টারজান, মুগলিদের মতো কাল্পনিক চরিত্রগুলো আমাদের অনেকের ছোটবেলাকেই এক চমৎকার রঙে রাঙিয়ে তুলেছিলো। তাদের মতো করে পশুপাখিদের সাথে চলার ইচ্ছা তখন আমাদের অনেকেরই হয়েছিলো। মজার ব্যাপার হলো, মানব ইতিহাসে এমন বেশ কিছু শিশুর সন্ধান পাওয়া যায় যাদের জীবনের সাথে কাল্পনিক সেই চরিত্রগুলোর মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। ভাগ্যের নৌকা কোনো এক ভাবে তাদেরকে পৌঁছে দিয়েছিলো বুনো জীবনের তীরে। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন সেখানে পশু সমাজে লালিত পালিত হবার পর যখন তারা সভ্য সমাজে ফিরে আসে, তখন দেখা যায় স্বাভাবিক মানুষের অধিকাংশ গুণই তাদের মাঝে অনুপস্থিত।
ইংরেজীতে এ শিশুদেরকে বলা হয় ‘Feral Child’। বাংলায় বোধহয় ‘বুনো শিশু’ শব্দযুগলই ভালো মানায়। আজ তাই সেসব বুনো শিশুদেরকে নিয়েই আলাপ করছি।
অক্সানা মালয়
মেয়েটির পুরো নাম অক্সানা অলেসান্দ্রিভ্না মালয়, জন্ম ১৯৮৩ সালের ৪ নভেম্বর ইউক্রেনের খার্সন প্রদেশের হর্নোস্তাইভ্কা জেলার নোভা ব্লাগোভিশ্চেঙ্কা গ্রামে। জন্মগতভাবে সুস্থ-স্বাভাবিক থাকলেও মেয়েটির দুর্ভাগ্য ছিলো অন্য দিকে। অক্সানার বাবা-মা ছিলো মদ্যপায়ী, তারা মেয়েটির ঠিকমতো খোঁজখবর রাখতো না। তাই কুকুরদের মাঝেই বড় হতে থাকে মেয়েটি। এখন কিভাবে যে অক্সানা কুকুরদের হাতে পড়লো তা সঠিকভাবে জানার উপায় নেই।
যখন লোকজন অক্সানার কথা জানতে পারে, ততদিনে তার বয়স হয়ে গিয়েছে সাড়ে সাত বছর। তখন সে ঠিকমতো কথা বলতে পারতো না। এছাড়াও মানুষের স্বাভাবিক গুণাবলীর আরো অনেক কিছুই তার মাঝে ছিলো অনুপস্থিত। বরং কুকুরদের সাথে থাকতে থাকতে কুকুরদের আচরণই তার মাঝে প্রকাশ পাচ্ছিলো। কুকুরের মতো চার পায়ে চলাফেরা করা (তার বেলায় দুই হাত, দুই পা), ঘেউ ঘেউ করা, মাটিতে শুয়ে থাকা, খাওয়া দাওয়া করা ও নিজেকে পরিষ্কার করতো সে।
উদ্ধারের পর মেয়েটিকে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য একটি প্রতিপালন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। সেখানে তাকে মানবসমাজে চলার জন্য দরকারি নানা শিক্ষা দেয়া হয়। পরবর্তীতে তার অবস্থার অনেক উন্নতি হয়। সে মানুষের মতোই স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলা শুরু করে। তারপরও বুদ্ধির কিছুটা সীমাবদ্ধতা ঠিকই রয়ে যায়। ২০১৩ সালে ইউক্রেনের জাতীয় টেলিভিশনে Govorit Ukraina টক-শোতে এক সাক্ষাৎকারে উপস্থিত ছিলো অক্সানা। সেখানে সে নিজের সম্পর্কে অনেক কথাই বলে। নিজেকে একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসেবেই ভাবতে চায় অক্সানা। পাশাপাশি অন্যরা যখন তাকে ‘কুকুর-বালিকা’ বলে ডাকে, তখন সে কষ্ট পায়। তার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন হলো তার সত্যিকারের মা-কে খুঁজে বের করা।
মারিনা চ্যাপম্যান
