রবীন্দ্রনাথ নিছক সাহিত্যিকই ছিলেন না, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও দূরদর্শিতাসম্পন্ন একজন মানুষও ছিলেন। তাঁর বিনির্মিত বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতী তাঁর দূরদর্শিতা ও শুভবুদ্ধির অন্যতম উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যজিৎ রায়, অমর্ত্য সেন, ইন্দিরা গান্ধী, মহাশ্বেতা দেবী, বিনোদ বিহারী মুখার্জী, সৈয়দ মুজতবা আলী, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সাহানা বাজপেয়ীর মতো দুই বাংলার নামকরা সব ব্যক্তিত্ব এই বিশ্বভারতীর আলো বাতাসেই বেড়ে উঠেছিলেন। শুধু উল্লেখিত এই ব্যক্তিদের কথাই যদি চিন্তা করা যায়, প্রত্যেকের মধ্যে দেখা যাবে সুবুদ্ধি, বিনম্রতা আর প্রতিভা- এই তিনটি জিনিসের অনিন্দ্য সংমিশ্রণ। বিশ্বভারতী তার ব্যতিক্রমী ও বাস্তবমুখী শিক্ষাপ্রণালীর মাধ্যমে তার প্রতিটি বিদ্যার্থীর অন্তরে কলা ও মনুষ্যত্ববোধ ঠিক একটি ফুলের মতো করেই বিকশিত করে তোলে। কীভাবে গড়ে উঠলো এই বিশ্বভারতী, চলুন জানা যাক গল্পটা।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় বোলপুরের অদূরে ছোট্ট একটা শহর শান্তিনিকেতন। এখানেই রয়েছে রবীন্দ্রনাথের নিজ হাতে গড়া বিশ্বভারতী। শান্তিনিকেতন শহরটা গড়ে তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৬৩ সালের কথা। একবার বোলপুর থেকে রায়পুর যাবার পথে ভুবনডাঙা নামে এক নির্জন জায়গায় একটি ছাতিম গাছের নিচে কিছুক্ষণ বসেন বিশ্রাম নেবার জন্য। জায়গাটা তার খুবই পছন্দ হয়ে যায়। তার মনে হলো ঈশ্বরের ধ্যান ও উপাসনার জন্যেও জায়গাটা খুবই উপযোগী। পরে রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে ভুবনডাঙার সেই ছাতিম গাছসহ কয়েক বিঘা জমি তিনি কিনে নেন। সেখানে তিনি তৈরি করেন একটি বাড়ি, নাম দেন ‘শান্তিনিকেতন’। বাড়ির চারপাশের শূন্য প্রান্তরে লাগানো হলো আম, জাম, কাঁঠাল, নারিকেল গাছ। ক্রমে পুরো এলাকাটাই শান্তিনিকেতন নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। দেবেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনকে মূলত অতিথিশালা ও উপাসনার জায়গা হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। এক পাশে উপাসনার জন্য তৈরি করতেছিলেন একটি মন্দির। তিনি মন্দিরের কাজ শুরু করলেও তার শেষ দেখে যেতে পারেননি। এর নির্মাণকাজ রবীন্দ্রনাথ শেষ করেন।
শিশু বয়সে রবীন্দ্রনাথ বাবার সাথে কয়েকবার এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। তারও যে জায়গাটা পছন্দ হতে দেরী হয়নি তা বলাই বাহুল্য। যৌবনে জমিদারীর দায়িত্ব পালনের সময়ও প্রায়ই এসে তিনি সময় কাটাতেন এখানে। রবীন্দ্রনাথ গতানুগতিক ধাঁচের পড়াশোনার সাথে বন্ধুত্ব কোনোদিনই করতে পারেননি। স্কুল নিয়ে তার তিক্ত বাল্যস্মৃতির কথাও অজানা নয়। নিজের কল্পনা আর দর্শন মিলিয়ে তাই তিনি শান্তিনিকেতনে একটা ব্যতিক্রমী বিদ্যালয় তৈরি করতে চাইলেন, যেখানে মন পাবে মুক্তি, থাকবে না গতানুগতিকতা ও কড়াকড়ি, শিক্ষায় থাকবে আনন্দের সংমিশ্রণ। রবীন্দ্রনাথের ভাইপো বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এমন এক ব্যতিক্রমী বিদ্যালয়ের আরেক স্বপ্নদ্রষ্টা। অকাল মৃত্যুতে তার সেই স্বপ্ন তার জন্য স্বপ্নই থেকে যায়। তবে সেই স্বপ্নের লাটাই শক্ত করে ধরেন তার রবিকাকা।
