ভ্রমণপিপাসুদের জন্য ভারতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলোর একটি হলো গোয়া। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক ভিড় করে ভারতের ক্ষুদ্রতম এই রাজ্যে। সমুদ্রসৈকত তো বটেই, পাশাপাশি গোয়ার উপাসনালয় ও বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোরও বিশেষ আবেদন রয়েছে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে। তবে গোয়া পর্যটন গন্তব্য হিসেবে যতটা জগৎবিখ্যাত, এর ইতিহাস কিন্তু ততটা সমাদৃত নয়। খোদ ভারতেও এমন অনেক মানুষ পাওয়া যাবে, যারা জানেই না যে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনেরও প্রায় দেড় দশক পর ভারতের অংশ হয়েছে গোয়া। তাছাড়া হিন্দু পুরাণে গোয়ার উল্লেখ কিংবা দীর্ঘ ৪৫০ বছর গোয়ায় পর্তুগিজ শাসন, এই বিষয়গুলোও অজানা অনেকের কাছে।
নামকরণ
বৈদিক যুগের শেষ দিকে, যখন বিশ্বখ্যাত হিন্দু মহাকাব্য ‘মহাভারত’ রচিত হয়, তখন গোয়াকে ডাকা হতো এর সংস্কৃত নাম ‘গোমন্তক’ হিসেবে। শব্দটির বেশ কিছু অর্থ রয়েছে, তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অর্থটি হলো উর্বরা ভূমি। অবশ্য গোয়া নামটি দিয়েছে পর্তুগিজরা। তারা দৃশ্যপটে হাজির হওয়ার পূর্বে, গোয়া (কিংবা গোবে বা গোবন্তপুরম) বলতে শুধু মান্দবী নদীর মুখে অবস্থিত বন্দর নগরীটিকেই বোঝানো হতো। পরবর্তীতে এখানেই পর্তুগিজরা গড়ে তুলেছিল তাদের রাজধানী, যা আজকের পুরনো গোয়া।
কিংবদন্তীর কাহিনী
পৌরাণিক কিংবদন্তী (এবং কিছুটা ইতিহাস) মতে, সরস্বত ব্রাহ্মণরা (ব্রাহ্মণদের মধ্যে যারা মাছ খায়) ছিল গোয়ায় বসতি স্থাপন করা প্রথম জনগোষ্ঠী। এই ব্রাহ্মণদেরকে সরস্বত বলার কারণ তারা বৈদিক যুগে বিদ্যমান সরস্বতী নদীর তীরে বাস করত। কিন্তু এক পর্যায়ে সরস্বতী নদীটি শুকিয়ে গেলে এই ব্রাহ্মণরা সারা ভারতবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এদের মধ্যে ৯৬টি পরিবারের একটি দল, যারা আজ গৌড় সরস্বতী নামে পরিচিত, খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের দিকে কঙ্কণ উপকূলবর্তী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। কথিত আছে, তারা নাকি পুরোপুরি সমুদ্রপথে এই অঞ্চলে এসেছিল। কঙ্কণ উপকূলে তাদের বসতি স্থাপিত অঞ্চলটিই আজকের গোয়া।
প্রাথমিক যুগ
গোয়া ছিল সম্রাট অশোকের অধীনে মৌর্য সাম্রাজ্যের একটি অংশ। তখন ভারতের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এটি পরিচিত ছিল বিভিন্ন নামে। যেমন: ভারতীয় অপরন্ত, গোমন্ত, গোবরাষ্ট্র, গোপরাষ্ট্র, গোবপুরী, গোপকপুরি, গোপকপট্টনা, গোবে ইত্যাদি। এছাড়া মধ্যযুগীয় আরব ভূতত্ত্ববিদদের কাছে এটির পরিচয় ছিল সিন্দাবুর বা সান্দাবুর নামে।
