ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ- একজন নারী, যার জন্মের সময় পিতা আশা করেছিলেন পুত্রসন্তান, কন্যারূপে যার জন্ম তার মায়ের ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যু ঠেকাতে পারেনি- সেই নারীই কালের পরিক্রমায় হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বৃহৎ ও শক্তিশালী সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি। প্রায় সমগ্র ইউরোপের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তখন এতোটাই বিস্তৃত হয়ে চলেছে যে বলা হতো, এখানে সূর্য কখনো ডোবে না। রানী প্রথম এলিজাবেথ- ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠতম শাসক, যার রাজত্বে ইংরেজি সাহিত্য হয়ে উঠে ছিলো বিশ্বসাহিত্যের মধ্যগগনের উজ্জ্বলতম সূর্য, রানী প্রথম এলিজাবেথ- যার নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের কাছে পরাজিত হয়ে ফিরে গিয়েছিলো ইউরোপের ত্রাস স্পেনের ‘দ্যা ইনভিন্সিবল আর্মাডা’, রানী এলিজাবেথ- যার কূটনৈতিক দক্ষতা ও শাসকসুলভ বিচক্ষণতা ডুবন্ত ইংল্যান্ডকে নতুন করে বাঁচিয়ে তুলে তুমুল শক্তিশালী হিসাবে রাজ্যের নতুন পথচলা সূচনা করে।
এই রানী এলিজাবেথই তার পিতার প্রতিষ্ঠিত ‘চার্চ অব ইংল্যান্ড’কে শক্তিশালী করে তুলে ইংল্যান্ডের রাজধর্মকে পৃথিবীর বুকে সমুন্নত রাখার সাহসী পদক্ষেপ নেন। নানা পুরুষের সাথে ছলনার অভিযোগে বিতর্কিত হলেও তার ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু যে ছিলো প্রিয় স্বদেশ, সে ব্যাপারে তার পরম শত্রুও প্রশ্ন তুলতে পারবে না। বরং বলা হয়ে থাকে, স্বদেশের প্রয়োজনে যাকে যেভাবে হাতে রাখা যায়, তাকে সেভাবেই রেখেছিলেন তিনি- তা সে শক্তিশালী ফ্রান্সের প্রিন্স ফ্রান্সিস হোক, কিংবা হোক কোন ক্ষমতাবান ডিউক। ব্যক্তিজীবনের উর্ধ্বে স্বদেশকে স্থান দেওয়া, তীক্ষ্ণ উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন, কূটনৈতিক জ্ঞানে বিচক্ষণ, প্রজাদের প্রতি স্নেহপরায়ণ, সৌজন্যহীন অহংকারী, পিতার মতো উদ্ধত, ছলনাময়ী, কৌশলী- তবুও ইংল্যান্ডের স্বার্থের প্রশ্নে আপোষহীন পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে দক্ষ সম্রাজ্ঞী ইংল্যান্ডের ও স্পেনের রানী প্রথম এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহণের পূর্ব থেকে আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকা জীবনের প্রতিটি ধাপই ছিলো তুখোড় নাটকীয়তায় পূর্ণ, উত্থান-পতনের ঢেউয়ে প্রবল রোমাঞ্চকর।
