ছোটবেলায় যখন বড়রা গল্প পড়ে শোনাতেন তখন আমাদের সবারই চোখের সামনে ভেসে উঠতো অনেক অনেককাল আগের দূর দেশের রাজা, রানী, জলদস্যুদের কথা। পঙ্খীরাজ কখনো চোখে না দেখা হলেও, মনে মনে আমরা তাকে ঠিকই কল্পনা করে নিতাম, সাথে কল্পনা করতাম তার পিঠের উপরে বসা রাজকুমার বা রাজকন্যাকে। এরপর বড় হওয়ার সাথে সাথে আমাদের সাথে পরিচয় ঘটে গল্পের বইয়ের এক আশ্চর্য জগতের সাথে। গল্প-উপন্যাস পড়ার সময় বইয়ের পাতা উল্টানোর সাথে সাথে আমরা চলে যাই অন্য এক জগতে। সেখানে আমাদের সামনে বুদ্ধির খেল দেখান ফেলুদা, অভিভূত হই হগওয়ার্টসের জাদুর মায়ায়।
বইয়ের গল্প আর চরিত্রের মাঝে নিজের ঠিকানা খুঁজে পাই। অথচ এসব জায়গা, এসকল চরিত্রকে তো আমরা নিজ চোখে দেখিনি। তাহলে কিভাব তারা এত স্পষ্টভাবে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে? কীভাবে আমরা ‘সমুদ্র’ শব্দটি বলা মাত্রই চোখের সামনে বিশাল কোনো সাগর দেখতে পাই, শুনতে পাই তার গর্জন?
এর উত্তর হলো ‘কল্পনা’।
আমরা আমাদের কল্পনা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে চোখের সামনে এই অদেখা স্থান আর চরিত্রগুলোকে এত স্পষ্ট দেখতে পাই। এ কারণেই আমরা ছোটবেলার অতীতকে নিজের চোখের সামনে দেখতে পাই। এ তো খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। কিন্তু একবার ভাবুন তো, আপনি যদি কখনো কল্পনা করতে না পারতেন তাহলে কেমন হতো? অবিশ্বাস্য লাগছে বুঝি? অনেকেই কল্পনা করতে না পারার বিষয়টি কল্পনাও করতে পারবেন না অথচ সংখ্যায় অল্প হলেও আমাদের চারপাশে আছে এমন মানুষ আছেন যারা জীবনে কখনোই কল্পনা করতে পারেননি, পারবেনও না।
চিকিৎসাশাস্ত্রে এ অবস্থার একটি নাম আছে। এর নাম অ্যাফান্টাসিয়া।
অ্যাফান্টাসিয়া কী?
আফ্যান্টাসিয়া (Aphantasia) হলো একজন ব্যক্তির মনের চোখ দিয়ে কোনো কিছু দেখার অক্ষমতা। সহজ ভাষায় ‘চোখের সামনে ভেসে ওঠা’র মতো দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে তারা একেবারেই অপরিচিত। উদাহরণস্বরুপ, আপনাকে বলা হলো- আপনার প্রিয় বন্ধুর কথা মনে করতে, আপনি তখন আপনার সেই বন্ধুর চেহারা আপনার মানসপটে দেখতে পারবেন। অ্যাফান্টাসিয়া আছে যাদের, তারা এই বিষয়টির সাথে সম্পূর্ণরূপে অপরিচিত।
“অ তে অজগর, আ তে আম”- শিশুদের বর্ণমালা শেখানোর সময় তাদেরকে এই কথাগুলো বলা হলে তারা ‘আ’ এর সাথে আমের সম্পর্ক স্থাপনের সময় চোখের সামনে একটি আম কল্পনা করে। নিজের মানসচক্ষুতে কোনো কিছুকে কল্পনা করা খুবই স্বাভাবিক একটি কাজ। অথচ এটি করতে অক্ষম এমন অনেক মানুষ রয়েছেন। বিজ্ঞানজগতে অ্যাফান্টাসিয়া মোটামুটি বেশ নতুন একটি বিষয়।
১৮৮০ সালে প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও মনোচিকিৎসাবিদ স্যার ফ্রান্সিস গাল্টন মানসিক চিত্রাবলীর উপর গবেষণার সময় অ্যাফান্টাসিয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু সে সময়ে এই বিষয়টির কোনো নাম ছিল না। তার ভাষ্যমতে, তার পরিচিতজনদের অনেকের মাঝেই এ বিষয়টি দেখা গিয়েছিল। উনিশ শতকে অ্যাফান্টাসিয়ার আবিষ্কার হলেও এরপর এ নিয়ে আর কোনো গবেষণা হয়নি। তাই গোটা বিষয়টি অন্ধকারে থেকে যায়।
