এক অদ্ভুত যুগ অতিবাহিত করছি আমরা। ইতিহাসের সূচনা থেকে পরস্পরের হাত ধরে যে মানবসভ্যতার জন্ম, আজ সে সভ্যতা টিকিয়ে রাখবার জন্যই বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হচ্ছে একে অপরের থেকে। মানতে হচ্ছে সামাজিক দূরত্বের কাঁটাতার। এরকম একটি সময়ে এসে থমকে যাওয়া জীবন আর একাকিত্ব যখন সঙ্গী হবার কথা, তখন প্রযুক্তি মানুষকে করছে একত্র। গুগল মিট, জুম, স্কাইপি, ফেসবুক লাইভ, গুগল হ্যাংআউটস-এর মতো অ্যাপগুলো আজ নিত্যদিনের জীবনের একটা অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের বাসার চার দেয়ালের মাঝে থেকেও আজ মানুষ করোনা পূর্ববর্তী জীবনের প্রায় সমস্ত কাজই করতে সক্ষম হচ্ছে। সেটা হোক ক্লাস, অফিস আদালতের দৈনন্দিন কাজ, বন্ধুদের আড্ডা কিংবা সরকারি মিটিংয়ের মতো বিষয়। এজন্যই ভিডিও কনফারেন্সের কারণে আজ বাড়ছে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ ধারণার জনপ্রিয়তা।
ভিডিও কনফারেন্সের এই নতুন দুনিয়ায় ‘জুম’ অ্যাপ একটি বহুল পরিচিত অ্যাপ। ইউজার ফ্রেন্ডলি হওয়ায় জুম অ্যাপ দ্রুতই হয়ে উঠেছে শীর্ষস্থানীয় একটি অ্যাপ। এরিক ইউয়ানের প্রতিষ্ঠিত এই অ্যাপটি ২০১১ সালে প্রথম মার্কেটে আসলেও তা জনপ্রিয়তা পায় ২০১৯ সালে। মাল্টিপল স্ক্রিন এবং ডিভাইস মিটিং, ওয়ারলেস স্ক্রিন শেয়ারিং, মাইক্রোসফট আউটলুক এবং গুগল ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে ক্যালেন্ডার ইন্টিগ্রেশনসহ আরও নানা ধরনের ফিচার থাকায় বর্তমানে এই অ্যাপটি সর্বাধিক ব্যবহৃত অ্যাপগুলোর মাঝে অন্যতম। প্রাতিষ্ঠানিক সব কার্যক্রমের ক্ষেত্রে করোনাকালীন যুগের শুরু থেকেই এই অ্যাপ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মার্চ মাসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জুম অ্যাপে ভিডিও কনফারেন্সে কেবিনেট মিটিং করার কথা টুইট করলে ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশের সরকারি মিটিং গুলোতেও জুমের ব্যবহার শুরু হয়। আমাদের দেশেও এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জুমের মাধ্যমেই নিয়মিত অন্য মন্ত্রীদের সাথে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
নিছক আড্ডা থেকে শুরু করে, প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাস, অফিসের আলোচনা, রাজনৈতিক সভা, চ্যানেলগুলোর লাইভ টকশো এবং দেশ পরিচালনায় সরকারি কাজকর্ম আজ হচ্ছে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। এমনকি সারা পৃথিবী জুড়ে করোনায় মৃত্যুবরণ করা মানুষদের আত্মীয়-স্বজন যখন সামাজিক দূরত্ব আর সরকারি নিয়মের কারণে শেষকৃত্যে অংশগ্রহণের মতো সামাজিক কাজগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তখন এই জুম অ্যাপ ই-ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রিয়জনকে শেষবারের মতো দেখার আকুতিগুলোর দাবি মেটাচ্ছে।
এত জনপ্রিয়তার পরও জুমের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন তুলেছেন সাইবার নিরাপত্তা গবেষকরা। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের অধ্যাপক অরবিন্দ নারায়াণান জুমকে ‘প্রাইভেসি ডিজাস্টার’ এবং ‘ম্যালওয়ার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য হ্যাক হওয়া থেকে শুরু করে স্ক্রিন শেয়ারের মাধ্যমে অনলাইনে চলতে থাকা ক্লাসে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির প্রবেশ এবং ভিডিও হাইজ্যাকিংয়ের মতো ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে।
