১৯১৭ সালের মে মাস। পর্তুগালের ফাতিমা অঞ্চলে ঘটেছিল এই ঘটনাটি। লুসিয়া নামে একটি দশ বছরের মেষ পালক বালিকা এবং তার দুই কাজিন দাবী করে বসে পাহাড়ের উপর তারা অদ্ভুত কিছু দেখেছে। তাদের ভাষ্য ছিল তারা দেখেছে মাতা মেরী প্রায় সময় পাহাড়ের উপর আসেন এবং সেখানে কিছুক্ষণ ভ্রমণ করে যান। ধর্মীয় ব্যাপার হবার কারণে সকলেই বালিকাদের কথায় বিশ্বাস করে এবং ধরে নেয় তিনিই পুণ্যময়ী দেবী মাতা মেরী।
প্রথমে শিশুরা তাদের পিতামাতার কাছে ঘটনাটি বলে। এর বাইরে কাউকে বললে প্রথম দিকে তেমন কেউ বিশ্বাস করেনি, পাত্তা দেয়নি। অল্প স্বল্প কেউ করেছে, তবে তা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। কিন্তু ঘটনাটি চলতেই থাকে। অল্পস্বল্প যারা বিশ্বাস করেছে তারা অন্যদেরকে বলেছে এবং বিশ্বাসের পক্ষে সাক্ষী দিয়েছে। এতে করে বিশ্বাসী লোকের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মানুষ ধীরে ধীরে আগ্রহীও হয়েছে। কিন্তু তখনো কেউ-ই মাতা মেরীকে চোখে দেখেনি। এমন অবস্থায় লুসিয়া নামের মেয়েটি জানায় তার কাছে নাকি মাতা মেরী বলেছেন এলাকার সকলে যেন মাসের ১৩ তারিখ পাহাড়ের পাদদেশে এসে জমা হয়। জমা হলে তিনি এমন কিছু করে দেখাবেন যা দেখে সকলে বিশ্বাস করবে তিনি সত্যি সত্যিই এখানে এসে ভ্রমণ করে যান নিয়মিত। সমগ্র পর্তুগালে এই গুজব ছড়িয়ে যায়।
মে মাস থেকে কয়েক মাস পার হয়ে তখন অক্টোবর চলে এসেছে। ১৩ই অক্টোবর সেখানে অবিশ্বাস্য পরিমাণ মানুষ এসে জমা হয়। জমা হওয়া মানুষের পরিমাণ ছিল ৭০ হাজারেরও বেশি।
উল্লেখ্য ঐ সময় সূর্য উপস্থিত ছিল এবং লোকজনকে সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হয়েছিল। কারণ পাহাড় ছিল সূর্যের অবস্থানের দিকে। কোনো কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর মতে সূর্য নাকি ঐ সময়ে ‘নাচানাচি’ শুরু করেছিল! কেউ কেউ দাবী করেছিল সূর্য ঐ সময়ে এলোমেলোভাবে ঘুরতে শুরু করেছিল। সবচেয়ে অদ্ভুত দাবীটি ছিল এরকম
… সূর্য যেন হঠাৎ করেই স্বর্গলোক থেকে বিচ্যুত হয়ে কয়েক খণ্ডে বিভক্ত হয়ে নিচে নামতে শুরু করলো। পাহাড়ের মাথায় যখন একদম লেগেই যাচ্ছিল তখন সকলে উত্তপ্ত আগুনে পুড়ে যাবার ভয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। এই মুহুর্তেই অলৌকিক ঘটনাটি ঘটে। আমরা দেখলাম হঠাৎ করেই আগুনের সূর্য নিচে নামা বন্ধ করে দেয় এবং আগের অবস্থানে ফিরে যায়। ফিরে গিয়ে সূর্য একদম স্বাভাবিকভাবে আলো দিতে থাকে। এরপর থেকে সবসময় শান্ত শিষ্টতা বজায় রাখছে সূর্য।
