১৯ মে, ১৮৪৫। ইংল্যান্ডের গ্রিনহিথ থেকে উত্তর মেরুর উদ্দেশ্যে সমুদ্রে ভাসল ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির দুটি জাহাজ- এইচএমএস টেরর ও এইচএমএস ইরেবাস। লক্ষ্য কিংবদন্তীর নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ খুঁজে বের করা, যা কিনা উত্তর মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরকে সংযুক্ত করেছে। অভিযানের নেতৃত্বে আছেন পোড় খাওয়া মেরু অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন ফ্র্যাঙ্কলিন। অফিসার, নাবিক এবং ক্যাপ্টেন ফ্র্যাঙ্কলিনসহ ১২৯ জনের বিশাল দলের জাহাজগুলোতে তিন বছরের প্রয়োজনীয় রসদসামগ্রী সহ ছিল প্রয়োজনীয় গোলা-বারুদও, যাতে পথে যুদ্ধ বাঁধলেও তারা উত্তর মেরুতে পৌঁছুতে পারে। শেষবার ফ্র্যাঙ্কলিনের নৌ-বহর দেখা গিয়েছিল ১৯৪৫ সালের জুলাইয়ের শেষদিকে, বাফিন উপসাগরে। তারপর স্রেফ গায়েব হয়ে যায় জাহাজ আর জাহাজের এতগুলো লোকজন। একদম লাপাত্তা, কোনো খোঁজই মেলেনি তাদের।
কী ঘটেছিল স্যার ফ্যাঙ্কলিন আর তার নাবিকদের কপালে? তারা কি পেরেছিলেন নর্থওয়েস্ট সমুদ্রপথ আবিস্কার করতে? গত ১৭০ বছর ধরে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছেন অভিযাত্রী, ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্বিকগণ।
স্যার ফ্র্যাঙ্কলিনের হারানো জাহাজের সন্ধানে বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা হয়েছে কানাডার মেরু সাগরের আনাচে কানাচে। এত বছরের এত খোঁজ কি পেরেছে হারিয়ে যাওয়া সেই অভিযানের রহস্য উদঘাটন করতে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই আজকের লেখাটি।
প্রায় দু’বছর হয়ে গেল ফ্যাঙ্কলিনের কোনো খোঁজ নেই। ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন লেডি ফ্র্যাঙ্কলিন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রভাবশালী সদস্য লেডি ফ্র্যাঙ্কলিন ব্রিটিশ এডমিরালকে চাপ দিতে শুরু করলেন ফ্র্যাঙ্কলিনের খোঁজে কোনো সন্ধানী দল পাঠাতে। ফলে ১৮৪৮ সালের বসন্তে স্যার জন রো-এর নেতৃত্বে স্থলপথে একটি দল পাঠানো হয়। স্যার রো ম্যাকেনজি নদীর পাড় ধরে এগিয়ে চলেন কানাডীয় আর্কটিক উপকূলের দিকে। কানাডীয় মেরু আদিবাসীদের কাছে তিনি শুনতে পান এক শ্বেতাঙ্গের অনাহারে মৃত্যুর কথা। ধারণা করা হয়, শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোকই ছিলেন ফ্র্যাঙ্কলিন।
জলপথেও পরিচালিত হয় দুটি অভিযান। ফ্র্যাঙ্কলিনের হারানো জাহাজ খুঁজে পেতে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। ততদিনে ফ্র্যাঙ্কলিনের হারানো অভিযান মানুষের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। নানা ধারণা-অপধারণার সাথে সাথে সাহিত্যও রচিত হয় এটা নিয়ে। ‘লেডি ফ্র্যাঙ্কলিনের বিলাপ’ নামের শোকগাঁথা তার মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল। তারপর একের পর এক নানা প্রমাণ পাওয়া যেতে থাকে ফ্র্যাঙ্কলিনের হারানো অভিযান সম্পর্কে।
অভিযানের প্রথম ধ্বংসাবশেষটি পাওয়া যায় ১৮৫০ সালে। সেবার এগারোটি ব্রিটিশ ও দুটি মার্কিন জাহাজ যাত্রা করে মেরু সাগরে। তারা বিচি আইল্যান্ডের (Beechy Island) পূর্ব উপকূলে দেখতে পায় ১৮৪৫-৪৬ সালে স্থাপিত একটি শীতকালীন ক্যাম্পের চিহ্ন। আর ফ্র্যাঙ্কলিনের দলের তিন নাবিক জন টরিংটন, জন হার্টনেল আর উইলিয়াম ব্রেইনির কবর পাওয়া যায় সেখানে।
