বিজ্ঞানের অভাবনীয় সব আবিষ্কার আমাদের রোজকার জীবনে পরিবর্তন নিয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কাজকে আরো সহজ, সঠিক আর কার্যকর করতে নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন আবিষ্কারকেরা। তবে বেশিরভাগ আবিষ্কার মানুষের কল্যাণের জন্যে তৈরি করা হলেও সব আবিষ্কার যে জনপ্রিয় হয় এমন কিন্তু নয়। অবাস্তব ধারণা, অসম্ভব নির্মাণ প্রক্রিয়া কিংবা ব্যবহার-অযোগ্যতাসহ নানা জটিলতায় বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন অনেক সময় কেবল বইয়ের পাতায় আর ধারণাযন্ত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে।
বিস্ময়কর ধারণার উপর ভিত্তি করে বানানো তেমনই এক যন্ত্রের নাম আইসোলেটোর হেলমেট। আবিষ্কারকের ভাষ্যমতে, এ যন্ত্র মানুষের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে রাখতে পারত, যাতে করে নিরবচ্ছিন্ন একাগ্রতার সাথে যেকোনো কাজ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব হয়।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সবাই জানি, কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে অনেকটা সময় ধরে মনোযোগ ধরে রেখে কাজ করতে পারাটা বেশ কঠিন। নানা কারণে আবার সেই মনোযোগ নষ্টও হয়ে যেতে পারে। যেমন- আশেপাশে চলতে থাকা হট্টগোল কিংবা কাজের মাঝে অন্যদিকে মনোযোগ চলে যাওয়া। কর্মক্ষেত্র হোক কিংবা বাসা-বাড়ি- কাজের এমন পরিবেশ খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে আশেপাশের অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু কাজের পরিবেশ নষ্ট করবে না।
সবসময় যে আশেপাশের পরিবেশ কাজ ভণ্ডুলের জন্যে দায়ী হয় এমনটাও নয়। প্রচণ্ড কাজের চাপে থাকা মস্তিষ্ক অনেক সময় নিজেই নিজের মনোযোগ নষ্ট করে। ঘরের পর্দায় আঁকা কিম্ভূতকিমাকার আঁকিবুঁকি, মনের সুখে উড়তে থাকা মাছি কিংবা জানালার বাইরে থেকে আসা একফালি রোদের ওঠা-নামাও তাৎক্ষণিকভাবে মনোযোগ নষ্ট করবার জন্য যথেষ্ট। মনোযোগ বিষয়ক সমস্যা শনাক্ত করা সম্ভব হলেও এর সমাধান খুঁজে বের করা মোটেও সহজ হচ্ছিল ছিল না।
সেই সময় হুগো গ্রান্সবাক নামে যুক্তরাষ্ট্রের এক উদ্ভাবক এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যা পরিধান করলে মানুষ কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে পারবে। ১৯২৫ সালে তিনি অদ্ভুত-দর্শন এই হেলমেটটি জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী থেকে উঠে আসা রোবটের মাথার মতো দেখতে সেই হেলমেটের নাম দেন তিনি ‘দ্য আইসোলেটর‘।
হুগো গ্রান্সবাক তার কর্মজীবনে নানা কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের বাইরে তিনি মূলত ছিলেন পত্রিকার সম্পাদক। নানা সময় বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদনা এবং প্রকাশের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর উপন্যাসের বাইরে নিজের পত্রিকায় লেখালেখি করতেও ভালোবাসতেন তিনি। ‘সায়েন্স অ্যান্ড ইনভেনশন’ নামের যে পত্রিকায় আইসোলেটরের বিষয় প্রথম প্রকাশিত হয়, সেই পত্রিকার প্রতি সংখ্যাতেই কয়েক পাতা জুড়ে থাকতো তার সম্পাদকীয়।
খেয়ালি উদ্ভাবক হলেও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে তার অবদান একেবারে সামান্য নয়। সর্বমোট ৮০টি আবিষ্কারের পেটেন্ট রয়েছে তার নামে। আইসোলেটরের বাইরে তার অন্যান্য আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনক্ষম ভিন্ন ধরনের শুষ্ককোষ (ড্রাইসেল), বৈদ্যুতিক চিরুনি, বৈদ্যুতিক আয়না, এমনকি আধুনিক যুগের ভিআর বক্সের মতো মাথায় পরিধানযোগ্য টেলিভিশনও।
আইসোলেটর হেলমেটের বিষয়টি হুগো গ্রান্সবাক সর্বপ্রথম প্রকাশ করেন ১৯২৫ সালের জুলাই মাসে। সায়েন্স অ্যান্ড ইনভেনশন পত্রিকায় তিনি অদ্ভুত এই হেলমেটের বিষয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এই প্রতিবেদনে আইসোলেটরের নির্মাণের ব্যখ্যার সাথে হেলমেট পরিহিত অবস্থায় নিজের ছবিও প্রকাশ করেন গ্রান্সবাক। সেই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আইসোলেটর হেলমেটের নকশা তিনি এমনভাবে করেছিলেন, যাতে মনোযোগ নষ্ট করার মূল দুই কারণ অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ আর দৃশ্যমান বস্তু উভয় বিষয় থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা যায়। প্রাথমিক নকাশায় একে শব্দ নিরোধক করার জন্য শোলার টুকরা ব্যবহার করা হয়, যা কাঠের তৈরি হেলমেটের ভেতরে প্রলেপ হিসেবে যুক্ত করা হয়। এরপর বিশেষভাবে প্রস্তুত করা উলের আবরণ দিয়ে হেলমেটটি পুরোপুরি ঢেকে দেয়া হয়।