১৫৫৩ সালের সেপ্টেম্বরে রাজা অষ্টম হেনরী অপেক্ষায় ছিলেন তার পুত্রসন্তানের আগমনের, কেননা আগে থেকেই তার গৃহে ছিলো ১৭ বছর বয়সী একজন রাজকুমারী (মেরী টিউডর)। রাজা হেনরী চেয়েছিলেন শৌর্যে-বীর্যে সুঠাম ও সুস্বাস্থ্যের একজন রাজকুমার। একদিকে পুত্র না হয়ে কন্যা হয়ে জন্মগ্রহণ করায় এলিজাবেথ পিতার বিমর্ষতার কারণ হয়, অন্যদিকে রাজার দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান হওয়ায় তার জন্মগত বৈধতাও হয় ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও এসবের কিছুই এলিজাবেথের পরবর্তী পঁয়তাল্লিশ বছরের গৌরবময় রাজত্বের উজ্জ্বলতাকে বিন্দুমাত্র ম্লান করতে পারেনি। অষ্টম হেনরীর প্রথম স্ত্রী রানী ক্যাথরিন তাকে পুত্রসন্তান দিতে ব্যর্থ হন এবং ফলস্বরূপ হারান রাজার ভালোবাসা ও রানী হওয়ার দাবী। দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যান বোলিন, যিনি ছিলেন এলিজাবেথের মা, রোমান চার্চ তাকে কখনোই রাজার স্ত্রীর স্বীকৃতি দেয়নি, অ্যান বোলিনও রাজার ভালোবাসা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি।
বিশ্বাসঘাতকতা ও চরিত্রহীনতার অভিযোগে যখন মা অ্যানের শিরচ্ছেদ করা হয় তখন এলিজাবেথের বয়স মাত্র তিন বছর। জীবনের প্রথমেই মায়ের স্নেহ ও সাহচর্যের সাথে সাথে এলিজাবেথ তার পিতা-মাতার প্রশ্নবিদ্ধ সম্পর্কের কারণে হারায় সিংহাসনে তার অধিকারও। সেবিকার কাছে সাধারণ অভিজাত মেয়ে হিসাবেই বেড়ে উঠতে থাকে এলিজাবেথ। এসময় অন্যদিকে হেনরী রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিরোধিতা করে ইংল্যান্ডে নিজেই প্রতিষ্ঠা করে বসে ‘চার্চ অব ইংল্যান্ড’। রাজার এই বিদ্রোহ রাজ্য ও রাজপরিবার উভয়কেই দু’ভাগে বিভক্ত করে ফেলে। অন্যদিকে তৃতীয় স্ত্রীর কাছে থেকে রাজা পেলেন বহু কাঙ্ক্ষিত পুত্রসন্তান ষষ্ঠ এডওয়ার্ড। রাজার মনোযোগ যখন পুত্রসন্তান ও রাজ্যের দিকে বেশি নিবেদিত, ছোট্ট এলিজাবেথ তখন প্রথা অনুসারে প্রাসাদ থেকে দূরে হ্যাটফিল্ড হাউসের শান্ত গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে উঠছিলো স্বাধীনভাবে। মাত্র চার বছর থেকে পড়াশোনা শুরু করা এলিজাবেথ ছিলেন ফ্রেঞ্চ, ল্যাটিন, গ্রীক ও ইটালিয়ান ভাষার অত্যন্ত দক্ষ।
১৫৪৭ সালে অষ্টম হেনরী মারা গেলে দশ বছরের বালক ষষ্ঠ এডওয়ার্ড সিংহাসনে বসে। বালকের শারীরিক দূর্বলতার কথা চিন্তা করে হেনরী আগেই উইলে সিংহাসনের উওরাধিকারী হিসাবে মেরী টিউডর ও এলিজাবেথের নাম উল্লেখ করে যান। রাজার আশঙ্কা সত্যি করে ষোল বছর পূ্র্ণ হবার আগেই যখন মারা গেলে এডওয়ার্ড, তখন প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসলেন কোনো নারী, তিনি মেরী টিউডর। মেরী ও এলিজাবেথ- উভয়েরই সিংহাসনে অধিকার তখন ভয়াবহ হুমকিতে পড়েছিল হেনরীর বড় বোন মার্গারেটের নাতনী ও স্কটল্যান্ডের সিংহাসনের ভবিষ্যৎ দাবিদার মেরী স্টুয়ার্টের উপস্থিতির দ্বারা। যদিও ইংল্যান্ডের সিংহাসনের প্রতি মেরী স্টুয়ার্টের দাবি বেশ জোরালো ছিলো, কিন্তু তার ক্যাথলিক ঘেঁষা মনোভাব থাকায় ও ফ্রান্সের রানী হওয়ার দরুন সে দাবী ইংল্যান্ডের জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়। কিন্তু এমন ঘোলাটে পরিস্থিতি ও রাজার কাছের লোকদের লাগাতার বিদ্রোহ ও চক্রান্ত মেরী টিউডর ও এলিজাবেথের সম্পর্ক বেশ জটিল করে তুললো।