এরপর তারা বেশ কয়েকটি জাহাজ দেখতে পায়। নিউফাউন্ডল্যান্ডের কাছাকাছি দুটি জাহাজ বরফখণ্ডে আটকা পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেগুলোকে টেরর আর ইরেবাস বলে ভুল করে তারা। পরে জানা যায়, ওগুলো আসলে তিমি শিকারীদের কোনো পরিত্যক্ত জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ছিল। পরে আর্কটিক অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে মানুষের কিছু হাড়গোড় পাওয়া যায়।
ফ্র্যাঙ্কলিনের দলের কোনো এক নাবিকের খুঁজে পাওয়া ডায়েরি থেকে জানা যায়, ১৮৪৮ সালের এপ্রিলে জাহাজটি জনশূন্য হয়ে পড়ে। যে কজন বেঁচে ছিল, তারা পায়ে হেঁটে পাড়ি জমায় উপকূলের দিকে।
কিন্তু কেন মারা গিয়েছিল নাবিকেরা? কানাডিয়ান মেরু অঞ্চলের আদিবাসী প্রত্যক্ষ্যদর্শী এবং অভিযানের প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ থেকে ধারণা করা হয়, তীব্র ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে নাবিকেরা একে অন্যকে হত্যা করে নরমাংস ভক্ষণ করা শুরু করার কারণে তাদের করুণ মৃত্যু ঘটে।
১৯৮০’র দশকে বিচি আইল্যান্ডে পাওয়া মৃতদেহ গবেষণা করে তাদের হাড়ে বিপুল পরিমাণ সীসার নিদর্শন পাওয়া যায়। এ থেকে ধারণা করা হয়, নাবিকদের টিনজাত খাবারে সীসার দূষণ ঘটেছিল অথবা তাদের সরবরাহকৃত পানিতে কোনোভাবে সীসা মিশে গিয়েছিল। শুধুমাত্র সীসার দূষণে এত নাবিক মারা গিয়েছিল, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাই ধারণা করা হয়, স্কার্ভি এবং নিউমোনিয়ার ব্যাপক প্রকোপে প্রাণ হারায় তারা। জনমানবহীন মেরু প্রান্তরে এই রোগগুলো তাদেরকে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ ও অসুস্থ করে ফেলেছিল।
নতুন এক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, নাবিকদের মৃত্যুর জন্য জিঙ্কও দায়ী ছিল। কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার একদল গবেষক মৃত নাবিক জন হার্টনেলের পায়ের বুড়ো আঙু্ল পর্যবেক্ষণ করে জানতে পারেন, হার্টনেলের আঙুলে পাওয়া সীসার মাত্রা প্রাপ্তবয়স্ক কোনো ব্যক্তির জন্য স্বাভাবিক। তবে তার শরীরে সীসার পরিমাণ নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায় মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে। অতিরিক্ত সীসার প্রভাবে তার হাড় ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছিল এবং তার সমস্ত শরীরে সীসা ছড়িয়ে গিয়েছিল, যা তাকে টেনে নিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে ।
গবেষণায় আরও জানা যায়, সম্ভবত হার্টনেলের শরীরে জিংকের দীর্ঘকালীন অভাব ঘটেছিল তার খাবারে মাংসের স্বল্পতার কারণে। জিংকের অভাবে তার আবেগীয় বিপর্যয় ঘটে, তিনি ডিপ্রেশনে ভুগতে শুরু করেন। পরবর্তীতে জিংক স্বল্পতা তাকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত করে, যা তার অনাক্রম্য ব্যবস্থাকে বিগড়ে দিয়েছিল। ফলে সে যক্ষা ও নিউমোনিয়ার সহজ শিকারে পরিণত হয় এবং পরিশেষে মৃত্যুর শীতল গর্ভে হারিয়ে যায়।
হার্টনেলের পরিণতি নির্দেশ করে, তার সহচর নাবিকদের ভাগ্যেও একই ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর ‘Victoria strait expedition’ এর ব্যানারে ব্যাপক পরিসরে কানাডার একটি দল গবেষণা চালায়। তারা কুইন মড উপসাগরে কিং উইলিয়াম আইল্যান্ডের কাছে হ্যাট আইল্যান্ডে দুটি জিনিস খুঁজে পায়- একটি কাঠের প্লাগ আর একটি লোহার পাইপ।
