১৮৬৮ সালে কার্ল মার্ক্স তার খুব কাছের বন্ধু লুডভিগ কুগেলমানকে একটি চিঠিতে বলেছিলেন, “যাদের ইতিহাস নিয়ে জানাশোনা আছে, তারা এটা ভালো করেই জানে যে বড় ধরনের সামাজিক পরিবর্তন কখনও নারীদের অংশগ্রহণব্যতীত সফল হয় না।” কার্ল মার্ক্স কি জানতেন, তার এই কথা ভারতের মণিপুর রাজ্যের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাবে ছত্রিশ বছর পরে? তার জানার প্রশ্নই আসে না। কারণ আধুনিক সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিকদের অন্যতম ও মার্ক্সিজমের প্রাণপুরুষ এই ব্যক্তি মারা যান ১৮৮৩ সালে। কিন্তু তার কথাটি ধ্রুব সত্যের মতোই যেকোনো সামাজিক পরিবর্তনের সাথে এখনও খাপে খাপে মিলে যায়।
মণিপুর রাজ্যের ইতিহাস পড়লে আপনি বুঝতে পারবেন নারীরা সবসময়ই এই রাজ্যে অন্য যেকোনো রাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীনতা ও কর্তৃত্ব উপভোগ করতো। এর পেছনে কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় জড়িত রয়েছে। কয়েক শতক আগে মণিপুর স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা আর তার পরিষদ দ্বারা শাসিত হতো। সেই সময়ে এই রাজ্যের নাম ‘মণিপুর’ ছিল না, ছিল ‘কাংলেইপাক’। কাংলেইপাক রাজ্যের প্রায় সকল ক্ষমতা ছিল রাজার হাতে। মধ্যযুগের সেই সময় ছিল অত্যন্ত সংঘাতবহুল, যুদ্ধ তখন নাওয়া-খাওয়ার মতোই অপরিহার্য। সবসময়ই মণিপুর রাজ্যের সাথে অন্যান্য অঞ্চলের যুদ্ধ লেগেই থাকতো। এজন্য মণিপুরি পুরুষদের প্রায় সবাইকেই রাজ্যের সেনাবাহিনীতে ‘সৈন্য’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে হতো। কারণ পুরুষরা যদি যুদ্ধ না করেন বা যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানান, তাহলে খোদ মণিপুর রাজ্যেরই অস্ত্বিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। রাজ্যের ছেলেদের অল্প বয়সেই সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হতো, যাতে পূর্ণ বয়সে উপনীত হতে হতে তারা দক্ষ যোদ্ধায় পরিণত হতে পারে।
মণিপুরি রাজ্যের পুরুষরা গণহারে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে মণিপুরি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একধরনের শূন্যতার সৃষ্টি হয়। যেমন- ব্যবসার কথাই ধরা যাক। মণিপুরি পুরুষরা যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় নারীরা একদিকে যেমন ঘর সামলাত, তেমনই ব্যবসা কিংবা চাষাবাদের মতো বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কাজেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করতো। নিজস্ব উপার্জনের ফলে মণিপুরি নারীদের স্বাধীনতার ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে, তারা ক্রমেই ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে শুরু করে। ১৫৮০ সালে ইম্ফল জেলায় তৎকালীন রাজা নারীদের উৎপাদিত পণ্য আরও সমন্বিত উপায়ে বিকিকিনি করার জন্য একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম দেয়া হয় ‘খৈরামবন্দ বাজার।’ মণিপুরি ভাষায় এই বাজারকে অভিহিত করা হতো ‘নুপি কেইথেল’ বা ‘ইমা কেইথেল’ হিসেবে। এর অর্থ দাঁড়ায় ‘নারীদের বাজার’। এই বাজারই পরবর্তীতে মণিপুরি নারীদের প্রধান আর্থসামাজিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। সময়ের সাথে সাথে এটি মণিপুর রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়।
১৮৯১ সালে মণিপুর রাজ্য ব্রিটিশদের হাতে স্বাধীনতা হারায়। ১৯০৪ সালের দিকে রাজ্যটিতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে এবং একপর্যায়ে তা সহিংসতায় রূপ নেয়। স্বাধীনতা হারানো ক্ষু্ব্ধ জনতা ব্রিটিশ কর্মকতাদের বসবাসের দুটো বাংলো আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজ কর্নেল ম্যাক্সওয়েল মণিপুরি পুরুষদের জন্য একধরনের ‘জোরপূর্বক শ্রম’ নীতি প্রণয়ন করেন। এই নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল পুড়ে যাওয়া বাংলোগুলোকে নতুন করে নির্মাণ করা। পুরুষরা প্রতি ত্রিশ দিন পর পর বাধ্যতামূলকভাবে দশ দিন ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন কাজে বিনামূল্যে খাটবে– এটাই ছিল এই নীতির মূল কথা। আদতে এটি ছিল একপ্রকার দাসত্বমূলক ব্যবস্থা। ম্যাক্সওয়েল যখন এই আদেশ প্রণয়ন করেন, তারপর থেকেই মণিপুরের নারীরা এর বিরুদ্ধে সংগঠিত হন এবং আন্দোলন শুরু করেন। বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ ও প্রতিবাদ মিছিল বের করার মাধ্যমে নারীরা প্রতিবাদ শুরু করেন।
