পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে, সে রাজতান্ত্রিকই হোক কী গণতান্ত্রিক, শাসকের বিরুদ্ধে সংঘটিত ষড়যন্ত্রের নজির খুব কম নেই। শাসক, তিনি যত বিপুল ক্ষমতার অধিকারীই হোন না কেন, মসনদে বসামাত্রই তাঁকে সর্বদা সজাগ থাকতে হয়েছে নিজস্ব নিরাপত্তার বিষয়টিতে। একে তো উচ্চস্তরের রাজনীতিতে বিরোধিতার অভাব হয় না, তার উপর আবার সেই শাসক বা নেতার পূর্ব ইতিহাসেই যদি থেকে থাকে চূড়ান্ত বিরোধী-বিদ্বেষ, তবে তাঁর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতে গিয়ে রাতের ঘুম উড়ে যাওয়ার যোগাড় হয় তাঁর পারিষদবর্গের। নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যেও তাঁদের সর্বক্ষণের অন্যতম ভাবনা হয়ে দাঁড়ায়, কীভাবে একশো শতাংশ নিশ্ছিদ্র সুরক্ষাবলয় তৈরি করা যায়। বাইরের শত্রুর থেকেও ঘরের মধ্যেকার শত্রুদের প্রতিহত করতে বিভিন্ন সময়ে নানা পন্থা নিয়েছেন তাঁরা। এই পন্থার অন্যতম হলো, খোদ শাসকের খাবার পরীক্ষা করার জন্য পৃথক বাহিনী মোতায়েন। রোমান সম্রাট ক্লডিয়াসের খাবার পরীক্ষা করে দেখতেন পাচকশালার মুখ্য গোমস্তা, যার নাম ছিল হ্যালোটাস। কিন্তু তা সত্ত্বেও ষাটোর্ধ্ব সম্রাটের মৃত্যু ঘটেছিল খাবারে বিষপ্রয়োগের কারণেই। আধুনিক সময়েও এই ধরনের খাদ্যদ্রব্য পরীক্ষক বহাল করার পরম্পরা বজায় রেখেছেন রাষ্ট্রনেতাগণ। উদাহরণ হিসেবে রাশিয়ার বর্তমান রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সদ্যপ্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
সর্বময় রাজনৈতিক নেতা- এই তিনটি শব্দ একসাথে উচ্চারণ করলে প্রথমেই আমাদের মনে যে নামটি আসবে, তিনি আর কেউ নন, জার্মানির অ্যাডলফ হিটলার। একজন সাধারণ সৈনিক থেকে নিজ প্রতিভাবলে দেশের একচ্ছত্র নেতা হয়ে ওঠা এবং পরবর্তীকালে তাঁর নারকীয় কর্মকাণ্ডের কথা ইতিহাসপ্রেমী মানুষ মাত্রেই জানেন। হিটলারের এই উত্থান দেখে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে যায়। তাদের সাম্রাজ্যে কখনও সূর্য অস্ত যেত না বলে যে গর্ব ছিল ইংরেজের, পৃথিবীব্যাপী সেই সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে তাদের অহমিকায় তুমুল আঘাত হেনেছিল ফ্যাসিবাদী শক্তির এই উত্থান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে। জার্মানি-ইতালির ফ্যাসিবাদী জোটের প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড-ফরাসি জোট ও তাদের অধীনস্থ উপনিবেশগুলো। পোল্যান্ড দখলের পর পূর্ব প্রাশিয়ার গ্রস-পার্তস শহরের কাছে মাসুরিয়ার জঙ্গলে তৈরি হয়েছিল হিটলারের সামরিক সদর দপ্তর। নাম দেওয়া হয় ‘উল্ফ’স লেয়ার’। ‘উল্ফ’ নামটি হিটলার নিজেই নিজেকে দিয়েছিলেন। অ্যাডলফ নামের অর্থ ‘নোবেল উল্ফ’। জঙ্গলে অবস্থিত দপ্তরটি ছিল জার্মান-অধিকৃত পূর্ব সীমান্তে হিটলারের প্রথম সামরিক দপ্তর।
