১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর (জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে ২৫ অক্টোবর) লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাশিয়ার তৎকালীন অস্থায়ী সরকারকে পদচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করে নেয়। একে ইতিহাসে ‘অক্টোবর বিপ্লব’ বা ‘বলশেভিক বিপ্লব’ নামে অভিহিত করা হয়। এর আগে একই বছরের মার্চে আরেক বিপ্লবের মাধ্যমে জারের পতন ঘটানো হয়েছিল। বলশেভিকদের ক্ষমতা দখলের পর তাদের বিরুদ্ধে ডানপন্থী, লিবারেল এবং সাম্রাজ্যবাদীরা একজোট হয়ে গঠন করে ‘হোয়াইট আর্মি’। এরপর রেড আর্মি (বলশেভিক আর্মি) ও হোয়াইট আর্মির (বলশেভিক বিরোধী আর্মি) মধ্যে শুরু হয় রাশিয়ান গৃহযুদ্ধ।
গৃহযুদ্ধ চলাকালে ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর আরো কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র একত্রিত হয়ে গঠন করে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিকস (ইউএসএসআর) বা সোভিয়েত ইউনিয়ন। কয়েক মাস পর ১৯২৩ সালের ১৬ জুন শেষ হয় গৃহযুদ্ধ; যুদ্ধে বলশেভিকদের রেড আর্মি জয়লাভ করে। কমিউনিস্ট মতবাদ ক্রমেই পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় বিস্তার লাভ করতে থাকে। আরো কয়েকটি প্রজাতন্ত্র যোগদান করে সোভিয়েত ইউনিয়নে। এর ফলে এক বিশাল রাষ্ট্রে পরিণত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিজম ও পশ্চিমা ক্যাপিটালিজম মতবাদের মধ্যে শুরু হয় স্নায়ু যুদ্ধ। সামরিক, মহাকাশ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সোভিয়েতরা পশ্চিমাদের সাথে সমান তালে চলেছিল। কিছুক্ষেত্রে এগিয়েও গিয়েছিল। মহাকাশে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণ ও পৃথিবীর কক্ষপথে প্রথম কোনো প্রাণী (লাইকা নামক কুকুর) পাঠানোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এগিয়ে ছিল।
কিন্তু এই পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৮০’র দশকের শেষের দিকে এসে হঠাৎ করে দুর্বল হতে থাকে। ১৯৯১ সালে এসে সোভিয়েত ইউনিয়নের চুড়ান্ত পতন ঘটে। এতটা সহজে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। ইউনিয়ন ভেঙে এর থেকে তৈরি হয় ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্র।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন শান্তিপূর্ণভাবে স্নায়ু যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায়। প্রায় চার দশকের স্নায়ু যুদ্ধে উত্তেজনা কখনো কখনো এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, পৃথিবী পারমাণবিক হলোকাস্টের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এসেছে। কিন্তু কেন একটি পরাশক্তির এমনভাবে পতন হলো, কেনই বা ভেঙে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন?
