সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ঘানা বিজনেস নিউজ নামের একটি ওয়েবসাইটে, ২০১৬ সালের ২রা ডিসেম্বরে। শিরোনাম ছিল, ঘানার নিরাপত্তাবাহিনী রাজধানী আক্রাতে একটি ভুয়া মার্কিন দূতাবাস বন্ধ করে দিয়েছে। ঘটনার বিবরণও ছিল শিরোনামের মতোই কৌতূহলোদ্দীপক। ঘানার রাজধানী আক্রায় গত ১০ বছর ধরে একটি ভুয়া মার্কিন দূতাবাস চালু ছিল, যেখান থেকে ৬,০০০ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে আমেরিকা যাওয়ার ভিসা প্রদান করা হতো। এর মধ্যে আসল এবং নকল দুই ধরনের ভিসাই ছিল। দূতাবাসটি সপ্তাহে তিন দিন মার্কিন পতাকা উত্তোলন করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতো। অফিস কক্ষের দেয়ালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার একটি ছবিও শোভা পেত।
Foreign, Ghana security authorities shut down fake US Embassy in Accra https://t.co/MWTRWNiUF9 #Ghana @USEmbassyGhana #SCAM
— Ghana Business News (@GhBusinessNews) December 2, 2016
ওয়েবসাইটটি তাদের সংবাদের সূত্র হিসেবে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিবৃতিকে উদ্ধৃত করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের ঐ বিবৃতিতে দাবি করা হয়, ভুয়া এ দূতাবাসটির পেছনে ঘানা এবং তুরস্কভিত্তিক অপরাধী চক্র কাজ করছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত গোপন সূত্রে সংবাদ পেয়ে ঘানা ডিটেক্টিভ ব্যুরোর সদস্যরা মার্কিন ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি এজেন্টদের সহায়তায় অপারেশন স্পার্টান ভ্যানগার্ডের আওতায় ভুয়া দূতাবাসটিতে অভিযান চালিয়ে সেটি বন্ধ করে দেয়। তারা সেখান থেকে ১৫০টি পাসপোর্ট, প্রচুর জাল নথিপত্র এবং জালিয়াতির সাথে জড়িত একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে।
সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই এটি ঘানাতে প্রচন্ড সাড়া ফেলে। মাত্র এক ঘন্টার মধ্যেই ওয়েবসাইটটির ঐ পেজটিতে ২০,০০০ ক্লিক পড়ে। দুই দিন পর সংবাদ সংস্থা রয়টার্স যখন সংবাদটি প্রকাশ করে, তখন সেটি বিশ্বব্যাপী ভাইরাল হয়ে যায়। বিশ্বের প্রায় সবগুলো জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পত্রিকা সংবাদটি প্রচার করে। অনেকগুলো সংবাদের শিরোনামে ব্যাপারটির কৌতুককর দিকটিও উঠে আসে। জার্মানির ডয়েচে ভেলে শিরোনাম করে, ঘানা ভুয়া দূতাবাসের রহস্য উদঘাটন করেছে, যারা আসল ভিসা দিত। চীনের শিনহুয়া সংবাদ সংস্থা শিরোনাম করে, আক্রার নকল মার্কিন দূতাবাস বন্ধ করে দিয়েছে দেশটির আসল দূতাবাস!
Regional Security Office Ghana Shuts Down Fake US Embassy https://t.co/UG79hSmRmH pic.twitter.com/9EpVBJcQs7
— SecurityJar (@SecurityJar) December 4, 2016
সংবাদটি ভাইরাল হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। একদিকে ঘটনাটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অবমাননাকর। এরকম প্রভাবশালী একটি রাষ্ট্রের দূতাবাসের নামে জালিয়াতি করে দশ বছর ধরে ভিসা দিয়ে দেশটিতে লোক পাঠানোর বিষয়টিকে অনেকেই হাস্যরসাত্মকভাবে গ্রহণ করে। অন্যদিকে ঘটনাটির উপাদানগুলো ছিল সবার পরিচিত: দারিদ্র্যের কারণে আফ্রিকানরা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েছে, স্থানীয় পুলিশের অদক্ষতা এবং দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে তারা বছরের পর বছর সফলভাবে অপরাধ চালিয়ে গেছে এবং শেষপর্যন্ত শেতাঙ্গ আমেরিকানরা এসে অপরাধীদেরকে গ্রেপ্তার করেছে – পুরো ব্যাপারটির মধ্যে একধরনের নাটকীয় ভাব আছে। কিন্তু শুধু একটাই সমস্যা, অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং ভাইরাল হওয়া এ সংবাদটি ছিল ভুয়া দূতাবাসের মতোই একটি ভুয়া সংবাদ!