উল্ফ’স লেয়ারে হিটলার আসেন ১৯৪১ সালের ২৩শে জুন, ‘অপারেশন বারবারোসা’ সূচনার একদিন পরেই। প্রায় সাড়ে তিন বছর এটি তাঁর প্রধান সদর দপ্তর ছিল। বিশ্বযুদ্ধের অন্তিমলগ্নে ১৯৪৪ সালের ২০শে নভেম্বরে এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে অবধি তিনি এই দপ্তরে ৮০০ দিনেরও বেশি সময় থেকেছিলেন। যতই নিজেকে অপরাজেয় ভাবুন, মৃত্যুভয় তাঁর বিলক্ষণ ছিল। বিশেষত, তাঁর খাবারে বিষ মিশিয়ে তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা কষছে শত্রু ব্রিটেন, এই আতঙ্ক তাঁকে প্রবলভাবে গ্রাস করেছিল। সেই সম্ভাব্য ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে উল্ফ’স লেয়ারে থাকাকালীন তাঁর খাবার পরীক্ষা করার জন্য ১৫ জন মহিলাকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল বিশেষ বাহিনী, যে বাহিনীর প্রধান সদস্যা ছিলেন জার্মান তরুণী মার্গট ওয়ল্ক।
মার্গটের জন্ম বার্লিনে। তারিখ ২৭শে ডিসেম্বর, ১৯১৭। বার্লিনের উইল্মার্সডর্ফ জেলার শ্মার্গেনডর্ফ গ্রামের একটি ফ্ল্যাটে বাবা-মায়ের সাথে থাকতেন ছোট্ট মার্গট। হিটলারের ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টি যখন ক্ষমতাদখল করল, সেসময় দেশের বেশিরভাগ মানুষই হিটলারের নেতৃত্বদানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নাৎসি দলে যোগদান করেন। কিন্তু মার্গটের পরিবার সে পথে হাঁটেনি। তাঁর বাবা নাৎসি দলে যোগদানকে পাপ বলে মনে করতেন। মার্গট নিজেও ‘হিটলার ইয়ুথে’র (নাৎসি পার্টির যুবদল) নারীবাহিনী ‘লিগ অফ জার্মান গার্লস’-এ যোগ দিতে অস্বীকার করেন। পড়াশোনা শেষ করে মার্গট একটি অফিসে সেক্রেটারির কাজ নেন ও তারপর কার্ল ওয়ল্ক নামে এক প্রাশিয়ানকে বিয়ে করেন। বিয়ের কিছুদিন পরেই কার্ল যুদ্ধে চলে যান।
১৯৪১-এর শীতে মিত্রশক্তি বার্লিনে বোমাবর্ষণ করে। মার্গটের পরিবার যে ফ্ল্যাটটিতে থাকত সেটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মার্গটের মতে, প্রায় এক হাঁটু জল উঠে এসেছিল বাড়িতে। কার্লের মা মারিয়ার অনুরোধে পূর্ব প্রাশিয়ার রাস্তেনবার্গ প্রদেশের গ্রস-পার্তজে ওয়ল্কদের পারিবারিক এস্টেটে চলে আসেন মার্গট ও তাঁর বাবা-মা। রাস্তেনবার্গের বর্তমান নাম কেরজিন, এটি এখন পোল্যান্ডে। গ্রস-পার্তজের বর্তমান পার্জ। যুদ্ধের বয়স ততদিনে দু’বছর অতিক্রান্ত। কিন্তু কার্লের কোনো খোঁজ নেই। মার্গট ধরেই নিয়েছিলেন, তাঁর স্বামী আর বেঁচে নেই।
এই গ্রস-পার্তজে এসেই তাঁর জীবন ঘুরে যায় সম্পূর্ণ অন্য দিকে। কার্লদের পারিবারিক বাড়ি থেকে মাত্র দু’মাইল দূরেই ছিল উল্ফ’স লেয়ারের দুর্ভেদ্য দুর্গ। গ্রামের মেয়র ছিলেন একজন নাৎসি। গ্রস-পার্তজে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই এসএস বাহিনী (নাৎসি দলের প্যারামিলিটারি বাহিনী শ্যুৎস্তাফেল) ওয়ল্কদের বাড়িতে এসে কড়া নাড়ে এবং মার্গটকে তাদের সাথে আসতে বলে। মনেপ্রাণে নাৎসিবিরোধী হলেও তাদের আদেশ অমান্য করে জীবনের ঝুঁকি নিতে পারেননি মার্গট। মার্গটসহ আরও কয়েকজন মহিলাকে এসএস বাহিনী নিয়ে আসে ক্রসেনডর্ফ গ্রামে। এখানে একটি দোতলা বাড়িতে উল্ফ’স লেয়ারের বাসিন্দাদের জন্য রান্না করা হতো। মার্গটসহ পনেরোজন মহিলাকে নিয়োগ করা হয় খোদ অ্যাডলফ হিটলারের জন্য প্রস্তুত করা খাবার চেখে দেখার কাজে।
