১৯৭১ সালের ১লা আগস্ট অনুষ্ঠিত হয় দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। আজ ১লা আগস্ট ২০২১, দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি। ৫০টি বছর পর চলুন আরেকবার ফিরে তাকাই এই অসামান্য আয়োজনের দিকে।
১৯৭১ সাল। পৃথিবী জুড়ে বিভেদ, ঘৃণা, হত্যা, নৃশংসতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হোয়াইট হাউজে তখন রিচার্ড এম. নিক্সন। ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙতে আরও অনেক দেরি। বার্লিন দেয়াল তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। এমন সময়ই পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় নারকীয় গণহত্যা। ঘোষণা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সর্বত্র শুরু হয় মুক্তির লড়াই। প্রচুর মানুষ সীমানা পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। ক’মাস আগের ভয়াবহ ভোলা সাইক্লোনে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। শরণার্থী শিবিরে খাবার আর ওষুধের জোগান দিতে হিমশিম খেতে হয়, কলেরার প্রাদুর্ভাবে লাখো মানুষ মরে। দেশের ভেতরও নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলে।
পন্ডিত রবিশঙ্কর তখন ক্যালিফোর্নিয়ায়। ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ আর্টসে ডিপার্টমেন্ট অব ইন্ডিয়ান মিউজিকের ফ্যাকাল্টি হিসেবে দায়িত্বরত।
রবিশঙ্করের জন্ম বেনারসে হলেও তার পিতৃদেব ছিলেন বাংলাদেশের সন্তান। তাই বেনারসে জন্ম-বেড়ে ওঠা এবং খুবই অল্প বয়সেই ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে বেড়ানোর পরও তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর বাঙালি। ততদিনে তিনি বিশ্বব্যাপী খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছেন। বলিউডে মিউজিক কম্পোজার হিসেবে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গেও। ১৯৫৪ সালে পারফর্ম করেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নে, ১৯৫৫ সালে নিউ ইয়র্কে। ১৯৫০-৬০ দশকে আমেরিকান রেকর্ড কোম্পানি থেকে পাবলিশ করেছেন বেশ কিছু জনপ্রিয় অ্যালবাম। ১৯৫৬ সালে ট্যুর করেছেন যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং যুক্তরাষ্ট্রে। অংশগ্রহণ করেছেন জাতিসংঘের দশম বর্ষপূর্তি এবং প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কো ইন্টারন্যাশনাল মিউজিক ফেস্টিভ্যালে।
১৯৬১ সাল থেকে আবার ট্যুর করেছেন ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ায়। ১৯৬৬ সালে পরিচিত হয়েছেন জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের সাথে। হ্যারিসনকে সেতার শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন বেদিক আধ্যাত্মিকতা। পারফর্ম করেছেন ১৯৬৭ সালের মন্টেরি পপ ফেস্টিভ্যাল এবং ১৯৬৯ সালের উডস্টক ফেস্টিভ্যালেও। পুরো পশ্চিম জুড়েই রবিশঙ্কর ছড়িয়ে দিয়েছেন ভারতীয় সঙ্গীতের বিপ্লব।