১৯০১ সালের ২২ ডিসেম্বর (৭ পৌষ) শান্তিনিকেতন আশ্রমে রবীন্দ্রনাথ একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন, নাম দেন ব্রহ্মচর্যাশ্রম। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ এই ৭ পৌষ তারিখেই ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। পিতার স্মরণে এই দিনেই তিনি তাই এই মহতী উদ্যোগ নেন। গুটিকতক কিছু বিদ্যার্থী নিয়ে শুরু হয় এই বিদ্যালয়ের পথচলা। প্রথম থেকেই সাথে ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন জগনানন্দ রায় ও রেবাচাঁদ। এদের চেষ্টা ও সহায়তায় ব্রহ্মচর্যাশ্রম অল্পদিনেই বেশ দাঁড়িয়ে যায়।
বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সাথে উপাসনা, খেলাধুলা আর সংস্কৃতির চর্চা চলতো সমান তালে। প্রকৃতির নিবিড় স্পর্শে, খোলা আকাশের নিচে, সবুজ সতেজ গাছগাছালির ছায়ায় রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার্থীদের নিয়ে বসতেন। বর্ষবরণ, বসন্তোৎসব, পৌষ মেলা, বর্ষামঙ্গল প্রভৃতি নানা অসাম্প্রদায়িক উৎসব-অনুষ্ঠানে ভরে থাকতো শান্তিনিকেতনের প্রাঙ্গন। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকলেই মানুষ প্রকৃতিকে ভালোবাসতে জানবে, আর প্রকৃতিকে ভালোবাসাই মানুষের মনুষ্যত্ব উন্মেষের প্রথম ধাপ। তাই প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতির বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি প্রকৃতির সাথে মানুষের সংযোগ করে দেখিয়েছেন শিক্ষাব্যবস্থা আসলে কেমনটা হওয়া উচিৎ। নিঃসন্দেহে সেই যুগে পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে এমন চিন্তাধারা বিরল ছিল।
ধীরে ধীরে শান্তিনিকেতনের পরিধি বৃদ্ধি পেতে থাকে। আশেপাশের জমিদারদের থেকে জায়গা কিনে আরও বড় পরিসরে কিছু করার পরিকল্পনা করেন রবি ঠাকুর। ১৯২১ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্কুলটি একটি কলেজে রুপ নেয়। স্বাধীনতার আগপর্যন্ত এটি কলেজ হিসেবেই ছিল। নোবেল পুরষ্কার থেকে পাওয়া অর্থ এই কলেজ গড়তে লাগিয়ে দেন কবিগুরু। ব্রহ্মশিক্ষার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল এই কলেজ। স্বাধীনতার পরে ১৯৫১ সালে, স্বাধীন ভারতের সরকার এই কলেজকে একটি পুরোদস্তুর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। রবীন্দ্রনাথ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দেন বিশ্বভারতী। বিশ্বের সাথে ভারতের অবিমিশ্র সংযোগ ও সমন্বয় এবং বিদ্যার্থীদের বিশ্বমানবে পরিণত করাই ছিল তার ব্রত। তার পুত্র রথীন্দ্রনাথ হন বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য।