হিটলার নিরামিশাষী ছিলেন বলে কখনও মাছ বা মাংস তাঁদের চাখতে দেওয়া হতো না। ফ্যুয়েরারের অভ্যাস ছিল একটি থালাতেই সমস্ত কিছু মেখে খাওয়ার। সেই ব্যাপারটি মাথায় রেখে পনেরোজন অসহায় মহিলাকেও অনুরূপ পদ্ধতিতে খাবার পরিবেশন করা হতো। প্রত্যেক মহিলা খাবার চেখে দেখতেন। সকলের চাখা হয়ে গেলে একঘণ্টা অপেক্ষা করা হতো। এই একঘণ্টার মধ্যে তাঁদের কোনোরকম অসুস্থতা দেখা দিচ্ছে কি না, সেই বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতেন নিরাপত্তারক্ষীরা। এবং তারপরেই সেই খাবার চলে যেত স্বয়ং ফ্যুয়েরারের কাছে।
তখন ইউরোপ জুড়ে সর্বগ্রাসী মহাযুদ্ধ চলছে। জার্মানিতে দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য সংকট। সাধারণ মানুষের পক্ষে সামান্য কফি পানও তখন বিলাসিতা। সেই পরিস্থিতিতে মার্গটদের ভাগ্যে তখন তিনবেলা জুটছে অ্যাস্পারাগাস স্যুপ, থালাভর্তি সুস্বাদু শাকসবজির তরকারি, নুডলস, সাথে গরম ভাত অথবা পাস্তা, সুমিষ্ট ফলও। সসে ডোবানো অ্যাস্পারাগাস বা অ্যাস্পারাগাস স্যুপ জার্মানদের অতিপ্রিয় খাবার। কিন্তু এই সুখের আড়ালে মরণভোমরার মতো লুকিয়ে রয়েছে মৃত্যুভয়। যুদ্ধের সংকটকালে সুস্বাদু খাবারের আস্বাদ গ্রহণের ভাগ্যকে যেন প্রতিনিয়ত দুর্ভাগ্য বলে মনে করতেন মার্গটরা। মার্গট শেষজীবনে বিভিন্ন সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই অসহনীয় অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন,
বেশিরভাগ মেয়েরাই খাবার খেতে গিয়ে ভয়ে কেঁদে ফেলত। খাবারে বিষ মেশানোর গুজবের সম্পর্কে আমরা সকলেই জানতাম আর তাই প্রতিনিয়ত, ভয় গ্রাস করত আমাদের। খাবার খেয়ে কোনোরকম তৃপ্তি হওয়া তো দূরের কথা, যতবারই খাবার মুখে তুলতাম, মনে হতো এই বুঝি শেষ খাওয়া হয়ে গেল। প্রতিদিন খাওয়ার শেষে যখন মেয়েরা দেখত কিছু খারাপ প্রভাব পড়েনি, আমরা সকলে জন্তুর মতো কেঁদে উঠতাম।
প্রতিদিন সকাল আটটায় এসএস অফিসার এসে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যেতেন মার্গটকে। যদিও উল্ফ’স লেয়ারে ফ্যুয়েরার সশরীরে উপস্থিত থাকলেই একমাত্র খাবার পরীক্ষা করতে হতো তাঁদের, তা-ও রোজ অফিসে হাজিরা দেওয়া ছিল অবশ্যকর্তব্য। খাবার চেখে দেখা ছাড়াও মার্গট আরও একটি কাজ করতেন। খাবারের বাজেট ও হিসেব বজায় রাখার কাজে উল্ফ’স লেয়ারের ক্যাশিয়ার এসিগকে সাহায্য করতেন। মাসিক বেতন ছিল তিনশো রাইখস মার্ক। যুদ্ধের সময়ে নেহাত কম অর্থ নয়। কিন্তু রোজকার মৃত্যুভয় নিয়ে কাজ করার যন্ত্রণার কাছে সে টাকা কিছুই ছিল না। সবসুদ্ধ আড়াই বছর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হিটলারের জন্য কাজ করেছিলেন মার্গটরা। বা, বলা ভালো, জীবনের ঝুঁকি নিতে একপ্রকার বাধ্য করা হয়েছিল তাঁদের। কিন্তু এই আড়াই বছরে যে মানুষটির জীবন রক্ষা করতে নিজেদের জীবন বাজি রেখে কাজ করে গেলেন তাঁরা, সেই অ্যাডলফ হিটলারকে কিন্তু তাঁরা সামনাসামনি কখনও দেখেননি। দেখেছেন তাঁর ব্যক্তিগত সচিবদের, হিটলারের প্রিয় জার্মান শেফার্ড ব্লন্ডিকে রোজই অফিসের বাগানে খেলতে দেখতেন, কিন্তু ফ্যুয়েরার-দর্শন তাঁদের কপালে জোটেনি।