গর্বাচেভের নতুন নীতি
একসময়ের পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছিল মূলত সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত নেতা হিসেবে তার প্রায় সাড়ে ছয় বছরের শাসনামলে যে বিপুল পরিমাণে সংস্কার বাস্তবায়ন করেছিলেন তার কারণে। তার করা সংস্কারগুলোকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার মূল কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৮৫ সালের ১১ মার্চ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় আরোহণ করেন মিখাইল গর্বাচেভ। ইতোমধ্যে সোভিয়েত জনগণ কমিউনিস্টদের অত্যাচার, নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। নতুন নেতা গর্বাচেভ অন্যান্য সোভিয়েত শাসকদের থেকে আলাদা ছিলেন। তিনি গতানুগতিক সোভিয়েত ধারার বাইরে গিয়ে নতুনভাবে ইউনিয়নকে সাজাতে চেয়েছিলেন।
গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নকে সংস্কারের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯৮৬ সালে গ্লাসনস্ত (স্বচ্ছতা) এবং পেরেস্ত্রোইকা (পুনর্গঠন) নীতি গ্রহণ করেন। গ্লাসনস্ত অনুযায়ী সোভিয়েতরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা পায়। প্রায় সাত দশকের সোভিয়েত শাসনে নাগরিকরা যে স্বাধীনতাহীনতায় ভুগেছে তার অবসান ঘটে। মানুষ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা ও মুক্ত আলোচনার অধিকার পায়। এছাড়া কমিউনিস্ট পার্টির একনায়কতন্ত্রের অবসানের মাধ্যমে নাগরিকদের ভোটাধিকার ও কমিউনিস্ট পার্টির বাইরে গিয়ে দল গঠন ও নির্বাচনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
আর পেরেস্ত্রোইকা অনুযায়ী ভঙ্গুর সোভিয়েত অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করার পরিকল্পনা করা হয়। নতুন নীতি অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়নকে অনেকটা বর্তমান চীনের মতো ক্যাপিটালিজম এবং কমিউনিজমের সংমিশ্রণে তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। এর মাধ্যমে অর্থনীতিতে যে রাষ্ট্রীয় আধিপত্য ছিল তা অবসানের পরিকল্পনা করা হয়।
উক্ত নীতিদ্বয়ের মাধ্যমে গর্বাচেভ কমিউনিস্ট পার্টির স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সার্বজনীন ভোটাধিকার, গণতন্ত্রীকরণ এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থনীতির পরিবর্তে মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এই নীতিগুলোর ফলে মানুষ খাঁচা থেকে মুক্ত পাখির মতো উড়তে থাকে। প্রায় সাত দশক ধরে চলা কমিউনিস্ট নির্যাতন থেকে চিরস্থায়ীভাবে বাঁচার প্রয়াস পায় তারা। এর ফলে নাগরিকরা উন্নত জীবনযাপন, আরো স্বাধীনতা ও কমিউনিজমের অবসানের পথ উন্মুক্ত হয়।
গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত গর্বাচেভের সংস্কারগুলোই সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার বদলে ধ্বংস করে দেয়।
গর্বাচেভের নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ফলে স্নায়ু যুদ্ধের শীতল সম্পর্কে কিছুটা উষ্ণতা আসে। স্নায়ু যুদ্ধ সমাপ্তিতে তার উদ্যোগের স্বীকৃতি সরূপ ১৯৮৮ সালে টাইম ম্যাগাজিন গর্বাচেভকে ‘ম্যান অভ দ্য ইয়ার’ মনোনীত করে। পরের বছর টাইম ম্যাগাজিন গর্বাচেভকে ‘দশকের সেরা ব্যক্তি’ হিসেবে মনোনীত করে। ১৯৯০ সালে গর্বাচেভ ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’ লাভ করেন।
অর্থনৈতিক কারণ
সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি অন্যান্য দেশ থেকে আলাদা ছিল। সেখানে সম্পদের কোনো ব্যক্তি মালিকানা ছিল না অর্থাৎ সকল সম্পদের মালিক ছিল রাষ্ট্র। তবে আইনগতভাবে সম্পদের মালিক রাষ্ট্র হলেও তা নিয়ন্ত্রণ করতো কমিউনিস্ট পার্টি। কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা রাষ্ট্রীয় সম্পদে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে থেকেছে। সোভিয়েত অর্থনীতি কমাণ্ড সিস্টেমের মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ছিল। অর্থনীতি এমন এক ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয় যেখানে শিল্প স্থাপন থেকে শুরু করে কৃষি উৎপাদন ও শ্রমিকদের মজুরি প্রদান সবই রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করতো। কেমন উৎপাদন হবে বা কী কী পণ্য উৎপাদন হবে তা নির্ধারণ করতো কমিউনিস্ট পার্টি ও সোভিয়েত পলিটব্যুরোরা (কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নীতিনির্ধারণী কমিটি)। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকায় প্রচুর উৎপাদনও হতো।
সত্তরের দশকে সোভিয়েত অর্থনীতির স্বর্ণযুগ ছিল। ১৯৯০ সালেও সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের পর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি ছিল। তখন মার্কিন অর্থনীতির ৬০ শতাংশ ছিল সোভিয়েত অর্থনীতি। ১৯৯১ সালের হিসেব অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়নের জিডিপি ছিল ২.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং গড় আয় ছিল ৮৭০০ মার্কিন ডলার। এতো ভালো অর্থনীতি হওয়ার পরও ব্ল্যাক মার্কেটের কারণে সোভিয়েত অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল। ধারণা করা হয়, সোভিয়েত ব্ল্যাকমার্কেটের আয়তন ছিল সোভিয়েত জিডিপি’র প্রায় ১০ শতাংশ। কমিউনিস্ট নেতা ও পলিটব্যুরোরা তাদের অত্যাধিক ক্ষমতার ফলে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। নেতা ও পলিটব্যুরোদের সীমাহীন দুর্নীতি সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছিল।
জোসেফ স্ট্যালিন তার আমলে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের চেয়ে ভারী শিল্প বিশেষ করে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের দিকে জোর দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পেট্রোলিয়াম উৎপাদনে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বে প্রথম সারিতে ছিল। পেট্রোলিয়াম সোভিয়েত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রেখেছিল। জার্মান আক্রমণের পর ১৯৪২ সালে সোভিয়েত জিডিপি ৩৪ শতাংশ কমে যায় ফলে তা সোভিয়েত শিল্পদ্রব্য উৎপাদনকে পঙ্গু করে দেয়। যুদ্ধ শেষে অর্থনীতিকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে ষাটের দশক পর্যন্ত সময় লেগেছিল।
স্ট্যালিন পরবর্তী সোভিয়েত নেতারাও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে। তারাও সামরিক ব্যায় ও অস্ত্র উৎপাদন কমায়নি, উপরন্তু বাড়িয়ে দিয়েছে। স্নায়ু যুদ্ধের ফলে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিল্প কারখানাগুলোতে অস্ত্র উৎপাদন উর্ধ্বমূখী হতে থাকে। ১৯৬৪ সালে নতুন সোভিয়েত শাসক লিওনিদ ব্রেজনেভ অর্থনীতিতে কিছুটা সংস্কার আনার চেষ্টা করেন। তার সংস্কারের ফলে অর্থনীতি অনেকটা গতিশীল হয়। তবে গোড়ায় গলদ থেকেই যায়। ব্রেজনেভের সংস্কারের পরও সোভিয়েত অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকরা ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়ায়নি।
সোভিয়েত ইউনিয়নে যত শিল্পদ্রব্য উৎপাদন হতো তার ৭০ শতাংশই সামরিক সরঞ্জাম। এ সময় স্নায়ু যুদ্ধের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশাল অর্থনীতির সাথে অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। সাধারণ মানুষের জীবনমানের দিকে দৃষ্টিপাত না করে ব্রেজনেভ স্নায়ুযুদ্ধে মেতে ওঠে। স্নায়ু যুদ্ধের ফলে পশ্চিমারা একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে তেল ও গ্যাস রপ্তানি নির্ভর সোভিয়েত অর্থনীতি ভঙ্গুর হতে থাকে। অর্থনৈতিক দূরাবস্থার মধ্যেও কমিউনিস্ট নেতাদের দুর্নীতি বন্ধ ছিল না বরং বৃদ্ধি পেতে থাকে। দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হতে থাকে। ফলে তরুণ সোভিয়েতরা ক্রমেই কমিউনিস্ট মতাদর্শের উপর থেকে আস্থা হারাতে থাকে। তারা সংস্কার দাবি করে।
