সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসা একটি বাক্য “ব্যর্থতাই সাফল্যের চাবিকাঠি”, যার মর্মার্থ বুঝে উঠতে আমাদের জীবনের অনেকটা সময়ই পার হয়ে যায়। ব্যর্থ হওয়ার যন্ত্রণা থেকে সাফল্য পাওয়ার উন্মাদনা কতটুকু বেশি বা কম, তার হিসেব মেলানো যেন জীবনের ছক ওলট-পালট করে দেখা। আবার ইংরেজিতে বলা হয় “Failure is the pillar of success”। অনেকেই ঠাট্টা করে বলেন, স্তম্ভ (pillar) বেশি হলে ভবন শক্তিশালী হয় ঠিকই, কিন্তু এর কাঠামোগত বিন্যাসে প্রচুর সমস্যা রয়ে যায়। এমন একটা বাড়ি, যাতে বাস করা যায় না, তেমন বাড়ির প্রয়োজনটাই বা কী?
প্রাত্যহিক জীবনে ‘সফল’ ও ‘অসফল’ এই দু’টো শব্দের সাথে যেন আমাদের নিত্য ওঠা-বসা। বিভিন্ন মানুষের চোখে শব্দ দু’টোর সংজ্ঞায়িত রূপও কিন্তু বেশ ভিন্ন। একেকজনের দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে শব্দ দুটোর বিশ্লেষণ। আবার আমাদের চলমান জীবনে শব্দ দুটোর তাৎপর্য এতটাই যে যে এর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। যেকোনো সময় এর দিক পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। “আজ যে রা,জা কাল সে ফকির”- এমন কথা শুধু লোকমুখে নয়, বরঞ্চ বাস্তবেও দেখা মেলে। সফল ব্যক্তি মাত্রই যেন তার জীবনাদর্শন ভিন্নরূপ, উন্নততর। পৃথিবীর সব পাপ গিয়ে জেঁকে বসে ঐ অসফল ব্যক্তিটিকে ঘিরে।
আমাদের এই তৃতীয় বিশ্বের সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে বদ্ধমূল ধারণা- অর্থোপার্জনের ভিত্তিতে সফলতা নিরূপিত হয়। পারিপার্শ্বিক বিচারে এই ধারণা দোষের কিছু নয়। কিন্তু সে বিচারে অসফল মানুষদের সংখ্যা একটু ভারি তা বলাই বাহুল্য। অন্যান্য উন্নত দেশের দিকে যদি আমরা নজর দিই, তাহলে দেখতে পাব সরকার থেকেই সাধারণ মানুষের চাহিদাগুলোর লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। সেটা কী করে? খুব সহজেই। একটা ভাল চাকরি পাওয়ার সাথে সাথেই ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে বাড়ি-গাড়ি, আসবাব, চিকিৎসা বীমা ইত্যাদি। খুব সহজ শর্তেই দিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন কিস্তি সুবিধা আর পূরণ হয়ে যাচ্ছে চাহিদার সাথে নানা শৌখিনতাও। এছাড়াও রয়েছে বাচ্চাদের ভালোভাবে পড়াশোনা করানোর সুযোগ। বেতন থেকে ঐ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ কেটে রাখার পর যা থাকে, তা ব্যাংকেই জমা হয়। তাই সবার চাহিদা একটা নির্দিষ্ট গন্ডিতেই বাধা পড়ে যায়।
অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে সকলে লিপ্ত হয় অনিয়ন্ত্রিত প্রতিযোগিতায়। চাই, চাই, আরও চাই। এই চাওয়ার যেন শেষ নেই। কিছু করারও নেই, পাশের সঙ্গীটি যে অনেকদূর এগিয়ে যাচ্ছে! আমাকেও যে পৌঁছাতে হবে সেই চূড়ায়। সোজা পথে না হোক, বাঁকা পথ তো আছেই। আর যে বাঁকা পথ ধরতে পারে না, সে হয়তো পড়ে রইবে অসফলতার কোনো এক আস্তাকুঁড়ে। চাহিদার যেখানে শেষ নেই, পাওয়ার হিসেব সবসময় পেছনে পড়ে থাকবে- এটাই তো স্বাভাবিক।
