মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হলোকাস্ট স্মারক জাদুঘরে গিয়ে সেখানকার সহযোগী কিউরেটর সুজি স্নাইডারের সাথে কথা বলে দেখতে পারেন। হলোকাস্টের লক্ষ লক্ষ স্মৃতিচিহ্ন সম্বলিত জাদুঘরটির প্রধান আকর্ষণ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। সুজি আপনাকে ইহুদীদের দেশান্তরিত করতে ব্যবহৃত ট্রেনটির কাছে নিয়ে যাবেন না, দেখাবেন না ডেথ ক্যাম্পে ঢোকানোর আগে ইহুদীদের পা থেকে খুলে রাখা জুতোর হৃদয় বিদারক কালেকশন।
তিনি বরং অমায়িক এক হাসি উপহার দিয়ে আপনাকে নিয়ে যাবেন হাতে বোনা সবুজ এক সোয়েটারের কাছে, যেটি প্রদর্শন পর্যন্ত করা হয়নি। ওয়াশিংটন জাদুঘরের সবচেয়ে স্মৃতিকাতর এই সোয়েটারটির সাথে মিশে আছে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরা এক বাচ্চা মেয়ের গল্প। চলুন তবে কিছুক্ষণের জন্য ফিরে যাওয়া যাক হলোকাস্টের সেই দুর্বিষহ দিনগুলোতে, দেখে নেয়া যাক কী ছিল সোয়েটারটির ভূমিকা।
অনুজ্জ্বল সবুজ বর্ণের সোয়েটারটি কালের স্মৃতিচিহ্ন বহন করতে করতে ক্রমশ মলিন হয়ে উঠেছে। সোয়েটারটি ছিল ক্রিস্টিন কেরেন নামক এক বাচ্চা মেয়ের পরনে। হামাগুড়ি দিয়ে পোল্যান্ডের এলভভ নর্দমা পাড়ি দেয়ার সময় এই জামাটিই ছিল তার সম্বল। চারদিকে ঘিরে থাকা নাৎসিদের চোখ ফাঁকি দিতে কর্দমাক্ত নর্দমাকেই রাস্তা বানাতে বাধ্য হওয়া মানুষগুলো কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল, তা হয়তো আজ ইন্টারনেটে এই লেখাটি পড়তে পড়তে আমরা কল্পনাও করতে পারবো না। তাই তো ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর হলোকাস্ট ডকুমেন্টশনের কিউরেটর সুজির কাছে এই সোয়েটারটি হলোকাস্টে খরচ হয়ে যাওয়া মানব জীবনের এক মর্মস্পর্শী স্বাক্ষর।
১৯৪৩ সালে ক্রিস্টিন শিগারের (যুদ্ধের পর তিনি নাম থেকে কেরেন অংশটি পরিবর্তন করে ফেলেন) বয়স ছিল মাত্র ৭ বছর। পোল্যান্ডের এলভভের নিকটবর্তী এক ইহুদী বসতিতে ছিল তার ঘর। পোল্যান্ডে জার্মানরা আক্রমণ চালানোর আগ দিয়ে ক্রিস্টিনের নানী নিজ হাতে নাতনীর জন্য বুনে দেন সবুজ রঙের একটি সোয়েটার। সোয়েটারটি শুধু এক টুকরো কাপড় নয়, নানীর দেয়া শেষ স্মৃতি। ক্রিস্টিনের কাছে তা বহু মূল্যবান ধন-রত্নের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। দু’বছর আগে হঠাৎ করে একদিন এক ট্রাক এসে তুলে নিয়ে যায় নানীকে, ছোট্ট ক্রিস্টিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে তার চোখের সামনে দিয়ে নানীকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একদল সৈনিক। খুব সম্ভবত পার্শ্ববর্তী বেলজেক ডেথ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।
নাতনীর দিকে ফিরে শেষবারের মতো হাত নেড়ে বিদায় জানাতে ঘুরে দাঁড়ায় নানী। সাথে সাথে তার মাথায় রাইফেলের বাট দিয়ে সজোরে আঘাত করে নাৎসি এক প্রহরী। দুঃস্বপ্নের মতো দিনরাত সেই স্মৃতি তাড়া করে ফিরত ক্রিস্টিনকে। তার বাবা-মা চাকরি করতো কাছের এক লেবার ক্যাম্পে। দিনের বেলা ছোট ভাইটিকে নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকতো সে, যাতে কোনো ট্রাক এসে নানীর মতো তাদেরও ধরে নিয়ে যেতে না পারে। একদিন জোর করে নাৎসিরা তাদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে পড়লে ছোট ভাইকে স্যুটকেসে ভরে মায়ের জামা-কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখে ক্রিস্টিন, নিজেও গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে থাকে তার পিছনে।