১৯০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে কর্নেল ম্যাক্সওয়েলের আদেশের বিরুদ্ধে মণিপুরি নারীদের এই আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে। প্রায় পাঁচ হাজার নারী খৈরামবন্দ বাজারে জড়ো হয়ে কর্নেলের বাসভবনের দিকে রওনা হয় দাবি আদায়ের জন্য। একপর্যায়ে ব্রিটিশ প্রশাসন আদেশটি পুনর্বিবেচনা করার কথা বলে প্রতিবাদরত নারীদের শান্ত করার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত নারীরা পিছু হটেননি। নির্ধারিত সময়ে ব্রিটিশরা নারীদের দাবি মনে না নেয়ায় পূর্বের মতোই এই আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয় এবং ব্রিটিশরা শক্তিপ্রয়োগ করে আন্দোলনকারীদের নারীদের দমাতে চেষ্টা করে। শেষপর্যন্ত কর্নেল ম্যাক্সওয়েল এই আদেশ প্রত্যাহারে বাধ্য হন। প্রথম ‘নুপি লান’ বা নারীদের বিদ্রোহে মণিপুরি নারীরা সাফল্য লাভ করে।
১৯০৭ সালে ব্রিটিশরা মণিপুরি শাসকদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে। কিন্তু তারপরও একজন ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে মণিপুরি রাজদরবারে আসন দেয়া হয় এবং রাজা ও তার সংসদের উপর তার ব্যাপক প্রভাব রাখার বিষয়টি স্বীকার করে নেয়া হয়। এই ব্রিটিশ প্রতিনিধির দাবি অনুযায়ী মণিপুরের উৎপাদিত চাল বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে পাঠানো শুরু হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে খোদ মণিপুরের নাগরিকদের উপর। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি চাল ও অন্যান্য সামগ্রী রপ্তানি করার ফলে মণিপুরে কৃত্রিম খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এই সুযোগ নেয় ব্রিটিশরা৷ তারা ব্রিটেনে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য মনিপুরে রপ্তানি করতে শুরু করে। এর পাশাপাশি মারওয়ারি ব্যবসায়ীরা স্থানীয় অসংখ্য ধানের আবাদী জমি কিনে নেয় এবং চালের কল স্থাপন করে। এসব কারণে মণিপুরের স্থানীয় চাল উৎপাদন শিল্প ধ্বংসের কাছাকাছি চলে যায়।
১৯৩৯ সালের দিকে অতিবৃষ্টি এবং শিলাবৃষ্টির কারণে মণিপুরের ধান উৎপাদন দারুণ ব্যাহত হয়। কৃষকরা মণিপুর রাজ্যের হর্তাকর্তাদের কাছে মণিপুরের চাল বাইরে রপ্তানি নিষিদ্ধ করার জন্য আবেদন জানায়, যাতে উৎপাদিত চাল স্থানীয় চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট হয়। প্রথমদিকে মণিপুর রাজা ও তার সংসদ এই দাবিতে এই আবেদন গ্রহণ করলেও পরবর্তীতে রপ্তানিকারকদের চাপে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। এর ফলে মণিপুর রাজ্যে চালের সংকট দেখা দেয় এবং দাম বাড়তে শুরু করে। সেই বছরের ডিসেম্বর মাসে শত শত নারী রাস্তায় বেরিয়ে আসে মণিপুরের চাল বাইরে রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য।
তারা মণিপুর দরবারের প্রেসিডেন্ট টি. এ. শার্পেকে বাধ্য করে মহারাজার কাছে টেলিগ্রাম পাঠানোর জন্য। ফিরতি টেলিগ্রাম আসার আগপর্যন্ত তাকে বন্দী করে রাখা হয়। প্রায় চার হাজার নারী মণিপুর দরবারের আশেপাশে অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে আসাম থেকে সেনাবাহিনী এসে নারীদের উপর নির্বিচারে বেয়নেট চার্জ করতে শুরু করে। বেয়নেট চার্জের প্রতিবাদে নারীরা সেনাদের দিকে পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করেন। মহারাজা এসব শোনার পর পরের দিনই ধান রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে খৈরামবন্দ বাজার প্রায় চৌদ্দ মাস বন্ধ রাখা হয়েছিল।
ভারতের ইতিহাসে মণিপুরের ‘নুপি লান’ বা নারী বিদ্রোহগুলো একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কারণ, মণিপুরের নারীরা নিজ রাজ্যের পুরুষদের দাবি আদায়ে আন্দোলন করে সফল হয়েছিলেন। প্রথম নুপি লানে নারীরা এজন্য আন্দোলন করেছিলেন যে পুরুষদের যেন জোরপূর্বক শ্রমপ্রদানে বাধ্য না হয়। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখে মণিপুরে ‘নুপি লান দিবস’ উদযাপনের মধ্যে দিয়ে বার বার নারীদের সেই গৌরবান্বিত ইতিহাস স্মরণ করা হয়।