কিন্তু ২০০৫ সালে ইউনিভার্সিটি অফ এক্সেটের অধ্যাপক ডা. অ্যাডাম জিম্যান অস্ত্রোপচারের পর মানসিক চিত্র তৈরীতে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। এমন এক ব্যক্তির সাথে এমন ঘটনা ঘটায় বিষয়টি আবার আলোতে আসে। এরপর ২০১৫ সালে জিম্যান তার গবেষণাপত্রে এরূপ ২১টির মতো ঘটনা ব্যাখ্যা করেন এবং এই অবস্থার একটি নামও দেন- ‘কনজেনিটাল অ্যাফান্টাসিয়া’। পরবর্তীতে অ্যাফান্টাসিয়া নামেই পরিচিত হয়। আর এই অবস্থা যাদের আছে তাদের বলা হয় অ্যাফান্টাসমিক। গবেষণার একটি নতুন ক্ষেত্র হওয়ার কারণে অ্যাফান্টাসিয়া সম্পর্কে খুব বেশি কিছু এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। বর্তমানে অবশ্য মনোবিজ্ঞানীগণ গুরুত্ব সহকারে এ বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
অ্যাফান্টাসিয়া পরীক্ষা
মনোবিজ্ঞানী স্টিভেন পিংকারের মতে, মানুষ তার পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে যা কিছু অনুভব করে, সে যে সকল অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়- তা থেকে পাওয়া তথ্য সংশ্লেষণের মাধ্যমে তার মস্তিষ্কে একটি চিত্র সৃষ্টি হয়। এই ছবিটি হতে পারে বাস্তব কোনো ঘটনার প্রতিচ্ছবি কিংবা নেহাত অবাস্তব কোনো বিষয়। এটাকে বলে মানসিক চিত্র তথা Mental Image। আমরা দিবাস্বপ্ন বা কল্পনা করতে পারি মূলত এ কারণেই। এর জন্যই আমরা বই পড়ার সময় চরিত্রগুলোকে চোখের সামনে দেখতে পাই, অতীতের স্মৃতিগুলো আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর অ্যাফান্টাসমিক মানুষ এ কাজটি করতে পারেন না। কোনো ঘটনা বা বিষয়কে চিত্রায়িত করার অক্ষমতাকে অ্যাফান্টাসিয়া বলে। আপনি কীভাবে আপনার নিজের অভিজ্ঞতা বা অনুভূতিকে অনুভব করছেন বা দেখছেন তা অন্যের পক্ষে দেখা অসম্ভব হলেও কিছু প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আপনি অ্যাফান্টাসমিক কিনা এ বিষয়ে একটি ধারণা পেতে পারেন।
অ্যাফান্টাসিয়া পরীক্ষার জন্য মনোবিজ্ঞানীগণ ‘Vividness of Visual Imagery Questionnairre’ নামের একটি প্রশ্নের তালিকা ব্যবহার করে থাকেন। এ তালিকার প্রশ্নগুলো ব্যক্তিকে মনে মনে বিভিন্ন বিষয়কে চিত্রায়িত করতে বলবে আর এটি দ্বারাই ব্যক্তির কল্পনাশক্তির পরীক্ষা করা হয়। ইউনিভার্সিটি অব এক্সেরটের এ প্রশ্নগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরী করেছে। যেহেতু এখানে ব্যক্তির মনে মনে চিত্রায়িত করা তথা কল্পনা করার ক্ষমতার পরীক্ষা করা হয়, সেই কারণে অ্যাফান্টাসিয়া আছে যাদের তারা এই তালিকার একটিও চিত্রায়িত করতে পারবেন না।
আপনার কি অ্যাফান্টাসিয়া আছে? তার জানতে চাইলে নিম্নের প্রশ্নত্তোরের সাহায্যে তা পরীক্ষা করুন। প্রথমেই প্রশ্নগুলোর সম্ভাব্য উত্তরগুলোর তালিকা দেয়া হলো। এর মধ্যে থেকে আপনি আপনার উত্তর বেছে নিন।
১। চোখের সামনে কোনো কিছুই ভেসে উঠছে না, কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
২। খুব ঝাপসা এবং অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি ।
৩। মোটামুটি স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি।
৪। বেশ স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি।
৫। একেবারে বাস্তব জীবনে দেখার মতো স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি।
এরপর আসা যাক প্রশ্নোত্তর পর্বে, নিচের প্রশ্নের জন্য উপরে দেয়া উত্তরগুলো থেকে বেছে নিবেন। প্রশ্নগুলো নিম্নরূপ-
১। আপনার খুব কাছের কোনো মানুষকে (সে হোক বন্ধু বা আত্মীয়) কল্পনা করুন যাকে আপনি সচরাচর দেখতে পান। তার চেহারা, মাথা অথবা শরীর আপনি কতখানি স্পষ্টভাবে দেখতে পান?