সে সময় ঘানার ভিসা এবং নথিপত্র জালিয়াতি বিভাগের প্রধান ছিলেন সেথ সেওরনু। এরকম কোনো অভিযান পরিচালিত হলে সেটি তার জ্ঞাতসারেই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ডিসেম্বরের ২ তারিখে যখন ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের প্রধান তাকে এসএমএস পাঠিয়ে ভুয়া দূতাবাসে অভিযানের কথা জানতে চান, সেথ তখন আকাশ থেকে পড়েন। কারণ অভিযান তো দূরের কথা, তার জানা মতে ঘানাতে কোনো ভুয়া মার্কিন দূতাবাসের অস্তিত্বই ছিল না। এমনকি মার্কিন বিবৃতিতে ঘানা ডিটেক্টিভ ব্যুরো নামে যে সংস্থাটির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, সে নামেও কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব ছিল না। তারপরেও তিনি একে একে ঘানার সবগুলো নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। বলাই বাহুল্য, তারাও কেউ কিছু জানত না।
Fake U.S. embassy shut down in #Ghana after operating & issuing #visas for about 10 years (@StateDept pics) https://t.co/gcTk2uLcxL pic.twitter.com/bMxHVeKWka
— China Xinhua News (@XHNews) December 5, 2016
পরবর্তী কয়দিন সেথের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়। স্থানীয় সাংবাদিকরা ছাড়াও বিবিসি, সিএনএনসহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো তাকে ফোন করতে শুরু করে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে একইসাথে একটি ভুয়া ডাচ দূতাবাসের কথাও উল্লেখ করা হয়েছিল, ফলে ডাচরাও তাকে ফোন করতে থাকে। সবাই ঐ অভিযান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চায়। কীভাবে ভুয়া একটি মার্কিন দূতাবাস দিনের পর দিন তাদেরকে ফাঁকি দিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল, সে ব্যাপারে কারোই আগ্রহের কোনো কমতি নেই। কিন্তু তারা নিজেরাও বেশি কিছু জানতো না। তাদের সবারই প্রাথমিক তথ্যসূত্র মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিটি, এর বাইরে অন্য কোনো সূত্র থেকেই কেউ কোনো তথ্য বের করতে পারেনি। সেথ ঘানায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করে ব্যাখ্যা চান, কিন্তু তারাও কোনো কিছু জানাতে ব্যর্থ হয়।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রিপোর্টটির সাথে কিছু ছবিও প্রকাশিত হয়েছিল। কিছু জাল নথিপত্রের ছবি, কয়েকটি পাসপোর্টের ছবি, এবং মলিন চেহারার পুরানো আমলের লাল রংয়ের একটি দোতলা বাড়ির ছবি। এই বাড়িটিকেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ভুয়া দূতাবাস বলে দাবি করা হয়েছিল। বাড়িটির মালিকদের মধ্যে একজন ছিলেন সুজানা ল্যাম্পটি। এক বন্ধুর কাছ থেকে ফোন পেয়ে যখন তিনি জানতে পারেন, তাদের বাড়িটির ছবি ভুয়া দূতাবাস হিসেবে সারা দুনিয়ার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে, তখন প্রথমে তিনি খুব একটা পাত্তা দেননি। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তার কাছে সাংবাদিকরা ছুটে আসতে থাকে, সবাই তার অপরাধ জীবনের বৃত্তান্ত জানতে চায়।
