মরুর রুক্ষ পরিবেশে সম্রাট চিন্তিত কীভাবে তার হৃত রাজ্য উদ্ধার করবেন। সৈন্যসামন্ত জোগাড় করে পুনরায় যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। এমনি এক সময়ে স্ত্রী হামিদা বানুর কোলজুড়ে এলো এক পুত্র সন্তান। ভবিষ্যতের মোঘল সম্রাট আকবর। সদ্যোজাত শিশু সন্তানকে প্রতিপালনের জন্য ধাত্রীদের ডাকা হয়। ইতিহাসে আকবরের জন্য দশজন ধাত্রী নিয়োগের কথা জানা যায়। এদের মধ্যে প্রধান ভূমিকা পালন করেন মাহম আনগা।
মাহম আনগা; ‘আনগা’ শব্দটি তুর্কি, যার অর্থ স্নেহময়ী ধাত্রী। যিনি মায়ের স্নেহ দিয়ে অন্যের সন্তানকে লালন করেন। মাহম মায়ের স্নেহ দিয়ে বড় করে তুলেছিলেন আকবরকে। বুদ্ধিমতী আর শিক্ষিত হিসেবে তুরস্কের মেয়ে মাহমের খুব নাম ছিল।
১৫৫৬ সালে সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর মাত্র ১৩ বছর বয়সে আকবর দিল্লির সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। তার কিছু সময় পূর্বে মাহম আনগাকে আকবরের প্রধান ধাত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ছোটবেলায় আকবর পড়াশোনার তেমন সুযোগ পাননি। কিন্তু নানা বিষয়ে জানার তার ইচ্ছে ছিল প্রবল। যুদ্ধবিদ্যা এবং দিল্লির সিংহাসন পরিচালনার জন্য আর্থিক এবং প্রশাসনিক নানা বিষয়ে জ্ঞানার্জনে তিনি নিজেকে সবসময় ব্যস্ত রাখতেন। এর বাইরে নানা বিষয়ে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে মাহম আনগাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
আকবর তার দৈনন্দিন কাজ থেকে একটু অবসর পেলেই মাহম আনগা আকবরকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন। বিভিন্ন সাহিত্য থেকে পাঠ করে শোনাতেন। আকবর একনিষ্ঠ ছাত্র হিসেবে সেসব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। মাহম আনগার মুখে শোনা অনেক কবিতা, গল্প, সঙ্গীত আকবর শিখে নিয়েছিলেন। শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত প্রভৃতি বিষয়ে সম্রাট আকবের অনুরাগের বিষয়ে তার এ ধাত্রী মায়ের অবদানের কথা অনেক ঐতিহাসিকেই স্বীকার করে থাকেন।
হুমায়ুন যখন রাজ্যহারা হয়ে সিন্ধু রাজ্যে অবস্থান করছিলেন তখন তার এই দুঃসময়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন মুঘল সৈনিক নাদিম খান। তিনি বাদশাহকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন যেন কোনো শত্রু বাদশাহর কাছে ঘেঁষতে না পারে। মাহম আনগাকেও হুমায়ুন খুব স্নেহ করতেন। এ কারণে হুমায়ুন যখন তার রাজ্য পুনরায় ফিরে পেলেন এর কিছুদিন পরই সৈনিক নাদিম খানের সাথে মাহম আনগার বিয়ের বন্দোবস্ত করেন সম্রাট। মাহম আনগা জন্ম দেন এক পুত্র সন্তানের। তার নাম রাখা হয় আদম খান।
হুমায়ুনের মৃত্যুর পর দিল্লির সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন সম্রাটের ১৩ বছরের নাবালক ছেলে আকবর। নাবালক হওয়ায় আকবরের হয়ে রাজ্যের প্রশাসন ও আর্থিক পরিচালনার ভার পড়ে মোঘল সাম্রাজ্যের সেনাপতি বৈরাম খানের ওপর। এই সময় মাহম আনগাকে মুঘল দরবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য করা হয়। বালক আকবর মাহম আনগাকে ভালবাসতেন এবং তাকে সম্মান করতেন। এই সুযোগে মাহম আনগা সম্রাটের সাথে রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন এবং নানাভাবে তাকে পরামর্শ দিতে চাইতেন। সম্রাট আকবর নিজের ভাইয়ের মতোই স্নেহ করতেন মাহম আনগার সন্তান আদম খানকে।
এদিকে সময় বহমান নদীর মতো বয়ে চলে। আদম বড় হয়ে ওঠেন। সমরবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন তিনি। মুঘল সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে ধীরে ধীরে উত্থান ঘটতে থাকে তার। খুব অল্প সময়ে সেনাবাহনীর এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সম্রাট আকবর তাকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করেন। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দমন এবং রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে আদম খানের ওপর যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়।