ধারণা করা হয় মারিনার জন্ম আনুমানিক ১৯৫০ সালে। তার বয়স যখন চার বছরের মতো, তখন একদল অপহরণকারী তাকে তার গ্রাম থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তারা মারিনাকে এক জঙ্গলে ফেলে রেখে চলে যায়। তারা হয়তো ভেবেছিলো জঙ্গলের প্রাণীরাই মারিনাকে শেষ করে দেবে কিংবা অনাহারে ভুগে মারা যাবে মেয়েটি। কিন্তু তাদের সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতে এগিয়ে এসেছিলো একদল কাপুচিন বানর।
পরবর্তী প্রায় পাঁচ বছর ধরে মারিনা বানরদের সাথেই থেকেছিলো। বানরদের মতো করেই খাবার খাওয়া, পানি পান করা, যোগাযোগের পদ্ধতি রপ্ত করে নিয়েছিলো সে। বানররাও তাকে বনের ভেতর দিয়ে শিকারীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলার কৌশল শিখিয়েছিলো।
শেষপর্যন্ত অবশ্য একদল শিকারীর হাতে ধরা পড়ে যায় মারিনা। তারা তাকে একটি পতিতালয়ে বিক্রি করে দিলে সেখান থেকেও কৌশলে পালিয়ে আসে সে। পরবর্তীতে আরো কিছু ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে যাবার পর ব্র্যাডফোর্ডের এক বিজ্ঞানীকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন তিনি। দুই সন্তানের জননী মারিনা তার জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে মেয়ে ভেনেসার সহায়তায় ২০১৩ সালে ‘The Girl with No Name’ নামে একটি বইও লিখেছিলেন।
ছাগলের হাতে প্রতিপালিত বালক
১৯৯০ সালে পেরুতে এক বালকের সন্ধান পাওয়া যায় যে কিনা একদল বুনো ছাগলের সাথে বাস করছিলো। ছেলেটি যে ঠিক কিভাবে ছাগলগুলোর কাছে গেলো তা আজও এক রহস্য। ছাগলের দুধ এবং বুনো ফলমূল খেয়েই বেঁচে ছিলো সে। মানুষের মতো কথা বলতে পারতো না সে। তবে ছাগপালের সাথে যোগাযোগের জন্য ঠিকই তাদের ডাক অনুকরণ করতে পারতো সে। তার হাত ও পাগুলো অস্বাভাবিক রকমের শক্ত হয়ে গিয়েছিলো। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে চার হাত-পায়ে চলাচলের ফলে তার হাড়ের গঠনও পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে তাকে কানসাসে পাঠানো হয়েছিলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য, নাম দেয়া হয়েছিলো ড্যানিয়েল।
লায়োখা
২০০৭ সালের কথা। মধ্য রাশিয়ার কালুগা অঞ্চলের একদল গ্রামবাসী জানায় যে, তারা বাইরের মারাত্মক ঠান্ডা তাপমাত্রায় এক নেকড়ের গুহায় একটি ছেলে দেখতে পেয়েছে। এমন অদ্ভুত সংবাদ পেয়ে অল্প সময়ের মাঝেই ছুটে আসে পুলিশ বাহিনী। ছেলেটিকে উদ্ধার করার পর দেখা যায় যে, সে কোনো কথা বলতে পারে না। বরং সে তাকে উদ্ধার করা পুলিশ সদস্যদের দিকে তাকিয়ে গর্জন করছিলো এবং আঁচড়ে-কামড়ে দিতে চাইছিলো।
ছেলেটিকে নিকটস্থ এক হাসপাতালে রেখে চলে যায় পুলিশ বাহিনী। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো যে, তার বয়স দশ বছরের মতো হবে। তার হাত ও পায়ের আঙুলগুলো ছিলো অনেকটা থাবার মতোই। এছাড়া ছেলেটির স্বভাবও ছিলো নেকড়েদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। হাসপাতালের কর্মচারীরা ছেলেটিকে ভালো করে গোসল করায়, তার নখগুলো কেটে দেয় এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তার রক্তের নমুনা নিয়ে রাখে। তারা ছেলেটির নাম দিয়েছিলো লায়োখা। সবার এত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়া যেন পছন্দ করতে পারছিলো না লায়োখা। তাই মাত্র চব্বিশ ঘন্টার মাঝেই হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায় সে। এরপর তার আর কোনো সন্ধান মেলে নি।
