বন্ধুবান্ধবের সাথে মোটরসাইকেলে করে ঘুরে বেড়ানোটা যেকোনো বাইক ক্লাবের প্রধান আকর্ষণ। নিছক মজা করার উদ্দেশ্যে সব বাইকারকে এক জায়গায় জড়ো করতে গড়ে তোলা হয় বাইকার ক্লাবগুলো। কিন্তু সেই ক্লাবের সদস্যরা যদি বাইকিংয়ের পাশাপাশি জড়িয়ে পড়ে মাদক চোরাচালান, খুন, ধর্ষণের মতো সংঘবদ্ধ সব অপরাধে, তবে সেই দলটিকে আর ক্লাব না বলে ‘বাইকার গ্যাং’ বলা হয়।
এ ধরনের গ্যাংয়ের সদস্যরা আইন অমান্য করার ক্ষেত্রে খুব সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আমেরিকায় বাইকার গ্যাংগুলোর দৌরাত্ম্য বেশি হলেও সারা পৃথিবীর অনেক দেশেই তারা কম-বেশি প্রাধান্য বিস্তার করে। তবে বাইকার গ্যাং ধারণা বা টার্মটির উৎপত্তি আমেরিকায় হওয়ায় শতকরা ৯৯ ভাগ গ্যাং আমেরিকা কেন্দ্রিক বলে ধরে নেয়া হয়। আপনারা যারা মনে করছেন বাইকার গ্যাং মানে এখানে কেবল পুরুষদের আধিপত্য বিরাজ করবে, তাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, গ্যাংগুলোতে নারী-পুরুষ উভয়েই সমান গুরুত্ব বহন করে।
এমসি বা মোটরসাইকেল ক্লাবগুলোর মধ্যে মাত্র এক শতাংশ নিজেদের ‘মোটরসাইকেল গ্যাং’ বলে দাবী করে। তারা নিজেদের নামই দিয়েছে ‘ওয়ান পার্সেন্টার’ বা ১%। তাদের ভাষ্যমতে, বাকি ৯৯% ক্লাবের সাহস বা যোগ্যতা নেই আইনের চোখে ধুলো দিয়ে নতুন কিছু করার। হ্যাঁ, অন্যান্য অপরাধীদের মতো তারাও নিজেদের অপরাধকে ‘ব্যতিক্রমধর্মী কিছু’ বলে চালিয়ে দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এখানে বলে রাখা ভালো, একটি ক্লাবের কয়েকজন সদস্য মিলে গ্যাং তৈরি করতে পারে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, গোটা ক্লাবের সবাই ঐ গ্যাংয়ের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই ‘বাইকার ক্লাব’ এবং ‘বাইকার গ্যাং’ দুটি আলাদা বিষয়। বিশ্বজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হাজারখানেক বাইকার গ্যাংয়ের মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত-সমালোচিত পাঁচটি গ্যাংয়ের কথা থাকছে আজকের আয়োজনে।
১. সানস অফ সাইলেন্স
‘সানস অফ সাইলেন্স’ গ্যাংটির উৎপত্তি হয় কলোরাডোর নিয়োট এলাকায়, ১৯৬৬ সালে। এরা ‘১%’ মোটরসাইকেল গ্যাংয়ের স্বঘোষিত সদস্য। ২০০৯ সালে তাদের গ্যাং সাম্রাজ্য নিয়ে ‘হিস্ট্রি চ্যানেলে’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ১৯৬৬ সাল থেকে তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল উত্তরাঞ্চলের দিকে। জার্মানিতেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এই ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়। দ্য সানস অফ সাইলেন্সের মূলমন্ত্র হলো- ‘Donec Mors Non Seperat’, ল্যাটিন এই কথাটির বাংলা করলে দাঁড়াবে, ‘যতক্ষণ না মৃত্যু আমাদের আলাদা করতে পারে’। অর্থাৎ আমরণ একসাথে অন্যায়-অপরাধ করার ব্রত নিয়েই মাঠে নেমেছে তারা।
সানস অফ সাইলেন্সের আমেরিকান ঈগল সম্বলিত লোগোটি অনুপ্রাণিত হয়েছে ‘দ্য বাডওয়েজার’ নামক বিয়ার কোম্পানির লোগো থেকে। ঈগল পাখির উপরে ‘এ’ আদ্যক্ষরের ঠিক নিচে তাদের মূলমন্ত্রটি ছাপানো হয়েছে। ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে ডেনভারের বৃহত্তম আন্ডারকভার বা গোপন অপারেশনের মাধ্যমে ‘দ্য সানস অফ সাইলেন্স’ গ্যাংয়ের ৩৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মাদক চোরাচালান ও অবৈধ অস্ত্র বহনের অভিযোগ ছিল। অভিযান চলাকালীন সময়ে তাদের কাছ থেকে ২০ গ্রাম মেথামফেটামিন, ৩৫টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৪টি হাতবোমা, ২টি সাইলেন্সারসহ প্রচুর পরিমাণে নগদ টাকা এবং বেশ কয়েকটি চোরাই মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়।