মাহম আনগা ও তার সন্তান আদম খান ধীরে ধীরে মুঘল সাম্রাজ্যের ক্ষমতার বলয়ে চলে আসতে থাকেন। কথিত রয়েছে, বৈরাম খাঁকে মুঘল সাম্রাজ্য থেকে বিতাড়িত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন মাহম আনগা ও তার ছেলে আদম খান। আদম খানের প্ররোচনায় আকবর বৈরাম খাঁকে হজ্ব করার উদ্দেশ্যে মক্কায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাদের এই প্রস্তাবে মাহম আনগা খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না।
ক্ষমতা নিষ্কন্টক করার জন্য তিনি চাইছিলেন বৈরাম খাঁকে রাজ্য থেকে স্থায়ীভাবে বিতাড়িত করা হোক। পরবর্তীতে বৈরাম খাঁ আফগান সীমান্তে নিহত হন। এই ঘটনায় কে বা কারা জড়িত ছিল ইতিহাসে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য না পেলেও এর ফলে যে মুঘল সাম্রাজ্যের ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে মাহম আনগা আর তার একমাত্র সন্তান আদম খান পুরোপুরি চলে আসেন, তা বলাই বাহুল্য।
সময়ের গতি প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে মাহম আনগা ও আদম খানের চরিত্রের মধ্যে পরিবর্তন দেখা দিতে থাকে। ক্ষমতার কেন্দ্রে দীর্ঘদিন থাকার ফলে তাদের মধ্যে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহনের ইচ্ছে দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাদের এই ইচ্ছেকে আরো জাগিয়ে তুলতে থাকে পীর মোহাম্মদ শিরওয়ানী নামের এক অভিজাত ব্যবসায়ী। এ সময় সম্রাটের নানা প্রশাসনিক কাজে মাহম আনগা ও আদম খান নিয়মিত হস্তক্ষেপ করতে থাকেন।
ফলে সম্রাট আকবর ক্রমে অসহিষ্ণু হয়ে পড়েন মাহম আনগা ও আদম খানের উপর। এ অবস্থায় আকবর ১৫৬১ সালে শামসুদ্দিন আতগা খানকে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। এতে মাহম আনগা ও তার সন্তান সম্রাটের ওপর প্রবল ক্ষুব্ধ হন। এর মধ্যে আদম খান সব সীমা অতিক্রম করে ফেলেন। ১৫৬২ সালের ১৬ মে শামসুদ্দিন আতগা খানকে তার কর্মক্ষেত্রেই নির্মমভাবে হত্যা করেন।
ক্রমেই সিংহাসনের লোভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো মা ও ছেলের। তারা সুযোগ খুঁজতে লাগলেন কীভাবে আকবরকে হত্যা করা যায়। সম্রাটকে সরাতে পারলেই মাহম আনগা ও তার ছেলে আদম খানের হাতেই চলে আসবে সমগ্র ভারতবর্ষ।
এদিকে মালওয়া রাজ্যের সাথে মুঘল সাম্রাজ্যের বিরোধ দেখা দিল। মালওয়া রাজ্য অধিকারে আনার জন্য সম্রাট আকবর যুদ্ধে পাঠালেন আদম খানকে। মালওয়া রাজ্য বিজয়ের পর আদম খান মালওয়া রাজ্যের মানুষের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালান। এমনকি রাজ অন্তপুরের মেয়েরাও এই অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি।
এই ঘটনায় সম্রাট খুবই ক্ষুব্ধ হন আদম খানের উপর। কিন্তু মাহম আনগার সন্তান হিসেবে শুধু তিরস্কার করেই আদম খানকে মুক্তি দেন সম্রাট। কিন্তু আদম খান তখন ক্ষমতার নেশায় মত্ত।
দিল্লির সিংহাসন দখলের আশায় তিনি তখন অন্ধ। এমনকি মায়ের কোনো কথাও তিনি আর শুনতে রাজি নন। একদিন এক গভীর রাতে মুঘল মহলের সকলে যখন ঘুমে অচেতন, তখন সুযোগ বুঝে আদম ঢুকে পড়েন আকবরের কক্ষে। আকবর ঘুমিয়ে আছেন ভেবে তার ওপর খোলা তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন আদম। মুহূর্তে আকবর সরিয়ে ফেলেন নিজেকে। ত্বরিতে আদম খানকে নিরস্ত্র করে ফেলেন সম্রাট। মুহূর্তের মধ্যে সাড়া পড়ে যায় মুঘল মহলে। রক্ষীরা এসে ঘিরে ফেলে আদম খানকে। ক্রোধে ফেটে পড়া বাদশাহ আকবর আদমকে দুর্গের উপর থেকে নিক্ষেপ করতে নির্দেশ দেন। নির্দেশ পালনে খুব একটা দেরি হয় না। মৃত্যু হয় ক্ষমতালোভী আদমের।
এই মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি মাহম আনগা। সন্তান হারিয়ে প্রায় নির্বাক হয়ে পড়েন তিনি। ধীরে ধীরে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দেন। অনেক গুণের অধিকারী হয়েও শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে একজন ধাত্রী মা মাহম আনগা কলঙ্কের অভিযোগ নিয়ে হারিয়ে গেলেন মুঘল ইতিহাস থেকে। তবে আকবর তার ধাত্রী মায়ের অবদানের কথা ভুলে যাননি। মাহম আনগা আর তার সন্তান আদম খানের সমাধির ওপর তৈরি করেন এক স্মৃতিস্তম্ভ।
ফিচার ইমেজ- safetydiversified.gq