পোশাক রীতি বা ড্রেসকোড সবার জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এ সম্পর্কে প্রত্যেকেরই ভালো ধারণা থাকা উচিত, কারণ এর উপরই নির্ভর করে আপনার ব্যক্তিত্ব, পরিচয়, অবস্থান, এমনকি সফলতা পর্যন্ত! কিন্তু পোশাক নিয়ে আমাদের অনেকেরই রয়েছে অস্পষ্ট ধারণা। তাই কোথায় কেমন পোশাক পরিধান করা উচিত এবং সর্বোপরি ড্রেস কোডের সামগ্রিক ধারণা দিতে আমাদের আজকের এই আয়োজন।
ড্রেস কোড মূলত এক ধরনের অলিখিত নিয়ম, যেটা অনুসারে মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন স্থান বা সময়ে উপযুক্ত পোশাক পরতে হয়। অবশ্য এটা যে সবসময় অলিখিত তা নয়। কেননা অনেক সময় অফিস বা অনুষ্ঠানে ড্রেস কোড উল্লেখ করা থাকে। সুনির্দিষ্ট পোশাক পরা নিয়মতান্ত্রিকতা এবং রুচির পরিচায়ক। এটি কর্মক্ষেত্রে কাজে মনোনিবেশ করতে যেমন সহায়তা করে, তেমনি আপনি যখন ভ্রমণে বা বন্ধুদের সাথে আড্ডায় আছেন, তখন আপনার মনকে নিরুদ্বেগ করে আনন্দের সঙ্গে মিশে যেতেও সাহায্য করে। আপনি নিশ্চয়ই ফর্মাল শার্ট-প্যান্ট এবং টাই পরে বন্ধু মহলে গিয়ে আড্ডা দিতে চাইবেন না! একইভাবে অফিসেও হাফ প্যান্ট পরে যাওয়া কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
অনেকেই মনে করেন ড্রেস কোডের ঝামেলাটা শুরু হয় কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সময়। ইউনিভার্সিটিতে আপনি হয়তো পরেন রঙ চটা জিন্সের সাথে চে গুয়েভারার লোগো সংবলিত টি শার্ট, মেয়েরা হয়তো পরেন গাড় রঙের কোনো সালোয়ার কামিজ, সাথে নানা রকম অলংকার। কিন্তু যখনই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সময় আসে, তখনই শুরু হয় ড্রেস কোড নামক ঝামেলার। আসলে ব্যাপারটি আদৌ সেরকম না, ড্রেস কোড যে শুধু অফিসে যাওয়ার সময়ই প্রাসঙ্গিক তা নয়।
কর্মক্ষেত্র, ক্যাম্পাস, বাইরে ঘোরাফেরা এমনকি বাসায় থাকার সময়ও আলাদা আলাদা পোশাকের আদব কেতা রয়েছে। আবার একই প্রতিষ্ঠানের ভেতর ভিন্ন ভিন্ন ডিপার্টমেন্টে থাকতে পারে আলাদা আলাদা পোশাকের চল। যেমন- প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়েটিভ ডিপার্টমেন্ট বা কারিগরী শাখায় পোশাকের তেমন নিয়মকানুন থাকে না। কিন্তু এক্সিকিউটিভ, মিডিয়া এসব শাখায় সাধারণত ফর্মাল পোশাক পরা হয়ে থাকে, কারণ তারা সরাসরি গ্রাহকের সাথে কাজ করেন। আবার সার্ভিস অথবা সেলস শাখায় সেমি ক্যাজুয়াল কিংবা বিজনেস ক্যাজুয়াল পোশাক পরার চল রয়েছে।
পুরুষদের পোশাকের সাধারণ ক্যাটাগরীসমূহ
(১) ষ্ট্রীটওয়্যার
নাম শুনে রাস্তার পোশাক মনে হলেও ষ্ট্রীটওয়্যার বলতে মূলত ঘরে পরার পোশাক বোঝায়। এই ফ্যাশনে হাফ প্যান্ট বা থ্রী কোয়ার্টার প্যান্টের সঙ্গে হাফ হাতা টি-শার্ট পরা হয়ে থাকে। চাইলে ঢোলা ট্রাউজারও পরতে পারেন। পায়ে থাকতে পারে স্যান্ডেল, লোফার ইত্যাদি। বন্ধুবান্ধবের সাথে ট্র্যাকিং বা সমুদ্র সৈকতে ভ্রমণে বের হলেও এ ধরণের পোশাক আরামদায়ক ও মানানসই হবে।