২. ভ্যাগোস
১৯৬০ এর দশকে ক্যালিফোর্নিয়ার সান বার্নার্ডিনো এলাকায় যাত্রা শুরু করে ‘ভ্যাগোস মোটরসাইকেল ক্লাব’। ক্লাবের সদস্যরা সবাই মিলে সবুজ রঙের পোশাক পরে, নর্স পুরাণের চতুর দেবতা ‘লোকি’র বেশ ধারণ করে ঘুরে বেড়াত। তাদের সংগঠনের প্রায় ২৪টি শাখা রয়েছে গোটা পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রে, যার মধ্যে অ্যারিজোনা, নেভাডাসহ বেশ কিছু নামকরা এলাকা রয়েছে। তাছাড়া মেক্সিকোতেও তারা নিজেদের ৩টি অঙ্গসংগঠন প্রতিষ্ঠা করে।
‘ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন’ বা ‘এফবিআই’ এবং ‘ব্যুরো অফ অ্যালকোহল, টোব্যাকো, ফায়ারআর্মস অ্যান্ড এক্সপ্লোসিভ’ বা ‘এটিএফ’ কর্তৃক অসংখ্যবার তাদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানো হয়েছে। মেথামফেটামিন উৎপাদন ও বিতরণ, খুন, অর্থ পাচার, অবৈধ অস্ত্র চোরাচালান সহ বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে তাদের নামে। ২০০৬ সালের মার্চ মাসে পরিচালিত একটি সংঘবদ্ধ অভিযানে ভ্যাগোস গ্যাংয়ের ২৫ সদস্য ও অন্যান্য সহযোগীদের গ্রেপ্তার করা হয়। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে এটিকে ‘সবচেয়ে বড় তদন্ত’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
৩. হেল’স অ্যাঞ্জেলস
আমেরিকার সবচেয়ে কুখ্যাত বাইকার গ্যাং ‘হেল’স অ্যাঞ্জেলস’। আমেরিকার হাইওয়েতে তাদের দীর্ঘদিনের পথচলার ইতিহাস রয়েছে। তাদের উৎপত্তি বা প্রতিষ্ঠা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। কেননা গোপনীয়তা রক্ষার্থে তারা এত বেশি সাংকেতিক নাম ব্যবহার করতো যে, কোনটি তাদের আসল নাম তা খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৯৪০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে কোনো একসময় ক্যালিফোর্নিয়ায় ‘হেল’স অ্যাঞ্জেলস এমসি’ নামক মোটরসাইকেল ক্লাবটি গড়ে ওঠে। তাদের স্মারকচিহ্ন হলো ‘মড়ার খুলি’ সম্বলিত একটি লোগো, যা ৮৫তম ফাইটার স্কোয়াড্রন ও ৫৫২তম মিডিয়াম বোম্বার স্কোয়াড্রন থেকে নকল করা হয়েছে। সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডের উপরে লাল ছাপার হরফে লেখা হয় ক্লাবের নাম। তুমুল জনপ্রিয়তার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি রাশিয়া, নিউজিল্যান্ড, এমনকি উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ আর অস্ট্রেলিয়ার প্রায় আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে তাদের শাখা-প্রশাখা।
প্রতিদ্বন্দ্বী বাইকার গ্যাংগুলোর সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে বারংবার নিয়ম ভেঙে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক অপযশ অর্জন করে হেল’স অ্যাঞ্জেলস। তারা সবচেয়ে মারাত্মক অপকর্মটি করে ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসে, আলতামন্ট স্পিডওয়েতে, আলতামন্ট ফ্রি কনসার্টে। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, কনসার্ট উপলক্ষে হেল’স অ্যাঞ্জেলসের কয়েকজন সদস্যকে নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয় ‘দ্য রোলিং স্টোনস’ ব্যান্ড। জনতার ভিড় বেড়ে গেলে কোনোরকম কথাবার্তা না বলে, সোজা বন্দুক বের করে বাইকার গ্যাংয়ের সদস্যরা। শুধু দর্শক সারিতেই নয়, মঞ্চে উঠেও থামে না তাদের হাঙ্গামা। পরবর্তীতে এক যুবককে প্রহার করে মেরেই ফেলে হেল’স অ্যাঞ্জেলসের গুটিকতক সদস্য। এমন জনারণ্যে আরেকবার অপকর্ম করেছিল তারা, নেভাডার ললিনে ‘হারাহ’স ক্যাসিনো অ্যান্ড হোটেলে’ সংঘটিত হয়েছিল তা। সেবার ক্যাসিনোতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল ‘মঙ্গোলস’ গ্যাংয়ের সদস্যদের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে হেল’স অ্যাঞ্জেলস দলের দুজন আহত এবং মঙ্গোলস দলের একজন ছুরিকাঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়।