বছরের পর বছর ধরে অর্থনৈতিক স্থবিরতা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেতর থেকে অচল করে দিয়েছিল। সোভিয়েত অর্থনীতি ঘুনে ধরা এক অর্থনীতিতে পরিণত হয় যাকে স্পর্শ করলেই ভেঙে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে গর্বাচেভ এসে ‘পেরেস্ত্রোইকা’ নীতির মাধ্যমে অবস্থার সংস্কার করে কিন্তু এ সংস্কার সোভিয়েত অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের বদলে আরো ভেঙে দেয়। নতুন নীতির মাধ্যমে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় অর্থনীতিতে উদারীকরণ করা হয়, কিন্তু ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাজার চাহিদার সাথে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে মারাত্মক ঘাটতি শুরু হয়ে গেছে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারের বিষয়ে অজ্ঞতা ও অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন আন্তর্জাতিক বাজারে টিকতে পারেনি। তাছাড়াও প্রতিযোগীতামূলক বাজারে পণ্য তৈরিতে বাকি বিশ্ব যেভাবে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করেছিল, তার সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থা খাপ খাওয়াতে না পারায় পণ্য উৎপাদন মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়।
উপরন্তু গর্বাচেভ এসে কর্মচারীদের মজুরি বাড়িয়ে দেন। ব্যায় নির্বাহের জন্য তিনি নতুন অর্থ ছাপানো শুরু করেন। বেতন বৃদ্ধি ও অর্থ ছাপানোর ফলে মুদ্রাস্ফীতি বহুগুণ বেড়ে যায়। সেইসঙ্গে ফিসকাল পলিসির অব্যবস্থাপনা দেশটিকে আরো ভেঙে দেয়। সেই সময় মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আসে যখন ১৯৮৬ সালে তেলের দাম কমে যায়। যা সোভিয়েত অর্থনীতির ভীত পুরোপুরি ভেঙে ফেলে। তার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক মার্কিন বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা। এভাবে ১৯৯০ সালে এসে অর্থনীতি এতটাই ভেঙে যায় যে, এতো বড় একটা রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে চালানো আর সম্ভব হচ্ছিল না।
চেরনোবিল পারমাণবিক বিপর্যয়
২৬ এপ্রিল ১৯৮৬, কিছু বুঝে উঠার আগেই পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার একটি ঘটে যায়। এটি এমন এক দুর্ঘটনা যা একটি সাম্রাজ্যের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। চেরনোবিল পাওয়ার স্টেশনের অবস্থান ছিল বর্তমান ইউক্রেনের প্রাইপিয়াত অঞ্চলে। দুর্ঘটনাটি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে এর তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ ছিল হিরোশিমায় পারমাণবিক হামলার ৪০০ গুণেরও বেশি। তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব সোভিয়েত ইউনিয়নের পুরো পশ্চিমাঞ্চল ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর উপর পড়েছিল।
এই দুর্ঘটনার কিছুদিন আগেই গর্বাচেভ গ্লাসনস্ত নীতি গ্রহণ করেছিল। দুর্ঘটনার পর সোভিয়েত জনগণ গ্লাসনস্ত নীতির বাস্তবতা সম্পর্কে বুঝতে পারে। গ্লাসনস্ত অনুযায়ী সোভিয়েত প্রশাসনের উচিত ছিল তাৎক্ষণিকভাবে ও খোলামেলাভাবে এই ঘটনা জনগণকে জানানো। কিন্তু বিস্ফোরণ সম্পর্কে অবহিত করার পরিবর্তে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকর্তারা জনগণের কাছে এই বিপর্যয় এবং এর বিপদ সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য লুকিয়ে রাখে। কমিউনিস্ট পার্টি এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সকল তথ্যকে পশ্চিমা প্রপাগান্ডা বলে উড়িয়ে দেয়।
দুর্ঘটনার কয়েকদিন পরেই ছিল মে ডে। দুর্ঘটনার ফলে তেজস্ক্রিয়তা সম্পর্কিত ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে পরিকল্পনা অনুযায়ীই মে ডে প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। এগুলো সোভিয়েত প্রশাসনের চরম দায়িত্বহীনতা হিসেবে চিহ্নিত হয়। সাধারণ জনগণ সোভিয়েত প্রশাসনের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে।