সবকিছু দিব্যি যথানিয়মে চলছিল। প্রতিদিন সকালে খাবারের টেবিলে হাজিরা দেওয়া, প্রাণ হাতে নিয়ে তিনবেলা খাবার চাখা, তারপর একঘণ্টা কাটলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার নিয়মিত জীবন। পরিস্থিতি বদলাল ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে। ততদিনে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতির সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। মিত্রশক্তি এগিয়ে আসছে দ্রুত। পূর্বদিক থেকে সোভিয়েতের রেড আর্মি আর পশ্চিমদিক থেকে ইঙ্গ-মার্কিন যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে জার্মানি কোণঠাসা। ততদিনে হয়ে গিয়েছে ঐতিহাসিক নর্ম্যান্ডি ইনভেশন। এই সময় হিটলারের নিজ দুর্গেই ঘটে গেল এক হাড়হিম করা ঘটনা। এতদিন যে ষড়যন্ত্রের ভয়ে এত নিশ্ছিদ্র সুরক্ষাবলয়ের আয়োজন, সেই ষড়যন্ত্রের ঘটনা অবশেষে ঘটল, এবং তার মূলে ব্রিটেন বা সোভিয়েত নয়, কয়েকজন উচ্চপদস্থ নাৎসি সমরনায়কই। আর ষড়যন্ত্রটি খাবারে বিষ মেশানোর মতো প্রাচীনপন্থী নয়, একেবারে বোমা বিস্ফোরণের মতো দুঃসাহসী পদক্ষেপ।
২০শে জুলাই উল্ফ’স লেয়ারে একটি সভাকক্ষে হিটলারের পায়ের কাছেই রাখা হয়েছিল একটি ব্রিফকেস বম্ব। উদ্দেশ্য, হিটলারকে সরানো ও নাৎসি সরকারকে ছুঁড়ে ফেলে মিত্রশক্তির সাথে সমঝোতায় আসা। এই চক্রান্ত ইতিহাসে ‘২০ জুলাই ষড়যন্ত্র’ নামে পরিচিত। মূল চক্রান্তকারীরা ছিলেন কর্নেল ক্লাউস ভন স্তফেনবার্গ, মেজর জেনারেল হেনিং ভন ত্রেস্কো, ফিল্ড মার্শাল আরউইন ভন উইৎজলেবেন, লিগেশান কাউন্সিলর অ্যাডাম ভন ট্রট জু সুলজ (মহানিষ্ক্রমণের পর সুভাষচন্দ্র বোস যখন জার্মানিতে ছিলেন, তখন তাঁর বিশেষ সহযোগী ছিলেন এই অ্যাডাম) প্রমুখ। এমনকি সুচারু রণনীতির জন্য স্বদেশে জনপ্রিয় ও শত্রুপক্ষেও সমান শ্রদ্ধেয় নাৎসি সর্বাধিনায়ক ফিল্ড মার্শাল আরউইন রমেলও এই চক্রান্তে জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়। এই মিশনের নাম তাঁরা দিয়েছিলেন ‘অপারেশন ভ্যাল্কাইরি’, যে ঘটনা নিয়ে পরবর্তীকালে হলিউডে বানানো হয়েছে ‘ভ্যাল্কাইরি’ ছবি, যে ছবিতে ক্লাউস স্তফেনবার্গের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন টম ক্রুজ।
২০শে জুলাইয়ের চক্রান্ত সফল হয়নি। ক্লাউস স্তফেনবার্গ নির্দিষ্ট জায়গায় ব্যাগটি রেখে পূর্ব-পরিকল্পনা মাফিক কিছুক্ষণ ফোনে কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। হিটলারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন কর্নেল হেইনজ ব্রান্ট। যে ম্যাপ টেবিলের উপর ম্যাপ রেখে হিটলার ও তাঁর আধিকারিকরা সোভিয়েতের আক্রমণ সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন, সেই