এরপর আসে ১৯৪৩ সালের বীভৎস সেই দিনগুলো। নাৎসিরা সিদ্ধান্ত নেয় ইহুদীদের যাবতীয় আস্তানা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে তাদের সমূলে ধ্বংস করে দেবে। ডেথ ক্যাম্পের বিভীষিকার হাত থেকে বাঁচতে ক্রিস্টিন ও তার পরিবার আক্ষরিক অর্থেই আন্ডারগ্রাউন্ডে আশ্রয় নেয়। এক পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে ঘুষ দিয়ে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভ্যন্তরে একটি ছোট টানেল নির্মাণ করিয়ে সেখানে পালিয়ে যায় একদল ইহুদী পরিবার। ২০০৭ সালে হিস্ট্রিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সে দিনগুলোর কথা মনে করে শিউরে ওঠেন ক্রিস্টিন, “ভয়ংকর এক পরিস্থিতিতে ছিলাম আমরা। মনে হচ্ছিল নরকে পৌঁছে গেছি”।
মাটির নিচে থেকে শুনতে পাচ্ছেন উপরে খেলছে বাচ্চারা। অথচ খোলা বাতাসে দু’দণ্ড বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার অনুমতিও ছিল না তাদের। দিনের আলো কতদিন যে চোখে দেখেননি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। জলাবদ্ধ সেই দুর্গন্ধময় জায়গায় অবর্ণনীয় আতঙ্কে দিন কাটাতো পরিবারগুলো। বৃষ্টি হলে পানি এমনভাবে বিপদসীমা অতিক্রম করে তাদের দিকে ধেয়ে আসত যে, একেকবার মনে হতো আজই হয়তো সব শেষ হয়ে যাবে। চারদিকে পানির কলকল ধ্বনি, ইঁদুরের কাছ থেকে খাবার বাঁচানোর লড়াই; ডায়রিয়া, হাম সহ নানাবিধ অসুখ- সব মিলিয়ে নারকীয় যন্ত্রণা ভোগ করার আর কিছুই বাকি ছিল না তাদের।
সময় কাটানোর জন্য ঐ পরিস্থিতিতেও ক্রিস্টিনের বাবা তাকে পড়তে শেখানোর উদ্যোগ নেন, মা তাদের মনোবল অটুট রাখতে সার্বক্ষণিক চেষ্টা চালিয়ে যান। পোলিশ কিছু বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় শহরের একমাত্র পত্রিকা ‘লিওপোল্ড সোচা’র মাধ্যমে বহির্বিশ্বের খোঁজ রাখছিল ইহুদীরা। ঐ বয়সেই বিষণ্নতার সাথে যুঝতে হয় ক্রিস্টিনকে। চোখের সামনে বাস্তবতার কাছে হার মেনে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়া প্রতিবেশীদের দেখে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে ৭ বছর বয়সী মেয়েটি। এই নরকের চেয়ে নাৎসিদের বন্দুকের গুলিকে শ্রেয় মনে করে কেউ কেউ পালিয়ে যায় নর্দমার অভ্যন্তরীণ আশ্রয় থেকে। বাকিরা এখানেই কাটিয়ে দেয় প্রায় ১৪ মাস। ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে রাশিয়া এসে এলভভকে মুক্ত করার পরেই বের হয় ইহুদী পরিবারগুলো।
নর্দমা পেরিয়ে ক্রিস্টিন যখন বহুদিন পর বাইরের দুনিয়ার মুখোমুখি হলো, তখন সে অপুষ্টিতে ভুগতে থাকা অসুস্থ এক বাচ্চা। অন্ধকারে থাকতে থাকতে প্রখর সূর্যের আলোয় কোনোমতেই মানিয়ে নিতে পারছিল না অনভ্যস্ত চোখ। আট বছরের বাচ্চাটি কিন্তু তখনো এক হাতে আঁকড়ে ধরে রেখেছে প্রিয় সবুজ সোয়েটারটি। বন্দীত্বের দিনগুলোতে এই সোয়েটারটিই তাকে সাহস জুগিয়েছে বেঁচে থাকার। অনুপ্রেরণা দিয়েছে নানীর মতো বড় হওয়ার। আশান্বিত করেছে বাইরের ঐ বাচ্চাদের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করার।