(২) ক্যাজুয়াল
ক্যাজুয়াল পোশাক ঘরের বাইরে ঘোরাফেরা, কেনাকাটা ইত্যাদি কাজের জন্য উপযোগী। ফুলহাতা কিংবা হাফহাতা শার্ট বা টি শার্ট- উভয়ই পরা যেতে পারে। ক্যাজুয়াল পোশাক নানা রংয়ের এবং ডিজাইনের হয়ে থাকে। সঙ্গে পরতে পারেন জিন্স বা গ্যাবাডিনের প্যান্ট। শার্ট প্যান্ট উভয় ক্ষেত্রেই নানা রং এবং ডিজাইনের হতে কোনো বাধা নেই। পায়ে থাকবে স্যান্ডেল, কেডস বা লোফার।
(৩) বিজনেস ক্যাজুয়াল
বিজনেস ক্যাজুয়াল ফ্যাশনে ক্যাজুয়াল লুকের ভেতর একটু ফর্মাল ছোঁয়া থাকে। আজকাল অনেকেই অফিসে বিজনেস ক্যাজুয়াল পরে থাকেন। তবে সব অফিস কিন্তু বিজনেস ক্যাজুয়াল পোশাকের অনুমতি দেয় না। এটা নির্ভর করে প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতির উপর। পোলো টি শার্ট এবং গ্যাবাডিন প্যান্ট এই ক্যাটাগরীর জন্য উপযোগী। খেয়াল রাখা প্রয়োজন, টি শার্টের কলার থাকতে হবে এবং টি শার্ট ও প্যান্ট উভয়ই অপেক্ষাকৃত কম নকশাদার ও শালীন হওয়া প্রয়োজন। অফিসিয়াল ট্রিপে এ ধরনের পোশাক বেশ আরামদায়ক। জুতার ক্ষেত্রে পুরোপুরি ফরমাল শু না পরে কিছুটা ক্যাজুয়াল লুকের জুতা বেশি মানানসই হবে।
(৪) স্মার্ট ক্যাজুয়াল
স্মার্ট ক্যাজুয়ালে ফরমাল এবং ক্যাজুয়াল পোশাকের ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থান ঘটে। ফর্মালের ভেতরেও ষ্টাইলিশ ভাবটা ফুটিয়ে তোলা যায়, যেটা কিনা একইসাথে প্রফেশনাল আবার আরামদায়ক। সাধারণ শার্ট-প্যান্ট পরতে পারেন, শার্ট প্যান্টে গোঁজা বা ইন থাকতে পারে। একটি ষ্টাইলিশ টাই ভালো মানাবে। সাধারণ ব্লেজার থেকে জ্যাকেট ষ্টাইলের কোট বেশী মানানসই। একরঙা জিন্সও পরতে পারেন।
(৫) বিজনেস ফরমাল
সাধারণত ফরমাল পোশাক বলতে আমরা যা বুঝি সেটাই হলো বিজনেস ফরমাল, যা পুরোপুরিভাবেই অফিসিয়াল পোশাক। আসলে একটি সম্পূর্ণ ব্লেজার সেট বা স্যুট থাকতে হবে। সাদা, হালকা নীল, ক্রীম ইত্যাদি রংয়ের ফুলহাতা শার্ট পরতে পারেন। হালকা ষ্ট্রাইপ দেয়া শার্টও মানানসই। শার্টের সঙ্গে থাকবে টাই। প্যান্ট এবং বেল্টটিও হতে হবে ফরমাল। সাধারণ ডায়ালের বেল্ট বা চেইন ঘড়ি থাকতে পারে হাতে। অক্সফোর্ড শু বেশি মানানসই হলেও পরতে এবং খুলতে অসুবিধাজনক হওয়ায় সাধারণ ফরমাল শু বেশি জনপ্রিয়। ঋতুভেদে স্যুট বাদ রেখে শার্ট-প্যান্ট এবং টাই পরতে পারেন।
(৬) সেমি ফরমাল বা ব্ল্যাক টাই
এটি মূলত পার্টি বা রাতের অনুষ্ঠানে পরার পোশাক। হলিউড মুভিতে আমরা যেমন টাক্সিডো পরতে দেখি, সেটিই এই পোশাক। বিশেষ গড়নের স্যুট পরা হয়ে থাকে, যেটার সামনের অংশের ল্যাপেলে সিল্কের মতো উজ্জ্বল রংয়ের কাপড় ব্যবহৃত হয় এবং বো টাই পরা হয়। পায়ে থাকবে পেটেন্ট লেদারের অক্সফাম, অপেরা পাম্প শু, যেটা অবশ্যই হতে হবে চকচকে।
কোথায় কী পরবেন?