ক্যালিফোর্নিয়া বসে দেশের খবর পেয়ে রবিশঙ্কর উদ্বিগ্ন হন। ‘৭১ এর শুরুর দিকেই বন্ধু জর্জ হ্যারিসনকে প্রথমবারের মতো চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতির খবর জানান তিনি। জর্জ হ্যারিসন বন্ধুর চোখে দেশ নিয়ে গভীর উদ্বেগ দেখতে পান।
বিটলস ততদিনে ভেঙে গেছে। হ্যারিসন তখন পুরোদস্তুর সলো আর্টিস্ট হিসেবে ক্যারিয়ার উপভোগ করছেন। বিটলস ভেঙে গেলেও বিটলম্যানিয়া কিন্তু তখনও অটুট। জন, জর্জ, পল আর রিঙ্গোর প্রতিটি কাজ লুফে নিচ্ছে ভক্তরা। ১৯৫০-৬০ দশকে পুরো পশ্চিমা পপ কালচারে দ্য বিটলস ঠিক কত বড় নাম, সেটা যারা জানেন না, তাদের দু-তিনটে লাইন লিখে বোঝানোও সম্ভব না।
জর্জ হ্যারিসন তখন পুরো পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত মুখগুলোর একজন। বিটলস ভাঙার পর ১৯৭০ সালে মুক্তি পেয়েছে হ্যারিসনের তৃতীয় সলো অ্যালবাম ‘All Things Must Pass‘। মুক্তি পেতেই গ্লোবাল হিট! ‘My Sweet Lord’, ‘Wah Wah’, ‘What Is Life’-সহ অ্যালবামের বেশ কিছু গান বহুদিন পর্যন্ত চার্টের একদম উপরে অবস্থান করেছে। ‘My Sweet Lord’ ১৯৭০ সালে যুক্তরাজ্যে মুক্তি পাওয়া সকল গানের মধ্যে সর্বাধিক বিক্রিত। সেসময় জর্জ হ্যারিসন প্রডিউসার হিসেবেও কাজ করছেন; বেশ কিছু জনপ্রিয় গান লিখছেন, সিনেমার মিউজিক কম্পোজ করছেন এবং তার বন্ধু রবিশঙ্করের ওপর ডকুমেন্টারি নির্মাণের কাজও করছেন।
১৯৬৫ সালে বিটলসের ‘Help!‘ সিনেমার শ্যুটিংয়ের সময় হ্যারিসন প্রথমবারের মতো পরিচিত হন ভারতীয় ক্লাসিক্যাল মিউজিকের সাথে। সেতার, তবলা, সারদের সুর তাকে অভিভূত করে। ভারতীয় সঙ্গীত এবং সংস্কৃতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। নিজেই সেতার কিনে শেখা শুরু করেন। ফলশ্রুতিতে বিটলসের ‘নরওয়েজিয়ান উড’ গানে ব্যবহৃত হয় সেতারের সুর। প্রথমবারের মতো ওয়েস্টার্ন রকের সাথে মেশে ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল রাগ। উৎপত্তি হয় ‘রাগা রক’ নামের নতুন এক জনরার।
এক বন্ধুর দেয়া রেকর্ডে প্রথমবারের মতো রবিশঙ্করের সেতার শোনেন হ্যারিসন। এরও বছরখানেক পর লন্ডনে দেখা হয় একদমই ভিন্ন দেশ, ভিন্ন সংস্কৃতি এবং ভিন্ন ধরনের সঙ্গীতের এই দুই গ্রেটের। কিছুদিন পরই রবিশঙ্করের কাছে সেতার শেখা শুরু করেন জর্জ হ্যারিসন। তিন মাসের মাথায় ছুটে যান বম্বেতেও। রবিশঙ্কর হ্যারিসনকে সেতার ধরতে শেখান, বাজানোর ধরন শেখান। তার চেয়েও বেশি শেখান আত্মিক এবং আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা। হ্যারিসনের মন-মস্তিষ্কে ছড়িয়ে দেন ভারতীয় দর্শন যা হ্যারিসনের বাকি জীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে তৈরি হয় একটা মহাজাগতিক সম্পর্কের, যা স্থায়ী ছিল হ্যারিসনের মৃত্যু পর্যন্ত। পরবর্তীতে রবিশঙ্কর হ্যারিসন সম্পর্কে বলেন, “He was my student, my brother, my son, all combined.” হ্যারিসনও বলেন, “Ravi Shankar is probably the person who has influenced my life the most.”