আজকের এই লেখাটি সফলতার বিপক্ষে নয়, বরং অসফলতার পক্ষে। আমাদের চারপাশে তাকালে দেখতে পাবো সফল ব্যক্তির চাইতে অসফল লোকের সংখ্যাই বেশি। এর জন্য একটি দেশের কর্মব্যবস্থা যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী আমাদের নিজস্ব কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অসফলতা মানুষের জীবনের বিভিন্ন মোড়ে এসেই ধরা দিতে পারে। কেউ চাকরি ক্ষেত্রে, কেউ ব্যবসায়, কেউ পড়ালেখায়, আবার কেউ প্রেমে। স্বপ্ন আমরা সবাই দেখি। অনেক সময় হয়তো সে স্বপ্ন বাস্তব করার জন্য যথেষ্ট প্রচেষ্টা আমাদের থাকে না। আবার চেষ্টা থাকলেও ভাগ্য অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলশ্রুতিতে তাই ব্যর্থতা ছাড়া অন্য কিছু আশা করা বাস্তবিক ভুল।
ব্যর্থ বা অসফল হওয়ার চাইতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় সমাজের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখার ভয়। সর্বদাই মনে আশঙ্কা ‘কী যেন ভাবছে লোকটা আমাকে নিয়ে!’ এই ধরনের চিন্তা-ভাবনা আমাদের অনেকের জীবনেরই নিত্যদিনের পাথেয়। আমাদের দেশটাই যে ওরকম! মানুষের হাতে আছে অজস্র সময়। অন্যের কথা ভাবতে ভাবতেই সকলের দিনলিপি পার। সে যাই হোক, এখন প্রশ্ন হলো- ‘অসফলতার গ্লানি থেকে কী করে মুক্তি পাওয়া যায়?’ বলা যত সহজ, করা যে ততটাই কঠিন! অনুপ্রেরণামূলক কথাবার্তা আর সফল মানুষের জীবনীতে সামাজিক মাধ্যমগুলো আজ পরিপূর্ণ। তার ওপর আছে নানা মুনির নানা উপদেশ। এতো উপদেশের সব যদি অনুসরণ করা যেত, তা হলে পৃথিবীতে ‘অসফল’ শব্দটাই মুছে যেত হয়তো।
এখন আসা যাক অন্য প্রসঙ্গে। ধরুন, আপনি একজন অসফল মানুষ। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই হয়তো আপনার ভুল ছিল। আজ পার হয়ে গেছে অনেকটা সময়। মন শুধু চাইছে যদি ফিরিয়ে আনা যেত হারিয়ে যাওয়া সময়, তবে নতুন করে গড়তাম এই জীবন। এই ভাবনা ভাবা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সেই হারিয়ে যাওয়া সময়টা যদি আজ আবার ফিরিয়েও দেওয়া হয়, তবু জীবনে কোনো পরিবর্তন আসবে না। কারণ আমরা আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এখনও পেছনের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। সামনে পড়ে থাকা সময়ের সাথে নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা থেকে এখনো বিরত।
‘depression’, ‘frustration’- শব্দগুলো জীবনের সাথে ক্রমেই মিশে যাচ্ছে হয়তো। আপনি ভেবে বসছেন নিজেকে দিয়ে আর কিছু করা সম্ভব নয়। ফলাফল কী দাঁড়ায়? ‘শূন্য’। তাই নিজেকে পাল্টে ফেলার মতো অদম্য সাহস বা প্রত্যয় যাদের নেই, তারা জীবনটাকে একটু অন্যভাবে দেখলেই এই অসফল জীবনের গ্লানি থেকে নিজেকে কিছুটা হলেও আড়ালে রাখা সম্ভব।
নিজেকে খুশি রাখা এবং নিজের জন্য কিছু করা
আমরা সবসময় অন্যের আনন্দ দেখে নিজে কতটা দুঃখী তা ভাবার চেষ্টা করি। এই ধারণা থেকে আমাদের বের হওয়া খুব জরুরী। অন্যের আনন্দকে সম্মান করে নিজে কীসে আনন্দ পাই সেদিকে নজর দিতে হবে। নিজেকে অন্যের কাছে দুঃখী হিসেবে প্রতীয়মান না করে আমার যা কিছু আছে তাই নিয়ে খুশি থাকার অভিপ্রায় আপনার প্রতি অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতেও বাধ্য করবে।
নিজেকে ভাল রাখার অভিপ্রায় সবসময়ই নিজেকে খুশি রাখার মতো দরকারি। নিজের কিছু ভাল দিক সবার আগে বেছে নিতে হবে। সকল মানুষেরই নিজস্ব কিছু ভাল দিক রয়েছে। সেই দিকগুলো সুন্দরভাবে সবার সামনে উপস্থাপন করতে হবে। নিজে কী ধরনের, অন্তর্মুখী না বহির্মুখী, সেটা বুঝে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। নিজের যা কিছু আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকার আপ্রাণ লড়াই করে যেতে হবে। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এই ধারণা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে।
