ফুল দিয়ে ছেয়ে দেওয়ার জন্য। গানটির হৃদয়স্পর্শী লিরিকের জন্যই এটি দেশ এবং কালের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের সকল দেশের আন্দোলন কর্মীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছে। এটি হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের গান, মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার গান।
বেলা চাও গানটির কথা
উনা মাতিনা মি সান জুয়েলিয়াতো,
ও বেলা চাও, বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও!
উনা মাতিনা মি সান জুয়েলিয়াতো,
এ ও ত্রোভাতো লিনভাজোর।
ও পার্তিজানো পোরতামি ভিয়া,
ও বেলা চাও, বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও!
ও পার্তিজানো পোরতামি ভিয়া,
কে মি সেনতো দি মোরির।
এ সেইউ মুইও দা পার্তিজানো,
ও বেলা চাও, বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও!
এ সেইউ মুইও দা পার্তিজানো,
তু মি দেভি সেপেলির।
সেপেলিরাই লাসুইন মোন্তাইনা,
ও বেলা চাও, বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও!
সেপেলিরাই লাসুইন মোন্তাইনা,
সোতো লোমব্রা দি উন বেল ফিওর।
এলে জেন্তি চে পাসেরানো,
ও বেলা চাও, বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও!
এলে জেন্তি চে পাসেরানো,
মি দিরানো চে বেল ফিওর।
কোয়েস্তো ইল ফিওরে দেল পার্তিজানো,
ও বেলা চাও, বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও!
কোয়েস্তো ইল ফিওরে দেল পার্তিজানো,
মোরতো পের লা লিবার্তা।
বঙ্গানুবাদ
এক সকালে আমি জেগে দেখি,
… বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও … (বিদায় হে সুন্দরী)!
এক সকালে আমি জেগে দেখি,
শত্রু আমাকে ঘিরে রেখেছে।
হে পার্টিজান, আমাকে নিয়ে যাও,
… বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও … (বিদায় হে সুন্দরী)!
হে পার্টিজান, আমাকে নিয়ে যাও,
কারণ আমি শুনতে পাচ্ছি মৃত্যুর পদধ্বনি।
আর যদি আমি মারা যাই পার্টিজান হয়ে,
… বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও … (বিদায় হে সুন্দরী)!
আর যদি আমি মারা যাই পার্টিজান হয়ে,
তুমি এসে আমাকে কবর দিয়ে দিও।
আমাকে কবর দিও ঐ পাহাড়ের উপর,
… বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও … (বিদায় হে সুন্দরী)!
আমাকে কবর দিও ঐ পাহাড়ের উপর,
কবরটি ছেয়ে দিও সুন্দর একটি ফুল দিয়ে।
কবরের পাশ দিয়ে যারা হেঁটে যাবে,
… বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও … (বিদায় হে সুন্দরী)!
কবরের পাশ দিয়ে যারা হেঁটে যাবে,
তারা বলবে, কী সুন্দর ফুল!
এটা হচ্ছে সেই পার্টিজানের ফুল,
… বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও … (বিদায় হে সুন্দরী)!
এটা হচ্ছে সেই পার্টিজানের ফুল,
যে মারা গিয়েছিল স্বাধীনতার জন্য!