টেবিলের একটি পায়ার কাছে রাখা ছিল ব্যাগটি। নিজের অজান্তেই ব্রান্ট ব্যাগটি পা দিয়ে সরিয়ে দেন। ফলে হিটলারের থেকে ব্যাগটি সরে যায় বেশ কিছুটা দূরে। বিস্ফোরণে হিটলার প্রাণে বাঁচলেও ব্রান্ট একটি পা হারান এবং পরদিন তাঁর মৃত্যু হয়। ঘটনার সময় তাঁরা পনেরোজন উল্ফ’স লেয়ারের চত্বরেই ছিলেন। কয়েকজন সেনা অফিসারের সাথে তাঁরা একটি তাঁবুতে বসে সিনেমা দেখছিলেন। হঠাৎ শোনেন তীব্র বিস্ফোরণের শব্দ। মার্গটের কথায়,
বিস্ফোরণের শব্দে আমাদের কাঠের বেঞ্চগুলো যেন কেঁপে উঠল। আমরা ছিটকে পড়লাম মাটিতে। আমি শুনলাম, কেউ যেন চিৎকার করে বলল-‘হিটলার মৃত।’ কিন্তু আসলে তো তা ঘটেনি। সামান্য কয়েকটা আঘাত ছাড়া তাঁর কিছুই হয়নি।
এই ঘটনার পরপরই আরও আঁটসাঁট করা হয় উল্ফ’স লেয়ারের নিরাপত্তা। আর বাড়ি থেকে নিয়মিত যাতায়াত করা চলল না আহার-পরীক্ষক বাহিনীর। কাছেই একটি স্কুলবাড়িতে অস্থায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা হল। তারপর থেকে সপ্তাহান্তে মাত্র একদিন নিজের বাড়িতে আসতে পারতেন মার্গট, তা-ও এসএসের কড়া প্রহরায়। এই স্কুলবাড়িতে থাকাকালীন এক রাতে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয় মার্গটের। একজন এসএস অফিসার তাঁকে ধর্ষণ করে। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারেননি বছর ছাব্বিশের তরুণীটি। কারণ, ওই মৃত্যুভয়। সামান্য মাথা তুললে নাৎসিরা যে নিজেদের লোককেও রেয়াত করে না তা তো নিজের চোখেই দেখেছিলেন মার্গট। তাই দুঃখ, লজ্জা সমস্ত ভুলেই সহ্য করে নিয়েছিলেন অত্যাচার।
যত সময় এগোচ্ছিল, ততই নিশ্চিত হয়ে আসছিল জার্মানির পতন। চক্রান্তের পর আর ঠিক চার মাস উল্ফ’স লেয়ারে ছিলেন হিটলার। সোভিয়েত সেনার ক্রম-আগমন চিন্তা বাড়াচ্ছিল নাৎসিদের। মার্গট জানতেন, ধরতে পারলে মহিলা বলে তাঁকেও ছেড়ে দেবে না রেড আর্মি। শুধুমাত্র নাৎসিদের হয়ে কাজ করার অপরাধেই কঠিন শাস্তি পেতে হবে তাঁকে। তিনি পালানোর সুযোগ খুঁজছিলেন। এসএস বাহিনীতে তাঁর এক বন্ধু লেফটেন্যান্ট গেরহার্ড ল্যাগ্রেঞ্জ তাঁকে পালাবার ব্যবস্থা করে দেন। হিটলারের প্রচারমন্ত্রী জোসেফ গোয়েবেলসের ব্যক্তিগত ট্রেনে তিনি বার্লিনে পালিয়ে যান। রেড আর্মি সম্পর্কে মার্গটের অনুমান সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল। মহিলা আহার-পরীক্ষক বাহিনীর বাকি চৌদ্দজন রাস্তেনবার্গেই থেকে যান, কারণ তাঁদের সকলেরই বাড়ি ছিল সেখানে। সেটাই হয়েছিল মস্ত ভুল। ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে রাস্তেনবার্গ দখলের পর রেড আর্মি নাৎসি দপ্তরের সকলকে গুলি করে হত্যা করে। বাদ যাননি সেই চৌদ্দ নারীও। এই মর্মান্তিক খবর মার্গট যুদ্ধের পরে জানতে পেরেছিলেন তাঁর পরিত্রাতা লেফটেন্যান্ট বন্ধুটির কাছ থেকেই।