জন
জনের ঘটনাটি জানা যায় ১৬৪৪ সালে স্যার কেনেল্ম ডিগবীর মুখ থেকে। জনের বয়স যখন ৫ বছর, তখন তাদের এলাকায় এক ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হয়। তখন জান বাঁচাতে পরিবারের অন্য আরো অনেকের সাথেই পার্শ্ববর্তী এক বনে পালিয়ে যায় তারা। বিপদ কেটে গেলে অন্য সবাই তাদের বাড়িতে ফিরে গেলেও ফিরে যায় নি ছোট্ট জন, অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলো সে।
এরপর থেকে বনেই কাটাতে থাকে সে। বনের নানা ফলমূল খেয়েই বেঁচে ছিলো ছেলেটি। এভাবেই কেটে যায় ষোলটি বছর। অবশেষে একুশ বছর বয়সে মানব সমাজে ফিরে আসে সে। স্থানীয় এক খামার থেকে খাবার চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় সে। উলঙ্গ জনের সারা শরীর ছেয়ে গিয়েছিলো চুলে। ভাষার ব্যবহার একেবারেই ভুলে গিয়েছিলো সে। তখন তার ঘ্রাণশক্তিও ছিলো অস্বাভাবিক রকমের প্রখর। আস্তে আস্তে মানবসমাজে থাকতে থাকতে আবারো ভাষা রপ্ত করে নেয় সে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, যতদিনে সে মানসমাজে থাকার যোগ্য হয়ে উঠেছিলো, ততদিনে তার প্রখর ঘ্রাণশক্তি আগের থেকে অনেকটাই লোপ পেয়ে গিয়েছিলো।
পিটার
১৭২৫ সালের কথা। উত্তর জার্মানির এক বনের কাছে খুঁজে পাওয়া যায় বোবা, উলঙ্গ এক ছেলেকে। তাকে নিয়ে আসা হয় ব্রিটিশ রাজা প্রথম জর্জের কাছে। ছেলেটিকে তিনি পছন্দ করে ফেলেন। খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করে ছেলেটিকে তার দরবারে নিয়ে আসা হয়। এরপরই ছেলেটি লন্ডনের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়।
রাজকীয় অতিথিরা পিটার নামের সেই ছেলেটিকে খুব পছন্দ করতেন। বিশেষ করে তার চার হাত-পা ব্যবহার করে ছুটে বেড়ানো তাদেরকে খুব মজা দিতো। এছাড়া তার টেবিল ব্যবহার করতে না চাওয়া, পকেট মারার অভ্যাস ও রাজসভার নারীদের চুম্বন দেয়ার অভ্যাসও তাদেরকে খুব হাসাতো। পিটার কখনোই কথা বলতে পারে নি, যদিও তাকে কথা বলা শেখাতে অনেক চেষ্টা করানো হয়েছিলো। মেঝেতে ঘুমোনোই ছিলো তার অভ্যাস। একসময় তাকে গ্রামাঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৭৮৫ সালে অবশেষে মারা যায় সে।
ম্যারি-আঞ্জেলিক মেমি লা ব্ল্যাঙ্ক
১৭৩১ সালের কথা। ফ্রান্সের সঙ্গি গ্রামের অধিবাসীরা সেদিন মুগুর হাতে যুবতী এক মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলো। মেয়েটির পরনে ছিলো শতচ্ছিন্ন কাপড় এবং পশুর চামড়া। মেয়েটিকে লোকজন লোকালয়ে আনতে সক্ষম হয় অনেক কষ্টের পর। এরপর তারা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে যে, মেয়েটি শুধুমাত্র পশুদের মতোই শব্দ করতে পারে এবং খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কাচা মাংসই তার প্রিয়। বিশেষ করে কোনো প্রাণীকে মেরে তৎক্ষণাৎ তার মাংসটি খেতেই সে বেশি পছন্দ করতো।