১৫৫৩ সালের জুলাইতে সিংহাসনে বসেই মেরী একের পর এক চক্রান্তের সম্মুখীন হন। লেডি জেন গ্রেইয়ের বিদ্রোহ দমন করার পর ঘটে স্যার টমাস হোয়াইটের নেতৃত্বে বিখ্যাত বিদ্রোহ ‘দ্য হোয়াইট প্লট’। সেসময় বোনকে ডেকেও পাশে পাননি মেরী, তাই বিদ্রোহ দমন করাবার পর সন্দেহের এক তীর এলিজাবেথের দিকে ছুটে যায় তার পক্ষ থেকে। অবশ্য এলিজাবেথ একদম নির্দোষ ছিলেন কিনা, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না, কেননা ইতিহাসবেত্তারা বলেন, বিদ্রোহের আগেই অজ্ঞাত চিঠির মাধ্যমে তাকে বিদ্রোহের খবর দেওয়া হয়েছিল। চিঠির উত্তরে এলিজাবেথ নিজের অবস্থান সম্পর্কে ধূম্রজাল রেখে লেখেন- তিনি তা-ই করবেন, যা ঈশ্বর তাকে দিয়ে করাবেন। এলিজাবেথের অসুস্থতার অজুহাতকে নাকচ করে দিয়ে মেরী তাকে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বন্দী করেন। অভিযুক্ত এলিজাবেথের শাস্তি হিসাবে দূর্গে পাঠানোর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে কম্পিত হাতে বোনের কাছে লেখা চিঠিতে এলিজাবেথ লেখেন- “প্রমাণহীন অভিযোগে অভিযুক্ত শত্রু হিসাবে নয়, একজন সাধারণ অনুগত প্রজা হিসাবে আমি আমার প্রতি আপনার পুনঃবিবেচনা আশা করছি।” যদিও বিদ্রোহে এলিজাবেথের যুক্ত থাকার পক্ষে অনেক যুক্তি-প্রমাণ ছিলো, তবু তার এই চিঠি মেরীকে দ্বিধার দোলাচলে ফেলে দেয়। সেইসাথে এই চিঠি প্রমাণ দেয় এলিজাবেথের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তারও।
বিশ্বাসঘাতকতা ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগের অবধারিত শাস্তি- মৃত্যুদণ্ডের আশঙ্কায় যখন এলিজাবেথ দূর্গে বন্দী দিন পার করছেন, তখন মেরীর স্বামী স্পেনের ক্রাউন প্রিন্স ফিলিপ ও তার বাবার হস্তক্ষেপে বেঁচে যান ইংল্যান্ডের এই ভবিষ্যৎ রানী। ৮ সপ্তাহ পরে যখন এলিজাবেথকে মেরী প্রাসাদে ডাকলেন, তখন মেরী বেশ অসুস্থ। রানী নিজে বিশ্বাস করতেন যে তিনি সন্তানসম্ভবা, কিন্তু তার স্বামীসহ অন্যরা জানতেন যে তা সত্য নয়। অসুস্থতা বাড়তে থাকলে প্রথমে অস্বীকৃতি জানালেও মেরী অনেকটা বাধ্য হয়েই মৃত্যুর মাত্র ১০ দিন আগে এলিজাবেথকে সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী বলে নির্বাচিত করেন। ওদিকে মেরীর পক্ষপাতমূলক শাসনে তখন অতিষ্ঠ পুরো ইংল্যান্ড।