এরপর ৭০০ বছর বিভিন্ন হিন্দু রাজবংশের নিয়ন্ত্রণে ছিল গোয়া। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চালুক্য (৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শতক), রাষ্ট্রকূট (৮ম থেকে ১০ম শতক) এবং কদম্ব রাজবংশ (১০০৬ থেকে ১৩৫৬ অব্দ)। এদের মধ্যে কদম্বরা ছিল বিশেষায়িত ও স্বতন্ত্র, কেননা তারা ছিল একটি স্থানীয় রাজবংশ যারা তাদের প্রতিবেশী ও ভিনদেশী প্রভুদের (চালুক্য) সাথে মৈত্রী তৈরীর মাধ্যমে ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছিল। তারা প্রথমে চন্দ্রপুরকে তাদের রাজধানী বানিয়েছিল, এবং এরপর রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিল গোবপুরীতে। গোবপুরী ছিল জুয়ারি নদীর তীরে অবস্থিত, যা আজকের গোয়া ভেলহা নামে পরিচিত।
কদম্বরাই প্রথম, একাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, পুরনো গোয়ায় বসতি স্থাপন করেছিল। তখন এর নাম ছিল থোরলেম গোরেম। এই সময়কালটি বিবেচিত হয় গোয়ার ইতিহাসের প্রথম স্বর্ণযুগ হিসেবে। তবে ১১৯৮ সালে শেষ চালুক্য রাজার মৃত্যুর পরে মিত্রদের সাথে কদম্বদের সম্পর্ক অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। সামগ্রিকভাবে এই অঞ্চলে তাদের দখলদারিত্ব ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, যা পরবর্তীতে মুসলিমদের সহজেই গোয়া দখলের পথ প্রশস্ত করে দেয়।
মুসলিম যুগ
১৩৫০ সালের দিকে মুসলিম বাহামিনি সাম্রাজ্য গোয়া দখল করে নেয়। একই সাথে তারা ধ্বংস করে দেয় গোয়ার অধিকাংশ মন্দির এবং অন্যান্য স্থাপত্য নিদর্শন। স্থানীয় পুরোহিতদেরকে তারা হত্যা করে, আর তাদের সম্পদ লুট করতে থাকে। কেবল তাম্বদি সুরলায় অবস্থিত শ্রী মহাদেব মন্দিরটি আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। সেখানেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অন্যান্য বিভিন্ন মন্দিরের অক্ষত দেবতা মূর্তিগুলোকে।
চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে বিজয়নগরের হিন্দু সাম্রাজ্যের কাছে পরাজয়ের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে প্রথম বাহামিনি শাসনের। কিন্তু ১৪৭০ সালেই তারা আবার ফিরে আসে এবং পুনরায় গোয়া দখল করে নেয়। ওই বিজয়ের মাধ্যমে পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে গোয়া বনে যায় ডেকানের মুসলিম বাহমানি রাজ্যের একটি অংশ। বাহমানিরা এরপর মান্দবী নদীর উত্তর উপকূলে বাণিজ্যের সুবিধার্থে একটি নতুন নগরীর গোড়াপত্তন করে, যেটির নাম তারা দেয় এলা। ১৪৯২ সালে বাহমানি সাম্রাজ্য পাঁচটি ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়, যেগুলোর নাম ছিল: বিদার, বেরার, আহমাদনগর, গোলকোন্দা ও বিজাপুর। গোয়া ছিল বিজাপুরের অন্তর্ভুক্ত, এবং এর শাসনকর্তা ছিলেন সুলতান ইউসুফ আদিল শাহ খান।
পর্তুগিজদের গোয়া দখল
১৪৯৮ সালের ২০ মে প্রথম কালিকট বন্দরে (বর্তমান কেরালায় অবস্থিত) নোঙর ফেলেন পর্তুগিজ পর্যটক ও অনুসন্ধানকারী ভাস্কো দা গামা। এর মাধ্যমে তিনি কেপ অভ গুড হোপ থেকে ভারতে আসার একটি নতুন পথ আবিষ্কার করেন, যা পর্তুগিজদের সামনে স্বর্ণালী সম্ভাবনার জন্ম দেয়। তারা বুঝতে পারে ভারতের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের বাণিজ্যে উন্নতির সমূহ সুযোগ রয়েছে। তবে তারা এটিও অনুধাবন করে যে ভারতে প্রবেশের জন্য তাদেরকে আরো কার্যকরী একটি বন্দর খুঁজে বের করতে হবে।
