অনেক উত্থান-পতন, নানা ঘটনাপ্রবাহ আর জীবনের প্রতি লাগাতার আসা হুমকি পার করে এলিজাবেথ ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসলেন। এলিজাবেথের ওপর আমাদের লেখার প্রথম পর্বে কুমারী রাজকুমারীর সিংহাসনে বসার রোমাঞ্চকর ঘটনাবলী পাঠকদের জানানো হয়েছে। এই লেখায় আমরা জানবো- কেমন ছিলো প্রিয় ইংল্যান্ড এলিজাবেথের হাতে? কেমন কেটেছে তার রাজ্যকাল ও সিংহাসনে উপনীত রানীর বাকি জীবন? ১৫৫৯ সালের ১৫ জানুয়ারি ছাব্বিশ বছর বয়সের যুবতী এলিজাবেথ যখন বোনের কাছ থেকে রাজ্যভার উওরাধিকার সূত্রে পান, তখন ইংল্যান্ড যেন একেবারে ঝড়ে উপড়ে যাওয়া বৃক্ষের মতো মাটিতে নুয়ে গেছে। মারাত্মক মহামারীতে ধুঁকছে সমগ্র দেশ। রাষ্ট্রের অর্থনীতির কথা বলতে গেলে বলতে হবে ‘দেউলিয়া’ শব্দটি, মুদ্রার মান কমে গেছে, একের পর এক রক্তক্ষয়ী ও অর্থক্ষয়ী যুদ্ধের পর ইংল্যান্ড তখন ক্লান্ত, সামরিক শক্তি অত্যন্ত দুর্বল। সেইসাথে একদিকে ফ্রান্স আর অন্যদিকে স্পেন ইংল্যান্ডকে যেন সর্বশক্তি দিয়ে সমানে টেনে যাচ্ছে নিজের দিকে, তাতে দেশটা ছিঁড়ে গেলে যাক। আর গত অনেকগুলো বছর ধরে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা তো চরম পর্যায়ে বিদ্যমান ছিলোই। এমন সময় দেশের ভার পড়ে একা কুমারী এলিজাবেথের ওপর।
রাজমুকুট পরবার পর দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত হতে লাগলো এলিজাবেথের বিয়ের ব্যাপারটি। লালচে-সোনালী কোঁকড়ানো চুল আর নীল চোখের কুমারী রানীর কাছে আসতে থাকে দেশের ভেতরের ও বাইরের অনেক রাজপরিবারের ও অভিজাত ব্যক্তিদের প্রস্তাব। সৎবোন ও পূর্বের রানী মেরীর স্বামী ও স্পেনের রাজা ফিলিপ তো মেরী অসুস্থ হবার পর থেকেই শ্যালিকার হৃদয়হরণের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। নতুন রানী তা প্রথমেই প্রত্যাখ্যান করে। রানীর পাণিপ্রার্থীদের তালিকায় আরো ছিলো সুইডেনের প্রিন্স এরিক ও রোমান সম্রাটের ছেলে আর্চডিউক চার্লস। প্রিন্স এরিকের ব্যাপারে প্রথমে রানীর পক্ষ থেকে ইতিবাচক মনোভাব রাখা হয় তার জনপ্রিয়তা ও ধর্মমতের দিকে লক্ষ রেখে। কিন্তু সুইডেন রাজপরিবারের সম্পদের পরিমাণ কম হওয়ায় তা পরে বাতিল হয়ে যায়। কুমারী এই রানী নামে অনেক পুরুষকে হাতে রাখার রটনা থাকলেও এলিজাবেথের জীবনে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় বন্ধু রবার্ট ডুডলির সাথে তার সম্পর্কের বিষয়টি। মেরীর রাজত্বকালে অনেকটা সময় একসাথে বন্দী থাকার জন্যেই হোক, আর বন্ধুত্বের একপর্যায়ে সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক নারী-পুরুষের আকর্ষণের জন্যেই হোক, রানী যে ডুডলির প্রেমে মজেছেন এ বক্তব্য বেশ জোরালো হয়ে উঠতে শুরু করে। কিন্তু বিবাহিত ডুডলির বাবা আগের রানীর সময়ে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন, সেইসাথে ডুডলির স্ত্রীর ভাগ্যেও ঘটে অস্বাভাবিক মৃত্যু। রানী উপদেষ্টারাও ডুডলিকে সিংহাসনের জন্য হুমকিস্বরূপ দেখতে শুরু করে। ফলে, এ সম্পর্ক থেকে পিছিয়ে আসতেই হয় এলিজাবেথকে। ফ্রান্সের রাজকুমার ফ্রান্সিসের সাথে বিয়ের কথা উঠলেও তা ভাঙে রাজনীতি ও ধর্মের কারণে। ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বিদেশী রাজা নিরাপদ মনে করেননি এলিজাবেথ। শেষ পর্যন্ত রাজসভাতে ঘোষণা দিলেন এলিজাবেথ- “ইংল্যান্ডই তার প্রথম স্বামী, তার প্রথম ভালোবাসা। ইংল্যান্ডের স্বার্থের অক্ষুণ্নতার জন্য সারাজীবন কুমারী রয়ে যাওয়া তার জন্য সম্মানেরই বৈকি!” এভাবে কুমারী রানী থেকে যান কুমারীই।
তবে এলিজাবেথের নামে একথা ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন যে- মোহিনী এই কুমারী নারী অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষমতাবান যুবকের সাথে নিজের ঘনিষ্ঠতা রেখেছিলেন, নিজের স্বার্থে তাদের প্রভাবকে ব্যবহারও করেছেন বিভিন্ন সময়। জীবনযাত্রার জাঁকজমকতা আর আড়ম্বরতায় আচ্ছন্ন করতেন অভিজাত ব্যক্তি থেকে সাধারণ মানুষ সকলকেই। তবু এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে, এ ছিলো তার শীতল চিন্তাপ্রসূত রাজনীতিরই এক অস্ত্র। বোধহয় এজন্যই অন্যে রাণীর প্রেমে পড়ুক বা রানী নিজেই অন্যের প্রেমে পড়ুন, যা-ই ঘটে থাকুক, সেটিকে তার ভাবমূর্তি ও একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রতিবন্ধকতা হতে দেননি কখনোই।
রাজ্যশাসনের শুরুর দিকেই এলিজাবেথ ধর্মীয় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। তিনি ছিলেন একজন প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান কিন্তু ইংল্যান্ড তখনও এক ক্যাথলিক দেশ। এই চ্যালেঞ্জকে আয়ত্ত করতে গিয়ে ধর্মীয় মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রহিত করে দেন রানী। ‘চার্চ অব ইংল্যান্ডের’ মাধ্যমে নিজের বিশ্বাসকে ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে তুলে ধরেন পৃথিবীর সামনে, ইংল্যান্ডের ধর্মগুরুদের সমর্থন দিতে হতো ‘চার্চ অব ইংল্যান্ডকে’। আর যারা সমর্থন দিতো না, কী হতো তাদের ভাগ্যে ? হিসাবটা সহজই ছিলো- আজীবন কারাবাস, নয়তো মৃত্যু।
প্রোট্যাস্টান্টদের দেশ ইংল্যান্ডে স্পেনের ক্যাথলিক রানী মেরী স্টুয়ার্ট হয়ে উঠেছিলেন এক বড় হুমকি। একদিকে এলিজাবেথ অবিবাহিতা ও সন্তানহীন, অন্যদিকে তারই ফুফাতো বোন মেরী বিবাহিতা ও পুত্রের জননী। সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তো উঠতোই। এই প্রশ্নই মেরীকে ইংল্যান্ডের সিংহাসনের দিকে মনোযোগী করে তোলে আর শুরু হয় স্পেন-ইংল্যান্ডের যুদ্ধ।