মন্ত্রিসভা এবং ক্যাবিনেটের মিটিংগুলোতে জুম ব্যবহার কতটা নিরাপদ, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এছাড়া তৃতীয় কোনো পক্ষ থেকে ইনফরমেশন রক্ষার জন্য জুমের দাবি করা ‘এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন’ এর যথার্থতা খুঁজে না পাওয়ায় সেটা মার্কেটিংয়ের জন্য করা পি.আর মুভ হিসেবে জুম কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে নেয়। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা থাকার পরও এরিক ইউয়ান জুমের ঊর্ধ্বমুখী জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে অ্যাপটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নতুনভাবে জোরদার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এমনকি ব্যবহারকারীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতের আগে নতুন কোনো ফিচার চালু না করার কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি।
জুমের মতো ভিডিও কনফারেন্সের অন্যান্য অ্যাপগুলোর মাঝে আছে গুগল মিট, স্কাইপি, গুগল হ্যাং আউটস। তবে সম্প্রতি জুমের পাশাপাশি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ম্যাসেঞ্জার রুম নামক ফেসবুকের ফিচারটি। যেখানে চ্যাটরুম ওপেন করে অন্যদের ইনভাইটেশন দিয়ে ভিডিও কনফারেন্সে যোগ করা যায়। বিশেষ করে ফেসবুকের সহজলভ্যতার কারণে রুম ওপেন করার জুমের মতো আলাদা অ্যাপের দরকার থাকে না। ম্যাসেঞ্জারেই রুম ওপেন করা যায়। এমনকি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট না থাকলেও যে কেউ ম্যাসেঞ্জার রুমে অ্যাড হতে পারে। যদিও এর গোপনীয়তা বিষয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তারপরও ব্যক্তিগত পর্যায়ে ম্যাসেঞ্জার রুম বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
অনলাইনে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম চালানোর আরেকটি মাধ্যম হল গুগল ক্লাসরুম। যেটি শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের ক্ষেত্রে। গুগল ড্রাইভ, গুগল ডকস, শিটস, স্লাইড, জিমেইল গুগল ক্লাসরুমের সাথে যুক্ত থাকায় অ্যাসাইনমেন্ট, গ্রেডিং- এ কাজগুলো সহজেই করা যায়। অন্যান্য অ্যাপের মতো শিক্ষার্থীর তথ্যের গোপনীয়তা নিয়ে এই অ্যাপও সমালোচনার শিকার হয়েছে।
গুগল মিট, গুগল হ্যাংআউটস, ফেসবুক লাইভ, ইন্সটাগ্রাম ভিডিও কল, হোয়াটস্যাপ, ভাইবার, ম্যাসেঞ্জার, স্ন্যাপচ্যাটসহ নানা ধরনের অ্যাপ ভিডিও এবং অডিও কনফারেন্সের জন্য বহু বছর ধরেই ব্যবহারকারীদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়ে আসছে। করোনাকালে প্রিয়জনদের কাছে থাকতে এখন এগুলোর গুরুত্ব এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের বাকি প্রয়োজনগুলোর মতোই অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব স্ক্রিনের উপস্থিতি।
একটা সময় ছিল, যখন ‘কোয়ারেন্টিন’, ‘আইসোলেশন’ শব্দগুলোর ব্যবহার দৈনন্দিন জীবনে একেবারে ছিল না বললেই চলে। নাক-মুখ খুলে মুক্ত বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়াটা জীবনে ছিল খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সাথে তখন ছিল প্রতিনিয়তই দেখাসাক্ষাত। দেখা হলে কোলাকুলি বা হাত মিলিয়ে নেয়াটা ছিল সামাজিক রীতির অন্তর্ভুক্ত। ভিডিও কনফারেন্স সে জীবনে ছিল কদাচিৎ, কোন প্রাত্যহিক ব্যাপ্যার নয়। কিন্তু আমরা সে জীবন পেছনে ফেলে অন্য এক জগতে, অন্য এক জীবনে বাস করছি। এখানে ‘কোয়ারেন্টিন’, ‘আইসোলেশন’, ‘মাস্ক’, ‘স্যানিটাইজার’ আর ‘ভিডিও কনফারেন্স’ বহুল ব্যবহৃত শব্দ।
মাসের পর মাস প্রিয়জনকে না দেখলে এ জীবনে ভিডিও কলই এখন একমাত্র উপায় ভার্চুয়ালি সবাইকে কাছাকাছি আনার। অনলাইনে ক্লাস হওয়ায় এ জীবনে স্কুল-কলেজের বেঞ্চগুলোতে ধুলো জমে। দেশ চালনার সমস্ত সিদ্ধান্তও এখানে নেওয়া হয় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। এমনকি সবটুকু সুখ নিয়ে বেঁচে থাকতে না পারলেও এ জীবনে সবটুকু দুঃখ নিয়ে প্রিয়জনকে বিদায় জানাবার জন্য শেষকৃত্যে যোগদানের একমাত্র মাধ্যম ভিডিও কনফারেন্স। এ জীবন যেন আসলেই স্ক্রিনে বন্দী সচল জীবন।