দেং জিয়াওপিংয়ের শিক্ষাসফর
১৯২০ সাল; দেং জিয়াওপিংয়ের বয়স সবে ১৬। উচ্চশিক্ষার জন্য চীন ছেড়ে ফ্রান্সে পাড়ি জমাবেন তিনি, যেটি হতে চলেছে তার আজীবনের শিক্ষাসফর। যেদিন দেশ ছাড়বেন, তার আগের রাতে বাবাকে বললেন, “আমার লক্ষ্য পশ্চিমে গিয়ে জ্ঞান ও সত্যের অন্বেষণ করা, যাতে একদিন আমি চীনকে বাঁচাতে পারি।”
এরপর সাত বছর তিনি কাটালেন ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নে। এরও পাঁচ দশকেরও বেশি সময় বাদে তিনি হলেন চীনের সর্বোচ্চ নেতা। প্রাতিষ্ঠানিক ভাষায় দেশটির সহপ্রধান। ততদিনে চীন অনেকটাই এগিয়ে গেছে। অনেক তাজা প্রাণ ও রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে দেশটি নিজস্ব একটি জায়গাও করে নিয়েছে।
কিন্তু তারপরও, কোথায় যেন একটি শূন্যতা রয়েই গিয়েছিল। কোনো একটি অপূর্ণতার কারণে সেই সময়ে একশো কোটি মানুষের আবাসস্থল হওয়া সত্ত্বেও দেশটি বিশ্বের আরও অনেক দেশের চেয়েই যোজন যোজন পিছিয়ে ছিল। দেশটির অনেক জায়গাই ছিল এতখানি প্রত্যন্ত ও অনগ্রসর যে সেসব জায়গার রাস্তাঘাটে গাড়ি, ট্রাক প্রভৃতির দেখাই পাওয়া যেত না। রাস্তাঘাটও ছিল নোংরা ও ভাঙাচোরা। কৃষকদের জীবনযাত্রার মান ছিল তথৈবচ। সব মিলিয়ে দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশই যেন ছিল চীন।
ঐতিহাসিক জাপান সফর
ঠিক কোন জায়গাটিতে ঘাটতি ছিল চীনের, যার ফলে সেখানকার অর্থনীতিতে এমন দূরাবস্থা চলছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরছিলেন দেং। এবং এবার সেই প্রশ্নের সদুত্তরের দেখা তিনি পেলেন পশ্চিমে নয়, পূর্বে। তা-ও এমন একটি দেশে গিয়ে, দীর্ঘদিন যাদেরকে শত্রু বলে গণ্য করে এসেছে চীনের সাধারণ মানুষ।
দেশটি হলো জাপান; একসময় যারা ছিল চীনের অধিকর্তা। তবে ১৯৭৮ সালের অক্টোবর মাসে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় সফরে সেই জাপানের মাটিতেই পা রাখলেন দেং। উদ্দেশ্য জাপানের সাথে দীর্ঘদিনের বৈরিতা দূর করতে চীন-জাপান শান্তি ও মৈত্রী চুক্তিতে স্বাক্ষর করা।
সেই সফরে গিয়ে চুক্তিতে স্বাক্ষর ছাড়াও সম্রাট হিরোহিতোর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন দেং। তবে সেবার জাপানে গিয়ে তিনি এমন আরও কিছু জিনিসের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন, যা ঝড় তুলেছিল তার মনস্তত্ত্বে। এবং পরবর্তীকালে পাল্টে দিয়েছিল গোটা চীনের ইতিহাসই।
জাপানে গিয়ে ঘুরে ঘুরে সেখানকার স্টিল, অটোমোবাইল ও ইলেকট্রনিক কারখানাগুলো দেখেছিলেন দেং। দেখেছিলেন সেদেশের বুলেট ট্রেনও। যতই দেখছিলেন, ততই বিমোহিত হচ্ছিলেন তিনি। মুগ্ধতা ক্রমশ বাড়ছিল। পাশাপাশি আরও একটি চিন্তা তার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল- যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপান যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি সামলে উঠে, আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এতখানি এগিয়ে যেতে পারে, চীনা মস্তিষ্ক থেকে কেন এমন জিনিস বের হবে না?