আস্তে আস্তে লোকজনের সাথে থাকতে থাকতে মেয়েটি ফরাসী ভাষা শিখে যায়। খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করে মেয়েটির নাম রাখা হয় ম্যারি-আঞ্জেলিক মেমি লা ব্ল্যাঙ্ক। পরবর্তীতে মেয়েটির এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে, অপহরণ করে তাকে ইউরোপে ক্রীতদাস হিসেবে আনার পরই সে পালিয়ে বনে চলে গিয়েছিলো।
ভিক্টর
ভিক্টরের গল্প শুনতে আমাদের চলে যেতে হবে ১৮০০ সালের শুরুর দিকে। ফ্রান্সের এভেরনের বনাঞ্চলের কাছাকাছি এক বারো বছর বয়সী কিশোরকে ঘোরাঘুরি করতে দেখতে পেলো স্থানীয় লোকজন। উলঙ্গ ও বোবা সেই ছেলেটির সারা শরীরেই ছিলো আঁচড়ের ছড়াছড়ি। তার গায়ে কেউ স্পর্শ করলে সে তা পছন্দ করতো না। কানের পেছনে কোনো গুলির আওয়াজ হলে সে ফিরেও তাকাতো না। কিন্তু ঠিক একই দূরত্বে কোনো আখরোট ভাংলে সে সাথে সাথেই উৎসুক নয়নে তার প্রিয় খাবারটির পানে চাইতো।
জ্যঁ-মার্ক গস্পার্ড ইটার্ড নামে এক লোক বধিরদের জন্য পরিচালিত এক স্কুলে পরামর্শক হিসেবে কাজ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, চেষ্টা করলে ছেলেটিকে হয়তো ভাষা শিক্ষা দেয়া সম্ভব। তিনি কাজ শুরু করলেন ছেলেটিকে নিয়ে, নাম দিলেন ভিক্টর। ইটার্ডের প্রচেষ্টায়ই ছেলেটি কাপড় পরতে ও গোসল করতে শিখেছিলো।
দিনা সানিচার
এখন যে ছেলেটির কথা বলতে যাচ্ছি, সে অনেকের কাছে ‘নেকড়ে বালক’ হিসেবেই বেশি পরিচিত। ঘটনার সূত্রপাত ১৮৬৭ সালে ভারতের বুলন্দশহর জেলায়। একদল শিকারী অদ্ভুত একটি জন্তুকে গুহায় থাকতে দেখে সেটিকে শিকার করতে এগিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু যখন ধোঁয়ার সাহায্যে ছেলেটিকে গুহার ভেতর থেকে বের করে আনা হলো, তখন তো তাদের চক্ষু চড়কগাছ। কারণ সেটি কোনো জন্তু নয়, বরং একটি বাচ্চা ছেলে, যার বয়স আনুমানিক ৬ বছরের কাছাকাছি!
জীবনের অধিকাংশ সময় ছেলেটি বুনো পরিবেশের মধ্য দিয়েই বড় হয়েছে। হাত-পায়ের সাহায্যে ছেলেটি পশুদের মতোই ছুটে বেড়াতো, স্থান করে নিয়েছিলো নেকড়েদের একটি দলে। কিন্তু কিভাবে সে সেই স্থানে এলো তা আসলেই এক রহস্য।
শিকারীরা ছেলেটিকে নিয়ে এসেছিলো আগ্রার সিকান্দ্রা মিশন এতিমখানায়। সেখানে তার নাম দেয়া হয় দিনা সানিচার। মিশনের কর্মচারীদের শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ১৮৯৫ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত দিনা একটি কথাও বলে নি কিংবা বলতে পারে নি। হাড় কামড়াতে পছন্দ করতো সে। রান্না করা মাংসের তুলনায় কাচা মাংসই ছিলো তার অধিক পছন্দনীয়। অনেকেই মনে করে থাকে যে, রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের ‘জাঙ্গল বুক’ বইয়ের ‘মুগলি’ চরিত্রটি আসলে দিনা থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে লেখা।