“বেঁচে ফিরলাম আমি, সাথে ফিরল আমার সোয়েটারটাও”, স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন ক্রিস্টিন। “সোয়েটারটি আমি সযত্নে লালন করছি, যেমনটা একসময় সে করেছে আমাকে”। যুদ্ধের পর ইজরায়েলে চলে আসেন ক্রিস্টিন, বিয়ে করেন, দন্ত চিকিৎসক হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে দেশান্তরিত হন যুক্তরাষ্ট্রে। এখানেই নামের শেষে কেরেন যুক্ত করেন তিনি। এই পুরোটা সময় একদিনের জন্যও কাছ ছাড়া করেননি সোয়েটারটি, প্রতিদিন সোয়েটারটির দিকে তাকিয়ে নতুন করে এগিয়ে চলার উদ্যম খুঁজে পেয়েছেন।
২০০৪ সালে তিনি সিদ্ধান্ত নেন শীতবস্ত্রটি জাদুঘরে দান করে দেবেন। জাদুঘরের স্থায়ী কালেকশনের অংশ হওয়ার আগেই বেশ কয়েকটি দেশ ঘুরে আসা সোয়েটারটি আজও বাকি সব স্মারকচিহ্নের মতো প্রদর্শিত হচ্ছে না। বরং ব্যক্তিগত আগ্রহের ভিত্তিতেই তা দেখানো হয় কতিপয় উৎসুক দর্শনার্থীদের। জনপ্রিয় এই বস্তুটি দেখতে প্রতিদিন জড়ো হয় অসংখ্য দর্শনার্থী। ২০০৮ সালে তার এই মর্মস্পর্শী কাহিনী নিয়ে ‘দ্য গার্ল ইন দ্য গ্রিন সোয়েটার’ নামে আত্মজীবনীমূলক বই লেখেন ক্রিস্টিন। এর আগে একই গল্প নিয়ে নির্মিত ‘ইন ডার্কনেস’ নামক সিনেমাটি ১৯৯১ সালে সেরা বিদেশি ভাষার ছবি ক্যাটাগরিতে অস্কারের জন্য মনোনীত হয়।
“হলোকাস্টে প্রাণ বিসর্জন দেয়া নানীর সাথে নাতনীকে সংযুক্ত করেছে এই এক টুকরো কাপড়”, বলেন সুজি। যুদ্ধ পূর্ববর্তী, যুদ্ধ চলাকালীন এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের লাখ লাখ সামগ্রী সংগ্রহ করে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। “শুরুতে সোয়েটারটি দিতে চাননি ক্রিস্টিন, কিন্তু এই জাদুঘরে জামাটি কত গুরুত্ব বহন করবে তা অনুধাবন করে নিজেই রাজি হয়ে যান। ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্মৃতিচিহ্নবাহী সোয়েটারটি আমাকে নাড়া দিয়ে গেছে”, জানান সুজি।
সুজি আর তার দল সারা দেশব্যাপী ঘুরে ঘুরে হলোকাস্টের স্মৃতিচিহ্নবাহী বিভিন্ন সামগ্রী খুঁজে বের করছেন। অনেকে আবার ইবে বা অন্যান্য অনলাইন সেলস সার্ভিসে স্বপ্রণোদিত হয়ে হলোকাস্টের স্মারকচিহ্ন দান করছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আশ্চর্যজনক হারে এসব স্মৃতিচিহ্ন দান করার প্রবণতা বেড়েছে বলে জানান সুজি। ২০১৪ সালে সোয়েটারটি সত্যিই হলোকাস্ট সময়কার কি না তা পরীক্ষা করতে আসেন লিয়া স্টার্ন নামক এক বিশেষজ্ঞ। তার উদ্যোগে সোয়েটারটির একটি রেপ্লিকা তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এই সোয়েটারটি খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং তা বিক্রি করে অর্জিত অর্থ জাদুঘরে দান করা হয়। সুজির মতে, “যুদ্ধ পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়কার যত বেশি তথ্যপ্রমাণ আমাদের হাতে আসবে, তত সহজে আমরা প্রমাণ করতে পারবো ইহুদীদের প্রতি যে অবিচার চালানো হয়েছিল তা একেবারেই অন্যায্য ছিল”।
ফিচার ইমেজ- history.com