এখন আমরা এই ঘটনাটিকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবো? ফাতিমা অঞ্চলে কি আসলেই কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল? মাতা মেরীর আত্মা কি সত্যি সত্যিই পাহাড়ে দেখা গিয়েছিল? উল্লেখ্য মেরী শুধুমাত্র সেই তিন শিশুর চোখেই দৃশ্যমান ছিল, অন্যদের চোখে অদৃশ্য ছিল। অন্যরা মেরীকে সরাসরি দেখতে পায়নি, কিন্তু তার অলৌকিক আলামত দেখতে পেয়েছিল।
যেহেতু মেরীকে মাত্র তিন জন ছাড়া আর কেউ দেখেনি, সেহেতু সেখানে অবশ্যই কোনো সমস্যা আছে। তাই এটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। মেরীর আগমনের ঘটনাকে অনায়াসে মিথ্যা বলে ধরে নেয়া যায়। কিন্তু সূর্যের নাচানাচি ও ঘূর্ণনের ঘটনাটি? একে কীভাবে উড়িয়ে দেয়া যায়? ৭০ হাজার মানুষ তো আর একসাথে ভুল করতে পারে না। কীভাবে এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেয়া যায়? সূর্য কি আসলেই পৃথিবীতে নেমে এসেছিল? (কিংবা পৃথিবী কি তার কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে সূর্যের কাছে গিয়েছিল, যার কারণে আপেক্ষিকভাবে মনে হতে পারে সূর্য পৃথিবীর পৃষ্ঠের কাছে চলে এসেছিল?)
ঘটনাটিকে ডেভিড হিউমের ছাচে ফেলে চিন্তা করি। অলৌকিকতাকে ব্যবচ্ছেদ করার জন্য ডেভিড হিউম কিছু নীতি প্রদান করেছিলেন। ডেভিড হিউমের নীতি অনুসারে তিনটি সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করা যায় এখানে।
১. সূর্য আসলেই নাচানাচি ঘুরাঘুরি করেছিল এবং এর খণ্ডাংশ পৃথিবীর দিকে ধেয়ে এসেছিল। একসময় তার আগের অবস্থানে ফেরতও গিয়েছিল। (কিংবা পৃথিবী তার কক্ষপথ পরিবর্তন করে সূর্যের কাছে চলে গিয়েছিল।)
২. সূর্য বা পৃথিবী কোনটিই তাদের অবস্থান থেকে নড়েনি। ৭০ হাজার মানুষের সকলে ঐ সময় হ্যালুসিনেশনের মাঝে থেকে এসব দেখেছিল
৩. এসবের কোনোকিছুই আসলে ঘটেনি। পুরো ঘটনাটিই আসলে একটি কল্পিত গল্প। বানানো এই গল্পকে ঘটনাক্রমে মানুষ বাস্তব হিসেবে ধরে নিয়েছে।
এই তিন সম্ভাবনার কোনটিকে বেশি যুক্তিসঙ্গত বা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়? তিনটি সম্ভাবনার সবগুলোতেই কম-বেশি অস্বাভাবিকতা আছে। তবে এদের মাঝে ৩য় সম্ভাবনাটিই সবচেয়ে কম নাটকীয়। ৩য় সম্ভাবনাটিকে সত্য বলে ধরে নিলে আমাদেরকে শুধুমাত্র এটা মেনে নিলেই হবে যে, কেউ একজন মিথ্যার আশ্রয়ে ভুলভাবে ৭০ হাজার মানুষ সম্পর্কে কোনোকিছু বলেছে। মিথ্যা হোক আর যা-ই হোক, চমকপ্রদ হবার কারণে এই ঘটনাটি সকলের মাঝে ছড়িয়ে যায়। ফেসবুক-টুইটারে যেমন করে কোনো ঘটনা ‘ভাইরাল’ হয়ে যায় অনেকটা তেমন।
২য় সম্ভাবনার সত্যতা ক্ষীণ। এটি সত্য হতে হলে আমাদেরকে ধরে নিতে হবে যে একসাথে ৭০ হাজার মানুষ একই বিষয়ে হ্যালুসিনেশনে পড়েছিল। একসাথে এতগুলো মানুষ হ্যালুসিনেশনে পড়াও বেশ বড় অলৌকিক ব্যাপার। তবে ১ম সম্ভাবনার চেয়ে কম অলৌকিক। ১ম সম্ভাবনা সত্য হলে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র-নিয়ম-নীতি ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।