বেশ কয়েকবার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর, অবশেষে ১৫১০ সালে আলফোনসো ডি আলবুকার্কের নেতৃত্বে সুলতান আদিল শাহের শাসনাধীন গোয়ায় ঢুকতে সমর্থ হয় পর্তুগিজরা। ১৭ ফেব্রুয়ারি আলবুকার্ক প্রথমবারের মতো গোয়ায় প্রবেশ করেন। সেদিন তিনি খুব কম বাধারই সম্মুখীন হন, কারণ সুলতান তখন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে অন্য কোথাও ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু প্রতিশোধস্পৃহায় মত্ত সুলতান খুব শীঘ্রই ফিরে আসেন, এবং ১৫১০ সালের ২৩ মে পাততাড়ি গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হন আলবুকার্ক। কিন্তু তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে পরেরবার যখন গোয়ায় আসবেন, এটিকে চিরতরে জয় করেই ছাড়বেন।
এর কয়েক মাস পর আবার গোয়া দখলের চেষ্টা চালান আলবুকার্ক। এবার তিনি সাহায্য পান তিমোজা নামের এক হিন্দু সর্দারের। ভাগ্য সবদিক দিয়েই সুপ্রসন্ন ছিল আলবুকার্কের জন্য। মাত্রই কিছুদিন আগে মারা গিয়েছেন সুলতান আদিল শাহ, আর ক্ষমতায় বসেছেন তার নাবালক পুত্র ইসমাইল আদিল শাহ। এলা কিংবা গোয়া শহর তখন মূলত তার অন্যতম সেনাপতি রাসুল খানের নিয়ন্ত্রণে। ১৫১০ সালের ২৫ নভেম্বর সেইন্ট ক্যাথরিন’স ডে-তে, রাসুল খানের সৈন্যদলের উপর আকস্মিক হামলা চালিয়ে, এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে এলা ও গোয়া দখল করে নেন আলবুকার্ক।
তবে এখানেই থামেননি আলবুকার্ক। আগের পরাজয়ের কারণে মনে মনে ফুঁসছিলেন তিনি। তাই পরের তিনদিনে এই অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর এক নারকীয় গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালান তিনি। কিন্তু হিন্দুদের সাহায্য পাওয়ায়, তাদেরকে ছাড় দেন তিনি। এমনকি তিমোজাকে নিজের সৈন্যদলের শীর্ষস্থানীয় পদে নিয়োগও দেন।
১৫৪৩ সাল নাগাদ পর্তুগিজরা সালসেত, মোরমুগাও ও বারদেজেও তাদের ক্ষমতার সীমানা সম্প্রসারিত করে ফেলে, এবং গোয়া হয়ে ওঠে তাদের পূর্বাঞ্চলীয় সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। ষষ্ঠদশ শতক শেষ হওয়ার আগেই গোয়া পৌঁছে গিয়েছিল পর্তুগিজ শাসনের অধীনে তার স্বর্ণযুগে। এটি তখন ‘গোল্ডেন গোয়া’ কিংবা ‘প্রাচ্যের লিসবন’ নামেও অভিহিত হতে শুরু করে।
গোয়ায় পর্তুগিজদের ধর্মীয় নিপীড়ন
পর্তুগিজদের সাথে সাথে তাদের ধর্মেরও আগমন ঘটে গোয়ায়, এবং সেটিও ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অবশ্য আলবুকার্কের প্রধান লক্ষ্য ছিল বাণিজ্য, তাই পর্তুগিজরা স্থানীয় হিন্দুদের প্রতি প্রথম দিকে বেশ সহনশীলই ছিল, যদিও মুসলিমদের প্রতি তাদের ক্রোধের কোনো সীমা ছিল না। তবে ১৫৪০ সালের পর থেকে গোয়ায় আবির্ভাব ঘটে ‘ইনকুইজিশন’-এর, এবং এর মাধ্যমে বদলে যায় গোটা দৃশ্যপট।
