স্যামন মাছের বৈচিত্র্যময় জীবন কাহিনী

যেন কোনো মানুষের স্বদেশ থেকে বিদেশ যাত্রা। আবার পরিণত বয়সে বিদেশ থেকে মাতৃভূমিতে ফিরে আসা। স্যামন মাছের জীবন প্রকৃতি যেন সেই একই নিয়মে বাঁধা। নদী থেকে সাগরে, আবার সাগর থেকে ফিরে আসা সেই নদীতেই- এই হলো প্রশান্ত মহাসাগরে স্যামন মাছের এক দীর্ঘ ভ্রমণ যাত্রা।

স্যাম্যান মাছের ভ্রমণ বৃত্তান্ত

স্যামন মাছের জন্ম নদীতে। ডিম ফুটে স্যামনের জন্ম হয় ৫০-১০০ দিনে। ডিম ফুটে যে বাচ্চার জন্ম হয় তাকে বলা হয় ‘অ্যালভিন’। সপ্তাহ দু-তিন দিন পর ছোট্ট স্যামন রওনা দেয় সাগরের উদ্দেশ্যে। তখন তাকে বলা হয় ‘ফ্রাই’। ছোট ছোট মাছের ঝাঁক থেকে কিছু খেয়ে নেয় পাখি, কিছু খেয়ে নেয় অন্য মাছ। তবু তারা চলতেই থাকে। ভ্রমণপথেই খুঁজে নেয় খাবার। বড় হয় চলতে চলতে।

স্যামন মাছের জীবন চক্র; Image Source: marine.ie

একটু বড় হলে তাদের বলে ‘স্মোল্ট’। এই স্মোল্ট ঢুকে পড়ে সাগরে। সেখানে বেড়ে ওঠে পরিপূর্ণভাবে। তখন সে পূর্ণবয়স্ক স্যামন। এবার ঘরে ফেরার পালা। বয়স্ক স্যামনরা ঝাঁক বেঁধে ফিরতে থাকে নদীতে, যেখানে তাদের জন্ম হয়েছিল। ফিরে এসে বংশবৃদ্ধি এবং তারপর মৃত্যু। সন্তানের জন্ম দিয়ে স্যামন বাবা-মা মারা যায়। তখনই সব সংগ্রামের অবসান। নতুন স্যামনের ঝাঁক এবার বেরোয় ভ্রমণে, এভাবেই চলতে থাকে তাদের জীবনচক্র।

কীভাবে খুঁজে নেয় স্যামন তার নিজের জন্মস্থান

সমুদ্রে এরা প্রায় ১০ হাজার মাইল ভ্রমণ করে। পুরো পথটাই বিপদসঙ্কুল। জেলে, নানা দূষণ, প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা এবং মানুষের তৈরি বিপদ- সব কিছুই পেরিয়ে যেতে হয় তাদের। তবু তারা বাঁচে, বেঁচে থাকে। তাদের বাঁচায় প্রকৃতি।

বছরখানেক সমুদ্রে কাটিয়ে স্যামন যখন ফেরে, ঠিক কোন জায়গায় তার জন্ম হয়েছিল তা খুঁজে বের করতে তাদের এতটুকু দেরি হয় না। জন্মভূমির বোধহয় আলাদা একটা গন্ধ থাকে। খুঁজে খুঁজে স্যাম্যান ঠিক সেখানেই হাজির হয়। তারপর মাটিতে গর্ত খুঁড়ে ডিম পাড়ার জায়গা তৈরি করে নেয়। ঘর বাঁধে। বংশবৃদ্ধির জন্য শুরু করে সংসার।

মাতৃভূমিকে খুঁজে নেয়ার তাগিদেই বোধ হয় স্যামনের পুনরায় নদীতে ফিরে আসা; Image Source:Bay Nature

যেসব দেশের বিচরণ

সবচেয়ে বেশি স্যামন মাছ জন্মায় আলাস্কায়। এর বেশিরভাগই যায় জাপানে। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ স্যামন কেনে জাপান। ফলে বিশ্ববাজারের স্যামনের দাম ঠিক করে জাপানই। আমেরিকা, কানাডা, রাশিয়া এবং জাপান- এই চারটি দেশের কাছে স্যামন মাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাপানে আইনুদের উৎসবের এক প্রধান অঙ্গ এই স্যাম্যান। রাশিয়ায় স্যামন মাছের রয়েছে দারুণ কদর। জাপান থেকে রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপ, আলাস্কা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া- এই দীর্ঘ জলপথে মানুষের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে এই মাছ। স্যামন এদের কাছে ঐতিহ্য, প্রাচুর্য এবং আকাঙ্খার প্রতীক। এরা তাদের সুস্থ পরিবেশ ও সুন্দর ভবিষ্যতের অঙ্গীকার। স্যামনের দীর্ঘ ভ্রমণ এদের দিনযাপনকে করে তোলে নিশ্চিন্ত।