That viral story about the fake US embassy in Ghana was probably fake – and started by the real US embassyhttps://t.co/rACpc1xNTn
— Rachel Savage (@rachelmsavage) December 1, 2017
সুজানা সাংবাদিকদেরকে বারবার একটা যুক্তিই দেখান, এই বাড়িতে যদি ১০ বছর ধরে ভুয়া মার্কিন দূতাবাসের মতো লাভজনক ব্যবসা চলতো, তাহলে কী বাড়িটির তখনও এরকম রং উঠে যাওয়া, প্লাস্টার খসে পড়ার মতো করুণ দশা থাকতো? আমেরিকায় লোক পাঠাতে পারলে তো বাড়ির সবারই এতদিনে আমেরিকায় স্থায়ী হয়ে যেতে পারার কথা ছিল! অথচ পরিহাসমূলক ঘটনা হচ্ছে, সুজানা নিজেই এর কয়েক মাস আগে আমেরিকার ভিসার জন্য আবেদন করেছিলেন। কোনো ভুয়া দূতাবাসে না, আসল মার্কিন দূতাবাসে গিয়েই। বলাই বাহুল্য, তার ভিসার আবেদন বাতিল হয়ে গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে তাকে বাড়ির অংশবিশেষ ভাড়া দিয়ে, আর বাড়ির পেছনে একটি বেকারি চালিয়ে জীবিকা অর্জন করতে হচ্ছিল।
রিপোর্টে যেরকম দাবি করা হয়েছিল, বাস্তবে অবশ্য সুজানার লাল দালানটিতে কখনো কেউ অভিযান চালায়নি, কাউকে সেখান থেকে গ্রেপ্তারও করেনি। অস্তিত্ব না থাকা ঘানা ডিটেক্টিভ ব্যুরোও না, কিংবা অস্তিত্ব থাকা নিয়মিত পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনীও না। বরং রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে ক্ষিপ্ত সুজানা নিজেই পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে হানা দিয়েছিলেন স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে। জানতে চেয়েছিলেন, তাদের বাড়ির ছবি কীভাবে পত্রিকাতে এসেছে? তারা কি কোনো পুলিশি তদন্তের অধীনে আছেন? পুলিশ তাদেরকে আশ্বস্ত করেছিল, তাদের চিন্তার কিছু নেই। কোথাও কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে নিশ্চয়ই, সেটা তারা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।
তবে সুজানা যে থানায় গিয়েছিলেন, সেখানকার পুলিশের কাছে তার বাড়িটি সম্পর্কে কোনো তথ্য না থাকলেও লয়েড বাইদু নামে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তার কাছে ঠিকই সে ব্যাপারে তথ্য ছিল। বাড়িটির ছবি তিনিই তুলেছিলেন। আর সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল ভুয়া দূতাবাসের মূল কাহিনী। ব্যাপারটা হচ্ছে, নকল দূতাবাস না থাকলেও ঘানাতে জাল পাসপোর্ট এবং জাল ভিসা প্রদানকারী চক্রের কোনো অভাব ছিল না। সত্যি সত্যিই বেশ কিছু প্রভাবশালী অপরাধী চক্র সেখানে আছে, যারা নিয়মিত বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে জাল কাগজপত্র তৈরি করে আমেরিকায় যাওয়ার ভিসা পেতে সাহায্য করে।
এ ধরনের চক্রগুলো আগে নিজেরাই সরাসরি নকল পাসপোর্ট, নকল ভিসার ব্যবস্থা করে দিত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাসপোর্টে বায়োমেট্রিক তথ্য সংযুক্ত হওয়ায় তাদেরকে কাজের ধরন পাল্টাতে হয়েছে। এখন নকল পাসপোর্ট বা ভিসার পরিবর্তে তারা অন্যান্য জাল কাগজপত্র, যেমন শিক্ষা সনদপত্র, ব্যাংক স্টেটমেন্ট প্রভৃতি তৈরি করে দিয়ে এবং কিছুকিছু ক্ষেত্রে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের উপর প্রভাব খাটিয়ে ভিসার ব্যবস্থা করে দেয়। এক হিসেব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে মার্কিন দূতাবাসে ভিসার জন্য জমা পড়া আবেদনের সাথে সংযুক্ত কাগজপত্রের মধ্যে অর্ধেকই ছিল জাল।