১৯৭১ এর এপ্রিল মাস। জর্জ হ্যারিসন এবং রবিশঙ্কর দুজনই তখন লস অ্যাঞ্জেলসে, রবিশঙ্করের ওপর নির্মিত ডকুমেন্টারির সাউন্ডট্র্যাকের কাজ করছেন। এরকম সময়েই পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় পূর্ব পাকিস্তানে চলমান নৃশংসতা তুলে ধরে তার বিখ্যাত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন। রবিশঙ্করের উদ্বেগ ততদিনে প্রায় বিষণ্ণতায় পরিণত হয়েছে। দেশের মানুষের জন্য কিছু না কিছু করতে তিনি উন্মত্ত হয়ে রয়েছেন।
রবিশঙ্কর প্রথমে একটা বেনিফিট কনসার্টের কথাই ভেবেছিলেন। ভেবেছিলেন জর্জ হ্যারিসন কিংবা সেই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা এবং বন্ধু অভিনেতা পিটার সেলার্স সেখানে থাকবেন। ভাগ্য ভালো হলে হয়তো ২৫,০০০ ডলারের মতো পাওয়া যাবে, যার পুরোটা তিনি পাঠাবেন শরণার্থীদের সাহায্যে। সেই চিন্তা থেকেই জর্জ হ্যারিসনকে তিনি চলমান যুদ্ধাবস্থা সম্পর্কে বললেন। তৎক্ষণাৎ জর্জ হ্যারিসন জানালেন, তিনি সর্বাত্মক সহায়তা করবেন। পরবর্তীতে রবিশঙ্কর বলেছিলেন,
I was in a very sad mood, having read all this news, and I said, “George, this is the situation, I know it doesn’t concern you, I know you can’t possibly identify.” But while I talked to George he was very deeply moved … and he said, “Yes, I think I’ll be able to do something.
এরপর জর্জ হ্যারিসন পুরোদমে কাজ করা শুরু করেন। পরিচিত সকল মিউজিশিয়ান, রেকর্ড কোম্পানি, ফিল্ম কোম্পানিকে একে একে টেলিফোন করেন। একটা ছোট ফান্ড রেইজিং ইভেন্ট থেকে পুরো ব্যাপার মোড় নেয় এক সুপারস্টার দিয়ে পরিপূর্ণ কনসার্টে! হ্যারিসন পরবর্তীতে বলেন,
‘The Concert For Bangladesh’ happened because of my relationship with Ravi… I said, “If you want me to be involved, I think I’d better be really involved,” so I started recruiting all these people.
হ্যারিসনের প্রাথমিক পর্যায়ে সম্ভাব্য পারফর্মারের তালিকায় ছিলেন বব ডিলান, রিঙ্গো স্টার, জন লেনন, পল ম্যাকার্টনি, এরিক ক্ল্যাপ্টন, লিওন রাসেল, বিলি প্রেস্টন, জিম কেল্টনার, ক্লস ভারম্যান আর ব্যাডফিঙ্গার ব্যান্ড। প্রাথমিক তালিকার প্রায় সবাই পারফর্ম করার জন্য রাজি হয়ে যায়। পল ম্যাকার্টনি বিটলসের অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যার কারণে হ্যারিসনের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে। আর জন লেনন শুরুতে রাজি হলেও শেষ পর্যন্ত পারফর্ম না করার সিদ্ধান্ত নেন।
একজন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ হ্যারিসনকে পরামর্শ দেন আগস্ট মাসে কনসার্টটি করার জন্য শুভ। সেবার পুরো আগস্ট মাসে নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের শিডিউল থাকে মাত্র একদিন, মাসের প্রথম দিন। তাই দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশের সময় নির্ধারিত হয় ১লা আগস্ট, ১৯৭১।
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই জর্জ হ্যারিসন তার ‘Bangla Desh’ গানটি লস অ্যাঞ্জেলসের স্টুডিওতে রেকর্ড করেন। রবিশঙ্করের বেনিফিট রেকর্ড ‘Joi Bangla’ প্রডিউস করেন। ইউনিসেফের সাহায্যে তৈরি করেন ‘George Harrison–Ravi Shankar Special Emergency Relief Fund’। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার শেষ পাতায় ঘোষণা করা হয়, “The Concert For Bangla Desh by George Harrison and Friends”।
