গোপন যে ভাষাগুলো সম্পর্কে জানে খুব অল্প মানুষই

পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেদের মাঝে গোপনে যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন সময়ই মানুষ বিভিন্ন উপায় বেছে নিয়েছে। গোপন ভাষাও তেমনি একটি উপায়। এ ভাষা জানতো কিংবা এখনও জানে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ। উদ্ভূত বিশেষ কোনো পরিস্থিতির সাপেক্ষেই তারা গোপন সেই ভাষাগুলোর জন্ম দেয়। সাধারণত কোনো শব্দের সাথে অন্য শব্দাংশের সংযোজন-বিয়োজন, মূল শব্দের মাঝে শব্দাংশের স্থানান্তরের মতো কাজগুলো করেই এমনটি করা হতো।

১) পোলারি

উনিশ শতকে ব্রিটিশ নাবিকদের মাঝে যোগাযোগের ভাষা ছিলো পোলারি। তবে সময়ের সাথে সাথে এ ভাষার ব্যবহারকারী পাল্টে যায়। গত শতকের ত্রিশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত ব্রিটেনে সমকামীতা নিষিদ্ধ ছিলো। তখনকার সমকামী পুরুষেরা নিজেদের মাঝে যোগাযোগের জন্য বেছে নেয় পোলারিকে।

Source: The Independent

গোপন এ ভাষার সাহায্যে তারা সবার সামনেও এমনভাবে কথা বলতে পারতো যে কেউই তাদের প্রকৃতি সম্পর্কে বুঝতে পারতো না। অপরিচিত কাউকে যদি একজন সমকামী পুরুষ স্বগোত্রীয় ভাবতো, তাহলে প্রথমে ঐ লোকটির কাছে গিয়ে পোলারি ভাষায় সে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতো। যদি সেই লোকটি পোলারি ভাষাতে উত্তর দিতো, তাহলে শুরু হতো সমকামী সেই দুই পুরুষের গল্পগুজব। আর যদি সেই লোকটি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতো, তাহলে প্রশ্নকারী সেই সমকামী লোকটি নিজের রাস্তা মাপতো।

এখন কিছু পোলারি শব্দের সাথে পরিচিত হওয়া যাক। তাদের ভাষায় ‘Sex’-কে বলা হয় ‘Trade’, আবার ‘Cottaging’ অর্থ বাথরুমে সঙ্গী খোঁজা! ‘Vada’ অর্থ কারো দিকে তাকানো, ‘Dolly eek’ বলতে বোঝায় সুন্দর চেহারা এবং ‘Chicken’ অর্থ যুবক। ‘Sharpy’, ‘Lilly Law’ কিংবা ‘Charpering Omi’ দিয়ে বোঝাতো পুলিশকে। কোনো পুরুষকে আকর্ষণীয় মনে হলে তাকে বলা হতো ‘Dish’, টেলিফোনকে বলতো ‘Polari Pipe’। ‘Polari’ মানে কী? এর অর্থ ‘কথা বলা’।

২) পিগ ল্যাটিন

ছোটরা মাঝে মাঝেই নিজেদের ভেতর মজা করার জন্য শব্দ নিয়ে খেলা করে। এমন খেলা থেকেই কালক্রমে উদ্ভব হয়েছিলো পিগ ল্যাটিন ভাষার। সেটাও আজকের কথা না, ১৮৬৯ সালে সর্বপ্রথম পিগ ল্যাটিন শব্দ ব্যবহারের কথা জানা যায়। তবে হগ ল্যাটিন, ডগ ল্যাটিন, গুজ ল্যাটিন ইত্যাদি নানা নামেও পরিচিত এ ভাষাটি।

Source: Crystal Hollenbeck

মূল ভাষা থেকে কোনো শব্দকে পিগ ল্যাটিনে রুপান্তরিত করতে বেশ কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। শব্দের শুরুতে ভাওয়েল থাকলে এর শেষে ‘way’ যোগ হবে। যেমন- ‘Amazing’ শব্দটি পিগ ল্যাটিনে হয়ে যায় ‘Amazingway’। কোনো শব্দ যদি কনসোনেন্ট দিয়ে শুরু হয় এবং এরপর ভাওয়েল থাকে, তাহলে সেই কনসোনেন্ট চলে যাবে শব্দের একেবারে শেষে। আর সেই কনসোনেন্টের পর যোগ হবে ‘ay’। যেমন- ‘Laptop’ শব্দটির পিগ ল্যাটিন রুপ হলো ‘aptoplay’। যদি দুটো কনসোনেন্ট দিয়ে শুরু হয়, তাহলে দুটোই চলে যাবে শব্দের শেষে। আগের মতো এবারো শেষে আসবে ‘ay’। যেমন- ‘Smart’ তাহলে পিগ ল্যাটিনে হয়ে যাবে ‘artsmay’।

আচ্ছা, ‘Roar’ তাহলে পিগ ল্যাটিনে কী হবে বলুন তো?