ব্রিটিশরা উপমহাদেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল, তাতে রবি ঠাকুরের বরাবরই আপত্তি ছিল। তিনি মনে করতেন, চার দেয়ালের মাঝের অধ্যয়ন ব্যবস্থা হলো মনকে নির্দিষ্ট ধারায় প্রবাহিত করা বা মনের গতিপথ নির্ধারণ করা। এ ব্যাপারে মহাত্মা গান্ধীর সাথে তার চিন্তাধারা মিলতো। একবার রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “আমাকে যা শিখানো হয়েছিল তার কিছুই মনে নেই; আমি যা শিখেছি, শুধু তা-ই মনে আছে।” শিক্ষাটা যে শিক্ষার্থীর নিজে আহরণ করার ব্যাপার, তাই তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি মনে করতেন, প্রতিভা সবার মাঝেই আছে, শুধু সবারটা একই সময়ে বিকশিত হয় না। এ কারণে তিনি এক নতুন শিক্ষাপ্রণালীর উদ্ভব করেছিলেন। তার এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী বা শিক্ষকরা যেকোনো কোর্স পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হওয়া অবধি চালিয়ে যেতে পারতেন। বিশ্বভারতীতে কোনো শিক্ষার্থী যদি এমন কোনো কোর্সে অধ্যয়ন করতে চায় যেটি সেখানে নেই, তাহলে প্রতিষ্ঠানটি তার জন্য আলাদাভাবে সেই কোর্স তৈরি করে তার জন্য শিক্ষক নিযুক্ত করে। বাইরে সে কোর্সের চাহিদা কেমন তাতে কিছু যায় আসে না। মনের আনন্দে শেখাটাই এখানে মূল।
বিশ্বভারতী অনেকগুলো অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে বিভক্ত, যেমন শিক্ষা ভবন (Institute of Science), কলা ভবন (Institute of Fine Arts), দর্শন ভবন (Institute of Philosophy), শিল্প সদন (Institute of Craft and Design), সঙ্গীত ভবন (Institute of Dance, Drama & Music), রবীন্দ্র ভবন (Institute of Tagore Studies and Research), শ্রীনিকেতন (Rural Extension Centre) ইত্যাদি। সেই প্রথমদিকে গড়া আশ্রম বিদ্যালয়টি এখন পাঠ ভবন নামে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর নামে আছে ‘মৃনালিনী আনন্দ পাঠশালা’। এটি পাঠভবনে প্রবেশের আগের প্রিপারেটরি স্কুল। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে তিলি তিলে রবীন্দ্রনাথ গড়ে তুলেছেন এই শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী। অর্থ সঙ্কটে পড়েছেন, এসেছে অনেক দুর্দশা, কিন্তু প্রাণের আবেগ রুখতে না পেরেই যেন সবকিছুর উপরে প্রাধান্য দিয়েছেন নিজের প্রাণের বিশ্বভারতীকে। এখন তা ভারতের অন্যতম সুবিখ্যাত বিদ্যাপীঠ।
প্রতি বছর ডিসেম্বরের শেষ দিকে, বিশ্বভারতীর পাশে ভুবনডাঙার মাঠে বসে পৌষ মেলা। শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠা দিবসে সেই ছাতিম গাছের জায়গাটায় বসে উপাসনা সভা। স্মরণ করা হয় এর প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। আশেপাশের এলাকা থেকে লোকজন আসে এই আনন্দ মেলায়। হয় কত বেচা-কেনা, কত হাসি-আনন্দের লেনা-দেনা, হয় যাত্রা, প্রদর্শনী, নিবিড় হয় অসাম্প্রদায়িক প্রাণের বন্ধন। এই হাটে সব বেচা-কেনা চুকিয়ে, সব লেনা-দেনা মিটিয়ে ওপার থেকে রবীন্দ্রনাথ এখন শুধু বুঝি দেখেন আর বিড়বিড় করেন, “এখন আমায় নাইবা মনে রাখলে!”
তথ্যসূত্র: তোমাদের রবীন্দ্রনাথ- সুভাষ ভট্টাচার্য (pub- 201; page 95-97)
ফিচার ইমেজ: Visva-Bharati, Santiniketan