চাকরির ইন্টারভিউয়ের সময় পোশাক নির্বাচন করা উচিত খুবই সতর্কতার সঙ্গে। সাদা, হালকা নীল বা এ ধরণের হালকা রংয়ের একরঙা শার্ট, ফরমাল প্যান্ট এবং টাই থাকতে পারে। পায়ে থাকবে কালো রংয়ের ফর্মাল জুতা। ইন্টারভিউ একটি সংবেদনশীল ব্যাপার। তাই খুঁটিনাটির উপরও নজর থাকা উচিত। এমন কোনো টাই, টাই পিন এবং কোটপিন পরা উচিত নয়, যাতে অপ্রাসঙ্গিক কিছু থাকে। যেমন ভিন্ন কোনো দেশের পতাকা বা কোনো কোম্পানির ব্র্যান্ড লোগো।
ইন্টারভিউতে মেয়েদের ক্ষেত্রে সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি পরা যেতে পারে, সেটা হওয়া উচিত একরঙা, তবে হালকা নকশাদার হতে পারে। খুব উজ্জ্বল রঙ যেমন কমলা, লাল ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। স্বাভাবিক ধরনের জুতা পরতে হবে এবং অলংকার পরিধান করতে হবে স্বল্প পরিমাণে। একই ধরনের পোশাক মেয়েদের প্রতিদিনকার অফিসিয়াল পোশাকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
কর্মক্ষেত্রে যোগদানের পরপরই পোশাক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে যাওয়া উচিত নয়। আগে অফিসের পরিবেশ বুঝে নিয়ে তারপর সে অনুযায়ী নিজের ব্যক্তিগত ফ্যাশন চিন্তা করতে পারেন। কোনটি আপনার জন্য প্রযোজ্য- বিজনেস ক্যাজুয়াল, স্মার্ট ক্যাজুয়াল নাকি ফরমাল? স্বতন্ত্রতা বজায় রাখার জন্য ফরমাল এবং বিজনেস ক্যাজুয়ালের মাঝামাঝিও চলতে পারেন। তবে অবশ্যই পরিবেশ বুঝে, যেটা আগেই বলা হয়েছে।
উৎসব, অনুষ্ঠান এবং দিবস উপলক্ষেও আলাদা ড্রেস কোড অনুসরণ করা উচিত। এতে ঐ অনুষ্ঠান বা দিবস কেন্দ্রিক কর্মকান্ডে আপনি যেমন স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীলভাবে মিশে যেতে পারবেন, তেমনি এটা আপনার রুচিশীলতার পরিচয়ও বহন করবে। যেমন বিজয় দিবসের কোনো অনুষ্ঠানে বিজয় দিবসের থিম ভিত্তিক কোনো পোশাক পরতে পারেন, ফ্যাশন হাউজগুলো আজকাল এ ধরনের দিবস কেন্দ্রিক থিম নিয়ে অনেক পোশাক বের করছে।
সর্বোপরি সঠিক ড্রেস কোড অনুসরণ করা আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। কর্মক্ষেত্রে আপনার উৎপাদনশীলতা (Productivity) বাড়ায় এবং আত্মসম্মান বজায় রাখতে সাহায্য করে। ফোর্বস ম্যাগাজিনের মতে, সঠিক পোশাক পরিধান হতে পারে আপনার সফলতার প্রথম পদক্ষেপ।