পার্টিজান আন্দোলনের সময় জনপ্রিয়তা পেলেও বেলা চাও গানটি ইতিহাস কিন্তু আরও পুরানো। এবং অধিকাংশ ফোক গানের মতোই এই গানটিরও প্রকৃত গীতিকার ও সুরকারের সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয়, গানটি প্রথম ইতালিতে জনপ্রিয়তা লাভ করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। সে সময় ইতালিতে, বিশেষ করে ইতালির উত্তরের পো উপত্যকার ‘মোন্দিনা’ নারীরা প্রতিবাদের অংশ হিসেবে এই গানটি গাইতেন।
মোন্দিনা বলতে ইতালির নারী চাষীদেরকে বোঝানো হয়, যারা মৌসুমের সময় ধানক্ষেতে কাজ করতেন। কঠোর পরিশ্রম, দীর্ঘ কর্মঘন্টা এবং কম মজুরির প্রতিবাদ হিসেবে তারা দল বেঁধে এই গান গাইতেন। তবে গানটির সুর একই থাকলেও কথাগুলো সে সময় একটু ভিন্ন ছিল। পার্টিজান আন্দোলনের পরিবর্তে সেখানে ছিল পোকামাকড় এবং মশার কামড়ের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন ভোরে উঠে কাজ করতে যাওয়ার কথা, পেছনে লাঠি হাতে জমির মালিকের দাঁড়িয়ে থাকার কথা, পরিশ্রম করতে করতে যৌবন হারিয়ে বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার কথা এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখার কথা।
বেলা চাও গানটির মোন্দিনা সংস্করণটি অন্তত ১৯০৬ সাল থেকেই পরিচিত। পার্টিজান সংস্করণটির সাথে সুর ছাড়াও এর অন্যতম প্রধান মিল হলো, দুটি সংস্করণেই এক চরণ পরপর ‘বেলা চাও, বেলা চাও’ শব্দগুলো আছে। পার্টিজান সংস্করণে বেলা তথা সুন্দরী বলতে মাতৃভূমিকে বোঝানো হলেও ধারণা করা হয়, মোন্দিনা সংস্করণে শব্দটি ব্যবহৃত হতো ধানক্ষেতে কর্মরত নারীদের নিজেদের সৌন্দর্য এবং যৌবন বোঝাতে, যেখানে তারা কঠোর পরিশ্রমের ফলে নিজেদের সৌন্দর্যকেই বিদায় জানাচ্ছেন।
বেলা চাও গানটির উৎপত্তি সম্পর্কে আরো কিছু বিবরণও পাওয়া যায়। যেমন অনেকে মনে করেন, এর মূল সুরটি এসেছে পূর্ব ইওরোপের ইহুদীদের মধ্যে জনপ্রিয় একটি ফোক গানের সুর থেকে। ১৯১৯ সালে আমেরিকাতে পূর্ব ইউরোপের ইহুদীদের ইদ্দিশ ভাষায় রেকর্ড করা একটি গানের সুরের সাথে বেলা চাও গানটির সুরের অস্বাভাবিক রকমের মিল থাকার কারণেই এ ধারণা করা হয়। সে কারণে অনেকে ধারণা করেন, এই সুরটি ইহুদীদের মধ্যে আগে থেকেই প্রচলিত ছিল, পরবর্তীতে আমেরিকা প্রবাসী কোনো ইতালিয়ানের মাধ্যমে তা ইতালিতে পৌছে এবং সেখানে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
তবে উৎস যাই হোক না কেন, বেলা চাও গানটি বিশ্ব জুড়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী গান হিসেবেই বেশি পরিচিত। বিশ্বের অন্য অনেক দেশের আন্দোলনের পাশাপাশি স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময়ও গানটির অনুবাদ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। নতুন প্রজন্মের অনেকেরই হয়তো গানটি সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু স্প্যানিশ টিভি সিরিয়াল ‘লা কাসা দে পাপেল’ এর প্রথম সিজনের সর্বশেষ এপিসোডে সিরিজটির প্রধান দুই চরিত্র, দ্য প্রফেসর এবং বার্লিনের মুখে গানটির অসাধারণ চিত্রায়ন দেখে অনেকেই নতুন করে গানটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে অনেকেই জানতে পেরেছেন, এটা সাধারণ কোনো গান না। সঙ্গীত শিল্পী এবং সঙ্গীত বিষয়ক লেখক জেরি সিলভারম্যান তার বইয়ে যেরকম দাবি করেছেন, গানটি বিশ্বের ইতিহাস সৃষ্টিকারী গানগুলোর মধ্যে অন্যতম।