সাদ্দাম হুসাইনের জীবনের শেষ অঙ্ক

সাদ্দাম হুসাইন আল-মাজিদ আল-তিকরিতি। সংক্ষেপে সাদ্দাম হুসাইন। দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে টিকে ছিলেন সদা অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র ইরাকের ক্ষমতার মসনদে। কঠোর হস্তে সকল বিদ্রোহকে রুখে দিয়েছিলেন। যমের মতো ভয় করতো তাকে ইরাকের মানুষ। তার চোখের শীতল দৃষ্টি যে কাউকে ভস্ম করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। তেল রপ্তানী নির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলে তিনি দেশকে যেমন সমৃদ্ধির পথ দেখিয়েছিলেন, তেমনি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে একের পর এক যুদ্ধে জড়িয়ে ইরাককে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার নেপথ্যেও ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর প্রায় বারো বছর পর আজও সাদ্দাম হুসাইন প্রশ্নে সমগ্র ইরাক দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

আজ আমরা এই একনায়ক, খলনায়ক এবং রাষ্ট্রনায়কের জীবনের শেষ অঙ্কের ওপর আলোকপাত করবো।

সাদ্দাম হুসাইন; Image Source: IBTimes UK

প্রথম গাল্‌ফ যুদ্ধের পর সাদ্দাম হুসাইনের নেতৃত্বে ইরাকি বাথ পার্টি পুনরায় সংগঠিত হতে থাকে। ভেঙে পড়া অবকাঠামো পুরোপুরি ঢেলে সাজানো শুরু হয়। সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠিত করা হয়। অর্থাৎ ইরাক ধীরে ধীরে আবার মধ্যপ্রাচ্যের এক শক্তিশালী শক্তিরূপে আবির্ভূত হতে শুরু করে।

ইরাকের এই অগ্রগতিতে শঙ্কিত হয়ে এবং পুনরায় ইরাক যেন পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আগ্রাসন চালাতে না পারে সেজন্য পশ্চিমা দেশগুলোর যোগসাজশে জাতিসংঘ ইরাকের ওপর বেশ কিছু অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এই অবরোধের আরেকটি কারণ ছিল ইরাকের পারমাণবিক এবং রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়াকে যথাসম্ভব ধীর করে দেয়া। তবে এই অবরোধ একসময় স্তিমিত হয়ে যায়, কারণ বিভিন্ন রাষ্ট্র বিপুল তেলের মজুদ থাকা ইরাকের সাথে বাণিজ্যে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে ইরাক ধীরে ধীরে গাল্‌ফ যুদ্ধ পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যেতে থাকে।

এরই মধ্যে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিমান হামলার কারণে আমেরিকা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান শুরু করে। যেসব দেশ তাদের সন্ত্রাসী তালিকার শুরুর দিকে ছিল, তাদের মধ্যে ইরাক অন্যতম। ২০০২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশ ইরাককে সন্ত্রাসের মদদদাতা হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি ইরাককে রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি এবং মজুদের জন্য দায়ী করেন এবং একইসাথে বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনকে, যার মধ্যে আল-কায়েদা অন্যতম, অর্থায়ন ও অস্ত্র সরবরাহ করে ৯/১১ হামলার জন্য ইরাককে পরোক্ষভাবে দায়ী করেন। তিনি ইরাককে সকল প্রকার রাসায়নিক অস্ত্র মুক্ত করার অঙ্গীকার করেন।

২০ সেপ্টেম্বর, ২০০১ তারিখে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকালে প্রেসিডেন্ট বুশ; Image source: RealClearPolitic

আমেরিকার চাপের কাছে নতি স্বীকার করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ২০০২ সালের ৮ নভেম্বর রেজ্যলুশন ১৪৪১ পাস করে, যাতে ইরাককে আন্তর্জাতিক পরিদর্শক দলকে ইরাকের সন্দেহজনক অস্ত্রাগার পরিদর্শনের অনুমতি দেয়ার জন্য বলা হয়। শুরুর দিকে নিরুৎসাহ দেখালেও ইরাক পরিদর্শক দলকে দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়।

