সুস্বাস্থ্য আর সৌন্দর্যকে কি কখনো আলাদা করা গেছে? সুস্থ না হয়ে কেউ কি কখনো সুন্দর হতে পেরেছে? না। সৌন্দর্য চিরকালই সুস্থতার পথ ধরে এসেছে। তাই প্রকৃতির যে উপাদানগুলো মানুষকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে, সৌন্দর্যচর্চাতেও বেশিরভাগ সময়ে তাদের উপকারিতা খুঁজে পাওয়া যায়। মানুষের জন্য প্রকৃতির আশীর্বাদের দানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটি হলো ফল। উপকূলীয় গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলগুলোতে অত্যন্ত পরিচিত, জনপ্রিয় আর স্বাস্থ্যকর একটি ফল হলো ডাব।
দক্ষিণ এশিয়াতেও ডাব খুবই সহজলভ্য এবং বেশ কম দামী পানীয় প্রধান ফল। এই ফলের স্বাস্থ্যগুণের তালিকা নেহায়েত কম তো নয়ই, বরং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি, এমনকি ক্যান্সারের রোগীকে যে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়, তার ক্ষতিকর প্রভাব কাটাতেও সাহায্য করে এই ফল। ডাবের স্বাস্থ্যগুণ নিয়ে প্রকাশিত আমাদের আগের একটি লেখায় এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আজকে ডাবের সৌন্দর্যগুণ সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক।
সৌন্দর্যের জন্য সর্বপ্রথমে প্রয়োজন ত্বকের সুস্থতা। আমাদের ত্বকে প্রায়ই ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও বিভিন্ন জীবাণুর সংক্রামণ ঘটে থাকে। ডাবের পানিতে ছত্রাকবিরোধী, ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণুরোধক উপাদান থাকায় ত্বককে জীবাণুমুক্ত রাখতে এটি দারুণ কার্যকর। বিশেষ করে ঋতু পরিবর্তনের সময়, গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে ছত্রাকের আক্রমণ বেড়ে যায়। বারবার ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয় এমন স্থানে পরপর কয়েকবার ডাবের পানি লাগালে উপকার পাওয়া যায়। শুকিয়ে যাওয়ার পর ধুয়ে শুকনো কাপড় দিয়ে মুখে ফেলতে হবে। ত্বকের জন্য এটিকে প্রাকৃতিক ‘অ্যান্টিসেপ্টিক’ও বলা চলে।
ব্রণ ত্বকের আরেকটি যন্ত্রণাদায়ক সমস্যা। যখন ত্বকের উপরিভাগের গ্রন্থিকোষগুলোতে অতিরিক্ত তেল জমে, তাতে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের ফলে তা স্ফীত হয়ে যায়। ডাবের পানির ব্যাকটেরিয়ারোধক বৈশিষ্ট্যের জন্য ব্রণ নিয়ন্ত্রণে ও সারাতে ডাবের পানি ভূমিকা রাখতে পারে। রোজ ব্রণ-আক্রান্ত স্থান পরিষ্কার করার পর অর্ধেক কাপ ডাবের পানি ও এক টেবিল চামচ মধুর মিশ্রণ ১৫ মিনিটের মতো লাগিয়ে নিজেই দেখুন এর ফলাফল। এছাড়া অনেকের ত্বকে লালচে ছোপ, কালচে দাগ বা রঙের পার্থক্য দেখা যায়। ত্বকের সমস্যা, ব্রণ পরবর্তী দাগ বা রাসায়নিক প্রসাধনী ব্যবহারের ফলে এমন হতে পারে। ডাবের পানি ও মুলতানি মাটির মিশ্রণ ১৫ মিনিট করে সপ্তাহে কয়েকবার ব্যবহার দিতে পারে এ সমস্যা থেকে মুক্তি।
সৌন্দর্য আর বার্ধক্যের ছাপ চিরকাল একে অপরের পরম শত্রু। মানুষের তাই সব সময়ই চেষ্টা থাকে বয়সের ছাপ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা। বিভিন্ন ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ম্যাংগানিজ ও পটাসিয়ামের মতো খনিজে সমৃদ্ধ ডাবের পানি এক্ষেত্রে হতে পারে সবচেয়ে কম খরচের এবং সহজপ্রাপ্যতার, সম্পূর্ণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন পরিপূর্ণ এক প্রাকৃতিক প্রসাধনী। বলিরেখা, কুঁচকানো ত্বকের পাশাপাশি ডাবের পানির কাইটোকিন ত্বকের কোষের দ্রুত বৃদ্ধি ও ক্ষতপূরণে কাজ করে। এককথায়, বাজারের যেকোনো বলিরেখা দূরকারী প্রসাধনীকে হারিয়ে দিতে পারে এই প্রাকৃতিক পানীয়। ডাবের পানিতে এই উদ্দেশ্য সাধনের প্রয়োজনীয় সকল উপাদান রয়েছে। রোজ কিছুক্ষণ এই পানি মুখে লাগিয়ে রাখলেই যথেষ্ট। এছাড়া আরো ভালো ফলাফলের জন্য ডাবের পানির সাথে টক দইয়ের মিশ্রণ এ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ত্বক থেকে রোদে পোড়াভাব দূর করতে নানা উপায় অবলম্বন করতে করতে ক্লান্ত? ডাবের পানি ব্যবহার করে দেখেছেন কখনো? অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি বিদ্যমান থাকায় রোদে পোড়া ত্বকের ওপর এই পানি কাজ করে বেশ দ্রুত। কচি ডাবের পানি রোদে পোড়া ত্বকে লাগিয়ে রেখে ২০ অথবা ২৫ মিনিট পরে ধুয়ে ফেলুন। কয়েকদিনের ব্যবহারে আসবে চোখে পড়ার মতো ফলাফল।