তারপর ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তারা ঘোষণা দেয়, ফ্র্যাঙ্কলিনের দুটি জাহাজের একটি তারা খু্ঁজে পেয়েছে। জাহাজটি খুব ভালো অবস্থায় ছিল। সেটি পাওয়া যায় কুইন মড উপসাগরের উত্তরে অবস্থিত ও’রেইলি দ্বীপের পশ্চিম অংশে। ২০১৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আর্কটিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অনুসন্ধিৎসু দল নিশ্চিত করে, তারা টেরর উপসাগরে কিং উইলিয়াম আইল্যান্ডের দক্ষিণে এইচএমএস টেররের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছে। আর নাবিকদের ডায়েরি থেকে জানা যায়, ফ্র্যাঙ্কলিন ১৯৪৮ সালে জাহাজ পরিত্যক্ত হওয়ার আগেই মারা যান। এটি ছিল ফ্র্যাঙ্কলিনের চতুর্থ মেরু অভিযান।
ফ্র্যাঙ্কলিনের হারানো জাহাজ খুঁজে বের করার জন্য পরিচালিত অভিযান ছিল সামুদ্রিক অভিযানের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ এবং ব্যয়বহুল অভিযান। শত শত অভিযান ফ্র্যাঙ্কলিনের করুণ ভাগ্য জানাতে পারলেও, মূল উপকারটা সাধিত হয় ভূতাত্ত্বিক জ্ঞানের জগতে। আর্কটিক উপকূল সম্পর্কে অজানা অনেক তথ্য জানা যায় এসব অভিযানে।
ফ্র্যাঙ্কলিনের মেরুতে মৃত্যু বৃথা যায়নি। তার দলবলের উধাও হওয়ার বহু বছর পর তৎকালীন ভিক্টোরিয়ান মিডিয়া স্যার ফ্র্যাঙ্কলিনকে নর্থওয়েস্ট প্যাসেজের আবিষ্কারক হিসেবে বীরের মর্যাদায় ভূষিত করে। যদিও প্রকৃতপক্ষে নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ আবিস্কার করেছিলেন স্যার রো। ফ্র্যাঙ্কলিনের জন্মশহরে তার প্রতিকৃতি স্থাপন করে তাকে সম্মানিত করা হয়। তার অভিযান নিয়ে অনেক টেলিভিশন অনুষ্ঠান, ট্রাভেল ডকুমেন্টারি, নাটক প্রভৃতি নির্মিত হয়। ফ্র্যাঙ্কলিনের নামে কানাডায় একটি জেলাও রয়েছে।
ফ্র্যাঙ্কলিনের অভিযানের অনুপ্রেরণায় রচিত হয়েছে অসংখ্য সাহিত্যকর্ম, যেগুলোর রচিয়তা ছিলেন সেই সময়ের বাঘা বাঘা সব সাহিত্যিক। ফ্র্যাঙ্কলিনের কাহিনী নিয়ে প্রথম রচিত নাটকটির নাট্যকার ছিলেন উইকি কলিনস। আর তার সহযোগী ছিলেন স্বয়ং চার্লস ডিকেন্স। ফ্র্যাঙ্কলিনের অভিযানের গল্পকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে প্রথম উপস্থাপন করেন জুল ভার্ন তার এডভেঞ্চার অব ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস বইতে। বইটিতে গল্পের নায়ক ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস স্যার ফ্র্যাঙ্কলিনের পদচিহ্ন অনুসরণ করে উত্তর মেরু আবিষ্কার করেন। মার্ক টোয়েন ফ্র্যাঙ্কলিনের অভিযান এবং ফ্র্যাঙ্কলিনের খোঁজে অভিযানগুলোকে কিছুটা ব্যাঙ্গাত্মক রুপে বলেছেন তার বই, ‘Some Learned Fables for Good Boys and Girls‘-এ।
সাম্প্রতিককালে ফ্র্যাঙ্কলিনের খোঁজ নিয়ে পল ওয়াটসনের রচিত বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থ ‘The Ice Ghost: Epic Hunt on Franklin’s lost Expedition‘ উল্লেখযোগ্য।
সম্প্রতি লন্ডনের গ্রিনউইচে অবস্থিত মেরিটাইম মিউজিয়ামে স্যার ফ্র্যাঙ্কলিনের মেরুতে বিপর্যয়ের কাহিনী বিভিন্ন অভিযাত্রী এবং ঐতিহাসিকের উক্তি, বর্ণনা, বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ এবং সম্পর্কিত আবিস্কারগুলোকে একসাথে করে গল্পটিকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করে তাদের সংগ্রহে স্থান দিয়েছে। প্রদর্শনীটির নাম দেওয়া হয়েছে, ‘Death in the Ice: The Shocking Story of Franklin’s Final Expedition’। এ লেখার শিরোনাম সেই প্রদর্শনীর শিরোনাম থেকেই নেয়া হয়েছে।