১৯৩০ সালের আগের কথা, কানাডার কিভালিক অঞ্চলে ছিল এক তুষার-স্নিগ্ধ হ্রদ। নাম তার আনজিকুনি। একদিন এক অনুসন্ধিৎসু বৃদ্ধ জেলের আগমন ঘটে এখানে। মিঠা পানির মাছের খোঁজে এস্কিমোর ইনুইট সম্প্রদায়ের এই লোকের এখানে ছুটে আসা। এসেই হ্রদের অগভীর তলদেশে টের পেলেন মাছের বেশ সরগরম উপস্থিতি। সঙ্গে সঙ্গে হ্রদের একপাশে তাঁবু খাটালেন তিনি। পাশে আগুন জ্বালালেন ডালপালা সংগ্রহ করে। খড়কুটো দিয়ে তৈরি করলেন নিজের জন্য ছিমছাম ছোট্ট একটি বাসস্থানও।
হিমশীতল কনকনে ঠাণ্ডা পরিবেশে বেশ কিছুদিন এখানে অবস্থানের পর এলাকাটি খুবই পছন্দ হলো তার। খবর পাঠালেন অপেক্ষায় থাকা নিজ গোত্রের লোকজনের নিকট। তার প্রতি গোত্রের সবার ছিল অপার ভরসা। ফলে, বিনাবাক্যে সবাই তল্পিতল্পা গুটিয়ে পৌঁছে গেলেন সেখানে। ধীরে ধীরে গড়ে তুললেন ২০০০ লোকের এক স্নিগ্ধ জনবসতি। নবাগত মানুষেরা হ্রদের নামানুসারে তাদের নতুন ভূমির নামকরণ করলেন আনজিকুনি গ্রাম।
মিঠা পানির হ্রদ থেকে মৎস্য আহরণ, তা দিয়ে তৈরি করা উপাদেয় ভোজন, সঙ্গে মাতাল করা চোলাই মদের উষ্ণ পানীয় ছিল তাদের প্রিয় খাবার। আনজিকুনিদের আতিথেয়েতায় এলাকার পাশ ঘেঁষে ছুটে চলা পথিকদের আনাগোনাও বাড়তে থাকে এ গ্রামে। ক্ষুধার্ত শিকারীরাও রাতের আঁধারে আসতো এখানে। এভাবে ধীরে ধীরে গ্রামটি পরিচিত হয়ে উঠে আশেপাশের দু-চার অঞ্চলে। পরিচিতি পায় অবসর-বিনোদন আর আড্ডা-কোলাহলের এক নৈসর্গিক স্থান হিসেবে।
১৯৩০ সালের নভেম্বর মাস, প্রচণ্ড শীতের এক জ্যোৎস্নাস্নাত রাতে এক কানাডিয়ান শিকারী মদ্যপানের উদ্দেশ্যে পা বাড়ান জনাকীর্ণ এই আনজিকুনির পথে। জো লেবল নামক এই ব্যক্তি এর আগেও বেশ কয়েকবার এসেছিলেন এ গ্রামে। গুটিকতক পরিবারের সঙ্গে তার গড়ে উঠেছিল সখ্যতাও। ফলে অনেকদিন পর সরল-সহজ এ মানুষগুলোর সঙ্গে পুনরায় দেখা হবে, চোলাই মদের চুমুকে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া হবে ভেবেই তার চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো। রিক্ত শীতের হিমশীতল হাওয়া উপেক্ষা করে তাই প্রফুল্ল মনেই গ্রামের পানে এগিয়ে চললেন তিনি।
লেবল আগেরবার যখন এখানে এসেছিলেন, তখন গ্রামে প্রবেশের পূর্বে বেশ দূর থেকেই লোকজনের হৈ-হুল্লোড় শুনতে পেয়েছিলেন। কিন্তু এবার যেন একটু ভিন্ন। গ্রামে পা দিতেই এক অদ্ভুত নীরবতা ঘিরে ধরলো তাকে। চারিদিকে যেন বিরাজ করছে গা ছমছমে পরিবেশ। যেন তিনি ভুল করে অন্য কোনো গ্রামে চলে এসেছেন। কিন্তু না! পূর্ণিমার ঝলমলে রূপালী আলোয় এখানে তার পরিচিত সবকিছুই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন। দেখতে পাচ্ছেন না কেবল চেনা-জানা প্রিয় গ্রামবাসীদের।
ভাবলেন, হয়তো রাত একটু গভীর হওয়ায় সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই পা চালালেন গ্রামের আরও ভেতরে। গ্রামের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন লেবল। এখানেও কারও কোনো সাড়া নেই। সবকিছুতেই কেমন পিনপতন নীরবতা! কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা না। কোথায় গেল তারা? এমন সাত-পাঁচ ভেবে পরিচিতদের ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন তিনি। জোর গলায় ডাকতে লাগলেন তাদের নাম ধরে।