আইসোলেটরের সামনের অংশে ব্যবহারকারীর দেখবার জন্যে দুটি ছিদ্র রাখা হয়। সেই ছিদ্রগুলো পুরু কালো কাচের টুকরা দিয়ে ভালভাবে হেলমেটের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। জানালার জন্য ব্যবহৃত সাধারণ কাচ ব্যবহার করা হয় এতে। বাইরে থেকে এই অংশটি দেখতে অনেকটা বেশি পাওয়ারের চশমার মতো মনে হত। উভয় চোখের কাচের নিচের দিকে সূক্ষ্মভাবে একটি করে সাদা রঙের রেখা টানা হয়। হুগো গ্রান্সবাকের মতে, শুধুমাত্র শব্দ নিরোধক হয়ে কোনো যন্ত্র মানুষের মনোযোগ পুরোপুরি ধরে রাখতে পারবে না, যদি না দেখবার ক্ষমটাকেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। দৃষ্টি যাতে নির্দিষ্ট কাজের উপরই সীমাবদ্ধ থাকে এবং অন্য কিছুর দিকে মনোযোগ ঘুরে না যায় সেজন্যই সাদা দাগ দেয়া অংশগুলোর উদ্ভাবন। সাদা রঙের এই দাগের উপরের সংকীর্ণ অংশটি এমনভাবেই তৈরি করা হয়েছিল যাতে চোখের ঠিক সামনে রাখা কাগজ বা অন্য কিছু বাদে আশেপাশের কিছুই ব্যবহারকারীর নজরে না আসে।
হেলমেটে অপর ছিদ্রটি রাখা হয় ব্যবহারকারীর নিঃশ্বাস নেবার কাজে ব্যবহারের জন্য। মুখের কাছাকাছি অবস্থানে থাকা এই বিশেষ অংশে ছাকনির মতো একধরনের কৌশল ব্যবহার করা হয়, যাতে এর ভেতর দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচল করতে পারলেও ভেতরের দিকে শব্দ ঢুকতে না পারে। পুরোপুরি নিঃশব্দ করতে না পারলেও আইসোলেটর হেলমেটকে ৭৫ ভাগ কার্যক্ষম বলে দাবি করেন এর উদ্ভাবক।
সেখানেই ক্ষান্ত দেননি গ্রান্সবাক। দ্বিতীয় প্রজন্মের হেলমেটের বিষয়েও তার কাজের কথা লিখে গেছেন সেই প্রতিবেদনে। নতুন সেই হেলমেটে বায়ুরন্ধ্র বা নিঃশ্বাস নেবার বিশেষ নল সংযুক্ত করার কথা উল্লেখ করেন তিনি। দ্বিতীয় প্রজন্মের এই আইসোলেটর ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ পর্যন্ত কার্যক্ষম বলেন গ্রান্সবাক। তবে আইসোলেটরের একটি সমস্যার কথাও উল্লেখ করেন তিনি। তা হলো ব্যবহারের স্থায়িত্বকাল। গ্রান্সবাক পরীক্ষা করে দেখতে পান, টানা ১৫ মিনিট বা এর বেশি সময় আইসোলেটর হেলমেট ব্যবহার করলে মানুষ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। নিঃশব্দ পরিস্থিতি, ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি এবং নিঃশ্বাস নেবার ব্যবস্থার জটিলতা- নানা কারণেই এই সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে কাজ করার জন্যে ১৫ মিনিট মোটেও দীর্ঘ সময় নয়।
সেজন্য নতুন হেলমেটে তিনি যুক্ত করেন অক্সিজেনের ছোট একটি ট্যাঙ্ক। সেই ট্যাঙ্ক একটি নলের সাহায্যে হেলমেটের নাকের কাছের ছিদ্রের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। গ্রান্সবাকের লেখা প্রতিবেদন অনুযায়ী, অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহারের ফলে আইসোলেটর ব্যবহারকারীর শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া সহজ হয় এবং এর ফলে প্রাণবন্তভাবে লম্বা সময় ধরে কাজ করাও সম্ভব হয়।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর আইসোলেটরের জনপ্রিয় হওয়া কিংবা বাণিজ্যিকভাবে নির্মাণের বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই ধরে নেয়া যায়, বাস্তব ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই আবিষ্কার খুব একটা উপযোগী ছিল না। কিন্তু বেশিরভাগ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মতোই এই যন্ত্রটিও মানুষের কাজকে সহজ করার কথা চিন্তা করেই তৈরি করা হয়েছিল।
একেবারেই অবশ্য হারিয়ে যায়নি মনোযোগ রক্ষাকারী যন্ত্র আইসোলেটোর। ২০১৭ সালে হোচু রায়্যু নামের একটি প্রতিষ্ঠান ‘হেল্মফন’ নামে একধরনের আইসোলেটোর হেলমেটের উপর কাজের কিছু ছবি প্রকাশ করে, যেখানে আধুনিক যুগের আইসোলেটর পরে কয়েকজন মানুষকে কাজ করতে দেখা যায়। গত শতাব্দীর প্রথমদিকে আবিষ্কার হওয়া হুগোর সেই আইসোলেটরের ভবিষ্যৎ সংস্করণ হয়তো কোনো একদিন সাধারণ মানুষের রোজকার ব্যবহৃত যন্ত্রে পরিণত হবে।