করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের জনজীবনে। পুরো পৃথিবী একপ্রকার থমকে আছে এর প্রভাবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ স্বাভাবিক জীবন এবং জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল কিছুই কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। বিশ্বজুড়ে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বা অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রিগুলোর অবস্থাও একই। নামী-দামী ফ্যাশন ব্র্যান্ড, যেমন- নাইকি, জারা, পুমার মতো প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন এবং বিপণন স্থগিত রেখেছে।
বায়ার বা ক্রেতা কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং দেশ থেকে পণ্যের অর্ডার বন্ধ বা সাময়িক বন্ধ করে রেখেছে। সেই সাথে নতুন অর্ডারও দেয়া হচ্ছে না। এতে করে একদিকে বায়ার যেমন লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে, তেমনই উৎপাদনকারী বা ম্যানুফাকচারার এবং যোগানদাতা বা সাপ্লাইয়ার প্রতিষ্ঠানেরও হচ্ছে লোকসান।
গ্লোবাল ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান অবস্থা
গ্লোবাল ফ্যাশনের কথা যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে, অনেক প্রতিষ্ঠানই করোনা মহামারির পর প্রচুর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এবং অনেক কোম্পানিই টিকতে না পেরে হারিয়ে যাবে। একে বলা হচ্ছে ‘ফ্যাশন’স ডারউইনিয়ান শেক-আউট’ (Fashion’s Darwinian Shakeout)। অর্থাৎ, যেসব কোম্পানি করোনা মহামারির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবে, সেসব টিকে থাকবে, বাকিরা হারিয়ে যেতে পারে।
করোনাভাইরাসের কারণে দেশে দেশে কোয়ারেন্টিন কিংবা লকডাউনের কারণে কম-বেশি সকলেই গৃহবন্দী। এখন এই গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় কেউ নিশ্চয়ই ফ্যাশন প্রোডাক্ট কেনা নিয়ে এতটা মাথা ঘামাবে না। যেগুলো নিতান্ত প্রয়োজনীয় বস্তু, সেসব ছাড়া গৃহবন্দী মানুষজন আর তেমন কিছু কেনাকাটা করতে চাচ্ছে না। ফলে ফ্যাশন কোম্পানির ইন-স্টক বা ইনভেন্টরিতে থাকা পণ্য বিপণন সম্ভব হচ্ছে না।
তবে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে একটি কথা সত্য। সেটি হলো, যতই মহামারি হোক বা যেটিই হোক, ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি কখনো হারিয়ে যাবে না। কোনো না কোনোভাবে ফ্যাশন টিকে থাকবে। সেটি ফ্যাশনের গতিপথ পাল্টে হোক, কিংবা হোক নতুন কোনো ফ্যাশনের আবির্ভাব হয়ে। ইতিহাস ঘাটলে এর প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায়।
ছোট একটি উদাহরণ দেয়া যাক। একটি সময় জিন্স ছিল খনি শ্রমিকদের পরিধেয়। এরপর সেটি হয়ে গেল দ্রোহী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ, যা কতিপয় অভিনেতা পরতেন। পরে সেই জিন্সই হলো আভিজাত্যের প্রতীক। জিন্স এখন সর্বসাধারণের প্রায় অপরিহার্য পরিধেয় হয়ে গেছে। জিন্স একই আছে (যদিও এখন মানে পরিবর্তন এসেছে), কিন্তু ফ্যাশনের পরিবর্তন হয়েছে অনেকবার। এভাবেই ফ্যাশন টিকে থাকে কোনো না কোনো পথে।
অন-ডিমান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং
একটা সময় ছিল যখন ফ্যাশন বা অ্যাপারেল চলছিল একটা গতানুগতিক পথে। পরবর্তী মৌসুমকে টার্গেট করে তৈরি হত পোশাক। যেমন- গ্রীষ্মের সময় শীতের পোশাক তৈরি হত বা এখনও হয় এবং শীতকালে এই পোশাক বাজারে ছাড়া হয়। একইভাবে শীতকালে তৈরি হয় গ্রীষ্মের পোশাক। এই পদ্ধতিটি প্রথাগত। কিন্তু, আধুনিক শিল্পনেতারা জানেন, এই গতানুগতিক পদ্ধতি কেবল ‘Seasonal way’-তে ‘Casual dress’ তৈরিতে সক্ষম। কিন্তু গ্লোবাল ফ্যাশনের অর্থ কেবল এই ক্যাজুয়াল ড্রেসের উৎপাদন নয় কিন্তু।
এখন করোনার কারণে প্রায় প্রতিটি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিই তাদের ব্যবসা পুরোপুরি বা সাময়িক স্থগিত করে রেখেছে। ফলে তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। আবার ইনভেন্টরিতে যে পরিমাণ পণ্য মজুদ আছে, তাতে ইনভেন্টরির খরচ আছে। ফলে বিক্রি এবং লাভ ছাড়াই এই খরচ গুনতে হচ্ছে কোম্পানিকে। এখানে শিল্পনেতারা আস্তে আস্তে অন-ডিমান্ড ম্যানুফাকচারিং প্রসেস-এর (On-demand Manufacturing Process) প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
