এসএস সুলতানা ট্রাজেডি: আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নৌ-দুর্ঘটনা

বন্দীশিবিরে আটকে থাকতে থাকতে একসময় জীবনের প্রতি সমস্ত আশা হারিয়ে ফেলেছিলেন ইউনিয়নের সৈনিকরা। সেখানে এমন খাবার দেয়া হতো যেগুলো শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে খেতে হয়, কোন স্বাদ-পুষ্টি নেই। এসব ছাইপাশ খেয়ে দিন দিন শরীর আরও দুর্বল হয়। দীর্ঘদিন এক কাপড় পরে থাকার কারণে সেগুলোর উপর কয়েক স্তরের তেল চিটচিটে ময়লা জমেছে, সেগুলো খুলে ফেলে নতুন কিংবা ধোয়া কাপড় পরারও সুযোগ নেই। বাইরের আলো-বাতাসে সময় কাটানোরও সুযোগ দিত না শত্রুরা, জীবনীশক্তি দিন দিন কমে আসছিল। প্রতিটি দিন যায়, বন্দীরা বাড়ি ফেরার স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার কোনো সুযোগ তাদের সামনে প্রতীয়মান হয় না। ইউনিয়নের সৈনিকেরা বাড়ির কথা মনে করে নস্টালজিয়ায় ডুবে যান, কিন্তু বাস্তবতা যখন মনের কোণে উঁকি দেয় তখন মৃত্যুর প্রহর গোণা ছাড়া উপায় থাকে না।

জতজগপগপব
কনফেডারেটদের হাতে আটকে থাকা কিছু হতভাগ্য ইউনিয়ন সৈন্য; image source: amazon.com

বন্দীশিবিরে আটকে থাকা সেনাদের অনেকেই ছিল একেবারে অল্পবয়সী তরুণ, যাদের যুদ্ধে যাওয়ার মতো বয়স হয়নি। কিন্তু দেশের স্বার্থে, আমেরিকার ঐক্য বজায় রাখবার সংকল্প নিয়ে তারা যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। যুদ্ধে নেয়ার জন্য যখন সরকারি লোকেরা যখন যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য লাইনে দাঁড় করায় তখন অনেকে আঙুলে ভর দিয়েছিল যাতে একটু উঁচু দেখায়, কেউ আবার বয়স লুকিয়েছিল। সামনে পুরো জীবনটা পড়ে আছে, চাইলেই যুদ্ধে না গিয়ে পরিবারের সাথে সময় কাটিয়ে দেয়া যায়– এসব মাথায় আনেনি সেই তরুণেরা। তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে বাড়িতে ফিরে পরিবারের সদস্যদের দুঃসাহসিক অভিযানের গল্পগুলো শোনাবে, তারা রোমাঞ্চিত হবে। কিন্তু কে জানতো, এই অভিশপ্ত যুদ্ধে শত্রুর হাতে বন্দী হয়ে বন্দিশালায় অমানবিক জীবনযাপনে বাধ্য হবে তারা?

আমেরিকার গৃহযুদ্ধে পক্ষ ছিল দুটি। দক্ষিণের প্রদেশগুলো আমেরিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা স্বাধীন দেশ গঠন করতে চেয়েছিল। এদেরকে বলা হয় ‘কনফেডারেট’। দক্ষিণের সেনাবাহিনীর অনেক নেতা ছিল বিশাল পরিমাণ জমির মালিক, যেগুলোতে চাইলেই দাসদের মাধ্যমে আবাদ করিয়ে বিশাল মুনাফা অর্জন করা যেত। তারা দাসপ্রথা বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। আর উত্তরের সেনাবাহিনী বা ‘ইউনিয়ন’ সেনাবাহিনী গঠিত হয়েছিল প্রায় সবধরনের মানুষ নিয়ে, সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ সেনাদের পাশাপাশি শ্বেতাঙ্গরাও ছিলেন, স্থানীয় জনগণের পাশাপাশি বাইরে থেকে অভিবাসী হিসেবে যাওয়া মানুষেরাও ছিলেন, দাসরাও ছিলেন সাথে মনিবেরাও ছিলেন। তারা অভিশপ্ত দাসপ্রথামুক্ত একটি অখন্ড আমেরিকার স্বপ্ন দেখতেন। তারা মনে করতেন, দক্ষিণের প্রদেশগুলো আমেরিকার সাথে বেইমানি করছে, তাদের দায়িত্ব যেকোনো মূল্যে আমেরিকার জাতীয় ঐক্য টিকিয়ে রাখা।

হডওতওগপ
আমেরিকার গৃহযুদ্ধে ইউনিয়নের সৈনিকেরা আমেরিকার ঐক্য টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন; image source: skyminds.net

