প্রতিটি যুদ্ধে দুটি পক্ষ থেকে। দুই পক্ষের মধ্যে কোনো বিষয়ে দ্বন্দ্ব হলে যদি দু’পক্ষ কূটনৈতিকভাবে দ্বন্দ্ব নিরসনে ব্যর্থ হয়, তখন সামরিক সংঘাত খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রেও যুদ্ধের এই স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম ছিল না। দুটো পক্ষের মধ্যে কেন্দ্রীয় শক্তি গড়ে উঠেছিল জার্মানি, অস্ট্রো-হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া এবং অটোমান সাম্রাজ্য নিয়ে। অপরদিকে, যুদ্ধের অপরপক্ষ অর্থাৎ মিত্রশক্তি গঠিত হয় প্রধান তিনটি দেশ ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে। চার বছর ধরে চলা (১৯১৪-১৮) প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তিকে পরাজিত করে মিত্রশক্তি বিজয়ী পক্ষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যুদ্ধ শেষের পর কেন্দ্রীয় শক্তির মূল দেশ জার্মানির সাথে ফ্রান্সের ভার্সাইয়ে এক চুক্তি করে মিত্রপক্ষ। আসলে ‘চুক্তি করে’ বললে ভুল হতে পারে, বলা যায়, ‘চুক্তি চাপিয়ে দেয়া হয়’। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, জোর করে চাপিয়ে দেয়া এই ত্রুটিপূর্ণ চুক্তির মাধ্যমেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ বপন করা হয়।
বর্তমানে হাঙ্গেরি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে এটি অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রো-হাঙ্গেরি ও ইউরোপের আরও বেশ কিছু অঞ্চল নিয়ে গঠিত হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্য যেহেতু অক্ষশক্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিল, তাই পরাজয়ের গ্লানি স্পর্শ করে তাদেরও। শুধু তা-ই নয়, জার্মানির উপর যেমন অপমানজনক ভার্সাই চুক্তি চাপিয়ে দেয়া হয়, ঠিক তেমনই হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্যের উপর এক চুক্তির মাধ্যমে ব্যাপক ভৌগলিক পরিবর্তন আনা হয়। হাঙ্গেরি হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হওয়ায় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এটি চুক্তির শর্তানুযায়ী প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ভূখন্ড হারিয়ে ফেলে। এই বিশাল ভূখণ্ড যুক্ত হয় সার্বিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া ও রোমানিয়ার মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে। এছাড়া এই ভূখন্ডে বসবাসরত লাখ লাখ হাঙ্গেরিভাষী মানুষ রাতারাতি অন্য অঞ্চলের নাগরিকত্ব গ্রহণে বাধ্য হওয়ায় বেশ বিপদে পড়ে যায়। এই ভৌগলিক পরিবর্তনের ঘটনা হাঙ্গেরির জনগণ মোটেও স্বাভাবিকভাবে নেয়নি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরই রাজতন্ত্রের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা প্রচলিত হয় হাঙ্গেরিতে। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের পর হাঙ্গেরির ক্রমশ অবনমন ঘটা আর্থসামাজিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে ব্যর্থ হওয়ায় গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমে আসে। যেহেতু ইউরোপের অনেক দেশ যুদ্ধের কারণে রীতিমতো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়, তাই মানুষ গতানুগতিক রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের উপর আর ভরসা করতে পারছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ভঙ্গুর আর্থসামাজিক পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে অনেক দেশের বামপন্থী দলগুলো জনমত গঠনের চেষ্টা চালায় এবং সফলতা লাভ করে। বামপন্থীরা যুদ্ধ সংঘটন ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতি নাগরিকের প্রতিকূলে যাওয়ার পেছনে পুঁজিবাদকে দায়ী