ব্যাবিলনের কথা কে না শুনেছে! প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত শহরের নাম ব্যাবিলন, যার ধ্বংসাবশেষ আজও রয়েছে আধুনিক ইরাকে, রাজধানী বাগদাদ থেকে ৫৯ মাইল (৯৪ কিলোমিটার) দক্ষিণ-পশ্চিমে।
ব্যাবিলন শহরের নামকরণ নিয়ে দুটি জনপ্রিয় অভিমত রয়েছে। প্রথমটি হলো, এ শব্দটি এসেছে আক্কাদীয় ভাষার ব্যাভ-ইল বা ব্যাভ-ইলিম থেকে, যার অর্থ ঈশ্বরের দরজা বা ঈশ্বরদের দরজা। আরেকটি অভিমত হলো, ব্যাবিলন শব্দটির উৎপত্তি হিব্রু ভাষার শব্দ ব্যাভেল থেকে, যার অর্থ বিভ্রান্তি।
বুক অব জেনেসিসের একাদশ অধ্যায়ে টাওয়ার অব বাবেলের কাহিনীতে ব্যাবিলনের উল্লেখ রয়েছে। হিব্রুদের দাবি হলো, স্বর্গ পর্যন্ত যেন টাওয়ারটি তৈরি করা সম্ভব না হয় সেজন্য ঈশ্বরের ইচ্ছায় টাওয়ারটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং এ নগরীর মানুষ পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়ে বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। এর ফলে সৃষ্টি হয় বিভ্রান্তি, এবং সেই বিভ্রান্তি থেকেই শহরের নামকরণ।
ব্যাবিলনের আগমন ঘটেছে অন্যান্য বিভিন্ন বাইবেলীয় বইয়েও; যেমন: ড্যানিয়েল, জেরেমিয়াহ, ঈসাইয়াহ এবং দ্য বুক অব রেভেলেশন ইত্যাদি। বাইবেলে বারবার এ শহরের উল্লেখই মানুষের মনে মেসোপটেমীয় প্রত্নতত্ত্বের ব্যাপারে আগ্রহ সঞ্চার করেছে, এবং সেই সূত্র ধরে ১৮৯৯ সালে জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক রবার্ট কোল্ডি প্রথম ব্যাবিলনের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন।
বাইবেল থেকে অর্জিত খ্যাতি (কিংবা কুখ্যাতি) ছাড়াও ব্যাবিলন শহরটির বিশ্বব্যাপী বিশেষ পরিচিতি রয়েছে এর অসাধারণ সব দালানকোঠা, দেয়াল ও অবকাঠামোর জন্য। এছাড়াও প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং আইনের পথপ্রদর্শক হিসেবে। তবে যে কারণে ব্যাবিলনের নাম সর্বাধিক উচ্চারিত হয়, তা হলো এর বিস্ময়কর ঝুলন্ত উদ্যান।
যেভাবে গোড়াপত্তন
ব্যাবিলন নগরী অবস্থিত ছিল ইউফ্রেটিস নদীর তীরে। খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ সালে দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন আক্কাদীয় ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর হাত ধরে এ নগরীর গোড়াপত্তন ঘটে।
খ্রিস্টপূর্ব ১৭৯২ থেকে ১৭৫০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন আমোরিটের রাজা হাম্মুরাবি। তার সময়ে ব্যাবিলন এ অঞ্চলের অন্যতম প্রভাবশালী সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়। হাম্মুরাবি আশেপাশের প্রতিবেশী নগর-রাষ্ট্রগুলো জয় করেন, এবং দক্ষিণ ও কেন্দ্রীয় মেসোপটেমিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলই অবিভক্ত ব্যাবিলনীয় শাসনের আওতায় নিয়ে আসেন। এভাবেই জন্ম হয় ব্যাবিলনিয়া সাম্রাজ্যের।
হাম্মুরাবির বদৌলতে ব্যাবিলন খুবই ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী একটি নগরীতে পরিণত হয়। তিনিই সৃষ্টি করেন পৃথিবীর একদম প্রথম দিককার, এবং সবচেয়ে সম্পূর্ণ ও লিপিবদ্ধ আইনি নীতিমালা, যা পরিচিত কোড অব হাম্মুরাবি নামে। এর মাধ্যমে ব্যাবিলন এ অঞ্চলের আর সকল নগরীকে ছাড়িয়ে যায়।
তবে ব্যাবিলনিয়ার আয়ু ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী। হাম্মুরাবির মৃত্যুর পরই এ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, এবং ব্যাবিলন পরবর্তী কয়েক শতকের জন্য একটি ছোট রাজ্য হয়েই থাকে।
নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য
নতুন এক সারি রাজার মাধ্যমে নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, যা খ্রিস্টপূর্ব ৬২৬ থেকে ৫৩৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৬১২ সালে নিনেভেহে অসরীয়দের পরাজিত করার মাধ্যমে নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্যে।
নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর এ অঞ্চলের জন্য একটি সাংস্কৃতিক নবজাগরণের সময়কাল। এ সময় ব্যাবিলনীয়রা চমৎকার সব দালান নির্মাণ করে, এবং রাজা দ্বিতীয় নেবুচাদনেজারের সময়কার বিভিন্ন মূর্তি, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যকলাও সংরক্ষণ করতে শুরু করে।
ব্যাবিলনের পতন
ইতিপূর্বের ব্যাবিলনিয়া সাম্রাজ্যের মতো নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বকালও ছিল খুবই স্বল্প। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে, গোড়াপত্তনের মাত্র এক শতকেরও কম সময়ের মধ্যেই, পারস্যের কিংবদন্তী রাজা সাইরাস দ্য গ্রেট দখল করে নেন বেবিলন। ওপিসের যুদ্ধে হেরে গিয়ে পুরোপুরি পারস্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার মাধ্যমে পতন ঘটে ব্যাবিলনের।
ইহুদি জাতির ইতিহাসে ব্যাবিলন
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে যখন ব্যাবিলন কর্তৃক জুদাহ রাজ্য দখল করা হয়, তারপর রাজা নেবুচাদনেজার হাজার হাজার ইহুদি জনগোষ্ঠীকে জেরুজালেম নগরী থেকে ধরে এনে ব্যাবিলনে রুদ্ধ করে রাখেন। এভাবেই প্রায় অর্ধশতক ধরে ব্যাবিলনে বন্দি থাকে ইহুদিরা।
সাইরাস দ্য গ্রেটের নেতৃত্বাধীন পারস্য শক্তির হাতে নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে অনেক ইহুদিই তাদের আদি নিবাস জেরুজালেমে ফিরে যায়। কিন্তু অনেক ইহুদি ব্যাবিলনে থেকেও যায়, এবং সেখানেই তারা দুই হাজারেরও বেশি সময় ধরে বাস করে একটি সমৃদ্ধশালী ইহুদি সম্প্রদায় গড়ে তোলে। ইহুদিদের জন্য পৃথক ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পর অবশ্য ১৯৫০’র দশক থেকে অনেক ইহুদিই সেখানে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে।
টাওয়ার অব বাবেল
ব্যাবিলন নগরীর উল্লেখ রয়েছে হিব্রু এবং খ্রিস্টীয় উভয় ধর্মগ্রন্থেই। এবং কোনো ধর্মগ্রন্থেই এ নগরীর ভাবমূর্তি খুব একটা উজ্জ্বল নয়। খ্রিস্টীয় ধর্মগ্রন্থে ব্যাবিলনকে দেখানো হয়েছে একটি পাপিষ্ঠ নগরী হিসেবে। অন্যদিকে হিব্রু ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে ব্যাবিলনে তাদের বন্দিদশার কাহিনী, এবং রাজা নেবুচাদনেজারকে সেখানে দেখানো হয়েছে একজন নির্মম বন্দিকারী হিসেবে।
ব্যাবিলন সম্পর্কে বাইবেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ ঘটেছে টাওয়ার অব বাবেলের কাহিনীতে। ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুসারে, মানবজাতি স্বর্গে পৌঁছানোর জন্য এখানে একটি টাওয়ার বানাতে শুরু করে। ঈশ্বর তা দেখতে পেয়ে টাওয়ারটিকে ধ্বংস করে দেন, মানবজাতিকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেন, এবং তাদের মুখের ভাষা বদলে দেন যেন তারা আর একে অন্যকে বুঝতে না পারে।
অনেক পণ্ডিতেরই বিশ্বাস, কিংবদন্তীতুল্য টাওয়ার অব বাবেলের অনুপ্রেরণা হয়তো এসেছিল এক বিশাল জিগারুট বা ধাপবিশিষ্ট বিশালাকার মন্দির থেকে, যা নির্মিত হয়েছিল ব্যাবিলনের প্রধান দেবতা মারডুকের প্রতি সম্মান প্রদর্শানার্থে।
ব্যাবিলনের দেয়াল
যেমনটি আগেই বলেছি, ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যে শিল্প ও স্থাপত্যকলার খুবই উন্নতি ঘটেছিল। বিশেষত রাজধানী ব্যাবিলনে এ দুইয়ের উন্নতি ছিল অসাধারণ। স্থাপত্যকলার অন্যান্য নিদর্শনের পাশাপাশি এখানে অজস্র দুর্ভেদ্য দেয়ালও নির্মিত হতে থাকে।
হাম্মুরাবি প্রথম গোটা ব্যাবিলন নগরীটিকে পরিবেষ্টিত করে দিয়েছিলেন দেয়াল দ্বারা। পরবর্তীতে রাজা দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার নগরীটিকে কেন্দ্র করে আরো তিনটি বৃত্তাকার দেয়াল নির্মাণ করেন, যেগুলো ছিল ৪০ ফুট উচ্চতার।
গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের মতে, ব্যাবিলনের দেয়ালগুলো এতটাই চ্যাপ্টা ছিল যে, সেগুলোর উপর রথ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। অথচ এতগুলো দেয়ালের অভ্যন্তরে যে নগরীটি ছিল, সেটি কিন্তু খুব একটা বড় ছিল না। আয়তনে সেটি ছিল মাত্র ২০০ বর্গ মাইল।
এছাড়াও রাজা দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার তিনটি বিশালাকার প্রাসাদও তৈরি করেছিলেন, যেগুলো সজ্জিত ছিল নীল ও হলুদ রঙের চকচকে টালি দিয়ে। তিনি নির্মাণ করেছিলেন অনেকগুলো মন্দিরও, যার মধ্যে সবচেয়ে বড়টি উৎসর্গীকৃত ছিল মারডুকের উদ্দেশে। মন্দিরটি ছিল ২৮০ ফুট উঁচু, যা আজকের দিনের ২৬ তলা অফিস ভবনের সমান।
ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান
ধারণা করা হয়, ইউফ্রেটিস নদীর তীরে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালে নির্মিত হয়েছিল ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান। কথিত রয়েছে, সম্রাট নেবুচাদনেজার সম্রাজ্ঞীর প্রেরণায় নির্মাণ করেছিলেন মাটি থেকে ৮০ ফুট উচ্চতায় ঝুলে থাকা বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ পুষ্পবাগ ও কৃত্রিম ঝর্ণা, যার নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিল ৪,০০০ শ্রমিক।
তবে প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি হিসেবে বিবেচিত এ উদ্যানের অস্তিত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বছরের পর বছর চেষ্টা চালিয়েও এ উদ্যানের অস্তিত্ব সম্পর্কিত পর্যাপ্ত প্রমাণ খুঁজে বের করতে পারেননি। তাই এটি যে ঠিক কোথায় অবস্থিত ছিল, কিংবা আদৌ এর অস্তিত্ব ছিল কি না, সে সম্পর্কে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
আবার কিছু গবেষক যে তথ্য-প্রমাণ উদ্ধার করেছেন, তা থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, ঝুলন্ত উদ্যানের অস্তিত্ব প্রকৃতপক্ষেই ছিল, তবে তা ব্যাবিলনে নয়, বরং নিনেভেহ নগরীতে।
ইশতার ফটক
ব্যাবিলনের আভ্যন্তরীণ শহরের প্রধান প্রবেশদ্বারটিকে বলা হতো ইশতার ফটক। ফটকটিকে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল ষাড়, ড্রাগন ও সিংহের ছবি সংবলিত উজ্জ্বল নীল রঙের ইট দিয়ে।
জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিংশ শতকের শুরুর দিকে এ ফটকের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছেন। পরবর্তীতে আসল ইট দিয়েই তারা বার্লিনের পেরগামন জাদুঘরে ইশতার ফটক পুনঃনির্মাণ করেছেন।
শেষ কথা
প্রাচীন বিশ্ব ইতিহাসের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রয়েছে মেসোপটেমিয়া। আর ব্যাবিলনের উল্লেখ ছাড়া এ অঞ্চলের ইতিহাস কখনোই সম্পূর্ণ হবে না। তাই এ নগরীর ধ্বংসাবশেষের গুরুত্বও অপরিসীম। সেজন্য সাদ্দাম হুসেনের আমলে ইরাক সরকার ব্যাবিলনের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার ও প্রাচীন এ নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ (যেমন- নেবুচাদনেজারের একটি প্রাসাদ) নতুন করে নির্মাণের কাজ হাতে নিয়েছিল।
কিন্তু ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাক দখলের পর সে প্রচেষ্টায় আসে বড় ধরনের আঘাত। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ব্যাবিলনের ধ্বংসাবশেষের উপরই তাদের একটি ঘাঁটি স্থাপন করে, যার ফলে প্রত্নতাত্ত্বিক এ নিদর্শনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২০০৯ সালে আবারো দর্শনার্থীদের জন্য জায়গাটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে বটে, কিন্তু ভয়াবহ একটি আধুনিক যুদ্ধের শাপে ব্যাবিলনের পুনরুদ্ধারযোগ্য অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও ইতিহাসই চিরকালের জন্য বিলীন হয়ে গিয়েছে। তা না হলে কে জানে, ব্যাবিলন সম্পর্কে আরো অনেক চমকপ্রদ তথ্যই হয়তো এতদিনে আমাদের সামনে চলে আসত, যেগুলো আমরা কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/