‘কুদৃষ্টি’, ‘অশুভ নজর’, ‘খারাপ বাতাস’- এই শব্দগুলোর সঙ্গে কমবেশি সবাই পরিচিত। বদ নজর থেকে বাঁচাতে ছোট ছোট বাচ্চাদের কপালে বড় করে কাজল দিয়ে কাল টিপ এঁকে দেয়া, কিংবা পায়ের তালু আর কানের লতিতে হাঁড়ির নিচের কালি লেপটে দেয়া, এই রীতিগুলো দেশের বিভিন্ন জায়গায় চালু আছে। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের যুগেও অনেকের গলায় বা হাতে দেখা যায় কালো ঘুনশিতে বাঁধা প্রমাণ সাইজের তাবিজ। এই যে মানুষের তাবিজ, মাদুলি আর রক্ষাকবচের উপর প্রবল বিশ্বাস, তা কি আজকের কথা? নাকি এই দুর্বলতা তাদের সবসময়েই ছিল? থাকলেও কত আগে?
চলুন‚ আজ প্রবেশ করা যাক মিশর দেশের এমন এক অধ্যায়ে‚ যা হয়তো দেবে চিন্তার কিছু খোরাক‚ অথবা জানাবে অভিশাপ আর রক্ষাকবচের প্রাচীন এক ইতিহাস।
স্ক্যারাব নামের গুবরে পোকা
হলিউডের বিখ্যাত The Mummy (১৯৯৯) সিনেমাটির কথা মনে আছে তো? মিশরের এক অভিশপ্ত পুরোহিতের মমি নিয়ে শুরু হয়েছিল যার কাহিনী, সেখানে বেশ কয়েকটি জায়গায় দেখানো হয় কালো রঙের শত শত গুবরে পোকা। একটি দৃশ্য তো রীতিমত বীভৎস, এক অনাকাঙ্ক্ষিত আগন্তুকের সমস্ত শরীরের ভেতর ঢুকে পড়ে এই গুবরে পোকারা। সিনেমায় এই পোকার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলা না হলেও, এদের সঙ্গে কিন্তু জড়িয়ে আছে মিশরের এক আশ্চর্য ইতিহাস।
ছয়-পেয়ে শক্ত খোলসের এই পোকাগুলো প্রায় ৬,০০০ এরও বেশি সংখ্যক প্রজাতির হয়ে থাকে। তার মাঝে ৪ ইঞ্চি লম্বা গোলিয়াথ বিটল থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রতম গুবরে পোকাও আছে। ছোট্ট এই গুবরে পোকাকে বলে স্ক্যারাব, ল্যাটিন শব্দ scarabaeus থেকে যার উৎপত্তি। চকচকে এই প্রাণীটির উল্লেখ পাওয়া যায় আদি মিশরের প্রায় প্রতিটি হায়ারোগ্লিফ, পুরাকীর্তি আর ভাস্কর্যে। অলঙ্কার, সীলমোহর ইত্যাদিতে পাওয়া যায় স্ক্যারাবের প্রতিকৃতি। তবে স্ক্যারাবের অলঙ্করণ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছিল বিভিন্ন ধরনের রক্ষাকবচ আর পবিত্র নিদর্শনগুলোতে।
স্বর্ণ, পান্না, ল্যাপিস ল্যাজুলি বা নীলা, টার্কোয়েজ বা নীলকান্তমণি ছাড়াও আরো অনেক মূল্যবান পাথর ও ধাতু দিয়ে স্ক্যারাবের আকৃতি তৈরি করতো মিশরীয়রা। ফারাওদের কবরের গায়ে খোদাই করে রাখা হতো এই ক্ষুদ্র পোকাটিকে। এমনকি উচ্চবংশীয়রা মূল্যবান পাথরের তৈরি এক বা একাধিক স্ক্যারাব সবসময় নিজেদের সাথে বহন করতেন, অথবা অলঙ্কার হিসেবে পরিধান করতেন, কেননা এটি তাদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে বলে তারা মনে করতেন। এতক্ষণে নিশ্চয়ই মনে প্রশ্ন জেগে গেছে, এত কিছু থাকতে একটা গুবরে পোকার মাহাত্ম্য কেন এত বেশি?
সূর্যদেবতার চিহ্ন স্ক্যারাব
ছোট এই গুবরে পোকা আসলে মিশরীয়দের অন্যতম প্রধান দেবতা ‘রা’ এর প্রতীক। রা এর পরিচয় বলে দিতে হবে? শক্তিশালী সূর্যদেবতা রা কে কে না চেনে?
কিন্তু রা এর সঙ্গে স্ক্যারাবের সম্পর্ক ঠিক কোথা থেকে এলো? রা হলেন সূর্যের দেবতা, আর স্ক্যারাব হলো মামুলি এক পোকা, ঠিক খাপ খায় না বলা চলে। চলুন জেনে নেয়া যাক অদ্ভুত এক ইতিহাস। সূর্যের দেবতা রা এর ছিল তিনটি রূপ। প্রথম রূপের নাম খেপরি, ঊষার দেবতা হিসেবে আগমন করতেন তিনি। দ্বিতীয় রূপটি রা স্বয়ং, দিনের দেবতা। সর্বশেষ রূপ ছিল সন্ধ্যের দেবতা হিসেবে, নাম আতুম। মিশরের আদিম অধিবাসীরা স্ক্যারাবকে ঊষার দেবতা খেপরির পবিত্র একটি প্রতীক হিসেবে সম্মান করতো।
খেপরির সূর্যোদয় আর স্ক্যারাবের ডিম পাড়া!