পরিদর্শক দল ইরাকে যাওয়ার কিছুদিন পরই আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ইরাকের বিরুদ্ধে দলটিকে অসহযোগিতার অভিযোগ করে। বিশেষ করে আমেরিকা এবং ব্রিটেন ইরাকের বিরুদ্ধে পরিদর্শনে বাধার সৃষ্টি এবং বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ অস্ত্র গোপন করার অভিযোগ করে এবং পরিদর্শক দলকে ফিরিয়ে আনার জন্য চাপ দিতে থাকে। যদিও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে ফ্রান্স, রাশিয়া এবং জার্মানি ইরাককে আরেকটি সুযোগ দেয়া এবং পরিদর্শনের সময়সীমা বাড়ানোর পক্ষপাতী ছিল। কিন্তু আমেরিকা এবং ব্রিটেন এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল যে ইরাক কখনোই রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি এবং মজুদ বন্ধ করবে না এবং পরিদর্শক দলকে সহযোগিতাও করবে না! তাই ইরাককে শায়েস্তা করতে তারা ইরাকের সীমান্তে বিপুল পরিমাণ সৈন্য এবং যুদ্ধাস্ত্র জড় করতে থাকে।

২০০৩ সালের ১৭ মার্চ আমেরিকা এবং তার মিত্ররা জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে ইরাকের সাথে সকল প্রকার কূটনৈতিক আলোচনার সমাপ্তি টানে। একইসাথে জর্জ ডব্লিউ. বুশ সাদ্দাম হুসাইনকে ইরাক ত্যাগের জন্য ৪৮ ঘন্টার সময়সীমা বেঁধে দেন। তা না হলে ইরাক আক্রমণের হুমকি দেন। যদিও ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া এবং অন্যান্য দেশ এই ঘোষণার নিন্দা জানায়।

সম্ভাব্য ইরাক আক্রমণ নিয়ে আলোচনায় (বাম থেকে) পর্তুগিজ প্রধানমন্ত্রী বারোসা, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ও স্প্যানিশ প্রধানমন্ত্রী জোসে আজনার; Image Source : brittanica.com

সাদ্দাম হুসাইন দেশ ত্যাগে অস্বীকৃতি জানান। ফলে ২০ মার্চ সকাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলো ইরাকের ওপর বোমা হামলা শুরু করে। বিভিন্ন সরকারি ভবন, সামরিক স্থাপনা, সাদ্দাম হুসাইনের সম্ভাব্য অবস্থান ইত্যাদি স্থান লক্ষ্য করে অবিরাম বিমান হামলা চলতে থাকে। একইসাথে কিছুদিনের মধ্যেই আমেরিকান পদাতিক বাহিনী কুয়েতের মধ্য দিয়ে ইরাকে প্রবেশ করে। ফলে দেশের জন্য লড়ে যাওয়া ইরাকি সৈন্যদের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে পড়ে।

আদতে ইরাকি বাহিনীর একটি বড় অংশ যুদ্ধ থেকে বিরত থাকে। তারা মিত্রবাহিনীর এই দুর্বার আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য কিছুই করেনি। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কোয়ালিশন সেনাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে  প্রতিরোধ গড়ে ওঠে তা-ও পরিচালনা করে বাথ পার্টির সশস্ত্র গ্রুপ সাদ্দাম্‌স ফাদাঈন। নিয়মিত সেনাবাহিনী নয়। বাসরা শহরে ব্রিটিশ বাহিনীও অনুরূপ আনাড়ি যোদ্ধাদের দ্বারা গড়ে তোলা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।

ইরাকি রিপাবলিকান গার্ডের একটি শক্তিশালী ইউনিট রাজধানী বাগদাদ প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। তবে মিত্রবাহিনীর নিয়মিত বিমান হামলার কারণে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ফলে মিত্রবাহিনীর পদাতিক ডিভিশন বাকি কাজটি খুব সহজ করে ফেলে। তারা ৪ এপ্রিল বাগদাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট দখল করে নেয়। পরবর্তী দিনগুলোয় পদাতিক বাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর যুগপৎ হামলায়  রিপাবলিকান গার্ডের যাবতীয় প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে যায় এবং ৯ এপ্রিল বাগদাদের পতন ঘটে।

সাদ্দাম হুসাইনের একটি মূর্তিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কিছু ইরাকি নাগরিক; Image Source: Britannica.com