করে বিভিন্ন পুস্তিকা প্রকাশ, লিফলেট বিলি ও পত্রিকায় লেখালেখি আরম্ভ করেন। সেগুলো হাঙ্গেরির সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণীর কাছে, ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। হাঙ্গেরিতেও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে সেদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠিত হতে শুরু করে। একসময় কমিউনিস্টরা হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের আদলে ‘হাঙ্গেরিয়ান সোভিয়েত রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়।
কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে হটিয়ে হাঙ্গেরির রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পথ কমিউনিস্ট পার্টির জন্য কখনোই মসৃণ ছিল না। ব্যাপক জনসমর্থন থাকার পরও তাদের ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার সবধরনের চেষ্টা করা হয়। রাজতন্ত্রের সমর্থকেরা জানতেন, একবার যদি বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসে তবে রাজতন্ত্র সমূলে উৎপাটন করা হবে। এজন্য প্রয়োজনের সন্ত্রাসবাদের ব্যাপক প্রয়োগের মাধ্যমে হলেও বামপন্থীদের ক্ষমতা দখল থেকে দূরে রাখার কৌশল অবলম্বন করে তারা। ডানপন্থী ও রাজতন্ত্রের সমর্থকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার লক্ষ্যে কমিউনিস্টরাও পাল্টা সন্ত্রাসবাদ প্রয়োগের নীতি গ্রহণ করে। দেশটির ক্ষমতা দখলের পর বামপন্থীদের কার্যকলাপ জনগণের মনে বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দেয়। হাঙ্গেরিয়ান সোভিয়েত রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার পর কমিউনিস্ট ভাবধারার বিরোধী যেকোনো সংগঠনের নেতাকর্মীদের উপর ব্যাপক নিপীড়ন চালানো শুরু হয়। হাঙ্গেরির বিভিন্ন স্থানে কমিউনিস্টদের আক্রমণে অসংখ্য ব্যক্তি মৃত্যুমুখে পতিত হন, যাদের অনেকেই ছিলেন নিরপরাধ। হাঙ্গেরিয়ান সোভিয়েত রিপাবলিকের ক্ষমতাসীন দলের কমিউনিস্টদের এই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপকে ‘রেড টেরর’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
রেড টেরর পরিচালনার জন্য হাঙ্গেরির সাধারণ মানুষের মনে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। সেটি বুঝতে পেরে বামপন্থীরা জনগণের মনোযোগ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে অভিনব পন্থা গ্রহণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর চুক্তি অনুযায়ী হাঙ্গেরি যেসব অঞ্চলের উপর অধিকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, সেগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য হাঙ্গেরিয়ান সোভিয়েত রিপাবলিক প্রয়োজনীয় সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। স্লোভাকিয়া ও ট্রানসিলভানিয়ার সাথে সংযুক্ত ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারের জন্য রোমানিয়ায় সরকারের সাথে হাঙ্গেরিয়ান সোভিয়েত রিপাবলিক সরকারে ঝামেলা শুরু হয়। হাঙ্গেরির কমিউনিস্ট পার্টি বলপ্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিলে রোমানিয়ার সরকার পাল্টা সামরিক শক্তিপ্রয়োগের ঘোষণা দেয়। দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ লাগলে তুলনামূলক শক্তিশালী রোমানিয়ার সৈন্যরা হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট দখল করে নেয়। রোমানিয়ার কাছে এহেন অপমানজনক পরাজয়ের পর জনরোষ থেকে বাঁচতে হাঙ্গেরিয়ান সোভিয়েত রিপাবলিকের প্রধান নেতা বেলা কুন ও তার অন্যান্য কমরেডরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
