তথায় রবো না চিরদিন
আবার আসিবো ফিরে
আবারও যাবো অনন্তে মিশে
তবুও
আমারে কবর দিও
হাঁটুভাঙার বাঁকে– ‘আমেরিকান নেমস’ কবিতার শেষ দুটি লাইন হতে অনূদিত, লিখেছেন স্টিফেন ভিন্সেন্ট বেনেট
চলুন পাঠক, আপনাদের নিয়ে যাই উন্মুক্ত প্রেইরিতে, যেখানে দিগন্তবিস্তৃত ঘাসের জঙ্গলে চরে বেড়ায় বুনো মোষ। যেখানে দল বেঁধে শিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় বুনো রেড ইন্ডিয়ানের দল। হাতে থাকে তীর-ধনুক, বেটে কুড়াল। চলুন হারাই উষর পশ্চিমে।
কথিত আছে, ইউরোপীয়রাই সর্বপ্রথম উত্তর আমেরিকাতে পৌঁছেছিল এবং পশ্চিমে সাম্রাজ্য বিস্তারের নীতি শুরু করেছিল। তাই সেই অঞ্চলে বসবাসকারী স্থানীয় রেড আমেরিকান জনগোষ্ঠীর সাথে ভূমি ও অধিকার নিয়ে ইউরোপীয়দের তীব্র দ্বন্দ্ব বাধে। মূলত, আধুনিক অস্ত্রের সমাহার ও সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার স্থানীয় জনসংখ্যার দুঃখজনক পরাজয় নিশ্চিত করে। তবে এই যুদ্ধ এবং সংঘর্ষের মধ্যে রেড ইন্ডিয়ানদের বেশ কিছু শক্তিশালী নেতার সাথে সম্মুখযুদ্ধে নামতে হয়েছিলো সাম্রাজ্যবাদীদের।
লেখক, ইতিহাসবেত্তা, গ্রন্থাগারিক ডরিস অ্যালেকজান্ডার ডি ব্রাউন তার ঐতিহাসিক রচনা ‘Bury My Heart At Wounded Knee – An Indian history of the American West’-এ ১৮৬০ সাল থেকে ১৮৯০ পর্যন্ত কীভাবে সাম্রাজ্যবাদীরা যুক্তরাষ্ট্রের আদি অধিবাসীদের অত্যাচার, নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে পৈতৃক ভূমি হতে উৎখাত করেছিলো সেই বর্ণনা দিয়েছেন। এই যে উৎখাত, তার বিরুদ্ধে আদি অধিবাসীদের যে সাতজন নেতা আমৃত্যু লড়েছেন, তাদের নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের লেখাটি।
ড্র্যাগিং ক্যানো
ড্র্যাগিং ক্যানো (১৭৩৮-৯২) চেরোকীদের নেতা হয়ে দক্ষিণে ঔপনিবেশিকদের সাথে যুদ্ধ করেছেন। ১৭৭৭ সাল থেকে তিনি চিকামুগা চেরোকি বা লোয়ার চেরোকিদের যুদ্ধপ্রধান ছিলেন। বিপ্লবের সময় তিনি অন্যান্য আদিবাসী ও ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধ করেন। চেরোকিদের জমি ও অধিকার সংরক্ষণের জন্য তিনি আজীবন লড়াই করেছেন।
যখন ড্র্যাগিং ক্যানো শুধুমাত্র দুধের শিশু, তখন তিনি ও তার মা চেরোকী আদিবাসীদের হাতে ধরা পড়েন। পরবর্তীতে তাদের চেরোকী গোত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অপহরণ ও জোরপূর্বক গোত্রে অন্তর্ভুক্ত করার ঘটনা বুনো পশ্চিমে খুবই স্বাভাবিক ছিল। শৈশবেই ড্র্যাগিং ক্যানোর উপর চেরোকীদের জীবনধারার প্রভাব ছিল। ওভারহিল চেরোকিদের রীতি অনুসারে একজন যোদ্ধা পুরুষ তখনই নিজের নাম ও যুদ্ধক্ষেত্রে যোগদানের অনুমতি অর্জন করতে পারবে যখন একা একটি ক্যানো বহন করে দেখাতে পারবে। তিনি একা ক্যানো বহন করতে না পারলেও টেনে নিয়ে এসেছিলেন। তখন থেকেই ওভারহিল চেরোকীরা তার নাম দেয় ‘ড্র্যাগিং ক্যানো’। তাকে যোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে যোগ দেওয়ারও অনুমতি দেওয়া হয়।
১৭৫৯-৬১ সালের মধ্যে ড্র্যাগিং ক্যানো অ্যাংলো-চেরোকী যুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময় তিনি লিটল টেনেসি নদীতীরের এক চেরোকী শহরে প্রধান ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। মার্কিন বিপ্লবের সময় চেরোকীরা ব্রিটিশদের সাথে বন্ধুত্ব করেছিল। চেরোকী ও ব্রিটিশদের পক্ষে ড্র্যাগিং ক্যানো তখন বেশ কিছু যুদ্ধে অংশ নেন। এমনকি ঔপনিবেশিকদের হারিয়ে জমি পুনরুদ্ধারেও সক্ষম হন।
