খেলাধুলা প্রাচীনকাল থেকেই বিনোদনের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রাচীনকালের রোমান কলোসিয়ামের যুগে মানুষ বনাম ক্ষুধার্ত পশুর লড়াই থেকে শুরু করে বর্তমানের অত্যাধুনিক স্টেডিয়ামের নিয়মতান্ত্রিক খেলাধুলার প্রদর্শনী– খেলাধুলা মানুষকে বিনোদিত করেছে ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়েই। খেলাধুলার সাথে রাজনীতির সম্পর্ক নেই– এটা মুখে যতই বলা হোক না কেন, বাস্তবতা ভিন্ন। যেমন বলা যায়, ঔপনিবেশিক সময়ে যেমন খেলাধুলা অনেকক্ষেত্রে জনগোষ্ঠীর মাঝে জাতীয়তাবাদ বিকাশে সহায়তা করেছে। অনেকে বলে থাকেন, খেলাধুলা হচ্ছে মানু্ষের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকা ক্ষোভ কিংবা হতাশার মতো অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করার একটি নিয়মতান্ত্রিক উপায়। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে খেলাধুলাকে যেভাবেই দেখা হোক না কেন, খেলাধুলা নিজস্ব গতিতেই এগিয়েছে।
বিশ্বে প্রচলিত রয়েছে বিভিন্ন রকমের খেলাধুলা। এরপর পাশাপাশি স্থানীয় খেলাও রয়েছে, যেগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়। নিঃসন্দেহে বর্তমানে প্রচলিত খেলাগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় খেলা হচ্ছে ফুটবল। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এই খেলাটি খেলা হয়ে থাকে। ফুটবলভিত্তিক বিভিন্ন টুর্নামেন্ট, যেমন- ইউরো, কোপা আমেরিকা, ফিফা বিশ্বকাপ কিংবা চ্যাম্পিয়ন্স লিগগুলোর মৌসুমে দল কিংবা বিশেষ খেলোয়াড় নিয়ে যে পরিমাণ আলোচনা-সমালোচনা দেখা যায়, সেটিই এই খেলার জনপ্রিয়তা মাপার জন্য সহায়ক হতে পারে।
মজার বিষয় হলো, ঔপনিবেশিক যুগে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি উপনিবেশ ছিল ফুটবলের জন্মস্থান হিসেবে স্বীকৃত এই ব্রিটেনের। কালক্রমে ব্রিটেন থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে খেলাটি ছড়িয়ে যায়। ভারতেও খেলাটি নিয়ে আসে ব্রিটিশরাই। শুরুতে উপনিবেশগুলোতে ছড়ালেও একসময় যেসব দেশ উপনিবেশ নয়, তারাও এই খেলা সানন্দে গ্রহণ করে।
ব্রিটেনে আঠারো শতকে যখন ব্যাপক আকারে ফুটবল খেলা শুরু হয়, তখন সেটি ছিল সেখানকার সামাজিক শ্রেণীর মধ্যকার একটি দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ। প্রথমদিকে সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষকে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে দেয়া হত, যেটি সেই শ্রেণীর মানুষকে ক্ষুব্ধ করে। ভারতেও যখন ফুটবল খেলা শুরু হয়, তখন তা সীমাবদ্ধ ছিল শুধু ব্রিটিশ সেনাসদস্যদের মাঝেই। একঘেয়েমি কাটানোর উপায় হিসেবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর গৃহকাতর শ্বেতাঙ্গ সেনাসদস্যরা ফুটবলকে বেছে নিয়েছিল। এছাড়া এই খেলা আমদানির পেছনে আরেকটি পরোক্ষ কারণ ছিল স্থানীয় ভারতীয়দের মাঝে প্রচলিত বিভিন্ন ‘নিম্নমানের’ খেলার বিপরীতে ‘সভ্য’ ব্রিটিশদের মাঝে একটি ‘আধুনিক’ খেলার প্রচলন ঘটানো। প্রথম পঞ্চাশ বছরে ভারতীয়দের শুধু দর্শক হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। পরবর্তীতে ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীতে যেসব ভারতীয় সেনাসদস্য ছিল, তাদেরকেও খেলাধুলায় নেয়া হতো। এর কারণ ছিল ব্রিটিশ ও ভারতীয়, দুই শ্রেণীর সেনাসদস্যদের মধ্যে বন্ধন তৈরি করা ও পার্থক্য ঘুচিয়ে আনা।
ভারতীয়দের মাঝে ফুটবলের জনপ্রিয়তা তৈরির পেছনে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা তো ছিলই, এর পাশাপাশি খ্রিস্টান মিশনারি স্কুল ও কিছু বিশেষ ক্রীড়ানুরাগী শাসকের ভূমিকা ছিল। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যেসব ভারতীয় ফুটবলে ক্রীড়ানৈপূন্য প্রদর্শন করতো, তাদেরকে পদোন্নতি দেয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়া হতো। এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় শ্বেতাঙ্গ সেনাসদস্যদের পাশাপাশি তাদেরকেও সুযোগ দেয়া হতো, যেটি তাদেরকে ব্যাটালিয়নে আলাদা করে পরিচিত করতে সাহায্য করতো। খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলগুলোতে ফুটবল ছিল প্রধান খেলা, যেটাতে ভারতীয় খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ করতে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করা হতো। যেমন- কাশ্মীরের একজন ব্রিটিশ প্রশাসক ছিলেন সেসিল আর্ল টিন্ডাল-বিস্কো। তিনি কাশ্মীরে ফুটবল খেলার প্রচলন করেছিলেন এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যে এতে করে বর্ণপ্রথার কারণে সামাজিক শ্রেণিবিভাগের সৃষ্টি হয়েছে সেটি দূর হবে, শিশুরা শারীরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে বেড়ে উঠবে।