১৫৪২ সালে সেইন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার ও জেসুইটদের আগমন ঘটে গোয়ায়। গোয়ায় পা রেখে জেভিয়ার বুঝতে পারেন, খ্রিস্টধর্ম এখানকার মানুষের মনে কোনো স্থায়ী জায়গা করে নিতে পারেনি। স্থানীয় বেশিরভাগ মানুষই হয়তো জোরপূর্বক কিংবা রাজনৈতিক কারণে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে, কিন্তু এখনো তারা মনেপ্রাণে তাদের পূর্বের ধর্মীয় রীতিনীতিকেই লালন-পালন করে চলেছে। সবকিছু পর্যবেক্ষণের পর তিনি এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, এই জনগোষ্ঠীকে প্রকৃত খ্রিস্টান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, আর সেজন্য গ্রহণ করতে হবে ইনকুইজিশনের মতো ভয়ঙ্কর পন্থা।
১৫৪৫ সালের ১৬ মে তিনি পর্তুগালের রাজাকে একটি চিঠি লেখেন, যেখানে ইনকুইজিশনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। অবশ্য সেই সময়ে পর্তুগালের রাজা ও পোপের মধ্যে চলছিল দ্বন্দ্ব। তাই সাথে সাথেই ইনকুইজিশন স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু জেসুইটরা ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ অব্যহত রাখে, তার ফলে ১৫৬০ সালে শুরু হয় ইনকুইজিশন কার্যক্রম। প্রাথমিকভাবে ইনকুইজিশনের লক্ষ্য ছিল কেবল নব্য খ্রিস্টানদেরকে শাস্তি দিয়ে ও ভয় দেখিয়ে প্রকৃত খ্রিস্টান হিসেবে গড়ে তোলা। কিন্তু ক্রমেই এর শিকারে পরিণত হয় স্থানীয় হিন্দু, মুসলিম, ইহুদি সকলেই। এমনকি অনেক ইউরোপীয়কেও ইনকুইজিশনের নামে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়।
ইনকুইজিশনের ব্যাপারটা অনেকটা এমন ছিল যে, খ্রিস্টান যাজকেরা প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় নজরদারি করে বেড়াতেন, এবং যদি তাদের মনে কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ জন্মাত যে ওই ব্যক্তি সঠিকভাবে খ্রিস্টধর্ম পালন করছে না, সাথে সাথে তাকে ধরে নিয়ে এসে অকথ্য নির্যাতন চালাতেন তারা। ১৮১২ সাল পর্যন্ত গোয়ায় ইনকুইজিশন চলে, এবং এই সময়কালের মধ্যে অগণিত মানুষকে শাস্তির নামে বন্দিশালায় বন্দি রাখা হয়, এমনকি জীবন্ত পুড়িয়েও মারা হয়। এসবের পাশাপাশি ইনকুইজিশন চলাকালীন প্রচুর মন্দির ও দেবতার মূর্তিও ধ্বংস করা হয়।
মারাঠাদের আক্রমণ
ভারতীয় জলসীমানায় ওলন্দাজদের আগমনের মাধ্যমে গোয়ায় পর্তুগিজদের ক্ষমতা খর্ব হতে শুরু করে। ১৬০৩ থেকে ১৬৩৯ সাল পর্যন্ত গোয়া অবরুদ্ধ ছিল ওলন্দাজ নৌবহর দ্বারা, যদিও কখনোই ওলন্দাজরা গোয়া দখল করতে পারেনি। এদিকে ১৬৩৫ সালে এক মহামারীতে আরো বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে গোয়ার অবস্থা।
এরপর ১৬৮৩ সালে মারাঠারা আক্রমণ চালিয়ে বসে গোয়ায়। সেই আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন শিবাজির পুত্র সাম্ভাজি। কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে মুগলরা এসে বাঁচিয়ে দেয় পর্তুগিজদের। ১৭৩৯ সালে আবারো শিবাজির পৌত্র রাজা শাহুর নেতৃত্বে মারাঠা আক্রমণ চালায় পর্তুগিজদের উপর। কিন্তু এ যাত্রায় তারা রক্ষা পায় এক পর্তুগিজ ভাইসরয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত আগমনের সুবাদে।