আমেরিকান বিপ্লবের পরবর্তী সময়গুলোতে চেরোকীরা তাদের জমির দখল বজায় রাখতে ড্র্যাগিং ক্যানোর নেতৃত্বে ঔপনিবেশিকদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও একাধিকবার পরাজিত হয়। ফলশ্রুতিতে চেরোকীরা নিজ জমির দখল ছেড়ে নতুন এলাকায় পুনর্বাসনে বাধ্য হয়। বিপ্লবী যুদ্ধের সময় বেশ কয়েকটি চেরোকী শহর ধ্বংস হয়ে গেলে তিনি বর্তমান চাট্টানোগা, টেনেসী এলাকায় তার লোকদের নিয়ে বসতি স্থাপন করেন। এই বসতিগুলো চিকামুগা খাঁড়ির নিকটে স্থাপন করায় এই অঞ্চলে বসবাসরত চেরোকীদের চিকামুগা চেরোকি বলা হয়। পরবর্তীতে, চেরোকী দলটি আরও নিচু জমিতে নতুন বসতি নির্মাণ করে।
ড্র্যাগিং ক্যানো, মুস্কোগি এবং চকোটসহ এলাকার অন্যান্য আদিবাসীদের সাথে জোট গঠনে সফল ভূমিকা পালন করে বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। রাতে এই জোটের সফলতা উদযাপন করার উৎসবে নৃত্যরত অবস্থায় তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ধারণা করা হয়, মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রমে অবসন্নতা অথবা আকস্মিক হৃদরোগ তার মৃত্যুর জন্য দায়ী।
তেকামসেহ
তেকামসেহ ছিলেন মার্কিন আদিবাসী শওনীদের নেতা এবং তেকামসেহ কনফেডারেসির প্রধান। তেকামসেহ কনফেডারেসি ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসীতত্ত্বের বিরোধিতা করা আদিবাসী গোষ্ঠীর ঐক্যজোট। শওনী নেতা ও যোদ্ধা তেকামসেহর জন্ম ও বেড়ে ওঠা যুদ্ধের পরিবেশেই। বিপ্লব এবং উত্তর পশ্চিম রেড ইন্ডিয়ানদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাকে অল্প বয়সেই অভিজ্ঞ করে তুলেছিল। কৈশোরের শুরুতেই তিনি বাবাকে হারান। ১৫ বছর বয়সে তিনি ওহাইও নদীতে চোরাচালান ও দাস পাচার বন্ধ করার কাজে নিয়োজিত আদিবাসী তরুণদের দলে যোগ দিয়েছিলেন।
উঠতি যৌবনে তেকামসেহ উত্তর-পশ্চিমে রেড ইন্ডিয়ানদের পক্ষে লড়াই করেছিলেন, ড্র্যাগিং ক্যানোর মহাজোটের সাথে যুক্ত হয়ে মার্কিন আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। ১৭৯০ সালে উত্তর-পশ্চিম রেড ইন্ডিয়ান যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ধি চুক্তির প্রস্তাব দেয়, তখন তেকামসেহ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান। রেড ইন্ডিয়ান নেতা ব্ল্যাক ফুটসহ বিভিন্ন গোত্রের অনেক শওনী নেতাই সন্ধিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত সীমাবদ্ধতা, মতাদর্শ এবং সকল ঐতিহ্যের একীভূতকরণ নীতি মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু তেকামসেহ নিজেদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলেন।
১৮০৫ সাল নাগাদ নিজ নেতৃত্বাধীন শওনী গোষ্ঠীকে নিয়ে তেকামসেহ আরও পশ্চিমে সরে যান। এর পেছনে প্রধান কারণ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত সমঝোতার বিরোধিতা করা, যার কারণে তার গোত্র ঝুঁকিতে পড়ে। এছাড়াও ধর্মীয় প্রথার প্রভাবও এই পশ্চাদপসরণের জন্য দায়ী ছিলো। তেকুমসেহর ছোট ভাই তেনস্কওয়াটওয়ের ধর্মীয় আচার-আচরণ দ্বারাও শওনীরা প্রভাবিত হয়েছিল। তেকুমসেহ ও অন্যান্যরা খুঁজছিলেন তাদের স্বপ্নের ধর্মীয় আবাস, যার নাম তারা দিয়েছিলেন ‘প্রফেটল্যান্ড’।
মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তেকুমসেহ বিভিন্ন আদিবাসী এবং আদি আমেরিকান সম্প্রদায় অধ্যুষিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করেছিলেন, তাদেরকে নিজ ভূমির দখলদারিত্ব বজায় রাখতে উৎসাহিত করার পাশাপাশি মার্কিনীদের জোরপূর্বক ভূমি দখল করে আবাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
১৮১০ সালে আদিবাসীদের মাঝে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ও সমর্থনের বশবর্তী হয়ে তেকুমসেহ ৪০০ আদিবাসী যোদ্ধার একটি দল গঠন করেন এবং ইন্ডিয়ানার গভর্নর উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসের বাসভবনে হামলা করে বসেন। পরবর্তীতে তেকুমসেহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গভর্নরের সাথে দেখা করেন। আদিবাসীদের একটি আমেরিকান-ইন্ডিয়ান জোট গঠনের জন্য তেকুমসেহ অন্যান্য গোত্রের সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেন ও সফল হন।