ইউনিয়নের অনেক সৈন্যকে আটক করেছিল কনফেডারেট সেনাবাহিনী, যাদেরকে পরবর্তীতে বন্দিশিবিরে নিয়ে আসা হয়। আলাবামা, জর্জিয়া ও মিসিসিপির বন্দীশিবিরগুলোর দুর্দশার কথা আগেই বলা হয়েছে। পর্যাপ্ত খাবার নেই, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা নেই, মুক্তি নেই। ১৮৬৫ সালে যখন গৃহযুদ্ধ শেষ হয়, তখন ইউনিয়ন ও কনফেডারেট– দু’পক্ষই যুদ্ধবন্দীদের নিঃশর্তভাবে ছেড়ে দিতে সম্মত হয়। মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকা ইউনিয়নের বন্দী সৈনিকদের জন্য এটি ছিল বিশাল সুখবর। তারা বাড়ি ফেরার স্বপ্নে পুনরায় বিভোর হয়ে ওঠে। দক্ষিণ প্রদেশগুলো থেকে উত্তরের প্রদেশগুলো আসতে হলে বিশাল নদীপথ পাড়ি দিতে হতো। স্থলপথেও ট্রেনের মাধ্যমে উত্তরে যাওয়ার উপায় ছিল, কিন্তু যুদ্ধের কারণে প্রায় সমস্ত রেলপথ ধ্বংস হয়ে যায়, তাই একমাত্র নদীপথ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। এজন্য উত্তরের সরকার তাদের সেনাবাহিনীর বন্দী সৈনিকদের পরিবহনের জন্য ‘এসএস সুলতানা’ নামের একটি জাহাজের সাথে চুক্তি করে।

‘এসএস সুলতানা’ তখন আমেরিকার সবচেয়ে ভালো বাষ্পচালিত জাহাজগুলোর একটি। ক্রুসহ প্রায় ৩৭৫ জন যাত্রী এই জাহাজে উঠতে পারতো। সেই সময়ের বাস্তবতা বিবেচনা করলে এই সংখ্যাটি ছিল অনেক বড়। উত্তরের ইউনিয়ন সরকার প্রতি অফিসারের জন্য দশ ডলার ও সাধারণ সৈন্যের জন্য পাঁচ ডলার দিতে রাজি হয়েছিল। জাহাজের মালিকের পক্ষে এত লোভনীয় প্রস্তাব গ্রহণ না করে উপায় ছিল না। আলাবামা, জর্জিয়া ও মিসিসিপি থেকে বন্দীদের ভিক্সবার্গ নামের একটি জায়গায় নিয়ে এসে জড়ো করা হয়, যেখানে নদীবন্দর ছিল। বন্দীশিবির থেকে মুক্ত সৈন্যরা জাহাজের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন।

হডওতপগপবক
এসএস সুলতানা ছিল সেসময়ের সবচেয়ে বড় বাষ্পচালিত যাত্রীবাহী জাহাজ; image source: npr.org

ভিক্সবার্গের নদীবন্দরে জাহাজ নোঙর করার পর এসএস সুলতানা জাহাজের ক্যাপ্টেন জেমস ক্যাস ম্যাসন বিস্মিত হয়ে যান, কারণ তিনি মনে করেছিলেন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর খুব বেশি সৈন্য হয়তো বেঁচে নেই। ভিক্সবার্গে নোঙর করার পর তার জাহাজের একটি বয়লারে সমস্যা হয়। তিনি ইঞ্জিনিয়ার ডেকে নিয়ে আসেন। জাহাজের সমস্যা খুব গুরুতর না হলেও একেবারে সহজও ছিল না। ঠিকমতো পর্যবেক্ষণ করার পর ইঞ্জিনিয়ার জাহাজ সম্পূর্ণ মেরামতের জন্য তার কাছে কয়েকদিন সময় চান, কিন্তু তিনি খুব দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য ইঞ্জিনিয়ারের উপর চাপ সৃষ্টি করেন। কারণ তার মনে ভয় ছিল হয়তো বেশি দেরি হলে মুক্তি পাওয়া সৈনিকেরা বাড়ি ফেরার জন্য বিকল্প কোনো জাহাজের ব্যবস্থা করে ফেলবে। যেহেতু তার অনুমানের চেয়ে অনেক বেশি সৈন্য ছিল, তাই বাড়তি পয়সা কামানোর জন্য সুযোগ কোনোভাবেই নষ্ট করতে চাননি। তার কথামতো অল্প সময়ের মধ্যেই ইঞ্জিনিয়ার জাহাজের বয়লারের সমস্যা সারিয়ে তোলেন।