৩) লীট

ইন্টারনেটের রাজ্যে ঘোরাঘুরি করা মানুষগুলো কখনো না কখনো লীট নামক ভাষার ব্যবহার দেখেছে। এখানে একটি শব্দের প্রতিটি বর্ণকে অন্য কোনো এক বা একাধিক সংখ্যা বা প্রতীক দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়ে থাকে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন সেই সংখ্যা বা প্রতীক যেন মূল বর্ণের কাছাকাছি হয়, চাইলে কিছু বর্ণকে অবিকৃতও রাখা যেতে পারে। যেমন- ‘Laptop’ কে লীট ভাষায় ‘|_@4-|-04’ এভাবে লেখা যায়। এটা সম্পূর্ণ আপনার ইচ্ছা। এখানে ‘|_ = L’, ‘@ = a’, ‘4 = p’, ‘-|- = t’ এবং ‘0 = o’।

Source: hksilicon.com

গত শতকের আশির দশকে এক হ্যাকার গ্রুপের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় লীটের। নিজেদের দলের সদস্যদের মাঝে গোপনে যোগাযোগের জন্য লিখিত এ ভাষা ব্যবহার করতো তারা। তবে চেষ্টা করলে একজন সাধারণ মানুষও এটা পড়তে পারবে। কম্পিউটার লীট পড়তে পারে না। এজন্য স্প্যাম ফিল্টারকে এড়াতে স্প্যামাররা একে ইমেইলে যোগ করে দেয়। অনেকে আবার নিজেদের পাসওয়ার্ডকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দিতে এ লীট ভাষার আশ্রয় নিয়ে থাকেন।

পাঠক, ‘Roar Bangla’ কে লীটে কীভাবে লেখা যায় সেটা জানাতে পারেন?

৪) সোয়ার্ডস্পিক

আজকের তালিকার একেবারে প্রথমে উল্লেখ করা পোলারি ভাষার মতো সোয়ার্ডস্পিকের ব্যবহারকারীও ছিলো সমকামী পুরুষেরা। তবে এক্ষেত্রে দেশটি পাল্টে গিয়ে হয়েছে ফিলিপাইন। গে লিঙ্গো কিংবা গে স্পীক নামেও পরিচিত এ ভাষাটি।

Source: Lonely Planet

সমাজের সবার চোখ এড়িয়ে নিজেদের মাঝে নির্বিঘ্নে যোগাযোগ রক্ষার্থে সোয়ার্ডস্পিককে বেছে নিয়েছিলো ফিলিপাইনের সমকামী পুরুষ সমাজ। ইংরেজি, জাপানী, স্প্যানিশ ও ফিলিপাইনের বেশ কিছু আঞ্চলিক শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে এ ভাষাটি। ফিলিপাইনের আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মাঝে রয়েছে টাগালগ, কেবুয়ানো, ওয়ারা, বিকোলানো এবং হিলিগেনন। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ব্র্যান্ড, রাজনীতিবিদ ও তারকাদের নামও নিজেদের মতো করে রুপান্তরিত করে নিজেদের ভাষায় ব্যবহার করতো সোয়ার্ডস্পিকভাষী সমকামীরা।

এ লেখায় উল্লেখ করা আগের তিনটি ভাষায় সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনের কথা উল্লেখ থাকলেও এসব থেকে মুক্ত সোয়ার্ডস্পিক। এমনকি এলাকাভেদেও পাল্টে যায় একই শব্দের রুপান্তরের নিয়ম। কেউ সুবিধামতো যেমন শব্দাংশ যোগ করে, তেমনি কেউ ইচ্ছে হলে শব্দের কিছু অংশ বাদ দেয়।