১৮১২ সালের যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যুদ্ধের সময় তেকুমসেহ ব্রিটিশ কনফেডারেট আর্মির পক্ষে নিজ বাহিনী নিয়ে মার্কিনীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং ব্রিটিশরা পরবর্তীতে আদিবাসী আমেরিকানদের একটি সংরক্ষিত অঞ্চল দেয়ার চেষ্টা করেছিল। ১৮১৩ সালের ৫ অক্টোবর তেকামসেহ যুদ্ধে মারা যান। কর্নেল রিচার্ড জনসন দাবি করেন, তিনি তেকামসেহকে হত্যা করেছেন, তবে এই দাবীর স্বপক্ষে সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তেকামসেহ ও ব্রিটিশ বাহিনী মার্কিনীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৮১২ সালের যুদ্ধে প্রস্তাবিত চুক্তিগুলোর শর্ত বজায় রাখেনি।
জেরোনিমো
জেরোনিমো চিরিয়াহুয়া অ্যাপাচিদের বেদোনকোহে গোত্রের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। অ্যাপাচি-আমেরিকান সংঘাতে সক্রিয় অবদান রাখা জেরোনিমো উত্তর মেক্সিকো এবং আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বেশ কয়েকটি ছোট ছোট অভিযানে অংশ নিয়ে মার্কিনীদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি করেন। ১৮৪৮ সালে মেক্সিকান-আমেরিকান যুদ্ধের পর এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে। তিনি ১৮৫০-৬৬ সাল অবধি এই সংঘাতে সক্রিয় ছিলেন।
এই সংঘাতে অ্যাপাচি প্রতিরক্ষা কৌশল ছিল গেরিলা যোদ্ধার ন্যায় ছোট ছোট ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করা। এই অভিযানগুলো শুধুমাত্র সামরিক উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হতো না, সাথে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যও কাজ করেছিল। পশুসম্পদ ও সরবরাহ চুরি থেকে শুরু করে অভিবাসী বন্দীসহ সবরকম সহিংসতাই যেন খুব স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছিলো। মার্কিন ও ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীরা এসব অভিযানের সমান সহিংস প্রতিক্রিয়া জানায়।
জেরোনিমো যে তার নিজের লোকদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিলেন তেমনটি নয়। স্বগোত্রীয়রাও তাকে খুব একটা পছন্দ করতো না। তিনি কোনো গোত্রের নেতৃত্ব দেননি, যুদ্ধপ্রধানও ছিলেন না। তিনি গেরিলা অভিযানের সফল নেতা ছিলেন এবং ৩০-৫০ জন নিজস্ব অনুসারী নিয়েই চলাফেরা করতেন। অনেক অ্যাপাচি বিশ্বাস করত, জেরোনিমোর কাছে ভবিষ্যত দেখার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা রয়েছে।
১৮৭৬-৮৬ এর মধ্যবর্তী সময়ে জেরোনিমো আমেরিকান শর্তাদি মেনে নেন এবং অ্যাপাচি রিজার্ভেশনে নিজের বাড়ি তৈরি করেন। এটি অ্যাপাচির জীবনধারার প্রচলিত পদ্ধতির বিরোধী ছিল। কিন্তু খুব বেশি দিন এই রুদ্ধ জীবন জেরোনিমোকে আটকে রাখতে পারেনি। রিজার্ভেশন ও নিজ বাড়ির মায়া ছেড়ে তিনি আবার গেরিলা অভিযান শুরু করেন। ১৮৮৬ সালে জেরোনিমো আবার আত্মসমর্পণ করেন এবং ওকলাহোমাতে পুনর্বাসিত হন, যেখানে তিনি কৃষিকাজ শুরু করেন।
১৮৯৮ সালে, জেরোনিমো ট্রান্স-মিসিসিপি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নেন, যেখানে তিনি দর্শকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। তিনি আমৃত্যু জনগণের মুখপাত্রের ভূমিকায় ছিলেন। তবে আইনত তিনি যুদ্ধবন্দী ছিলেন। এমনকি তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি থিওডোর রুজভেল্টের সাথে সাক্ষাৎ করে নিজের এবং অন্যান্য অ্যাপাচিদের সাথে সংঘাতপূর্ণ সম্পর্কের ইতি ঘটাতে অনুরোধও করেছিলেন তিনি। এই অনুরোধ মার্কিন প্রশাসন মেনে নেয়নি। ১৯০৯ সালে ওকলাহোমার ফোর্ট সিলে যুদ্ধবন্দী থাকাকালেই জেরোনিমো মারা যান।