জাহাজের ধারণক্ষমতা সব মিলিয়ে ৩৭৫ জন হলেও ক্যাপ্টেন ম্যাসন সবাইকে জাহাজে উঠতে নির্দেশ প্রদান করেন। বাড়ি ফেরার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা সৈনিকেরাও আর অপেক্ষা করতে রাজি ছিলেন না, তাই জাহাজের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী উঠার ফলে দুর্ঘটনার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, সেটি মাথায় রেখেই তারা জাহাজে উঠে যান। ৩৭৫ জন ধারণক্ষমতার জাহাজে উঠেছিল প্রায় ২,৫০০ জন! সব বাধা উপেক্ষা করে ১৮৬৫ সালের ২৪ এপ্রিল এসএস সুলতানা উত্তরের প্রদেশগুলোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। আবহাওয়া ছিল প্রতিকূল, কারণ বন্যার কারণে মিসৌরি নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি উচ্চতা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কিন্তু ক্যাপ্টেন ম্যাসন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে, সমস্ত যাত্রীসহ গন্তব্যে কোনো ঝঞ্ঝাট ছাড়াই পৌঁছাতে পারবেন তিনি। মেমফিস নামের একটি জায়গায় তিনি সাময়িক যাত্রাবিরতির ঘোষণা করেন।

জচিতওতপত
পরিমাণের চেয়ে অত্যধিক যাত্রী নেওয়া, বয়লারের যান্ত্রিক ত্রুটি ও খারাপ আবহাওয়ার জন্য রাতের বেলা জাহাজটি ডুবে যায়;
image source: allthatinteresting.com

মেমফিসে যেদিন ক্যাপ্টেন ম্যাসন যাত্রাবিরতি দিয়েছিলেন, সেদিন রাতেই তারা পুনরায় যাত্রা শুরু করেন। রাত দুটোর দিকে ক্যাপ্টেন বাদ দিয়ে সবাই যখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন, তখনই বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, ভিক্সবার্গে নোঙর করার পর যে বয়লারে লিকেজ হয়েছিল, সেটিই বিস্ফোরিত হয়। কেন্টাকি ও টেনেসি প্রদেশ থেকে আগত অনেক সৈনিক বিস্ফোরিত বয়লারের অনেক নিকটে অবস্থান করছিলেন। তারা বিস্ফোরণের প্রায় সাথে সাথেই মারা যান। অনেকে আবার বিস্ফোরণের ধাক্কায় নদীতে পড়ে যান। একটু পর বাকি দুটো বয়লারও বিস্ফোরিত হয়।

বিস্ফোরণের পর ডুবতে থাকা জাহাজে যেসব সৈনিক অবস্থান করছিলেন, তাদের হাতে দুটি পথ ছিল। হয় জাহাজে থেকে গিয়ে আগুনে পুড়ে মরা, নতুবা জাহাজ থেকে লাফ দিয়ে নদীতে নামা। উত্তাল নদীতে নেমে পড়লেও বাঁচার সম্ভাবনা ছিল খুবই ক্ষীণ, আর রাতের বেলা কিছু দেখাও যাচ্ছিল না। নদীতে লাফ দিয়ে অনেকে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ হিসেবে ভাসতে থাকা কাঠের তক্তা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলেন, অনেকে আবার সাঁতার কাটতে থাকা ঘোড়া পিঠও আঁকড়ে ধরেছিলেন। জাহাজটি যে মিসৌরি নদীর যে জায়গায় ডুবেছিল, তার আশেপাশের তীরবর্তী এলাকা ছিল কনফেডারেট বাহিনীর অধীনে। কিন্তু শত্রুতা ভুলে গিয়ে সেদিন তারা নিজেদের সাধ্যমতো ইউনিয়ন সৈনিকদের বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিলেন।

টাইটানিকের কথা আমরা সবাই জানি। প্রায় ১,৫০০ মানুষ মারা গিয়েছিল টাইটানিকের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায়। কিন্তু এসএস সুলতানা জাহাজডুবির ভয়াবহ দুঃখজনক ঘটনা আমরা অনেকেই জানি না, এমনকি খোদ আমেরিকাতেও এই ঘটনা নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। টাইটানিক নয়, আমেরিকার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় নৌ-দুর্ঘটনা হচ্ছে সুলতানা ট্রাজেডি, যাতে প্রায় ১,৮০০ মানুষ মারা গিয়েছিল। এই ঘটনা এমন সময়ে ঘটে যখন গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে, আব্রাহাম লিংকন আততায়ীর হাতে হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। আমেরিকার গণমাধ্যম তখন এসব ঘটনায় এত বেশি মনোযোগ দিয়েছিল যে, সুলতানা ট্রাজেডির মতো ঘটনা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। সুলতানা ট্রাজেডিতে সবচেয়ে দুর্ভাগা ছিল সেই সৈনিকেরা, যারা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শত্রুর বন্দীশিবির থেকে মুক্তি পাবার পরও নিজেদের এলাকায় আর ফিরে যেতে পারেনি, পরিবারের সাথে শেষ দেখাটুকুও করতে পারেনি।

Related Articles

Exit mobile version