ব্রিটিশ ভারতে ফুটবলে শ্বেতাঙ্গদের পাশাপাশি ভারতীয়দের সুযোগ তৈরি হওয়ায় খুব দ্রুত ফুটবল খেলার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। খেলাটি একসময় শুধু সেনাবাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীতে স্কুলগুলোতে এই খেলা দ্রুত ছড়িয়ে যায়। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাংলায় বাংলায় সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায় এই খেলাটি। উনিশ শতকের শেষ দিকে বাংলায় ফুটবল খেলার বেশ কিছু ক্লাব গড়ে ওঠে। টাউন ক্লাব, মোহন বাগান, হাওড়া ইউনাইটেড বা কলকাতা রেঞ্জার্স– এই ক্লাবগুলো বাংলার ফুটবলের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। বাংলার নামকরা ‘মোহন বাগান স্পোর্টিং ক্লাব’ ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজের বেশ কিছু ক্রীড়ানুরাগী ব্যক্তিত্বের হাত ধরে। মোহন বাগান ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ বসু। তিনি পরবর্তীতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন ১৯১৪ সালে। বিশ শতকের শুরুর দিকে ভারতের স্থানীয় ক্লাবগুলোর মধ্যে মোহন বাগান সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে মর্যাদা পায়।
১৯১১ সালের দিকে মোহন বাগান ক্লাবটি এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, রীতিমতো ব্রিটিশদের সাথে সমান তালে পাল্লা দেয়া শুরু করে। বাংলার ফুটবল খেলোয়াড়দের মধ্য থেকে বাছাই করে সেরাদের এই ক্লাবটির মূল একাদশে খেলানো হতো৷ খেলোয়াড়দের সেই সময় খালি পায়ে খেলতো, বর্তমানের মতো মসৃণ মাঠ ছিল না সেই সময়ে। অনেক খেলোয়াড়দের ব্রিটিশদের অধীনে চাকরি করতেন, যাদেরকে অনুশীলনের বাড়তি সুযোগ দেয়া হতো না। তারপরও মোহন বাগানের খেলোয়াড়েরা সব বাধা উপেক্ষা করে খেলে যাচ্ছিলেন। আঞ্চলিক টুর্নামেন্ট জিতলেও তৎকালীন সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আইএফএ শিল্ডের শিরোপা বারবার অধরাই থেকে যাচ্ছিল। ১৯১১ সালের আগে মোহন বাগান যতগুলো আইএফএ শিল্ডে অংশগ্রহণ করেছিল, সবগুলোতেই ব্রিটিশ দলগুলোর বিপক্ষে তারা পরাজিত হয়।
১৯১১ সালে বেশ কিছু দলকে পরাজিত করে আইএফএ শিল্ডের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যায় মোহন বাগান। সেখানে তারা সামরিক বাহিনীর ফুটবল দল রাইফেল ব্রিগেডকে চল্লিশ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে পরাজিত করে। এই জয়ের পর পুরো বাংলায় ফুটবলের নতুন এক জোয়ার সৃষ্টি হয়। এরপর সেমিফাইনালে তারা মুখোমুখি হয় আরেকটি সামরিক ফুটবল দলের। না, কোয়ার্টার ফাইনালের মতো এবারও তাদেরকে হতাশ হতে হয়নি। প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে উঠে যায় মোহন বাগান স্পোর্টিং ক্লাব। বহুল প্রতীক্ষিত ফাইনাল খেলার তারিখ নির্ধারিত হয় ২৯ জুলাই।
একদিকে ছিল মোহন বাগান, আরেকদিকে পুরো টুর্নামেন্টে অপরাজিত ব্রিটিশ দল ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্ট। ধারণা করা হয়ে থাকে, প্রায় এক লাখ লোক ম্যাচটি উপভোগ করেছিলেন। মোহন বাগান ইতিহাস গড়ে ফাইনালে জয় লাভ করে। প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে আইএফএ শিল্ড জেতার সেই ঘটনা এখনও মোহন বাগানের সমর্থকদের বুক গর্বে স্ফীত করে দেয়। উপমহাদেশের সব সংবাদপত্র তো বটেই, সুদূর লন্ডনেও এই জয়ের ফলে সৃষ্ট জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়। দ্য ইংলিশম্যান নামের একটি ব্রিটিশ পত্রিকা লেখেছিল, “কংগ্রেস বছরের পর বছর ধরে যা করতে ব্যর্থ হচ্ছিল, তা করে দেখিয়েছে মোহন বাগান। ব্রিটিশদের পরাজিত করা যায় না– এই মিথকে তারা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।“
মোহন বাগানের আইএফএ শিল্ডের পর থেকে ফুটবল হয়ে সুপ্ত ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ‘পাওয়ার হাউজ’। দীর্ঘ ব্রিটিশ শাসনে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া ভারতীয়রা ফুটবলের মাধ্যমে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ ও হতাশা উগড়ে দেয়ার উপায় খুঁজে পায়। ভারতীয়দের হাতে ব্রিটিশদের প্রতিটি পরাজয়ে তারা আলাদা এক অনুভূতি লাভ করতে থাকে। ব্রিটিশরা যেখানে সবক্ষেত্রে ভারতীয়দের কোণঠাসা করতে সচেষ্ট ছিল, সেখানে ফুটবল হয়ে ওঠে ভারতীয়দের প্রতিবাদের ভাষা।