প্রিয় মানুষটির জন্য কিছু করা
আমরা শুধু সফল হওয়ার লড়াইয়ে ব্যস্ত। কিন্তু সফল হওয়ার দৌড়ে অনেক সময় আমরা আমাদের প্রিয় মানুষটির কথা ভুলতে বসি। নিজে যদি অসফলও হই তাহলেও আমাদের কাছের মানুষটির জন্য কিছু করার আপ্রাণ চেষ্টা করা উচিৎ। প্রিয় মানুষের জন্য কিছু করতে পারার সুখ আপনাকে এনে দিতে পারে অনাবিল আনন্দ যা যেকোনো অসফল মানুষকেই এনে দিতে পারে অমূল্য কিছু পাওয়ার নিঃশর্ত সন্তুষ্টি।
অন্যকে সাহায্য করার চেষ্টা
আমরা সকলেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। শুধু নিজের কথাই ভেবে চলেছি নিরন্তর। তাই নিজের কিছু না পাওয়াকে আমরা অনেক বেশি বড় করে দেখি। কিন্তু নিজের সাধ্য অনুযায়ী অন্যকে সাহায্য করার মধ্যে এক অপরূপ স্বর্গীয় অনুভূতি রয়েছে যা শুধু পাওয়ার হিসেবে হিসেব করা যায় না।
দেশের জন্য কিছু করতে পারা
প্রতিটি অসফল মানুষের জন্য দেশ একটি বিশাল আশ্রয়। নিজের দেশকে ভালোবেসে, নিজের দেশের জন্য কিছু করার প্রত্যয় এনে দিতে পারে এক ভালো লাগার তৃপ্তি, যা সেই সকল মানুষের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিবে যারা দেশ রক্ষার ক্ষমতায় বসে দেশকে বিকিয়ে দিয়ে নিজের স্বার্থ রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট।
নিজেকে সৎ এবং যোগ্য করে গড়ে তোলা
অন্যের সাথে অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হয়ে নিজের ভাল দিকের বিকশিত করার চেষ্টা করা অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমানের কাজ। অন্যের অসৎ পথের অনুসরণ না করে সৎ পথে কিভাবে ভাল থাকা যায় এবং নিজের যা আছে তা যে সৎ পথে থেকেই উপার্জিত এমন ভাবনা নিজেকে অনেক বেশি আত্মতৃপ্তি এনে দিতে বাধ্য।
জীবনের ছোট ছোট প্রাপ্তিগুলোকে উপভোগ করা
আমাদের জীবনটা খুব স্বল্প সময়ের। এই ক্ষুদ্র জীবনে আমরা শুধু পাওয়ার হিসেবই করে যাই। এই জীবন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনেক যোগ-বিয়োগে পরিপূর্ণ। পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ নেই যার জীবনের ডায়েরি শুধু পাওয়ার হিসেবে ভর্তি। জীবনে অনেক উত্থান-পতন আসবে, ঘাত-প্রতিঘাত আসবে। কিন্তু জীবন তার নিজের আঙ্গিকেই বয়ে চলবে। তাই এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে প্রতিদিনকার যেটুকু পাওয়া তারই যথাযথ উপলব্ধি রাখা একান্ত জরুরি। ভবিষ্যতে অনেক বড় কিছু করব, সেই ভাবনা থেকে দূরে সরে এসে আজ নিজের জীবনে কী সুন্দর ঘটলো তার হিসেব করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
এই লেখাটি মোটেও বিশ্লেষণধর্মী নয় বা কোনো উপদেশমূলক রচনাও নয়। আপনারই জীবনের কিছু উপলব্ধি সামনে তুলে ধরার একটি ছোট্ট প্রয়াস। হয়তো অনেকের জীবনাদর্শের সাথে এই কথাগুলো মিলে যেতে পারে অথবা অনেকেই এর সাথে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন। কিন্তু পৃথিবীতে অসফল মানুষের সঙ্গী হওয়ার মতো লোকের খুবই অভাব, এটাই আজকের পৃথিবীর বড় সত্য। সুখী লোকের মানুষের আশেপাশে কত লোকের আনাগোনা, কিন্তু দুঃখী মানুষটির দিকে তাকিয়ে দেখার মতো দু’দন্ড সময় নেই কারো হাতে। তাই এই নিষ্ঠুর বাস্তবতায় অসফল ব্যক্তি মাত্রই নিজেকে নিজের উপর নির্ভর করতে হয় এবং নিজেকে নিজেই সামলাতে হবে।
তথ্যসূত্র
successconsciousness.com/index_000009.htm