আলাস্কায় সবচেয়ে বেশি স্যামন মাছ জন্মায়; Image Source: cunard.co.uk

আকার ও আয়তনের দিক থেকে নানা জাতের স্যামন

সবচেয়ে বড় আকৃতির স্যামন হচ্ছে ‘চিনুক’ অর্থাৎ রাজা স্যামন। একটা চিনুকের ওজন কমবেশি ১২৫ পাউন্ড পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত এদের ওজন হয় ২২ পাউন্ড। লম্বায় ৩ ফুট। এছাড়া আছে কোহো, চাম, পিঙ্ক, সকেই, চেরি এবং স্টিলহেড। লম্বায় এরা দুই ফুটের কাছাকাছি। এই স্টিলহেড প্রজাতিটি শ্রেণীভূক্ত হয়েছে ১৯৮৯ সালে। এই সাত রকম স্যামন ছাড়া আরো অনেক রকমের স্যামন প্রশান্ত মহাসাগরে পাওয়া যায়।

সবচেয়ে বড় আকৃতির স্যামন ‘চিনুক’; Image Source: Eiko Jones

স্টিলহেড ছাড়া এদের সকলেরই জীবনধারা মোটামুটি একই ধরনের। অর্থাৎ, নদীতে জন্ম, জন্মের পরেই সমুদ্রভ্রমণে বেরিয়ে পড়া, পূর্ণ বয়সে বংশবৃদ্ধির জন্য পুরনো নদীতেই ফিরে এসে বংশবিস্তার এবং মৃত্যু। তবে স্টিলহেড এবং আটলান্টিক মহাসাগরের স্যামন মাছের বেলায় এই নিয়মের কিছুটা হেরফের ঘটে। এরা বেশ কয়েকবার ডিম দিতে পারে।

অন্যরকম এক ইতিহাস

স্যামন মাছ হাজার বছরের পুরনো এক প্রজাতি। কামচাটকা উপদ্বীপের উসকিতে প্রত্নতত্ত্ববিদরা মাটি খুঁড়ে ১১,০০০ বছরের পুরনো স্যামন মাছের হাড় এবং মানুষের দেহাবশেষ পেয়েছেন। গবেষকদের ধারণা, ঐ সময় উসকিতে স্যামন মাছের একটা প্রজননক্ষেত্র ছিল।

এখনো আছে। পুরাকালের মানুষ উসকি নদীর ধারে জড়ো হয়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতো, প্রচুর পরিমাণে স্যামন মাছ যেন পাওয়া যায়। আরেকটি মজার ব্যাপার আছে। মানুষের ইতিহাস খুঁটিয়ে দেখলে জানা যায়, পুরাতন প্রস্তর যুগের মানুষ খাদ্যের জন্য প্রধানত নির্ভর করতো বাইসন, ম্যামথ- এসবের ওপর। ডাঙার এই প্রাণীর যখন বংশ লোপ পেতে লাগলো, তখন মানুষের নজর পড়লো জলে।

উসকি নদী; Image Source: wikimedia commons

তখন নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ ডাঙা ছেড়ে খাদ্যের খোঁজে নেমে পড়লো জলে। সে সময় বড় বড় সামুদ্রিক প্রাণী, তিমি, সিন্ধুঘোটক, স্যামন- এসব বিস্তর পাওয়া যেত। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে জলে শিকার চালাতো তারা।

যেসব নদী এদের আতুঁড়ঘর

মার্কিন মুলুকের কলম্বিয়া, স্কিনা, শাক্রামেন্টো, বেল্লাকুলা নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে স্যামন মাছ দেখা যায়। এছাড়াও রাশিয়ার কাছে সাখালিন দ্বীপের অচেপুকা নদী বা আলাস্কা অঞ্চলের ইউকন নদী, আবার এদিকে জাপানের কাছকাছি আমুর নদীতে স্যামনের প্রাচুর্য দেখা যায়। সাখালিনের অচেপুকা নদীতে স্থানীয় মানুষজন ওখানে ছোট ছোট জালে কিংবা কাঠের পুরনো বাক্সে স্যামন ধরেন, কেউবা ধরেন খালি হাতে।

বেল্লাকুলা নদীতে প্রচুর পরিমাণে স্যামন মাছ ধরা হয়; Image Source: Pinterest

জাপানীদের কাছে স্যামন মাছের কদর

স্যামন মাছ খাওয়ার ব্যাপারে জাপানের সাথে টেক্কা দেয়া মুশকিল। তারা গোগ্রোসে এই মাছ খায়। এর আচার, স্যাম্যান বেক, ভাজা, স্যুপ- সবই খায় জাপানীরা। এমনকী কাঁচা খেতেও আপত্তি নেই। এই মাছের পেট, ডিম, মাথা– সবই তারা খায়। স্যামন দিয়ে বানায় বার্গার আর সসেজ।