২। পূর্বে উল্লেখিত সেই ব্যক্তির বিশেষ কোনো শারীরিক বৈশিষ্ট্য কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন?
৩। সেই মানুষটি কিভাবে হাঁটেন বা চলাফেরা করেন তা কি আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠছে? উঠলে তা কতটা স্পষ্টভাবে?
৪। একটি সূর্যোদয়ের দৃশ্য কল্পনা করুন এবং মনোযোগ দিয়ে কল্পনার ছবিটি লক্ষ্য করুন। আপনার কল্পনার সূর্যটি নীল আকাশের বুকে কতখানি স্পষ্ট?
৫। মনে করুন, আপনার কল্পনার আকাশ থেকে মেঘগুলো সব সরে যাচ্ছে। সেই পরিষ্কার আকাশটি আপনার চোখে কতখানি নীল? কতটা পরিষ্কার?
৬। এবার কল্পনা করুন, আপনার সেই কল্পনার আকাশে মেঘ জমেছে, কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে সব কিছু্- এটি আপনি কত স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছেন?
৭। এখন মনে করুন, আপনার সেই আকাশে একটি রংধনু দেখা যাচ্ছে। রংধনুর ৭ রঙ আপনার চোখের সামনে কতখানি জীবন্তভাবে ভেসে উঠছে?
৮। কল্পনা করুন, আপনি একটি বাগানে বসে আছেন। সেই বাগানের গাছে বসে আছে অনেকগুলো পাখি। আপনি কি পাখির ডাক শুনতে পারছেন?
যাদের অ্যাফান্টাসিয়া আছে তাদের এখানকার প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর হবে– না । কেননা তারা কল্পনা করতে পারেন না, তাদের চোখের সামনে কিছু ভেসে ওঠে না।
কীভাবে জীবনযাপন করেন অ্যাফান্টাসমিকরা?
যদিও মানুষের সবচেয়ে স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য তাদের মধ্যে নেই কিন্তু বিজ্ঞানীদের চোখে এটি কোনো মানসিক রোগ নয়, বরং একটি অবস্থা মাত্র। অনেকের জন্ম থেকে অ্যাফান্টাসিয়া দেখা যায়। কারো কারো আবার বিভিন্ন অস্ত্রোপচারের ফলে এমনটা হয়ে থাকে। পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ২-৩% এর মাঝে এটি দেখা যায়। অ্যাফান্টাসিয়ার জন্য তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন স্থবির থাকে না। বরং দেখা যায় যে, এদের অধিকাংশই হিসাব নিকাশ, বিজ্ঞান অথবা কৌশলগত দিক দিয়ে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে আছেন। উদাহরণস্বরূপ, ব্লেইক রসের কথা বলা যেতে পারে। মজিলা ফায়ারফক্সের অন্যতম এ প্রতিষ্ঠাতা জন্ম থেকেই অ্যাফান্টাসিয়া নিয়েই বেঁচে আছেন। ২০১৬ সালে একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে তিনি তার অ্যাফান্টাসিয়ার কথা প্রকাশ করেন।
আমাদের কাছে যেমন কল্পনা না করতে পারাটা অদ্ভুত, অ্যাফান্টাসমিকদের কাছে কল্পনা করার বিষয়টি ঠিক ততটাই অদ্ভুত। তাদের অনেকের কাছে অ্যাফান্টাসিয়া শ্রেয়, অনেকের কাছে কল্পনা করার বিষয়টি একটি ভারের মতো। তবে অনেকের কাছে তা একটি দুঃখের কারণ, কেননা আর দশটা মানুষ যেভাবে স্মৃতির রোমন্থন করতে পারেন, তারা তা পারেন না। আমরা যেভাবে জগতটাকে দেখি, অ্যাফান্টাসিয়া যাদের আছে তারা সেভাবে দেখেন না।
মানবদেহ এক অপূর্ব সৃষ্টি। সভ্যতার এত বছর হয়ে গেল অথচ মানবমন এবং মস্তিষ্কের রহস্যের এখনো কোনো সমাধান হয়নি। বিজ্ঞানীগণ অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন এ রহস্যের উদঘাটন করার জন্য। কে জানে? হয়তো আপনার আশেপাশেই আছেন কোনো এক অ্যাফান্টাসমিক মানুষ!
ফিচার ছবিসূত্র: neurocritic.blogspot.com