ঘানার পুলিশ অবশ্য ২০১০ সাল থেকেই ভিসা জালিয়াতি রোধ করার জন্য বিশেষ বিভাগ চালু করেছিল। তারা এবং মার্কিন কর্মকর্তারা নিয়মিতই ভিসার আবেদনের জন্য জমা পড়া কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করার চেষ্টা করেন, কিন্তু যে বিপুল পরিমাণ নকল কাগজপত্র প্রতিদিন জমা পড়ে, তাতে সব সময় তাদের পক্ষে সবগুলো নথি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যাচাই করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া কর্তৃপক্ষের অবহেলা, অদক্ষতা এবং দুর্নীতি তো আছেই। শহরের বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যেই ভিসা জালিয়তি করার বিভিন্ন কেন্দ্রের বিজ্ঞাপন, তাদের এজেন্টদের ফোন নাম্বার চোখে পড়ে, কিন্তু তারপরেও তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো অভিযান পরিচালিত হয় না।
তবে লয়েড বাইদু ছিলেন অন্যান্য গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। ফলে ২০১৬ সালের জুন মাসে তিনি যখন একটি উড়ো ফোনের মাধ্যমে গোপন সংবাদ পান যে, আক্রার শহরতলিতে একটি লাল দালানের ভেতর থেকে একটি চক্র মার্কিন দূতাবাসের নামে গোপনে জাল ভিসা প্রদান করছে, সাথে সাথেই তিনি তার এক সহকারীকে নিয়ে সেখানে ছুটে যান। কিন্তু ঠিকানা অনুযায়ী লাল দালানটি খুঁজে পাওয়ার পর তিনি কিছুটা হতাশই হন। তার কাছে তথ্য ছিল, লাল দালানটি মার্কিন দূতাবাসের পরিচয়ে কাজ করছিল, সপ্তাহে তিন দিন সেখানে মার্কিন পতাকা উত্তোলন করা হতো এবং মানুষ সেখানে গিয়ে ৬,০০০ ডলারের বিনিময়ে ভিসা গ্রহণ করতো। কিন্তু বাইদু মিনিট পাঁচেক ভবনটি দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন, অধিকাংশ উড়ো ফোন কলের মতোই এটিও মিথ্যা ছিল।
ফোনের তথ্যানুযায়ী নির্ধারিত দিন হওয়া সত্ত্বেও বাড়িটির সামনে কোনো মার্কিন পতাকা ছিল না। সেখানে আমেরিকার ভিসা পেতে আগ্রহী মানুষের কোনো ভিড় ছিল না। তাছাড়া বাড়িটি এবং এলাকাটি যেরকম নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানের, তাতে ঘানার মতো দরিদ্র দেশের মানুষ একে দূতাবাস মনে করে ৬,০০০ মার্কিন ডলার করচ করবে, এই চিন্তাটাই ছিল অস্বাভাবিক। তারপরেও বাইদু সাধারণ পথচারীর ছদ্মবেশে কয়েকবার বাড়িটির আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে শেষে তিনি ফিরে এসেছিলেন। তবে তার আগে রুটিন অনুযায়ী বাড়িটির একটি ছবি তুলে এনেছিলেন এবং পরে অফিসে ফিরে সংক্ষিপ্ত একটি রিপোর্ট লিখে ফাইলবন্দী করে কেসটির ইতি টেনেছিলেন।
এক সপ্তাহ পরেই বাইদুর কাছে আরেকটি ফোন আসে। এবার জানানো হয়, ঐ একই এলাকায় আরেকটি অ্যাপার্টমেন্টে নকল পাসপোর্ট-ভিসার ব্যবসা চলছে। এবার অবশ্য শুধু ঠিকানা না, সেই সাথে আরও কিছু খুঁটিনাটি তথ্যও ছিল, যার ফলে বাইদু আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তথ্যানুযায়ী এই জালিয়াতির মূল হোতা অ্যাপার্টমেন্টটির মালিক কাইরি বোয়াকি, যিনি মাত্র ৪৫০ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে জাল ভিসার ব্যবস্থা করে দেন। দেরি না করে জুনের এক সন্ধ্যায় পাঁচজন গোয়েন্দা, ঘানিয়ান সোয়াট টীম, এবং মার্কিন দূতাবাসের একজন ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি এজেন্টকে নিয়ে লয়েড বাইদু ঐ অ্যাপার্টমেন্টে অভিযান পরিচলানা করেন।