জর্জ হ্যারিসন ঠিক কতটা জনপ্রিয় ছিলেন, সেটা আগেই বলা হয়েছে। এবার তার সাথে বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপ্টন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, বিলি প্রেস্টন! সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় রক তারকারা! ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় সবখানে পৌঁছে যায় কনসার্টের খবর। দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসা শুরু করে মানুষ। টিকিট বিকিয়ে যায় চোখের পলকে। এতটা উন্মাদনায় হ্যারিসন বাধ্য হন দুটি শোর আয়োজন করতে। ঠিক হয় ১লা আগস্ট কনসার্ট ফর বাংলাদেশের দুটি শো হবে। প্রথমটি দুপুর আড়াইটায়, দ্বিতীয়টি রাত আটটায়।
রিহার্সেল শুরু হয় জুলাইয়ের ২৬ তারিখ থেকে। পারফর্ম করতে চাওয়া প্রত্যেকে একে একে যোগ দেন রিহার্সেলে। গিটারিস্ট, বেজিস্ট, ড্রামার, গায়কদল, ট্রাম্পেটিয়ারসহ ৭৫ জন স্টার আর্টিস্টের মহাসমারোহ ঘটে। রিঙ্গো স্টার ছুটে আসেন সুদূর স্পেন থেকে। লিওন রাসেলও শুরু থেকেই হ্যারিসনের সঙ্গে থাকেন। অ্যাপেল কর্প পুরো কনসার্টের সাউন্ড ও ভিডিও রেকর্ডের দায়িত্বে থাকে। পুরো প্রোগ্রাম ম্যানেজের দায়িত্বে থাকেন নিউ ইয়র্কের সেরা অর্গানাইজাররা।
বিপত্তি বাধে এরিক ক্ল্যাপটনকে নিয়ে। তিনি তখন তীব্রভাবে হিরোইনের নেশায় আসক্ত। এতটাই আসক্ত যে রিহার্সেলে উপস্থিত থাকাটাও প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। জর্জ হ্যারিসন বাধ্য হয়ে আরেকজন গিটারিস্ট নিযুক্ত করেন। তবে একদম শেষ দিন, শেষ সাউন্ডচেকের সময়ে ক্ল্যাপ্টন এসে উপস্থিত হন। শেষদিন উপস্থিত হন বব ডিলানও। একটা বাইক অ্যাকসিডেন্টের পর প্রায় এক বছর লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন ডিলান। এতদিন পর এত বিশাল মাপের আয়োজন দেখে ডিলান কিছুটা শঙ্কিতই হয়ে পড়েন। হ্যারিসনকে বলেন, “Look, it’s not my scene.”
বব ডিলান অবশ্য ঠিকই বলেছিলেন। রক অ্যান্ড রোল মিউজিকের ইতিহাসে এর আগে এরকম কিছুই হয়নি। সময়ের সেরা তারকারা একসাথে পারফর্ম করছেন। তা-ও আবার বিনামূল্যে, এক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সাহায্যার্থে! এর আগে এরকম কনসার্টের কথা কেউ চিন্তাও হয়তো করেনি। জর্জ হ্যারিসনও একদম একা হয়ে কোনোদিনই লাইভ কনসার্টে পারফর্ম করেননি। ডিলানকে অভয় দিয়ে হ্যারিসন বলেন, “At least you’ve played on your own in front of a crowd before. I’ve never done that.” শেষ পর্যন্ত ডিলান নিশ্চিত করে কিছুই বলেননি হ্যারিসনকে। একদম শেষ সময়েও হ্যারিসন জানতেন না বব ডিলান আদৌ পারফর্ম করবেন কিনা।
১ আগস্ট, ১৯৭১। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের গেটে ব্যাপক ভিড়। ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করছে হাজারো দর্শক। আড়াইটার কনসার্টের সময় প্রায় ২০,০০০ দর্শক উপস্থিত। কনসার্টের শুরু করলেন জর্জ হ্যারিসন। প্রথমে পারফর্ম করলেন রবিশঙ্কর। সেতার নিয়ে বসে মাইকটা কাছে টেনে নিয়ে বললেন,
We are not politicians, we are artists, but through our music we would like you to feel the agony and also the pain and lot of sad happenings in Bangladesh.