একই দিন দক্ষিণের গুরুত্বপূর্ণ শহর বাসরা দখলে নেয় ব্রিটিশ বাহিনী। পরবর্তী দিন ১০ এপ্রিল উত্তরাঞ্চলের শহর কির্কুক এবং ১১ এপ্রিল মসুল শহরের পতন ঘটে। ইরাকের সর্বশেষ শক্তিশালী ঘাঁটি এবং সাদ্দাম হুসাইনের বাসস্থান তিকরিতে সামান্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয় সাদ্দামের সমর্থকেরা। সেটিও ১৩ এপ্রিলের মধ্যে হাতছাড়া হয়ে যায় ইরাকের। এরপরও সাদ্দাম হুসাইনের অনুগত কিছু বিচ্ছিন্ন গ্রুপ গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তবে তারা বলার মতো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে ১ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

মাত্র এক মাস দশ দিনের সর্বাত্মক হামলায় পতন ঘটে সাদ্দাম রাজত্বের। ইরাকে হামলা শুরুর পর থেকেই সাদ্দাম হুসাইনকে আর জনসম্মুখে দেখা যায়নি। বাগদাদের পতনের পর তিনি পুরোপুরি আত্মগোপনে চলে যান। আমেরিকার মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার শীর্ষে চলে আসেন সাদ্দাম। শুরু হয় কোনো একজন মানুষকে খুঁজে পাওয়ার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে চালানো অন্যতম বৃহৎ অভিযানের।

বাগদাদ পতনের পর সাদ্দাম হুসাইনের মূর্তি ভেঙে ফেলা হচ্ছে; Image Source: The New Yourker 

সাদ্দামের ব্যাপারে একটি বিষয়ে সবাই নিশ্চিত ছিল যে, তিনি কখনোই ইরাক ছেড়ে যাবেন না। সিআইএর মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক জুডিথ ইয়াফে বলেছিলেন, সাদ্দাম কস্মিনকালেও ইরাক ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেননি। তার মনজুড়ে ছিল শুধুই ইরাক। ফলে শুধুমাত্র ইরাকেই তাকে খুঁজতে চিরুনি অভিযান শুরু হয়। ২০০৩ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সাদ্দাম হুসাইনের খোঁজে চালানো বারোটি অভিযান ব্যর্থ হয়। এই সময়ের মধ্যে সাদ্দাম হুসাইন থাকতে পারে এই আশায় ৬০০টি টার্গেটে হামলা চালানো হয় এবং ৩০০ জন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। কিন্তু কেউ কোনো তথ্য দিতে পারেনি। অবশেষে ১ ডিসেম্বর পূর্বে বাগদাদের রাস্তায় গাড়ি চালাতো এমন একজন ব্যক্তি আমেরিকান বাহিনীর কাছে একটি নাম ফাঁস করে। মুহাম্মদ ইব্রাহীম ওমর আল-মুসলিত, যিনি সাদ্দাম হুসাইনের ‘ডান হাত’ নামে খ্যাত।

পরিবর্তী দুই সপ্তাহ জুড়ে এই মুহাম্মদ ইব্রাহীমের খোঁজ চলে। আমেরিকান সৈন্যদের কাছে তার ছদ্মনাম ছিল ‘দ্য সোর্স’ এবং ‘দ্য ফ্যাটম্যান’। এই সময়ের মধ্যে ফ্যাটম্যানের পরিবারের ৪০ জন সদস্যকে তার অবস্থান জানার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী ১২ ডিসেম্বর বাগদাদে অবস্থিত একটি বাড়ি থেকে মুহাম্মদ ইব্রাহীমকে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন সকালে তিনি কয়েকটি স্থানের নাম বলেন যেখানে সাদ্দাম হুসাইনের থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

তার দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে আদ-দ্বার শহরের নিকটে দুটি স্থান চিহ্নিত করা হয়। স্থান দুটোর কোড নাম ছিল উলভারিন-১ এবং উলভারিন-২। ৬০০ সদস্যের একটি দল এই অভিযানে অংশ নেয়। তাদের সাথে ছিল অত্যাধুনিক ট্যাঙ্ক, গাড়ি, হেলিকপ্টার, ইঞ্জিনিয়ারের দল এবং অন্যান্য স্পেশাল অপারেশন ফোর্স। এই অভিযানের নাম দেয়া হয় অপারেশন রেড ডন

প্রাথমিকভাবে উলভারিন-১ এবং উলভারিন-২ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছুই পায়নি। সবাই যখন ফিরে যেতে মনঃস্থির করে, ঠিক তখনই কোনো এক সৈন্য একটি খুব সরু গর্তের মতো সুরঙ্গ খুঁজে পায়। সেই সুরঙ্গের মধ্য অবশেষে খুঁজে পাওয়া যায় মুখ ভর্তি দাড়ি এবং জীর্নশীর্ণ পোশাক পরিহিত মোস্ট ওয়ান্টেড সাদ্দাম হুসাইনকে।