ডাবের পানি আর শসার রসের মিশ্রণ চোখের নিচের কালো দাগ কমায়। ত্বকের ক্লিনজার আর টোনার হিসাবেও ডাবের পানির জুড়ি নেই। গভীরভাবে পরিষ্কার করার সাথে সাথে তুলে আনে ত্বকের অতিরিক্ত তেল। অন্যদিকে ত্বকের আবশ্যক প্রাকৃতিক আর্দ্রতা এবং পিএইচের সামঞ্জস্য অক্ষুণ্ণ রাখে।
উজ্জ্বল ও কোমল ত্বকের জন্য রোজ ডাবের পানি দিয়ে শুধু মুখ ধুলেই হয়। এই পানীয় গ্রহণ ভেতর থেকে ত্বকের রঙ উজ্জ্বল করা ছাড়াও ডাবের পান, শসার রস ও কাঁচা দুধের মিশ্রণ রোজ ১৫ মিনিট ব্যবহার করলে প্রাকৃতিকভাবেই ত্বক হবে দাগহীন ও দীপ্তিপূর্ণ। দাগ সারানোর গুণের জন্য প্রাচীনকাল থেকেই এর পসার কম নয়। বসন্তের কঠিন দাগের প্রাথমিক চিকিৎসাতে তো আজও ঘরে ঘরে এর পরিচিতি। আবার কোনো উৎসবের আগে ডাবের পানি, চন্দন ও হলুদের মিশ্রণ ঐ একই সময় ব্যবহার করে খুব সহজেই ত্বককে করতে পারেন আরো তারুণ্যময়, ফরসা ও কোমল। ত্বকের এ এক পরম উপকারী বন্ধুই বটে!
ত্বকের জন্য ডাবের পানির এত উপকারিতাই কিন্তু শেষ নয়, চুলের জন্যও এই পানীয় প্রকৃতির এক আশীর্বাদ। অনেক সময় চুলের অবস্থা মানুষের সার্বিক শারীরিক অবস্থার কথা প্রকাশ করে। ভিটামিন, প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টিগুণের অভাবে চুল পড়ে যাওয়া, পর্যাপ্ত চুল না গজানো ও চুল ভেঙে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা যায়। পটাসিয়ামসমৃদ্ধ ডাবের পানি চুলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। এক্ষেত্রে শুধু ডাবের পানি চুলের গোড়ায় দিয়ে কিছুক্ষণ ম্যাসাজ করাই যথেষ্ট। চুলের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধিতে ডাবের পানি ব্যবহার করা যায়। ডাবের পানির আর্দ্রতা রক্ষা এবং কন্ডিশনিং করার গুণই চুলের জন্য এর এতো আনুকূল্যের পেছনের কারন। শ্যাম্পুর পর সমপরিমাণ ডাবের পানি ও সাধারণ পানির মিশ্রণ দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলে দেখুন এর এই প্রাকৃতিক যাদুকরী ফলাফল।
খুশকি কিন্তু মাথার ত্বকের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি। বিশেষ করে ঋতু পরিবর্তনের সময়ে এই সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করে। প্রকৃতির এই সাধারণ পানীয়ের ছত্রাকবিরোধী গুণ খুশকি প্রতিরোধ করে। চুলের পরিমাণ অনুযায়ী দশ চা চামচ ডাবের পানি আর এক চা চামচ নিমের তেল অনুপাতে মিশ্রণ নিয়ে মাথার ত্বকে দিয়ে এক ঘন্টা অপেক্ষার পর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। দামি অনেক রাসায়নিক প্রসাধনী ও শ্যাম্পু অপেক্ষা সাধারণ এই নিরাময় পদ্ধতি বেশ ফলপ্রসূ।
এছাড়া ডাবের পানি ত্বকে ও চুলের গোড়ায় রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে, যা চুল ও ত্বকের অনেক সমস্যা দূর করার জন্য অতি প্রয়োজনীয়। গ্যাস্ট্রিক, বদহজমের সমস্যা সারিয়ে ডাবের পানি শরীরের বিপাক ক্রিয়ার উন্নতি ঘটায়। দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করতেও ডাবের পানি বেশ সহায়ক। দেহের এ সকল স্বাভাবিক ক্রিয়া ভালো থাকাও সুন্দর ও সুস্থ ত্বক ও চুলের জন্য আবশ্যক।
এভাবে প্রকৃতির এই উপাদানের মধ্যে রয়েছে মানুষের জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক গুণ। সুস্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য রক্ষায় ডাবের পানির তুলনা নেই। আবার এই পানি বাহ্যিক ব্যবহারের জন্য দুই থেকে তিনদিন ঢাকনাসহ পরিষ্কার পাত্রে রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা যায় সহজেই। সাধারণ মানুষের জন্য তাই পরিশ্রমের অর্থ বিভিন্ন দামী প্রসাধনীর ব্যবহারে ব্যয় না করে প্রকৃতির মাঝে সমাধান খোঁজা অনেক বেশি সহজ ও যুক্তিযুক্ত। প্রকৃতিই তো সকল কল্যাণকর বস্তুর প্রকৃত উৎস। এক্ষেত্রে খাবার পানীয় ও প্রাকৃতিক নির্ভেজাল প্রসাধনী হিসাবে সকলেই নিশ্চিন্তে বেছে নিতে পারে ডাবের পানি, কম মূল্যে প্রকৃতির অমূল্য এক উপহার।
ফিচার ইমেজ: cocospure.com