ভাগ্যক্রমে এবারের তথ্য সঠিক ছিল। তারা সেখান থেকে ১৩৫টি জাল পাসপোর্ট, প্রচুর জাল নথিপত্র, ঘানার ৪৫টি সরকারী প্রতিষ্ঠানের নকল রাবার স্ট্যাম্প উদ্ধার করেন। গ্রেপ্তার করেন কাইরি রোয়াকসহ আরো তিনজনকে। এটি অবশ্য কোনো ভুয়া মার্কিন দূতাবাস ছিল না, ছিল নিছকই একটি জালিয়াতি চক্রের কার্যালয়। জব্দ করা পাসপোর্টগুলোর সবগুলোতেও মার্কিন ভিসা ছিল না। আমেরিকা ছাড়াও ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, কেনিয়া এবং ইরানের ভিসাও ছিল সেখানে। কিন্তু নিঃসন্দেহে এটি ছিল বেশ বড় ধরনের সফল একটি অভিযান। পরবর্তী কয়েক মাস ধরে বাইদু এবং তার সহকর্মীরা মামলার জন্য চার্জশিট প্রস্তুত করেন। কিন্তু যখন তারা মামলা দায়ের করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তখনই সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভুয়া মার্কিন দূতাবাসের সংবাদটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
ভুয়া দূতাবাসের সংবাদটিতে সংশ্লিষ্ট অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলেন লয়েড বাইদু এবং তার উপরস্থ কর্মকর্তা সেথ সেওরনু। কারণ রিপোর্টটির প্রতিটি খুঁটিনাটি বিবরণ এসেছে বাইদু পরিচালিত দুটি ভিন্ন ভিন্ন অভিযান থেকে। এমনকি ভুয়া দূতাবাস হিসেবে যে ছবিটি ব্যবহৃত হয়েছে, বাইদুর দাবি অনুযায়ী সেটি তার নিজের হাতে তোলা ছবি। এর বাইরে পাসপোর্ট এবং জাল কাগজপত্রের ছবি হিসেবে যে ছবিগুলো প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো ছিল দ্বিতীয় অভিযানের ছবি। সেরকম ছবির এক কোনে যে বাদামী জুতার অংশবিশেষ দৃশ্যমান, সেটিও বাইদুর জুতা। অথচ রিপোর্টের মূল বক্তব্যটিই ভুয়া! কোনো ভুয়া মার্কিন দূতাবাস ঘানাতে কখনো ছিল না।
লয়েড বাইদুর কাছে এ রহস্যের কোনো সমাধান নেই। হতে পারে মার্কিন দূতাবাসের কোনো কর্মকর্তার কাছে কেউ একজন বাইদুর রিপোর্টগুলো হস্তান্তর করেছিল। কিন্তু বোঝাবুঝির ভুল থেকেই হোক, কিংবা অভিযানের গুরুত্ব বাড়িয়ে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করার উদ্দেশ্যেই হোক, দুটি প্রায় একই রকমের, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন অভিযান থেকে পাওয়া তথ্য এবং ছবি একত্রিত করে রিপোর্টটি তৈরি করা হয়েছিল। হয়তো দূতাবাস থেকে পাঠানো কোনো ক্যাবলের উপর ভিত্তি করেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত কারণ এখন আর জানার কোনো উপায় নেই, কারণ ঘটনার পর প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেলেও কাহিনীটি যে ভুয়া ছিল, মার্কিন দূতাবাস বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনও তা স্বীকার করেনি। দূতাবাসের ওয়েবসাইটে এখনও শোভা পাচ্ছে ভুয়া সেই বিবৃতিটি।
ফিচার ইমেজ- YEPOKA YEEBO