এরপর রবিশঙ্কর শুরু করলেন বাংলাদেশের একটা ফোক টিউন থেকে তৈরি “Bangla Dhun”। পুরো অডিটোরিয়াম জুড়ে অসম্ভব রকমের শান্তি। ২০,০০০ মানুষের অধিকাংশই প্রথমবারের মতো শুনছেন ক্লাসিক্যাল ইন্ডিয়ান মিউজিক। রবিশঙ্করের সেতার, আল্লা রাখার তবলা, আলি আকবর খানের শারদ আর কমলা চক্রবর্তীর তানপুরায় তৈরি অসামান্য সুর যেন একটুকরো বাংলাদেশের ছবিই এঁকে দিচ্ছে হাজারো দর্শকের বুকে। পারফর্মেন্স শেষে রবিশঙ্কর যখন স্টেজ থেকে নামছেন, হাজার হাজার দর্শকের চোখে-মুখে তখন মুগ্ধতা, অডিটোরিয়াম জুড়ে অবিরাম করতালি।
এরপর একসাথে মঞ্চে উঠলেন জর্জ হ্যারিসন, রিঙ্গো স্টার, এরিক ক্ল্যাপ্টন, লিওন রাসেল, বিলি প্রেস্টন, জিম কেল্টনার আর ক্লস ভারম্যান। পুরো ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন যেন উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল! সময়ের সেরা সব সুপারস্টার একসাথে, একই মঞ্চে। এ যেন এক স্বপ্ন। জর্জ হ্যারিসন একে একে গাইলেন “Wah-Wah”, “Something” আর “Awaiting on You All”। হ্যারিসনের পর বিলি প্রেস্টন গাইলেন তার জনপ্রিয় “That’s the Way God Planned It”। রিঙ্গো স্টার গাইলেন তার “It Don’t Come Easy”। হ্যারিসন আরও গাইলেন “Beware of Darkness” “While My Guitar Gently Weeps”। লিওন রাসেল গাইলেন রোলিং স্টোন্সের “Jumpin’ Jack Flash” আর “Young Blood”। হ্যারিসন গাই]’লেন “Here Comes the Sun”।
এই পর্যায়ে এসে হাতের অ্যাকুয়াস্টিক গিটার রেখে ইলেক্ট্রিক গিটার নেয়ার সময় জর্জ হ্যারিসনের চোখ পড়ল লাইন আপ লিস্টে। দেখলেন বব ডিলানের নাম আর প্রশ্নবোধক চিহ্নটি। শেষ মুহূর্তে একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে এন্ট্রান্স গেটের দিকে ফিরে তাকালেন হ্যারিসন। দেখলেন নার্ভাসনেস কাটিয়ে গুটি গুটি পায়ে বব ডিলান মঞ্চে উঠে আসছেন। পরবর্তীতে হ্যারিসন বলেছিলেন, “He was so nervous – he had his guitar on and his shades. It was only at that moment that I knew for sure he was going to do it.” বব ডিলানকে দেখে আবারো উল্লাসে ফেটে পড়লো উপস্থিত দর্শক। অনুষ্ঠানটি পুরোপুরি পূর্ণতা পেল। ডিলান একে