এখানে অবশ্যই বলে রাখা ভালো, মেরীর অসুস্থতার বিষয়টি প্রকাশ পাবার পর থেকেই এলিজাবেথের প্রতি ফিলিপের ব্যবহারে পরিবর্তন ঘটে থাকে। মূলত ফিলিপ চেয়েছিলেন তরুণী এলিজাবেথের হৃদয় জয় করে সিংহাসন দখল করতে। একই মনোভাব দেখা যায় আরো অনেক অভিজাত পুরুষের মধ্যেও। কিন্তু এলিজাবেথ নিজের স্বকীয়তা আর স্বাধীনতার ব্যাপারে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সমস্ত প্রেম ও প্রস্তাবকে কৌশলে পাশ কাটিয়ে নিজের স্বাধীনতা ও ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখেন তিনি।
মেরীর শাসনামলে প্রোটস্ট্যান্টদের ওপর নির্যাতন চরমে উঠেছে, বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে রাজ্যের নানা প্রান্তে। মেরীর সময়ে একবার প্রায় ৩০০ সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারা হলো। ক্যাথলিক হতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে এরকম নানা ঘটনা তখন রোজকার ব্যাপার। এলিজাবেথের সাথে সকলে লক্ষ করে গেলো মেরীর একের পর এক ভুল পদক্ষেপগুলো। সমগ্র ইংল্যান্ড প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত, আক্রোশে ক্ষীপ্ত, যেন ইংল্যান্ডের আকাশ-বাতাসও তখন চাচ্ছে ঘৃণিত, রক্তপিপাসু মেরীর সমাপ্তি। ১৫৫৮ সালে হিংস্রতা ও ব্যর্থতার প্রতিমূর্তি এই নিঃসন্তান মেরীকে মৃত্যু এসে মুক্তি দিয়ে যায়।
১৫৫৮ সালের নভেম্বরে যখন এলিজাবেথ শান্ত গ্রাম্য পরিবেশে বাগানে হাঁটছিলেন, তখন দু’জন দূত দ্রুত ছুটে এসে তাকে জানায় যে, তার বোন আর নেই এবং এখন তিনিই ইংল্যান্ডের রানী।
১৫ জানুয়ারি, ১৫৫৯। লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে এক বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রানী হিসাবে অভিষিক্ত হন এলিজাবেথ। নতুন রানীর আগমনে সমগ্র ইংল্যান্ড আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। সাধারণ মানুষের সামনে নতুন দিনের নতুন আশার প্রতীক হয়ে এলেন কুমারী রানী প্রথম এলিজাবেথ। এই আনন্দ একদিকে মেরীর বিদায়ের আনন্দ, অন্যদিকে স্বাধীনচেতা এলিজাবেথের আগমনের আনন্দ। সত্যিই পৃথিবীর মানুষ তার মতো স্বাধীনচেতা শাসক খুব কম পেয়েছে। রানী এলিজাবেথের কাহিনীতে তার সিংহাসনে আরোহণের রোমাঞ্চকর অধ্যায় না বললে যেন কিছুতেই কাহিনী সম্পূর্ণ হয় না। জন্মের অস্বীকৃতি, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যুর হুমকি, স্বাধীন সত্ত্বার প্রতি আগ্রাসনের লাগাতার চেষ্টা সবকিছু জয় করে টিউডর রাজবংশের সর্বশেষ উত্তরাধিকারী হিসাবে ইংল্যান্ডের মুকুট পরেন তিনি। জীবনের এক অধ্যায় থেকে তার পথচলা শুরু হয় আরেক অধ্যায়ে, মহামারীতে বিপর্যস্ত, যুদ্ধে ক্লান্ত, অর্থনৈতিকভাবে ভগ্ন রাজ্যপাটকে নতুন করে গুছিয়ে আনার পথচলা। কেমন ছিলো মহারানী এলিজাবেথের রাজত্ব ও রাজপাট, কেমন ছিলো তার হাতে ইংল্যান্ড? এই সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ পর্বে আমরা তা জানবো।