৪. মঙ্গোলস
মঙ্গোলস, যারা ‘মঙ্গোল ন্যাশন’ বা ‘মঙ্গোল ব্রাদারহুড’ নামেও পরিচিত, ১৯৬৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেবেলোয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্ণবাদের শিকার হয়ে যারা ‘হেল’স অ্যাঞ্জেলস এমসি’তে প্রবেশ করতে পারেনি তারা ‘হিসপ্যানিক বাইকার’ নামে আরেকটি সংঘ গঠন করে। পরবর্তীতে সেখান থেকেই জন্ম নেয় ‘মঙ্গোলস এমসি’। কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ সবাই মঙ্গোলস দলের সদস্য হতে পারে, তাদের স্মারকচিহ্নে ‘মঙ্গোলস’ কথাটি কালো রঙ দিয়ে বিশাল হরফে লেখা। পনি টেইল করে চুল বাঁধা, মোটরসাইকেলে চড়ে বসা, চোখে সানগ্লাস পরা, হাতে তরবারি ধরা এক খেলোয়াড়ের উপরে স্মারক কথাগুলো লিখে তৈরি করা হয়েছে তাদের লোগো। মঙ্গোলদের ইতিহাস মিশে আছে মূলত পশ্চিমা যুক্তরাষ্ট্রে, পাশাপাশি কানাডা, মেক্সিকো আর ইতালিতেও তারা সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে।
২০০৮ সালে মঙ্গোলস এমসির বিরুদ্ধে যথাযথ প্রমাণ সংগ্রহ করতে এটিএফের চার সদস্য পুরোদস্তুর গ্যাংয়ের সদস্য বনে যান! অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে তারাও বাইক রেসে অংশ নিতেন, তাদের যাবতীয় কার্যাবলীতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতেন। আন্ডারকভার এই অপারেশনের ফলস্বরূপ গ্যাংয়ের ৩৮ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়, যাদের মধ্যে গ্যাংয়ের প্রেসিডেন্ট রুবেন ডক ক্যাভাজোস নিজেও ছিলেন। পরবর্তীতে ১৬০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয় এবং ১১০ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, মঙ্গোলস এমসি ক্লাবের সদস্যরা এখন তাদের লোগো ব্যবহার করতে পারবে না।
৫. পেগানস
১৯৫৯ সালে ম্যারিল্যান্ডে জন্ম হয় পেগানস বাইকার গ্যাংটির, ১৯৬৫ সালের মধ্যেই তার বিস্তার ঘটে বাতাসের গতিতে। সূর্যের উপর বসে থাকা নর্স পুরাণের অগ্নিদেবতা সার্টর, হাতে ধরা একটি তলোয়ার যাতে লাল, নীল আর সাদা বর্ণে লেখা ‘পেগানস’- এই হলো পেগানসদের স্মারকচিহ্ন। হাতাকাটা ডেনিম জ্যাকেটের সাথে নাৎসি বাহিনীর লোগোর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ পোশাকে দেখা যায় তাদের। তাদের অনেকের হাতেই ‘আরগো’ এবং ‘নুনইয়া’ লেখা ট্যাটু দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা পুরোপুরি তাদের দখলে থাকে।
কুখ্যাত হেল’স অ্যাঞ্জেলস মোটরসাইকেল ক্লাবের সাথে মারামারিতে জড়িয়ে পড়া ছাড়াও তাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। খুন, অগ্নিসংযোগ, মাদক চোরাচালান তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ত্রাসে পরিণত করেছে। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, মোটরসাইকেল আর ট্যাটু বলকে কেন্দ্র করে সংঘটিত এক গোপন অভিযানে পেগানস মোটরসাইকেল ক্লাবের ৭৩ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তারা স্বীকার করে, হেল’স অ্যাঞ্জেলসের ১০ জন আহত বাইকারকে তারা বেধড়ক পিটিয়েছে। তারপর ২০০৫ সালে, পেগানের সদস্যরা ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিতভাবে হেল’স অ্যাঞ্জেলসের ফিলাডেলফিয়া অঞ্চলের সহকারী সভাপতিকে খুন করে। এরপর থেকে তাদের বেশিরভাগ সদস্যই পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
ফিচার ইমেজ: Eskipaper.com