বার্লিনে গিয়ে মার্গট আশ্রয় নেন এক সহৃদয় অধ্যাপক ডক্টর হাইড গ্রাউয়ার্টের গ্রুনেওয়াল্ডের বাড়িতে। কাজ ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন, সে খবর বার্লিনের এসএসের সদর দপ্তরে এসে পৌঁছেছিল। গ্রাউয়ার্টের বাড়িতেও তাঁর খোঁজে হানা দেয় এসএস বাহিনী। কিন্তু গ্রাউয়ার্টের বুদ্ধিমত্তায় সে যাত্রা রক্ষা পেয়ে যান মার্গট। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সেনার করালচক্ষু এড়ালেন তরুণী। জার্মানির পতন আসন্ন। নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে হিটলার ও তাঁর স্ত্রী ইভা ব্রাউন আত্মহত্যা করলেন। তারিখটা ১৯৪৫ সালের ৩০শে এপ্রিল। দু’সপ্তাহ ধরে এসএস ও হিটলার ইয়ুথ বাহিনীর অসম লড়াইয়ের পর ২রা মে বার্লিন দখল করল সোভিয়েত সেনারা। ইউরোপের মাটিতে ধ্বনিত হলো যুদ্ধান্তের ঘণ্টা। কিন্তু অসহায় বার্লিনবাসীদের জন্য তা কোনো সুখের বার্তা বয়ে নিয়ে আসেনি। রেড আর্মির সেনাপ্রধান নিকোলেই বার্জারিন পরাজিত শহরবাসীর জন্য পানীয় জল, খাবার, চিকিৎসা, বিদ্যুত ইত্যাদি পরিষেবা যথাসম্ভব দ্রুত চালু করে শহরে স্থিতাবস্থা ফেরানোর চেষ্টায় রত হলেও প্রতিশোধস্পৃহায় মত্ত বেশিরভাগ সেনা সেই মহৎ উদ্যোগে সামিল হয়নি। বহু জায়গায় তারা লুটপাট চালায়, নিরপরাধ জার্মানদের গণহারে হত্যা করে, ভীত মহিলাদের বাড়ি থেকে বার করে এনে তাঁদের ইজ্জত লুণ্ঠন করে।
দু’বার সেনার হাত থেকে বেঁচে গেলেও তৃতীয়বার আর নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি মার্গট। তিনি বলেছেন, “আমরা লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করছিলাম। ওদের চোখে ধোঁকা দেওয়ার জন্য আমরা বুড়ি সেজেও বাঁচবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওরা তখন মত্ত পশু।” সম্পূর্ণ বেআব্রু করে এক ডাক্তারের বাড়িতে তাঁদের কয়েকজন মহিলাকে নিয়ে যায় সেনা। টানা চৌদ্দ দিন ধরে লাগাতার ধর্ষণ করা হয় মার্গটকে। এই নিরন্তর শারীরিক অত্যাচারের ফলে তিনি সারাজীবনের মতো গর্ভধারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন।
এত যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন মার্গট। কিন্তু পরের বছর ১৯৪৬ সালের ২৭শে মার্চ হঠাৎই অপ্রত্যাশিতভাবে কার্ল ফিরে আসার পর আবার নতুন করে বাঁচার ইচ্ছা জেগে ওঠে। সোভিয়েত বন্দীনিবাসে অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন কার্লও। মার্গটের দরজায় সেদিন মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এক শীর্ণকায়, অকালবৃদ্ধ মানুষ, যাঁকে দেখে মার্গট চিনতে পারেননি। মার্গটের সেবা শুশ্রূষার ফলে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। তখন তাঁরা কপর্দকশূন্য। পেটের তাড়নায় রাতের অন্ধকারে আলু চুরি করতে হয়েছে কার্লকে। পরবর্তী জীবনে বার্লিন-উইল্মার্সডর্ফ ট্যাক্স অফিসে সেক্রেটারির কাজ নিয়েছিলেন মার্গট। কাজ করেছেন এক চিত্র প্রযোজকের সেক্রেটারি হিসেবেও। সেখানে দেখেছিলেন প্রখ্যাত জার্মান অভিনেতা হেরাল্ড জুঙ্কেকে। সন্তানহীন দম্পতির বাকি জীবন বেশ আনন্দেই কেটেছে। মাঝে মাঝেই নিজেদের গাড়িতে চেপে বেড়াতে যেতেন অস্ট্রিয়া, ইতালি, সুইজারল্যান্ড।