একে গাইলেন তার নাইন্টিন সিক্সটিজের ডিকেড-ডিফাইনিং পাঁচটি গান: “A Hard Rain’s A-Gonna Fall”, “Blowin’ in the Wind”, “It Takes a Lot to Laugh, It Takes a Train to Cry”, “Love Minus Zero/No Limit” আর “Just Like a Woman”। ডিলানের সাথে সাথে সাইড ভোকাল আর দুটো ইলেকট্রিক গিটার নিয়ে পারফর্ম করলেন জর্জ হ্যারিসন এবং লিওন রাসেলও।
ডিলানের পর শেষপর্যায়ে হ্যারিসন গাইলেন “Hear Me Lord” এবং নতুন গান “My Sweet Lord”। কনসার্টের একদম শেষে এসে জর্জ হ্যারিসন গাইলেন “Bangla Desh”। তিনি গাইলেন,
𝑴𝒚 𝒇𝒓𝒊𝒆𝒏𝒅 𝒄𝒂𝒎𝒆 𝒕𝒐 𝒎𝒆 𝒘𝒊𝒕𝒉 𝒔𝒂𝒅𝒏𝒆𝒔𝒔 𝒊𝒏 𝒉𝒊𝒔 𝒆𝒚𝒆𝒔
𝑯𝒆 𝒕𝒐𝒍𝒅 𝒎𝒆 𝒕𝒉𝒂𝒕 𝒉𝒆 𝒘𝒂𝒏𝒕𝒆𝒅 𝒉𝒆𝒍𝒑
𝑩𝒆𝒇𝒐𝒓𝒆 𝒉𝒊𝒔 𝒄𝒐𝒖𝒏𝒕𝒓𝒚 𝒅𝒊𝒆𝒔
𝑨𝒍𝒕𝒉𝒐𝒖𝒈𝒉 𝑰 𝒄𝒐𝒖𝒍𝒅𝒏’𝒕 𝒇𝒆𝒆𝒍 𝒕𝒉𝒆 𝒑𝒂𝒊𝒏
𝑰 𝒌𝒏𝒆𝒘 𝑰 𝒉𝒂𝒅 𝒕𝒐 𝒕𝒓𝒚
𝑵𝒐𝒘 𝑰’𝒎 𝒂𝒔𝒌𝒊𝒏𝒈 𝒂𝒍𝒍 𝒐𝒇 𝒚𝒐𝒖
𝑻𝒐 𝒉𝒆𝒍𝒑 𝒖𝒔 𝒔𝒂𝒗𝒆 𝒔𝒐𝒎𝒆 𝒍𝒊𝒗𝒆𝒔
𝑩𝒂𝒏𝒈𝒍𝒂𝒅𝒆𝒔𝒉, 𝑩𝒂𝒏𝒈𝒍𝒂𝒅𝒆𝒔𝒉
𝑾𝒉𝒆𝒓𝒆 𝒔𝒐 𝒎𝒂𝒏𝒚 𝒑𝒆𝒐𝒑𝒍𝒆 𝒂𝒓𝒆 𝒅𝒚𝒊𝒏𝒈 𝒇𝒂𝒔𝒕
𝑨𝒏𝒅 𝒊𝒕 𝒔𝒖𝒓𝒆 𝒍𝒐𝒐𝒌𝒔 𝒍𝒊𝒌𝒆 𝒂 𝒎𝒆𝒔𝒔
𝑰’𝒗𝒆 𝒏𝒆𝒗𝒆𝒓 𝒔𝒆𝒆𝒏 𝒔𝒖𝒄𝒉 𝒅𝒊𝒔𝒕𝒓𝒆𝒔𝒔”
আড়াইটার শো বিপুল সফলতা নিয়ে শেষ হলো। ২০,০০০ দর্শকের মুখে মুখে রটে গেল বাংলাদেশের নাম।
রাত আটটার শোতে আরো ২০,০০০ মানুষ ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে উপস্থিত হলেন। লাইন আপে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আবারও দারুণ সফল একটি শো উপহার দিলেন জর্জ হ্যারিসন। প্রথম শোর চেয়ে আরো নির্ভার হয়ে সবাই পারফর্ম করলেন দ্বিতীয় শোতে। আবারো জর্জ হ্যারিসন হাজারো মানুষের মনে বিধিয়ে দিলেন বাংলাদেশের কথা।
একরাতের মধ্যে প্রায় পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের নাম। শুধুমাত্র কনসার্টের গেট ফি থেকেই আয় হয় প্রায় ২,৫০,০০০ মার্কিন ডলার, যার পুরোটাই পৌঁছায় বাংলাদেশে। এছাড়া কনসার্টের লাইভ সাউন্ড রেকর্ডিং অ্যালবাম হিসেবে এবং ভিডিও রেকর্ডিং সিনেমা হিসেবে কিছুদিনের মধ্যেই মুক্তি দেয়া হয় বিশ্বব্যাপী, যা থেকে আয় হয় প্রায় সাড়ে ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। রবিশঙ্কর পুরো ব্যাপারটা নিয়ে বলেন,
What happened is now history: it was one of the most moving and intense musical experiences of the century.
দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশের কারণে খুব বেশি আর্থিক উপকার সেসময় হয়নি। সব মিলিয়ে যে ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছিল, তা নানা দুর্নীতি আর ট্যাক্সের জাঁতাকলে পড়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত পৌঁছেছিল আরও একযুগেরও বেশি সময় পর, ১৯৮৫ সালে। এর মাঝে বাংলাদেশে বন্যা হয়েছে, দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে, লাখো মানুষ মরেছে খাবার আর ওষুধের অভাবে। তবুও এই একটা মাত্র কনসার্ট যেভাবে পুরো বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল তার সাথে আসলে কিছুরই তুলনা চলে না।
এই এক ইভেন্টের কারণে বাংলাদেশে প্রচুর টাকা, ওষুধ, খাদ্যের সুবিধা আসা শুরু করে। বিশ্বের মানুষ বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। বাংলাদেশের জন্য বিপুল জনমত তৈরি হয়। বাংলাদেশে ব্যাপক পরিমাণ মিডিয়া কাভারেজ পৌঁছে। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ না হলে হয়তো রাতারাতি এসবের কিছুই হতো না। জর্জ হ্যারিসন ১৯৯২ সালে বলেন,
The money we raised was secondary. The main thing was, we spread the word and helped get the war ended … What we did show was that musicians and people are more humane than politicians.
‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো রক অ্যান্ড রোলের সাথে মেশে মানবিক আহ্বান। মানুষ দেখে মিউজক কতটা শক্তিশালী হতে পারে। এর মাধ্যমেই পাকাপোক্তভাবে বেনিফিট ইভেন্টের চল শুরু হয়। ১৯৮৫ সালে ইথিওপিয়ায় চলমান দুর্ভিক্ষের সহায়তায় আয়োজন করা হয় লাইভ এইড কনসার্ট। আরও বিভিন্ন ইস্যুতে একে একে অনুষ্ঠিত হয় লাইভ আর্থ, ফার্ম এইড, সেলফ এইড, লাইভ ৮-সহ আরও অনেক অনেক বেনিফিট কনসার্ট, যা থেকে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হয়েছে বহু শিশুর পেট ভর্তি খাবার, বহু মানুষের জীবনের শান্তি।
রবিশঙ্কর আর জর্জ হ্যারিসন প্রমাণ করেছিলেন, একটি বুলেটের চেয়েও একটি গান বেশি শক্তিশালী। দেখিয়েছিলেন কীভাবে চাইলেই মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানো যায়। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ ইতিহাসের সেরা মানবতাবাদী উদ্যোগগুলোর একটি হয়ে থাকবে। আর বিশ্বব্যাপী ভক্তদের মনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে রবিশঙ্কর এবং জর্জ হ্যারিসনের নাম।