এদিকে বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফেরত আসা জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ সৈন্যদের নিয়ে সাবেক হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল মিক্লোস হর্থি একত্রিত হন। তারা হাঙ্গেরির দক্ষিণে এক বিদ্রোহী সরকার গঠন করেন। কিন্তু তারা এতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাদের লক্ষ্য ছিল পুরো হাঙ্গেরির শাসনক্ষমতা দখল করা এবং সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। অ্যাডমিরাল মিক্লোস হর্থি তার সেনাবাহিনীর নাম দেন ‘ন্যাশনাল আর্মি’ এবং তার নেতৃত্বে পরিচালিত সেনাবাহিনীর প্রতিটি ইউনিটকে ‘হোয়াইট গার্ড’ বলা হতো। পর্যাপ্ত শক্তি সঞ্চয়ের পর তারা ধীরে ধীরে হাঙ্গেরির রাজধানীর দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। ন্যাশনাল আর্মিতে সৈন্য নিয়োগের জন্য খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফেরত আসা হাঙ্গেরীয় সৈন্যরা নির্দ্বিধায় হর্থির সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। ন্যাশনাল আর্মি ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে বুদাপেস্টে প্রবেশ করে। এর চার মাস পর অ্যাডমিরাল হর্থি হাঙ্গেরির সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে আইনসভার সমর্থন লাভ করেন।
পরবর্তী দুই বছর হাঙ্গেরিতে কমিউনিস্ট নেতাকর্মী ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষদের জীবনে নরক ঘনিয়ে এসেছিলো। ন্যাশনাল আর্মির সদস্যরা কমিউনিস্টদের গ্রেফতার করার পর খুব সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতো। আসলে তখনকার হাঙ্গেরিতে বিচারব্যবস্থা মোটেও স্বাধীন ছিল না। কমিউনিজমের সাথে কোনভাবে জড়িত থাকলে যে মৃত্যুদন্ড কিংবা নিদেনপক্ষে যে দীর্ঘসময় কারাবাস করতে হবে, এটা প্রায় নিশ্চিত ছিল। এছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট নেতাদের জনসমক্ষে ফাঁসিতে ঝোলানো হতো, যাতে করে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ন্যাশনাল আর্মির যে বিভিন্ন ইউনিট ছিল (যেগুলোকে হোয়াইট গার্ড বলা হতো) সেগুলো বিভিন্ন কমান্ডারের অধীনের হাঙ্গেরীয় সমাজে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে সফল হয়। ধারণা করা হয়, ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত দুই বছরে প্রায় দশ হাজার সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে ন্যাশনাল আর্মির সদস্যরা গ্রেফতার করেছিলো, যাদের মধ্যে প্রায় এক হাজার জন মানুষকে হত্যা করা হয়। হোয়াইট গার্ডের সদস্যদের হাতে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশই বামপন্থী রাজনীতির সাথে কোনভাবে সংযুক্ত ছিলেন।
প্রায় দুই বছর ধরে চলা সামরিক অভিযানে ন্যাশনাল আর্মির হাতে গ্রেফতার হওয়ার অনেকেই ছিলেন ইহুদি ধর্মাবলম্বী। কারণ হাঙ্গেরির কমিউনিস্ট পার্টিতে ইহুদি নেতাকর্মীর সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। তাই তখনকার সমাজে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, প্রত্যেক ইহুদিই কোনো না কোনোভাবে অবশ্যই বামপন্থী রাজনীতির সাথে সংযুক্ত। হাঙ্গেরীয় সমাজে প্রচলিত এই স্টেরিওটাইপের জন্য অসংখ্য নিরপরাধ ইহুদিকে মেরে ফেলা হয়। ন্যাশনাল আর্মি ক্ষমতা দখলের পর ক্ষমতা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে খোদ অ্যাডমিরাল মিক্লোস হর্থির সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে রেষারেষি শুরু হয় এবং সেটি সহিংসতায় রূপ নেয়। এছাড়াও হোয়াইট গার্ডের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আসে যে অর্থের জন্য অনেক সময় এই ইউনিটের সদস্যরা জোরপূর্বক অপহরণ করে। হাঙ্গেরির ইতিহাসে জাতীয়তাবাদী সেনাবাহিনীর দ্বারা পরিচালিত এই সন্ত্রাসবাদকেই ‘হোয়াইট টেরর’ বলা হয়।