সাদ্দাম হুসাইনকে সুরঙ্গ থেকে বের করে আনা হচ্ছে; Image Source: CMH News and Features

সাদ্দাম হুসাইন বিনা প্রতিরোধে আত্মসমর্পণ করেন। সেখান থেকে তাকে বাগদাদ এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। তার অবস্থানকৃত সেই সুরঙ্গ থেকে একটি একে-৪৭ রাইফেল এবং  ৭,৫০,০০০ মার্কিন ডলার উদ্ধার করা হয়। সাদ্দাম হুসাইনের সাথে থাকা আরও দুই ব্যক্তিকেও গ্রেফতার করা হয়। এ অভিযানে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

সাদ্দাম হুসাইনকে যে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে তা মোটামুটি সবারই জানা ছিল। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় তা ঘটবে সেটাই ছিল দেখার বিষয়। গ্রেফতারের পর সাদ্দাম হুসাইনকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সন্ধান দেয়ার জন্য দীর্ঘদিন যাবত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে তিনি তাদেরকে হতাশাই উপহার দিয়েছিলেন প্রতিবার। ফলে আমেরিকানরা সাদ্দামের কাছ থেকে কোনো ধরনের মূল্যবান তথ্য উদ্ধার করতে না পেরে একপর্যায়ে জিজ্ঞাসাবাদ পর্বের ইতি টানেন। জিজ্ঞাসাবাদের পুরোটা সময় জুড়ে সাদ্দাম নিজেদের ইতিহাস এবং ইরাকে তার অস্তিত্বের গল্প শুনিয়ে গেছেন!

২০০৫ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাদ্দাম হুসাইনের বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। এটা যে শুধুই একটা লোক দেখানো প্রহসনের বিচার হবে তা বাকি সবার মতো সাদ্দামও জানতেন। তার পক্ষে লড়া প্রখ্যাত আইনজীবী নুয়াইমি সবসময় বলতেন, “এই মামলায় আমরা কখনোই সফল হতে পারবো না। বিচারকদের সবাই রাজনীতিবিদ। আর বিচারকাজের চিত্রনাট্য অনেক আগেই লেখা শেষ।” তবে মামলা লড়ে যাওয়া ছাড়া সাদ্দামের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না।

বিচারকার্য চলাকালে সাদ্দাম হুসাইন; Image Source : Die Welt

সাদ্দাম হুসাইনের আইনজীবীদের সব ধরনের চেষ্টার পরও সকল প্রকার বিচারিক কার্যক্রম শেষে ৫ নভেম্বর, ২০০৬ তারিখে বিচারক রউফ সাদ্দাম হুসাইনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার রায় ঘোষণা করেন। রায় পড়া শুরু করা মাত্র সাদ্দাম হুসাইন তার ডান হাত দিয়ে শূন্যে ঘুষি মেরে বজ্রকন্ঠে বলতে থাকেন, ”ইরাকি জনগণ দীর্ঘজীবী হোক। জাতি দীর্ঘজীবী হোক। বিশ্বাসঘাতকের দল নিপাত যাক। অনুপ্রবেশকারীরা নিপাত যাক। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। জনগণ দীর্ঘজিবী হোক। জাতি দীর্ঘজীবী হোক। অনুপ্রবেশকারীর দল ধ্বংস হোক।”

এরপর শুধুই অপেক্ষা, অন্তিম দৃশ্য মঞ্চায়নের জন্য। যেকোনো সময় চলে আসতে পারে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের ঘোষণা। সতর্ক প্রহরায় ছিল আমেরিকান বাহিনী। তবে একচুলও বিচলিত ছিলেন না সাদ্দাম হুসাইন। এ সময় তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন, কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতেন, প্রহরীদের সাথে আড্ডা জমাতেন, পুরাতন দিনের স্মৃতিচারণা করতেন আর সাথে থাকতো তার সবচেয়ে প্রিয় কোহিবা সিগার।

৩০ ডিসেম্বর ফাঁসির দিন ধার্য করা হয়। দিনটি ছিল ঈদুল ফিতরের দিন। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুই উৎসবের মধ্যে একটি।