৫) থিভ্‌স ক্যান্ট

এবার একটু অপরাধীদের জগত থেকে ঘুরে আসা যাক। থিভ্‌স ক্যান্ট, রোগ্‌স ক্যান্ট, পেড্‌লার্স ক্যান্ট প্রভৃতি নামে পরিচিত এ ভাষাটি বিভিন্ন ইংরেজিভাষী দেশের চোরেরা নিজেদের মাঝে গোপনে যোগাযোগ করতে ব্যবহার করতো। সাম্প্রতিক সময়ে এ ভাষার ব্যবহার প্রায় বিলুপ্তির পথে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কিছু অপরাধী চক্রের সদস্যরা এখনও এটি ব্যবহার করে থাকে।

Source: keithnicolas.wordpress.com

থিভ্‌স ক্যান্ট মূলত দু’রকমের হয়ে থাকে- সিম্পল থিভ্‌স ক্যান্ট এবং অ্যাডভান্সড থিভ্‌স ক্যান্ট। এ দুয়ের মাঝে অবশ্য প্রথমটির জনপ্রিয়তাই সবচেয়ে বেশি। অপরাধ জগতে নতুন আসা লোকজন, সমাজের নিম্নশ্রেণীর সদস্য এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই ছিলো মূলত সিম্পল থিভ্‌স ক্যান্টের ব্যবহারকারী। অন্যদিকে খুব বড় মাপের অপরাধীরাই কেবল অ্যাডভান্সড থিভ্‌স ক্যান্ট ব্যবহার করতো। এ ভাষাটি এতটাই গোপনীয় ছিলো যে খোদ সিম্পল থিভ্‌স ক্যান্টের ব্যবহারকারীদের অনেকে অ্যাডভান্স সংস্করণটির অস্তিত্ব সম্পর্কেই অন্ধকারে ছিলো। অবশ্য এর পেছনে কারণও ছিলো। অ্যাডভান্সড ভার্সনটি খুব কমই লেখা হতো, ভাষা হিসেবে এর ব্যবহারও ছিলো বেশ সীমিত। বেশ অভিজ্ঞ লোকদের কাছেই কেবল এ সম্পর্কে জ্ঞান নেয়া যেত।

সিম্পল থিভ্‌স ক্যান্টে একজন অপরাধীকে বলা হতো ‘Pigeon plucker’, অন্যদিকে অপরাধের শিকার হওয়া একজন ব্যক্তিকে তারা বলতো ‘Pigeon’। অর্থ জালিয়াতির নামটাও ছিলো বেশ চমৎকার- ‘Drawing the king’s picture’। অ্যাডভান্সড থিভ্‌স ক্যান্টে মরুভূমিকে ‘akbun’, ডায়মন্ডকে ‘urtel’, ফার্মকে ‘narak’, খাবারকে ‘safe’ এবং হ্যালোকে ‘syetonta’ বলা হয়।

আপনাদের যদি থিভ্‌স ক্যান্ট ভাষা সম্পর্কে আরো জানার আগ্রহ থাকে তাহলে এই লিঙ্কে সিম্পল থিভ্‌স ক্যান্ট এবং এই লিঙ্কে অ্যাডভান্সড থিভ্‌স ক্যান্ট ভাষা সম্পর্কে আরো জানতে পারবেন।

৬) লুনফার্দো

আর্জেন্টিনার বন্দীরা নিজেদের মাঝে গোপনে যোগাযোগের জন্য লুনফার্দো নামক এ ভাষাটি ব্যবহার করে থাকে। অবশ্য এর যাত্রা শুরু হয়েছিলো বুয়েন্স আয়ার্সের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষদের হাত ধরেই। এ ভাষাটি মূলত স্প্যানিশ ও ইতালিয়ান ভাষা থেকে শব্দ নিয়ে গড়ে উঠেছে। আনুমানিক পাঁচ হাজারেরও বেশি শব্দ আছে এ ভাষায়। ইন্টারনেটে ইংলিশ-লুনফার্দো ডিকশনারী বা কনভার্টার না থাকলেও রয়েছে স্প্যানিশ-লুনফার্দো ডিকশনারী। এখান থেকে চাইলে সেই সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে পারেন, যদি আপনার স্প্যানিশ ভাষা জানা থাকে।

ফিচার ইমেজ- Linkedin

Related Articles

Exit mobile version