সূর্য সমগ্র পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক অঞ্চল জুড়ে উদীয়মান ছিল। সূর্য যদি কয়েক টুকরো হয়ে যায় কিংবা বিক্ষিপ্তভাবে ঘোরাঘুরি করে, তাহলে শুধুমাত্র পর্তুগালে নয়, সমগ্র বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ তা দেখতে পাবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে শুধুমাত্র পর্তুগালের ফাতিমা অঞ্চলের মানুষেরাই তা দেখেছে। তাহলে এ থেকে কী বোঝা গেল? আর সূর্য যদি পৃথিবীতে নেমে আসতো তাহলে সাক্ষাৎ নরক তৈরি হতো পৃথিবীতে। সূর্যের এতো তীব্র উত্তাপে পৃথিবীর সকল মানুষ পুড়ে কাবাব হয়ে যেতো। তাদের সামনে ঘটনাটি ঘটলে আসলে তারাই সবার আগে মরে ভূত হয়ে যেতো। আর এটি হলে তারা আর বলতে পারতো না যে তারা নিজের চোখে সূর্যকে নাচানাচি করতে দেখেছে।
বলা হয়ে থাকে লুসিয়া নাকি দর্শকদের বলেছিল সূর্যের দিকে তাকাতে। যারা যারা তাকিয়েছিল, বলতে হবে তারা একদমই বোকার মতো কাজ করেছিল। কারণ এভাবে তাকালে চোখে স্থায়ী সমস্যা হতে পারে। তাছাড়া এভাবে তাকালে মানুষ দ্বন্দ্বে পড়ে যেতে পারে এবং মনে হতে পারে সূর্য যেন টলটল করছে। বিশেষ কোনো চিন্তাভাবনা না রেখে স্বাভাবিক মস্তিষ্ক নিয়ে তাকালেও মাঝে মাঝে মনে হয় সূর্য টলটল করছে। এই টলটল করার কথা মানুষকে বললে এটাই বাড়তে বাড়তে ‘ঘোরাঘুরি’ বা ‘নাচানাচি’তে রূপান্তরিত হতে পারে।
যদি এখানের কেউ একজন সূর্যের দিকে তাকিয়ে এরকম দ্বন্দ্বে পড়ে যায় এবং তা অন্যদেরকে বলতে থাকে, তাহলে তা মুহূর্তের মধ্যেই সমস্ত এলাকা ছড়িয়ে পড়বে। পড়াই স্বাভাবিক। মানুষ গুজব ছড়ানোতে এক্সপার্ট। এদের মধ্যে কেউ যদি সাংবাদিক হয় এবং একটু রসিয়ে পত্রিকায় ছাপিয়ে দেয়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। চিরকালের জন্য ‘সত্য’ হয়ে যাবে ঘটনাটি। এটি সত্য কারণ এই ঘটনার সত্যতার ডকুমেন্ট আছে। ডকুমেন্ট হচ্ছে পত্রিকা।
তবে ডেভিড হিউমের নীতি অনুসারে ঘটনাটি ঘটেছে নাকি ঘটেনি তা বড় কথা নয়। বরঞ্চ সবার আগে দেখতে হবে সম্ভাব্য কোন ঘটনাটি তুলনামূলকভাবে কম অলৌকিক। এতগুলো মানুষ একসাথে একটি হ্যালুসিনেশনে বিশ্বাস করছে, এমন ঘটনা যে পরিমাণ অবাস্তব তারচেয়ে বেশি পরিমাণ অবাস্তব হচ্ছে সূর্যের নড়াচড়া ও স্থানচ্যুতি। ডেভিড হিউমের নীতি কখনোই বলছে না যে ‘অলৌকিক ঘটনা’ অসম্ভব। এই নীতি বারবার বলছে কোনো অলৌকিকতা বিশ্বাস করার আগে বিবেচনা করে দেখা উচিৎ এবং সম্ভাব্য অন্যান্য ঘটনার সাথে তুলনা করে দেখা উচিৎ। তুলনা করলেই বের হয়ে আসবে কোনটির বাস্তবতা কতটুকু বেশি।