১৫৬৮ সালে ল্যাংসাইডের যুদ্ধে স্কটল্যান্ড পরাজিত হয়ে যখন রানী মেরী ইংল্যান্ডের কাছে আশ্রয় চাইলেন, ইংল্যান্ডের রানী তার আশ্রয় নির্ধারণ করলেন কারাগারে। এর এক কারণ যতটা না ছিলো মেরীর জন্য ঘৃণা, তার চেয়েও বেশি আশঙ্কা ছিলো ক্যাথলিক রানীকে আশ্রয় দেওয়া দেশের প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে তৈরি করতো অসন্তুষ্টি। বন্দী হিসেবে থাকলেও মেরীর উপস্থিতি ছিলো এলিজাবেথের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। একদিকে যেমন রাজমুকুটে তার অধিকারের প্রশ্ন ও দেশীয় ক্যাথলিকদের বিদ্রোহের আশঙ্কা ছিলো, অন্যদিকে ছিলো নানা ষড়যন্ত্রের ভয়। ওদিকে মেরী যে বন্দীদশাতেও সিংহাসনের বিরুদ্ধে নানা চক্রান্ত করে আসছেন- তাও শোনা যেতে লাগলো। বিশেষ করে ক্যাথলিক রানী মেরীকে কেন্দ্র করে উত্তর ইংল্যান্ডের ক্যাথলিকদের মধ্যে বিদ্রোহের সম্ভাবনা ব্যাপকভাবে দানা বাঁধতে শুরু করেছিলো। অবশেষে ক্ষিপ্ত ও ভীত রানী ১৫৮৭ সালে মেরী সম্পর্কিত সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ করেন মেরীরই জিম্মাদার পলিটের ওপর এবং সেই হুকুমনামায় নিজের সই ও সীলমোহর দেওয়ার ব্যাপারে দায়ী রাখলেন তার নিজস্ব সচিব ডেভিডসনকে। প্রায় আঠারো বছর মেরী এলিজাবেথের বন্দী হয়ে থাকেন। ইংল্যান্ডকে প্রোটেস্ট্যান্ট দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে রানী এলিজাবেথ দেশের ক্যাথলিকদের প্রতি বেশ কঠোর হয়ে ওঠেন। একবার ক্যাথলিকদের এক বিদ্রোহ দমন করতে রানীর নির্দেশে প্রায় ৭০০ ক্যাথলিককে প্রাণ হারাতে হয়।
রানী এলিজাবেথকে নিয়ে নানা রকম গল্পের প্রচলন ইতিহাসে আছে। এর বেশিরভাগই তৈরি হয়েছে তার সারাজীবন অবিবাহিত থেকে যাওয়ার ওপর ভিত্তি করে। অনেক ইতিহাসবিদ বলে থাকেন, শারীরিক ত্রুটির কারণেই বিয়ে করেননি তিনি, অনেকে বলেন তার সন্তান জন্মদানের অক্ষমতাকে ঢাকাই বিয়ে না করার আসল কারণ। কিন্তু সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে রাণীর প্রকৃতপক্ষে পুরুষ হওয়ার বিষয়টি, এর পক্ষে-বিপক্ষে ইতিহাসে আছে প্রচুর আলোচনা, তথ্যচিত্র। যেমন বলা যায়, প্রখ্যাত লেখক স্টিভ বেরির উপন্যাস ‘দ্যা কিংস ডিসেপশন’ এর কথা। এখানে লেখক দাবি করেন, রাজার দ্বিতীয় কন্যা কম বয়সেই অসুখে ভুগে মারা গেলে দেশে উত্তরাধিকারীর শূন্যতা সৃষ্টি হওয়ার ভয়ে এবং গৃহযুদ্ধের আশংকায় লালচুলো বালক নেভিলকে এলিজাবেথ সাজিয়ে হাজির করা হয়। আবার অন্যান্য গল্পেও এসেছে রাজকুমারীর মৃত্যুর পর প্রাসাদের লালচুলো ও নীল চোখের বালককে এলিজাবেথ সাজানোর গল্প।
সে যা-ই হোক, কিন্তু এলিজাবেথ যে একজন যোগ্য শাসক ছিলেন, তার প্রমাণ তার রাজত্বের আগের ও পরের ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থা। এলিজাবেথ তার শাসনকালে উদ্ধুদ্ধ হন দেশের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে দেশকে ঋণমুক্ত করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এবং সামরিকভাবে দেশকে শক্তিশালী করতে। ব্যাপকভাবে ব্যয় সংকোচ করে ও অতিরিক্ত কর বসিয়ে তিনি দেশের কাঁধ থেকে ঋণের বোঝা নামান। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের নেতৃত্ব দিতে না পারলেও যুদ্ধের আগে ও পরে সৈন্যদের সামনে তার জমকালো ও গর্বিত উপস্থিতি ও আবেগঘন বক্তৃতা তাকে বানিয়েছিলো সৈন্যদের জন্য এক অসামান্য প্রেরণার উৎস। রাজনৈতিক জ্ঞানে ও কূটনৈতিক বিচক্ষণতার ছাপ দেখা যায় তার প্রতিটি সিদ্ধান্তে। মুকুট পরবার পরেই মন্ত্রীসভার অনুমতি নিয়ে তৈরি করলেন সেরা এক উপদেষ্টামণ্ডলী। তাদের সুচিন্তিত পরামর্শের সাথে নিজের ব্যক্তিগত বুদ্ধি ও চিন্তাভাবনা মিশিয়েই নিতে থাকলেন সিদ্ধান্ত, চালাতে থাকলেন রাজ্য। ইতিহাস তার ব্যাপারে বলে, তিনি ছিলেন এমনই একজন রানী, যার ডান হাত কখনো জানতে পারতো না যে তার বাঁ হাত কী করতে যাচ্ছে। রূপে-লাবণ্যে, অাভিজাত্যে, বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞায়, কৌশলে ও মোহনীয়তায় অভিজাত শ্রেণির কাছে তো বটেই, জনসাধারণের কাছেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন উৎসাহ ও প্রেরণার, স্বকীয়তার ও স্বাধীনতার এক জ্বলন্ত প্রতিমূর্তি। অসংখ্য মেধাবী, সাহসী, বীর ও সাহিত্যিক, তরুণ – মধ্যবয়ষ্ক- এমনকি সামান্য বুদ্ধির মানুষও তার রাজত্বের সময় বেরিয়ে পড়েছিলো ইংল্যান্ডের স্থলে-জলে-রণাঙ্গণে কিছু একটা করে দেখাবার নেশায়। শেক্সপিয়ার এই সময়ই ইংরেজী সাহিত্যকে দেন তার অমূল্য সব নাটকের সমাহার, স্পেনসর গেঁথে যান নিজের চিন্তাপ্রসূত প্রবন্ধের মাল্যবর।
ইতিহাসের এই নক্ষত্রতুল্য নারীর জীবনের শেষ অধ্যায় তেমন সুখের ছিলো না। শরীরে বয়সের ছাপ নিয়ে একাকী ও ভগ্নমনা রানী হয়তো ভালোবাসার উষ্ণতা চেয়েছিলেন, কিন্তু ক্ষমতা আর মুকুট তাকে তা পেতে দেয়নি কখনোই। সুদর্শন ও তরুণ নাইট এসেক্সের প্রতি রাণীহৃদয় নরম হলেও এসেক্সের কূটকৌশলের কাছে তা পরাজিত হয়। ফলস্বরূপ, ১৬০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে রানীর আদেশেই ফাঁসিকাষ্ঠে প্রাণ দিতে হয়, সেইসাথে যেন এলিজাবেথের হৃদয়েরও মৃত্যু হয়। ঠিক দু’ বছর পর ১৬০৩ সালের ২৪ শে মার্চ মারা গেলেন ইংল্যান্ডের কুমারী রানী এলিজাবেথ, যার স্মৃতিসৌধ বলা হয় সমগ্র ইংল্যান্ডকেই। তার কুমারী থাকার পেছনে নানা শারিরীক জটিলতার কথা আলোচনায় আসলেও একথা স্বীকার করতেই হবে- কুমারী এই রাণীর জন্য ব্যক্তিসুখের চেয়ে বড়ো ছিলো স্বদেশের স্বাধীনতা, তার নিজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো তার ভালোবাসার প্রিয় ইংল্যান্ড। তাই তিনি জীবনের সর্বস্ব দিয়ে ভগ্নপ্রায় ইংল্যান্ডকে পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়ে যান এবং তার প্রথম আইনসভার অধিবেশনে তার বলা আবেগগঘন, স্মরণীয় উক্তিটিই আমৃত্যু প্রমাণ করে যান-
“আমার প্রজাদের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা ভিন্ন আমার কাছে পৃথিবীর কিছুই মূল্যবান নয়।”