খেপরির সাথে তারা পেয়েছিল স্ক্যারাবের আশ্চর্য এক মিল। স্ক্যারাব, বা গুবরে পোকারা ডিম পাড়ার সময় হলে একটা অদ্ভুত কাজ করে। তারা গোবরের ভেতরে ছোট ছোট ডিম পেড়ে রাখে‚ এরপর উলের বলের মতো সুনিপুণভাবে গুটি পাকিয়ে রাখে। ছোট গোবরের বলগুলোকে তারা পা দিয়ে ঠেলে মাটিতে গড়িয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো‚ ঊষার দেবতা খেপরি বিগত রাতের সূর্যের মৃত্যুর পর প্রতিদিন সকালে বৃত্তাকার নতুন সূর্যকে আকাশের গায়ে গড়িয়ে নিয়ে আসেন। আর এভাবেই নতুন দিনের সূচনা হয়। এর সঙ্গে স্ক্যারাবের ডিম গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার সাদৃশ্য রয়েছে। খেপরি যেমন নতুন দিনের আগমনী নিয়ে আসেন‚ স্ক্যারাব তেমনি নিজের উত্তরসূরীকে বয়ে নিয়ে যায়।
উল্লেখিত ব্যাপারটা ছাড়াও সম্ভবত আরও কিছু ছিল‚ যা স্ক্যারাবের অলৌকিকতা সম্পর্কে মিশরীয়দের মনে বিশ্বাস জন্মিয়েছিল। হয়তো গোবরের গুটির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা বাচ্চা স্ক্যারাবদের দেখে তাদের জীবনচক্র নিয়ে অন্যরকম একটি ধারণা হয়েছিল তাদের। কিংবা এমনও হতে পারে যে‚ আসলে এর সঙ্গে অলৌকিকতার কোনো সম্পর্কই নেই!
পরকালের শাস্তি লাঘব
স্ক্যারাবের রক্ষাকবজ কিন্তু মিশরীয়দের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল‚ যতটা না ইহকালের জন্য, তারচেয়েও বেশি পরকালের জন্য। ফারাওদের মমির সঙ্গে দেওয়া স্ক্যারাব আকৃতির পরিধেয়‚ মাদুলি কিংবা কবরের গায়ে খোদাই করে রাখা স্ক্যারাবের ছবিগুলোই তার প্রমাণ। প্রায় অনেক মমির বুকের ওপরে পাওয়া গেছে একটি বিশেষ স্ক্যারাবের কবজ‚ যা হলো মানুষের হৃৎপিন্ডের আকৃতির। বলা হয়‚ মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো ইহলীলা সাঙ্গ হবার পরে মৃত্যুদেবতা মা’ত প্রত্যেকের অন্তরে থাকা পাপ আর পূণ্যের হিসাব করেন। কারো পাপের পাল্লা ভারি হলে সে পরলোকের সুখের জীবনে প্রবেশ করতে পারে না কখনোই। এই ‘হার্ট-স্ক্যারাব’ বুকের ওপর বসিয়ে দেয়া হতো এজন্যে যে‚ এটি মা’তের সামনে মৃত ব্যক্তির পূণ্যের পাল্লা ভারি করে দেবে।
তুতানখামেনের অভিশাপ
শেষ করা যাক বিখ্যাত ফারাও তুতানখামেনের মমির রহস্যময় কাহিনী দিয়ে। ফারাও তুতের মমিকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য গল্প, যার মাঝে রয়েছে কল্পনা, বাস্তব আর ইতিহাসের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। কথিত আছে, তুতানখানেমের মমিটি অভিশপ্ত এক মমি। মমিকে কেউ বিরক্ত করলেই তার জীবনে নেমে আসবে ভয়াবহ সব দুর্যোগ। ব্যাপারটি শুরু হয় লর্ড কার্নারভনের তুতানখামেনের মমিটি আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। মমি খুঁজে পাওয়ার অল্প কিছুকালের মধ্যেই, ১৯২৩ সালে কার্নারভন সামান্য একটি মশার কামড়ে জ্বর ও ইনফেকশনের দরুণ মৃত্যুবরণ করেন।
ফারাও তুতের কবর থেকে একটি পেপারওয়েট উপহার হিসেবে দেওয়া হয় স্যার ব্রুস ইংহামকে। পেপারওয়েটটি অবশ্য সাধারণ কিছু ছিল না, মমি করা একটি হাত ছিল এতে। উপহার হিসেবে অবশ্যই এমন কিছু আকর্ষণীয় নয়! তবে সেই মমি করা হাতের কব্জিতে পরা ছিল একটি স্ক্যারাব ব্রেসলেট, যাতে খোদাই করা ছিল ভয়ংকর একটি সাবধানবাণী:
“Cursed be he who moves my body. To him shall come fire, water and pestilence.”
(অভিশপ্ত সে, যে আমার দেহকে আন্দোলিত করে। নিশ্চয়ই তার উপর নেমে আসবে অগ্নি, বন্যা আর মহামারী।)
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, উপহারটি পাওয়ার পর স্যার ইংহামের বাড়িটি সম্পূর্ণভাবে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তিনি পরে বাড়িটি পুনর্নির্মাণ করেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বাড়িটি এবার সম্মুখীন হয় ভয়াবহ বন্যার। সত্যিই কি সেগুলো নিছক দুর্ঘটনা ছিল? নাকি এর পেছনে কাজ করেছিল তুতানখামেনের অভিশাপ?
ফিচার ইমেজ: Getty Image