দেশে দেশে হোয়াইট টেরর: প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয় ও ফ্রেইকর্পসের উত্থান || পর্ব-১

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর আগে জার্মান জনগণ ভেবেছিল- কাইজারের নেতৃত্বে তারা বিশ্বজয় করবে। বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক ও গণমাধ্যম আত্মগর্বী জার্মান জনগণকে আরও তাতিয়ে দিয়েছিল। এদিকে দেরিতে শিল্পবিপ্লব হওয়ায় উৎপাদিত পণ্যের বাজারের জন্য জার্মানির দরকার ছিল উপনিবেশ। কিন্তু কাইজার দেখতে পেয়েছিলেন- বেশিরভাগ উপনিবেশ হয় ব্রিটেন, নয়তো ফ্রান্স দখল করে রেখেছে। জার্মানির ইতিহাসের অন্যতম সেরা রাজনীতিবিদ অটো ভন বিসমার্কের সময় দেশটি সংঘর্ষ এড়িয়ে চলার নীতি গ্রহণ করলেও সময়ের পরিবর্তনে এই নীতি মূল্যহীন হয়ে পড়ে। সুতরাং বিসমার্ক-পরবর্তী সময়ে জার্মানির নীতিনির্ধারকদের হাতে যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু হুটহাট করে তো আর যুদ্ধ ঘোষণা করা যায় না, সেজন্য প্রয়োজন একটি মোক্ষম অযুহাত। এ ধরনের তুমুল উত্তেজনাকর সময়ে সার্বিয়ান আততায়ীর হাতে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফার্দিনান্দের মৃত্যু ছিল এমন একটি ঘটনা, যা সামনে রেখে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়া যেত, এবং জার্মানি সেটাই করে।

িতপতকতৃ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে জার্মানির অর্থনীতি ভেঙে পড়ে; image source: iwm.org.uk

চার বছরের যুদ্ধ শেষ হয় জার্মানির নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। যে জাতি একসময় বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছিল, তারা মুখ থুবড়ে পড়ল। পরাজয়ের গ্লানিতে ডুবে গেল তাদের সমস্ত অহংকার ও গর্ব। যে সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের শুরুতে অদম্য মনে হচ্ছিল, তারা শেষ পর্যন্ত মিত্রপক্ষীয় সৈন্যদের কাছে লজ্জাজনক আত্মসমর্পণে বাধ্য হলো। যে দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীরা জাতীয়তাবাদী চেতনায় জার্মান সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তারা মুখ লুকােনোর জায়গা না পেয়ে চলে গেলেন আত্মগোপনে। যে উপনিবেশের জন্য কাইজার ও তার পরিষদ যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত উপনিবেশ তো দূরের কথা, উল্টো নিজ দেশের বেশ কিছু সমৃদ্ধ অঞ্চল মিত্রপক্ষের হাতে ছেড়ে দিতে হলো। সবচেয়ে বড় কথা, জার্মান প্রতিনিধিদের ফ্রান্সে ডেকে নিয়ে এমন এক চুক্তি চাপিয়ে দেয়া হলো, যেটি মেনে চললে দেশটির সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। ভার্সাই চুক্তি নামের সেই চুক্তির মাধ্যমে পরাজিত জার্মানির উপর অপমানজনক সব শর্ত চাপিয়ে দেয়া হয়।

ভার্সাই চুক্তি জার্মানির উপর চাপিয়ে দেয়া মিত্রপক্ষের সম্পূর্ণ অপরিণামদর্শী একটি সিদ্ধান্ত ছিল। জার্মানিতে ভাইমার প্রজাতন্ত্রের পতনের পর যে হিটলারের উত্থান ঘটে, এর পেছনে ভার্সাই চুক্তির বিশাল অবদান রয়েছে। অনেকে মনে করেন, ভার্সাই চুক্তি চাপিয়ে দেয়ার বদলে যদি জার্মানিকে পুনরায় জাতিগঠনের সুযোগ দেয়া হতো, তাহলে হয়তো জার্মান জনগণ প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠত না এবং হিটলারেরও উত্থান ঘটত না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জার্মানিতে যে বেশ কিছু ব্যক্তিগত সামরিক বাহিনীর উত্থান ঘটে এবং ভাইমার রিপাবলিক বামপন্থীদের দমনের জন্য এই ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীগুলোকে নিয়োগ দিয়েছিল, এর পেছনেও ভার্সাই চুক্তির দায় রয়েছে। যুদ্ধের পর জার্মান সমাজের অর্থনৈতিক দুর্দশার ফায়দা তুলে বামপন্থীদের উত্থান ঘটছিল। ভাইমার প্রজাতন্ত্র কমিউনিজমের হাত থেকে জার্মানিকে রক্ষার জন্য সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং একে জার্মানির ইতিহাসে ‘হোয়াইট টেরর’ বলা হয়।

হডজচকব
জার্মানিতে অসংখ্য মানুষকে কর্মসংস্থানের অভাবে বেকারত্ব বরণ করতে হয়; image source: Wikimedia Commons