জানা গছে, সারা পৃথিবীতে যত স্যামন মাছ ধরা হয়, তার বেশিরভাগ অংশ ধরা হয় জাপানে। জাপানীরা বছরে প্রায় চার লক্ষ টনের ওপর স্যামন খায়। টোকিওর সুকিজি বাজারে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি স্যামন বেচাকেনা হয়। সূর্য ওঠার অনেক আগে থেকেই বাজার বসে যায়। স্যামনের ডিম মার্কিনীরা আগে ফেলে দিতো। এখন অবশ্য সেই ডিম প্রক্রিয়াজাত করা হয়। 

টোকিওর সুকিজি বাজারে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি স্যামন মাছ বিক্রি হয়; Image Source: berkeleyside.com

স্যামন মাছের অধিকার নিয়ে বিশ্বজুড়ে মতবিরোধ

স্যামন মাছের অধিকার নিয়ে পৃথিবী জুড়ে একটা মতবিরোধ রয়েছেই। আমেরিকা, কানাডা এবং জাপান সরকার মনে করে, জলপথে বিশ্বভ্রমণ করলেও প্রতিটি স্যামন মাছ তার জন্মভূমির একান্ত নিজস্ব প্রাণী। দেশ থেকে বেরোলেও দেশে ফিরে আসা তার স্বভাব।

সুতরাং, সে অন্য দেশের অধিকারে যাবে কেন? কিন্তু এই ‍দৃষ্টিভঙ্গি সকলের নেই। বিশেষ করে তাইওয়ান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার জেলেদের ধারণা, মাছ প্রকৃতির দান। তাই মাছ সকলের। এরা সবাই, এমনকি, জাপানের জেলেরাও সমুদ্রে ফাঁদ পেতে টপাটপ স্যামন ধরে। সাগরের ৩০ ফুট গভীরে থাকে এই ফাঁদ। ব্যাপারটা বেআইনি। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন আছে। তা সত্ত্বেও চুরি করে এই মাছ প্রচুর পরিমাণে ধরা হয়। ইতিমধ্যে আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশের খবরের কাগজে এর প্রতিবাদ করে লেখালেখিও হয়েছে।

রাশিয়ার কেনাই নদীতে স্যামন মাছ ধরার উৎসব; Image Source:  Seward City News

অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে এ ধরনের ফাঁদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এই ফাঁদ পেতে স্যামন ধরার প্রচুর নিন্দা করা হয়েছে। স্যামন বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এভাবে মাছ নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। কারণ, সমুদ্রগামী যে স্যামন, সেটি আকারে খুবই ছোট। কিন্তু ওই মাছই যখন সমুদ্র থেকে ফিরতে থাকে, তার চেহারা হয় বিরাট। তাই ফাঁদ পেতে আগেই ছোট স্যামন ধরে লাভটা কী?

পুষ্টিগুণ

স্যামন ধরার পর বরফে রেখে দিতে হয় সপ্তাহ তিনেক। তারপর রান্নার প্রশ্ন। নইলে সরাসরি স্যামন খাওয়া খুব ঝুঁকির ব্যাপার। হজমের গোলমাল হতে পারে। এ মাছে প্রোটিনের পরিমাণ প্রচুর। এর তেল রক্তে শকরার পরিমাণ কমায়। হৃদরোগের আশঙ্কা কমায়। মানব স্বাস্থ্যের এই সুবিধাগুলোর কথা ভেবে এখন পৃথিবীর অনেক দেশে স্যামনের চাষ হচ্ছে।

নানা কিংবদন্তী

হাজার বছরের পুরনো এই মাছ মিশে গেছে কিংবদন্তির সঙ্গে। এত পুরনো প্রজাতি এতদিন ধরে যে টিকে আছে, এটাই আশ্চর্যের। জাপানের আইনুদের বিশ্বাস, হাজার হাজার বছর ধরে স্যামন মাছ যে টিকে আছে তার কারণ স্যামনের আত্মা আইনুদের বাঁচানোর জন্য বারে বারে পৃথিবীতে ফিরে আসে।

জাপানে আইনুদের উৎসবের এক প্রধান অঙ্গ এই স্যামন; Image Source: Sydney Morning Herald

স্যামন মাছের সংখ্যা পৃথিবীর বিভিন্ন নদী থেকে ইতিমধ্যে বেশ কমে গেছে। বাঁধ, দূষণ, সেচ ব্যবস্থা ইত্যাদির জন্য গত কয়েক বছরে এর সংখ্যা বেশ কমেছে। সেজন্যই বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন, যেভাবেই হোক এ মাছকে টিকিয়ে রাখতে হবে। বংশবৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গেলে স্যামন মাছ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এর ওপর নির্ভর করে আছে পৃথিবীর অনেক মানুষের জীবিকা। প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়ে স্যামন হয়ে উঠেছে তাদের ভবিষ্যতের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক।   

ফিচার ইমেজ- fishesofaustralia.net.au

Related Articles

Exit mobile version