তার ডাকে সাড়া দিয়ে কেউ বেরিয়ে আসছে না দেখে একটি ঘরের দরজার কপাটে ঠক ঠক শব্দ করলেন লেবল। ধাক্কা দিলেন আলতো করে। দেখলেন- দরজা ভেতর থেকে খোলা। ঘরের ভেতরে এলোমেলোভাবে পড়ে আছে বাসিন্দাদের ব্যবহৃত তৈজসপত্র, কাপড়চোপড়সহ আরও নানা কিছু। উনুনে অর্ধসিদ্ধ খাবারের পাত্রও চোখে পড়লো তার। ভাবলেন এ ঘরের সবাই হয়তো কোথায় গিয়েছে। তাই সরল মনে অন্য আরেকটি ঘরের পানে পা বাড়ালেন লেবল। কিন্তু না, সেখানেও একই ঘটনা! এভাবে গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি পরখ করে একরকম অদ্ভুতুড়ে পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন তিনি।
এবার তার শিরদাঁড়া বেয়ে এক হিমশীতল আতঙ্ক মাটিতে নেমে এলো। বুঝতে পারলেন, এই মুহূর্তে এখানে একদমই একা তিনি! তখনই অজানা আতঙ্কে শরীরটা মোচড় দিয়ে উঠলো তার। তৎক্ষণাৎ গ্রাম থেকে দ্রুত বেরিয়ে এলেন তিনি। কিছুদূর যেতেই নিরাপত্তা বাহিনীদের টেলিগ্রাফের দেখা পেলেন। ঘটনার বিস্তারিত লিখে পাঠালেন তাদের কাছে। পরদিন একদল চৌকশ সদস্য পৌঁছে গেল সেখানে। তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলো পুরো এলাকা। কিন্তু একজন জনমানবেরও দেখা পেল না তারা। তবে যা পেলো তা রীতিমতো ঘাবড়ে দিল তাদের।
গ্রামের একপাশে সারিবাঁধা কবরগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। কারা যেন কবর থেকে লাশগুলো তুলে নিয়ে গেছে। যে পথে গেছে, সে পথে পড়ে আছে গ্রামবাসীদের সাতটি পোষা স্লেজ কুকুরের অর্ধমৃত নিথর দেহ। কুকুরগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে ভয়ংকর কিছুর সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করেছে তারা। সেদিন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা এখানকার ঘটনার কোনো কিছুই আঁচ করতে পারেনি। আশপাশের গ্রামবাসীও জানে না ঠিক কী হয়েছে আনজিকুনিদের সাথে। তবে তাদের দাবি, কিছুদিন পূর্বে আনজিকুনি গ্রামের আকাশে একধরনের নীলাভ আলোর ঝলকানি দেখতে পেয়েছে তারা।
অতঃপর, রোমহষর্ক এ ঘটনার বহুদিন পর গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করলেন। সেখানে তারা জানান, জো লেবলের দাবি বানোয়াট ও মিথ্যে। জো লেবল এর আগে কখনো এ গ্রামে যাননি, এবং নির্জন এ স্থানে কখনোই কোনো মানব বসতি গড়ে ওঠেনি। তবে প্রশ্ন হলো, প্রতিবেদনের তথ্য যদি সত্য হয়, তবে লেবলের বর্ণনা শুনে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা যেদিন সেখানে গিয়েছিল, তারাও দেখতে পেয়েছিল জনশূন্য পরিত্যক্ত বসতি, এলোমেলো নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈজসপত্র। এমনকি ইনুইটদের ব্যবহৃত নলাকার বন্দুকও পেয়েছে তারা। তাহলে এগুলো কাদের? কারাই বা এমন বৈরী পরিবেশে বসতভিটা তৈরি করে নিমিষেই উধাও হয়ে গেল?
আজ অবধি আনজিকুনিদের সেই নিখোঁজ রহস্যের কোনো সমাধান হয়নি। জানা যায়নি নিগূঢ় রহস্যে আবৃত এই জল্পনা-কল্পনার পেছনের ঘটনা। তদন্ত করেও এর কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি কেউ। তবে, ধারণা করা হয় কোনো অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল তারা, যার রহস্য আজও অজানা, হয়তো অজানা হয়েই থাকবে চিরদিন।