কার্ল চলে গিয়েছেন ১৯৯০ সালে, বার্লিন প্রাচীর পতনের পরপরই। তারপর আরও চব্বিশ বছর একাই কাটিয়েছেন জীবন। শ্মার্গেনডর্ফের যে ফ্ল্যাটে তাঁর জন্ম, সেখানেই থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। দীর্ঘ সত্তর বছর ধরে মনের মধ্যে জমিয়ে রেখে দিয়েছিলেন যুদ্ধের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার গল্প। ২০১২ সালে তাঁর পঁচানব্বই বছর পূর্ণ হওয়ার দিন এক স্থানীয় সাংবাদিককে এসব নারকীয় কাহিনী শুনিয়েছিলেন তিনি। তারপর বহু নামী দেশী-বিদেশী সংবাদপত্র থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়। তাঁর জীবনের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে দুটি উপন্যাস। প্রথমটি ইতালিয় লেখিকা-সাংবাদিক রোসেলা পস্তোরিনোর ‘অ্যাট দ্য উল্ফ’স টেবল’, অন্যটি ঐতিহাসিক উপন্যাস-রচয়িতা ভি এস আলেকজান্ডারের ‘দ্য টেস্টার’।
নাৎসিদের মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন তিনি, তাদের হয়ে কাজ করাকে একরকম অপরাধ বলেই মনে হতো তাঁর। যদিও এ কাজ তাঁকে করতে হয়েছিল পরিস্থিতির শিকার হয়েই। যে হিটলারকে তিনি শেষজীবনে এসেও বলেছেন, “লোকটা মানুষ হওয়ার অযোগ্য“, সেই লোকেরই সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে নিজের মূল্যবান জীবনকে তুচ্ছ করে, এই মানসিক দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। এরকম নির্মম অসহায়ত্বের পাশাপাশি পুরুষের যৌনলালসার শিকার হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে তাঁর সঙ্গে। অপরাধবোধ ও লজ্জাবোধ থেকেই এসব ঘটনা কখনও জনসমক্ষে বলতে চাননি তিনি। বারবার ভুলতে চেষ্টা করলেও সারাজীবন তাঁর মনকে অশান্ত করেছে মানবজাতির ইতিহাসের এই চির-কলঙ্কজনক অধ্যায়, যার শিকার হয়েছিলেন মার্গটের মতো বহু অসহায়, নিরপরাধ মানুষ।
মার্গট ওয়ল্কের জীবনকাহিনী যুদ্ধের প্রকৃত বীভৎসতার একদম বাস্তব উদাহরণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির জয়কে গৌরবান্বিত করার একটি মরিয়া চেষ্টা বরাবরই দেখা গেছে। তারা নাকি ফ্যাসিবাদী জার্মানি-ইতালি-জাপানকে পরাস্ত করে বিশ্ব-মানবতাকে রক্ষা করেছিল। যদিও মিত্রশক্তির সর্বোচ্চ শক্তিমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-কর্তৃক হিরোশিমা-নাগাসাকির উপর ফেলা পারমাণবিক বোমাবর্ষণ কোন মানবতার পরিচায়ক সেটা তার্কিকগণই জানেন। সোভিয়েত সেনাবাহিনীও যুদ্ধের নানা পর্যায়ে বর্বরতায় নাৎসিদেরও ছাপিয়ে গিয়েছে। এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ইত্যাদি নানা দেশে সোভিয়েতের নৃশংসতার শিকার হয়েছিলেন সাধারণ নিরপরাধ মানুষ। সেখানে রক্ষক অবতীর্ণ হয়েছে পৈশাচিক ভক্ষকের ভূমিকায়। আসলে যুদ্ধ কখনও মানবতা রক্ষার্থে হয় না, হয় রাজায়-রাজায় স্বার্থের সংঘাতে আর সেখানে প্রাণ হারাতে থাকে সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ, যার সাথে তার পাশের দেশের মেহনতি মানুষটার কোনোদিন ঝগড়া ছিল না।