দুর্ঘটনার ১৮ দিন পর ১৪ মে গর্বাচেভ প্রথমবারের মতো এ সম্পর্কে বিবৃতি দেন। যাতে তিনি চেরনোবিলকে দুর্ভাগ্য বলে অভিহিত করেন। সেইসঙ্গে পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদনগুলোকে দূষিত মিথ্যাচারের চরম অনৈতিক প্রচার বলে অভিহিত করেন। কিন্তু দুর্ঘটনা কবলিত অঞ্চলগুলোতে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে ভোগান্তিতে থাকা মানুষগুলোর মন্তব্য কমিউনিস্ট পার্টির মিথ্যাচারকে উন্মোচিত করে। ফলে সরকার ও গ্লাসনস্ত নীতির উপর থেকে জনগণের আস্থা চুরমার হয়ে যায়।
চেরনোবিল দুর্ঘটনা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পেছনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছে। কয়েক বছর পরে, গর্বাচেভ এই দুর্ঘটনার বার্ষিকীতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমার পেরেস্ত্রোইকা নীতি প্রবর্তনের চেয়েও চেরনোবিল সম্ভবত দুর্ঘটনার পাঁচ বছর পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আসল কারণ ছিল।”
১৯৮৯ সালে সংঘটিত বিপ্লবসমূহ
গর্বাচেভ মনে করতেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনোন্মুখ অর্থনীতিকে রক্ষা করতে হলে বাকি বিশ্বের সাথে বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে আরো স্পষ্ট করে বললে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে। ১৯৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যানের সাথে বৈঠকে সোভিয়েত নেতা গর্বাচেভ পরমাণু অস্ত্রের লড়াই থেকে বেরিয়ে আসার এবং আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেন। এক বছর পর তিনি ওয়ারশো চুক্তিভুক্ত দেশগুলোতে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী কিছু দেশ ছিল যাদেরকে সোভিয়েত স্যাটেলাইট স্টেট বলা হয়। এই দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ না হলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা প্রভাবিত এবং সেখানে সোভিয়েত আজ্ঞাবহ কমিউনিস্ট সরকার বিদ্যমান ছিল। ১৯৮৯ সালে গর্বাচেভের নতুন সামরিক নীতি অনুযায়ী পূর্ব ইউরোপের স্যাটেলাইট দেশগুলো সোভিয়েত বলয় থেকে বের হয়ে যেতে চাইলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই দেশগুলোতে সামরিক হস্তক্ষেপ করবে না।
এই সিদ্ধান্ত সোভিয়েত জোটকে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ভেঙে চুরমার করে দেয়। কিছুদিনের মধ্যেই এই দেশগুলোতে কমিউনিস্ট বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। কিছুদিন পর পোল্যান্ডে কমিউনিস্ট বিরোধী ট্রেড ইউনিয়নবাদীরা কমিউনিস্ট সরকারকে স্বচ্ছ নির্বাচন প্রদানে বাধ্য করে। নভেম্বরে বার্লিন প্রাচীর ভেঙে দুই জার্মানি এক হয়ে যায়। এরপর চেকোস্লোভাকিয়ায় ‘ভেলভেট ডিভোর্স’ বিপ্লবের মাধ্যমে সেখানকার কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত করা হয়।
ডিসেম্বরে, রোমানিয়ার কমিউনিস্ট স্বৈরশাসক নিকোলাই সিউসেস্কু এবং তার স্ত্রী এলেনাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৮৯ সালে সংঘটিত এই বিপ্লবগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য প্রজাতন্ত্রগুলোকে উৎসাহিত করেছে। পরবর্তীতে তারাও স্বাধীনতার দাবি তোলে। এই বিপ্লবগুলোর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার আন্তর্জাতিক প্রভাব হারায়। আন্তর্জাতিক অনাস্থা ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ অনাস্থায় রূপ নেয়। এর রেশ ধরেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রজাতন্ত্র স্বাধীনতা দাবির সাহস করে। এই বিপ্লবগুলোই সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের প্রথম ধাপ।
(সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অন্যান্য কারণ সম্বন্ধে জানতে পড়ুন এ সিরিজের ২য় পর্ব)