দেং ভাবলেন, নিশ্চয়ই হবে, শুধু প্রয়োজন দেশে সেরকম বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা। অপরিকল্পিত অর্থনীতির কারণে প্রচুর ভুগেছে চীন। এবার সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতেও আনতে হবে আমূল পরিবর্তন।
চীনা অর্থনীতির সংস্কার
বস্তুতই, চীনের তৎকালীন নেতারা দীর্ঘদিন ধরেই অনুভব করে আসছিলেন দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যের ইতিহাসকে যে করেই হোক পাল্টে ফেলতে হবে। জাপান সফর শেষে দেশে ফিরে দেংয়ের মনেও এমন চিন্তাধারা আরও গভীরভাবে জেঁকে বসলো। তাই তিনি আহবান করে বসলেন কম্যুনিস্ট পার্টির একাদশ কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ সেশন।
১৯৭৮ সালের সেই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো, চীনে আর আগেকার মতো সমাজতন্ত্র থাকবে না। বরং সেখানকার কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতিতে নিয়ে আসা হবে পরীক্ষামূলক বাজার উপাদানের সম্মিলন, যাকে উপস্থিত নেতারা অভিহিত করেন চীনা ভাবধারার সমাজতন্ত্র হিসেবে।
এবং এভাবেই, আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে চীনে শুরু হয়েছিল দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে ওঠার লড়াই, যার পোষাকী নাম Reform and Opening Up।
সংস্কারের ফলাফল
সত্যি সত্যিই আজ অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে চীন। ১৯৭৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর দেং যখন চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোডম্যাপ প্রণয়ন করেছিলেন, তখন দেশটির অর্থনীতি ছিল একেবারেই ভঙ্গুর। সেই সময় চীনের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ছিল মাত্র ১৫ হাজার কোটি ডলার। চল্লিশ বছর পর জিডিপি এখন ১২ লাখ কোটি ডলার। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পর চীনই এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। খুব শীঘ্রই হয়তো তারা যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে যাবে।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিলিয়নিয়ারও এখন চীনের। দেশটিতে এই মুহূর্তে ৬২০ জন বিলিয়নিয়ার রয়েছে। পাশাপাশি মিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ২০ লাখ। গত ২০ বছরে প্রাপ্তবয়স্ক চীনা নাগরিকের মাথাপিছু আয় চার গুণ হারে বেড়েছে। দেশটিতে মাত্র এক শতাংশেরও কম নাগরিক চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। দেং ক্ষমতায় থাকাকালীনই দেশটির ২০ কোটি কৃষকের দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হয়েছিল। আর একসময় যে চীন দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল, তারাই আজ বিশ্বের সামগ্রিক সম্পদের দশ শতাংশের মালিক
এই সবই সম্ভব হয়েছে দেং জিয়াওপিংয়ের দূরদর্শী নেতৃত্বের ফলেই। জাপান থেকে দেশে ফিরে এসে তিনি যদি চীনের অর্থনীতিকে বদলে দেয়ার ছক না কষতেন, তাহলে আজ পুরো বিশ্বজুড়ে চীনের এমন জয়জয়কার দেখা যেত না। দেখা যেত না সকল ক্ষেত্রে চীনা পণ্যের এমন একচেটিয়া আধিপত্যও। তাই তো দেংকে বলা হয় চীনের অর্থনৈতিক সংস্কার ও সমাজতান্ত্রিক আধুনিকীকরণের প্রধান স্থপতি।
চীনের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পাশাপাশি ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন দেং জিয়াওপিং চীনের আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিশাল প্রভাব ফেলেছিলেন।
রাজনৈতিক সংস্কার