হোয়াইট টেররের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা পেতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী বছরগুলোতে জার্মানির আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা জরুরি। যুদ্ধের সময় প্রতিদিন জার্মানিকে সৈন্যদের খাবার, পরিবহন, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদির পেছনে বিশাল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছিল। জার্মানরা ভেবেছিল যত দ্রুত যুদ্ধ শেষ করা যায়, ততই ভাল, এতে বিশাল অংকের অর্থ বেঁচে যাবে। জার্মানির প্রতিদ্বন্দ্বী মিত্রশক্তির ফ্রান্স কিংবা ব্রিটেনের উপনিবেশ থাকায় তারা সেগুলো থেকে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করতে পারত, যে সুবিধাটি জার্মানির ছিল না। এজন্য দেখা গিয়েছে যুদ্ধের শেষ দিকে যখন জার্মানির অর্থনীতি দুর্বল হতে শুরু করেছে, তখনও ইংল্যান্ডের কিংবা ফ্রান্সের রণক্ষেত্রগুলোতে মিত্রপক্ষ নিয়মিত সৈন্যের সমাবেশ ঘটাচ্ছিল। আবার আমেরিকার যোগদান মিত্রপক্ষের শক্তি বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। যুদ্ধ শেষে জার্মানির অর্থনীতি ভেঙে পড়ে, এবং ভার্সাই চুক্তির ফলে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছিল যেন দেশটির অর্থনীতি আর কখনও আগের অবস্থায় ফিরে যেতে না পারে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির অবস্থা ছিল আরও ভয়াবহ। অনেক যুদ্ধফেরত সৈন্য এসে দেখতে পায়- মিত্রপক্ষের আক্রমণে তাদের পরিবারের সবাই মারা গিয়েছে, বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যুদ্ধের সময় অসংখ্য সামরিক সরঞ্জাম তৈরির কারখানা চলমান ছিল, যেগুলোতে অসংখ্য জার্মান নাগরিকের কর্মসংস্থান হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এই কারখানাগুলোর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসে, সেগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং শ্রমিকেরা বেকারত্ব বরণ করে। এছাড়া মিত্রপক্ষ জার্মানির সামুদ্রিক বাণিজ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কারণে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেয়। অপ্রতুল যোগানের কারণে দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। এর পাশাপাশি যুক্ত হয় মুদ্রাস্ফীতি। জার্মান মুদ্রার দাম পড়ে যাওয়ার কারণে অসংখ্য ধনী ব্যক্তি রাতারাতি গরীব হয়ে যান। এছাড়া বিশ্বযুদ্ধের পর স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী ইউরোপের অনেক দেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, যার মধ্যে ছিল জার্মানিও। যেহেতু দারিদ্র্যের সাথে অপরাধ সংঘটনের বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে, তাই জার্মান সমাজে যুদ্ধের আগের চেয়ে অপরাধ বেড়ে গিয়েছিল।

কতকতল
ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানির সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হানা হয়; image source: history.com

ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানির সেনাবাহিনী প্রায় ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হয়। এই চুক্তিতে বলা হয়- জার্মানির ভাইমার প্রজাতন্ত্র মাত্র এক লক্ষ সদস্যের সামরিক বাহিনী রাখতে পারবে, আর সেনাকর্মকর্তার ক্ষেত্রে সংখ্যাটি ছিল চার হাজার। এছাড়া জার্মান সামরিক বাহিনীতে কতজন কর্মকর্তা কোন বিভাগে থাকবে, সর্বোচ্চ কত ডিভিশন সৈন্য থাকতে পারবে– সেগুলোও এই চুক্তিতে নির্ধারণ করে দেয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, জার্মান সেনাবাহিনী কী পরিমাণ অস্ত্র নিজেদের অধিকারে রাখতে পারবে, কতগুলো সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের কারখানা দেশটিতে চলমান থাকবে– সেটাও বলা হয় এই চুক্তিতে। নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ক্ষেত্রেও প্রায় একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। এতসব নিষেধাজ্ঞার জন্য জার্মানির নবনিযুক্ত ভাইমার প্রজাতন্ত্র বিপুল পরিমাণ সামরিক অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জাম মিত্রবাহিনীর কাছে হস্তান্তরে বাধ্য হয়। যুদ্ধে যেহেতু জার্মানি ছিল পরাজিত পক্ষে, তাই জার্মানির প্রতিনিধিরা মিত্রপক্ষের এহেন স্বেচ্ছাচারিতার কোনো প্রতিবাদ করতে পারেননি।

ওতকগকগকত
মুদ্রাস্ফীতির কারণে হঠাৎ করে জার্মান সমাজে মুদ্রার মান কমে যায়; image source: oldpics.net

বলে রাখা ভাল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির প্রায় উনিশ লাখ সৈন্য অংশগ্রহণ করে। তাই ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে যখন যুদ্ধফেরত সৈন্যের সংখ্যা এক লাখে নামিয়ে আনা হয়, তখন বেশ জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়। যুদ্ধফেরত সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে চার বছর সময় অতিক্রান্ত করায় যুদ্ধ থেকে ফেরত এসে সমাজে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে কিনা– এটা তখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়। এছাড়াও অনেক সৈন্য যুদ্ধ থেকে এসে দেখতে পায়- পরিবারের সদস্যরা সবাই মিত্রপক্ষের আক্রমণে মারা গিয়েছে এবং বাড়িঘর সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছে– যার কথা আমরা আগেই জানতে পেরেছি। একদিকে এই যুদ্ধফেরত সৈন্যদের কোনো কর্মসংস্থান ছিল না, অপরদিকে এই সৈন্যরা আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে জানত, আর যুদ্ধের হারার পর তাদের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন ধিক ধিক করে জ্বলছিল। তাই ভাইমার প্রজাতন্ত্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সন্দেহ ছিল- যদি কখনও এই সৈন্যরা হাতে অস্ত্র পেয়ে যায়, তাহলে হয়তো জার্মানিতে ভয়ংকর অবস্থার তৈরি হতে পারে। কিন্তু তাদের সামনে যুদ্ধফেরত সৈন্যদের যে সমস্যা উত্থাপিত হয়েছিল তার একটি সুন্দর সমাধান আসে।

Related Articles

Exit mobile version