শেষ পর্যন্ত এক চুক্তির মাধ্যমে ঘটে যুদ্ধবিরতি। সেই চুক্তি অনুযায়ী পর্তুগাল তাদের দখলে থাকা উত্তর ভারতীয় কয়েকটি প্রদেশ ফিরিয়ে দেয় মারাঠাদের। প্রতিদানস্বরূপ মারাঠারা তাদের সৈন্যবাহিনী ফিরিয়ে নেয় গোয়া থেকে।
প্রশাসনিক পরিবর্তন
গোয়ায় পর্তুগিজদের সরকার পুরনো গোয়া থেকে স্থানান্তরিত হয় প্রথমে মোরমুগাও (বর্তমান মারমাগাও), এবং পরবর্তীতে ১৭৫৯ সালে পানজিমে (নতুন গোয়া, কিংবা বর্তমান পানাজি)। এই প্রশাসনিক পরিবর্তনের পেছনে একটি বড় কারণ ছিল কলেরা মহামারী। ১৬৯৫ থেকে ১৭৭৫ সালের মধ্যে কলেরা মহামারীর দরুণ পুরনো গোয়ার জনসংখ্যা ২০,০০০ থেকে ১,৬০০-এ নেমে এসেছিল; এবং ১৮৩৫ সালে সেখানে বাস করতেন কেবল হাতেগোনা কয়েকজন যাজক, সন্ন্যাসী ও মঠবাসিনী।
দেশভাগ পরবর্তী সময়কাল
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছ থেকে, এবং ভারত ও পাকিস্তান নামক প্রধান দুইটি দেশে বিভক্ত হয়। কিন্তু তখনো গোয়া ছিল পর্তুগালের অধীনে। ১৯৪৮ ও ১৯৪৯ সালে ভারত গোয়ার অধিকার দাবি করে। এছাড়া পর্তুগালের উপর চাপ আসতে থাকে উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণও ভারতের হাতে তুলে দিতে।
১৯৫৪ সালের মাঝামাঝি পর্যায়ে গোয়ার জাতীয়তাবাদীরা পর্তুগিজ ছিটমহল দাদরা ও নগর হাভেলি দখন করে নেয় এবং সেখানে ভারতীয় প্রশাসন স্থাপন করে। পর্তুগিজদের জন্য আরো একটি বড় সমস্যার আবির্ভাব ঘটে ১৯৫৫ সালে, যখন ভারতীয় সত্যাগ্রহীরা গোয়া অঞ্চলে প্রবেশের চেষ্টা চালায় শুরুর দিকে সত্যাগ্রহীদেরকে বের করে দেয়া গিয়েছিল, কিন্তু যখন একসাথে বিপুল সংখ্যক মানুষ সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা চালায়, তখন পর্তুগিজ কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় অস্ত্র চালাতে। এর ফলে প্রচুর মানুষ হতাহত হয়।
এই ঘটনার সূত্র ধরে ১৯৫৫ সালের ১৮ আগস্ট পর্তুগাল ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কেও ব্যাপক অবনতি ঘটে। গোয়ার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে ভারত, যা এই অঞ্চলের মানুষের জন্য প্রচণ্ড দুর্দশা বয়ে আনে। স্বভাবতই গোয়ার স্থানীয় অধিবাসীরা তাদের প্রশাসনের প্রতি খুবই নাখোশ ছিল এসবের কারণে।
অপারেশন বিজয়
উত্তেজনা চরম অবস্থায় পৌঁছায় ১৯৬১ সালে, যখন পর্তুগিজরা একটি ভারতীয় মাছ ধরার নৌকায় গুলি চালিয়ে একজন জেলেকে মারার প্রতিবাদে ভারতীয় সেনাবাহিনী আক্রমণ করে বসে গোয়া। এই সামরিক অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন বিজয়’। ৩৬ ঘণ্টা ধরে ভারতীয়দের সাথে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে যুদ্ধের পর গোয়ার গভর্নর জেনারেল ম্যানুয়েল আন্তোনিও ভাসালো ই সিলভা স্বাক্ষর করেন আত্মসমর্পণ পত্রে। সেই দিনটি ছিল ১৯৬১ সালের ১৯ ডিসেম্বর। এভাবেই গোয়া অঞ্চল চলে আসে ভারতের দখলে। আর গোয়ায় অবসান ঘটে ৪৫০ বছরের পর্তুগিজ শাসনের।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/