সাদ্দাম হুসাইন অজু করলেন। বিশ্বমঞ্চে শেষবারের মতো আবির্ভূত হওয়ার আগে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলেন। তার নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত স্পেশাল বারোর সদস্যদের সাথে শেষবারের মতো করমর্দন করলেন। এ সময় সৈন্যদের কয়েকজন লক্ষ্য করলেন যে, তার চোখের কোনে অশ্রু ঝলমল করছে।

ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত। বাগদাদের কাদিমিয়া জেলার ইশতিখ্‌বারাত সামরিক সদর দপ্তরের ভেতরে ঝোলানো হয়েছে ফাঁসির রজ্জু। মোয়াফফাক আল-রুবায়ি ফাঁসির কার্যক্রমের প্রধান দায়িত্ব পালন করছিলেন। একজন বিচারক সাদ্দাম হুসাইনের বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ উচ্চস্বরে তাকে পড়ে শোনান। সাদ্দাম হুসাইনকে এ সময় অত্যন্ত শান্ত এবং নির্ভার লাগছিল।

ফাঁসির মঞ্চে ওঠার প্রথম সিঁড়িতেই তিনি থমকে দাঁড়ান। ফাঁসির রশির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে তিনি রুবায়িকে বলেন, “ডক্টর, এসব তো মানুষের জন্য!” শেষবারের মতো সাদ্দাম নিজের ভয়ডরহীন ব্যক্তিত্বের প্রমাণ দিলেন।

সাদ্দাম হুসাইনের জীবনের শেষ দৃশ্য দেখতে সেখানে উপস্থিত ছিল বেশ কিছু সংখ্যক শিয়া ইরাকি। তবে ভীত সন্ত্রস্ত সাদ্দাম হুসাইনকে দেখার আশায় আসা এসব মানুষকে সাদ্দাম বেশ হতাশই করেন বলতে হয়। তার মধ্যে ভয়ের লেশ মাত্র ছিল না। বরং খুব স্বাভাবিকভাবেই জল্লাদের সব নির্দেশ পালন করছিলেন তিনি।

মাথায় কালো মুখোশ পরতে অস্বীকৃতি জানান সাদ্দাম। মুখোশ পরিহিত জল্লাদদের মধ্যে সাদ্দাম হুসাইনের চেহারা তখন জ্বলজ্বল করছিল। এ সময় একজন জল্লাদ সাদ্দামের গলায় একটি কালো রুমাল পেঁচিয়ে দেন, যাতে ফাঁসি কার্যকরের আগে রশি দ্বারা তিনি কোনো ধরনের ব্যথা না পান।

উন্মত্ত শিয়া জনতা “মোক্তাদা মোক্তাদা” বলে চিৎকার করছিল। সাদ্দাম হুসাইন এ সময় বিদ্রুপ করে তাদের প্রতি বলেন, ”তোমরা কি একে নিজেদের বীরত্ব বলে ভাবছো?”

এ সময় একজন বলে ওঠে, “নরকে যা তুই।” সাদ্দাম হুসাইন ত্বরিত জবাব দিলেন, “বর্তমান ইরাকের মতো নরকে?”

সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা জন ম্যাগুইর বলেছিলেন, “এই সময় উপস্থিত জনতা কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, কারণ সাদ্দাম হুসাইন ছিলেন নির্ভীক। একবারের জন্যও পা কেঁপে ওঠেনি তার।”

কালেমা শাহাদাত পড়ছিলেন সাদ্দাম হুসাইন। মাঝপথেই পায়ের নিচের পাটাতন হঠাৎ সরে যায়। মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে যাওয়ার মতো একটি শব্দ শোনা গেল। এরপর কেটে যায় বেশ কয়েকটি মিনিট। ঝুলে আছে সাদ্দাম হুসাইনের নিথর দেহ। কিছুক্ষণ পর একজন ডাক্তার মৃতদেহের হার্টবিট চেক করলেন। কোনো সাড়া নেই। ফলে মৃত ঘোষণা করা হলো তাকে।

এর মধ্য দিয়েই শেষ হলো সাবেক ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসাইনের ঘটনবহুল জীবনযাত্রার।

This article is in Bangla. This is about Saddam Hussein's defeat and death. Reference book is mentioned below. Other references are hyperlinked inside the article.

তথ্যসূত্র-

১) The Prisoner In His Palace – Will BardenWerper

২) সাদ্দাম হোসাইন: জীবনের শেষ দিনগুলো – উইল বার্ডেনওয়ার্পার; অনুবাদ: মোয়াজ আবরার; প্রকাশনী: নবপ্রকাশ

Featured Image: The independent

Related Articles

Exit mobile version