দেং ক্ষমতায় আসার আগপর্যন্ত চীনের রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল একজন ‘কাল্ট অব পার্সোনালিটি’র। চেয়ারম্যান মাও এমন একটি সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে একজন ব্যক্তিই ছিলেন সর্বসময় ক্ষমতার অধিকারী, এবং তিনিই একনায়ক হিসেবে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব করে যাবেন। যদিও দেং চীনে গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামোর পক্ষপাতী ছিলেন না এবং ক্ষমতার এখতিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির করতলে রেখে দিতেই আগ্রহী ছিলেন, তারপরও তিনি তার সরকারে পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থার তুলনায় কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছিলেন। তিনি তার নিজের অফিসের গুরুত্ব নিজে থেকেই অনেকটা কমিয়ে এনেছিলেন, এবং ক্ষমতার কিঞ্চিৎ বিকেন্দ্রীকরণ ঘটিয়েছিলেন, যা চীনের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তনই নিয়ে এসেছিল। সরকার ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে সেটিকে আরও বেশি কার্যকরী করে তোলায়ও তিনি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন।
মধ্যমপন্থী পররাষ্ট্রনীতি
দেংয়ের নেতৃত্বে চীন কেবল বিশ্ব মানচিত্রের নতুন পরাশক্তি রূপেই আবির্ভূত হয়নি, বরং অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার সুনামও অর্জন করেছিল। ক্ষমতায় বসার প্রথম বছরেই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামগ্রিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন, যা ছিল সেই প্রজন্মের অভূতপূর্ব একটি ঘটনা। তিনি জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্সের মত দেশগুলোর সাথেও নতুন করে কূটনৈতিক মৈত্রী গড়ে তুলেছিলেন। তার এমন বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির ফলে বিদেশীরা চীনে বিনিয়োগে আগ্রহী হতে থাকে, আর ক্রমশই ফুলে-ফেঁপে চীনের অর্থনীতি। অবশ্য দেংয়ের শাসনামলেও চীন তিব্বত, তাইওয়ানের মত বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের প্রতি নিজের আগ্রাসী মনোভাব বজায় রাখে।
আন্দোলন অবদমনে নৃশংসতা
দেং তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার এবং ইতিবাচক পররাষ্ট্রনীতির কারণে সর্বমহলে ভূয়সী প্রশংসায় সিক্ত হলে কী হবে, তার বিরুদ্ধে সকল বিপ্লবকেই তিনি কঠোর হাতে দমন করেছেন, এবং তার ফলে সর্বোচ্চ নৃশংসতার পরিচয় দিতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। অত্যন্ত নির্মমভাবে তিনি গণতন্ত্রকামী আন্দোলনগুলোকে দমন করেছেন। ১৯৮৯ সালের ৩-৪ জুন তিয়ান আনমেন স্কয়ারে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে তিনি সেখানে দুই লক্ষের মতো সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করেন। চীনা সেনাবাহিনী নির্বিচারে নিরস্ত্র তিন সহস্রাধিক বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে। এর পাশাপাশি তিনি তার পুরো শাসনামল জুড়েই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে গ্রেফতার ও জেলবন্দি করা অব্যাহত রাখেন।
শেষ কথা
১৯৮৯ সালে তিয়ান আনমেন স্কয়ারে নৃশংসতার পর দেংয়ের প্রতিপত্তি অনেকটাই হ্রাস পায়, এবং সেই বছরই তিনি চীনের কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দেন। ১৯৯২ সালে রাজনীতি থেকেও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেন। তবু চীনে তখনও চলছিল দেং জিয়াওপিংয়ের যুগ। সাধারণ মানুষের কাছে তিনিই সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে স্বীকৃত হতে থাকেন, এবং নেপথ্যে থেকে দেশের শাসনক্ষমতা তিনিই পরিচালনা করছেন বলে অনেকেই ধারণা করতে থাকে।
তবে ব্যক্তিগতভাবে দেং তার উত্তরসূরীদের শাসনব্যবস্থা নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলেন না। যখন তিনি দেখতে পেলেন নতুন শাসকদের অধীনে তার অর্থনৈতিক এজেন্ডা পূরণ হচ্ছে না, তখন তিনি চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহরগুলোতে এক ঐতিহাসিক সফরের সূচনা করেন। একে একে তিনি গুয়ানজাও, শেনজেন, জুহাই শহরগুলো ভ্রমণ করেন, এবং নববর্ষ পালন করেন সাংহাইতে। ভ্রমণের আড়ালে তিনি এসব শহরে নতুন করে তার অর্থনৈতিক মূলনীতির প্রচারণা চালাতে থাকেন, এবং তাতে সফলও হন। এভাবেই রাজনীতি থেকে অবসরের পরও দেং দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেন। তাই তো অনেকের কাছে আজও তিনিই আধুনিক চীনের রূপকার।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/