অন-ডিমান্ড ম্যানুফাকচারিং প্রসেস হচ্ছে যে, এখানে গতানুগতিক পদ্ধতিতে অর্থাৎ মৌসুমভিত্তিক উৎপাদন করা হবে না এবং কোনো পণ্য ইনভেন্টরিতে রাখার দরকার নেই। যখন দরকার হবে তখন সরাসরি ম্যানুফ্যাকচারার সেই পণ্য উৎপাদন করে দেবে। যদিও এই ধারণাটি এখনও সেভাবে কার্যকর হয়নি। এর কারণ সঠিক প্রযুক্তির অভাব এবং সঠিক দিক-নির্দেশনার অভাব। তবে এই মহামারির ফলে শিল্প-কলকারখানা এবং শিল্পনেতারা অন-ডিমান্ড ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের দিকে নজর দিচ্ছেন।
অর্থাৎ সহজ করে বলতে গেলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো মৌসুমভিত্তিক উৎপাদন থেকে যুগোপযোগী এমন পদ্ধতির প্রতি গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করছে যা হবে টেকসই। ফলে এই মৌসুমী উৎপাদন অদূর ভবিষ্যতে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অবশ্য কিছু কিছু মৌসুমী উৎপাদন জরুরি।
অন-ডিমান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং-এর আরো একটি সুবিধা আছে। সাধারণত কোনো বিশেষ ঘটনা বা সময়ের পরে মানুষের ফ্যাশনের রুচি পরিবর্তন হয়ে থাকে। যেমন- বর্তমান পরিস্থিতির কথা চিন্তা করা যাক। করোনাভাইরাসের থেকে বাঁচতে মানুষ কী-ই না করছে; মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস, দিনে কয়েকবার হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা হ্যান্ডওয়াশ ইত্যাদির ব্যবহার। এখন যদি এমন পোশাক তৈরি হয় যে পোশাক করোনাভাইরাস প্রতিরোধী, তাহলে কিন্তু মানুষ সেদিকে স্বাভাবিকভাবেই ঝুঁকবে, যেমন ঝুঁকেছে মাস্ক-গ্লাভসের দিকে।
সম্প্রতি ব্রাজিলভিত্তিক টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠান ‘সানশিস্তা টেক্সটাইল’ (Santista Textile) কোভিড-মুক্ত ডেনিম ট্রিটমেন্ট প্রসেস উদ্ভাবন করেছে। ঠিক এভাবেই আরো ট্রিটমেন্ট এবং ট্রিটেড প্রোডাক্ট তৈরি হবে, যেসব হবে কোভিড-মুক্ত। এটি একটি সাধারণ উদাহরণ দেয়া হলো। কারণ ফ্যাশনের গতিপথ বদলায় মূলত বিশেষ কোনো ঘটনা বা সময়কে কেন্দ্র করে। যেমন ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’ কিংবা ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরে মানুষের ঘরে-বাইরে, আচরণে, ফ্যাশনে অনেক পরিবর্তন এসেছিল। গবেষকরা ধারণা করছেন, করোনা মহামারি হবে এসব পরিবর্তনের আরেকটি অধ্যায়।
লোকাল বনাম গ্লোবাল ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি
সাধারণত ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিগুলো লোকাল এবং গ্লোবাল- দুই ধরনের ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি থেকে পণ্য উৎপাদন করে থাকে। অর্থাৎ, কতিপয় পণ্য লোকাল ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি থেকে তৈরি করা হয়। এতে সুবিধা হলো, লোকাল মার্কেটে সহজে সেগুলোর প্রবেশ নিশ্চিত করা যায়। আবার এখন অনলাইন শপিংয়ের সুদিন চলছে। অনলাইনে যারা কেনাকাটা করে, তারা অর্ডার করে আর খুব দেরি করতে চান না। কাজেই তাদের কথা মাথায় রেখে লোকাল ইন্ডাস্ট্রি থেকে পণ্য তৈরির ব্যবস্থা করা হয় এবং ২-৩ দিনের মধ্যে ডেলিভারির ব্যবস্থাও রাখা হয়।
কিন্তু গ্লোবাল ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিগুলোর ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি ভিন্ন। গ্লোবাল ম্যানুফ্যাকচারিং ব্যাপারটি হচ্ছে, এক দেশের বায়ার অন্য কোনো দেশের ইন্ডাস্ট্রিকে তাদের ব্র্যান্ডের পণ্য তৈরির অর্ডার দেয়। এক্ষেত্রে পণ্য তৈরির পর সেটি শিপিংয়ে অনেকটা সময় চলে যায়। এগুলো সাধারণ রিটেইল আউটলেটে দেয়া হয়। কারণ অনলাইন শপিংয়ের ক্ষেত্রে এর ডেলিভারির সময় লাগবে বেশি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থাৎ, করোনাগ্রস্ত অবস্থায় অন্য দেশ থেকে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে অনেক সমস্যা হচ্ছে। বায়ার কোম্পানি প্রচুর অর্ডার পুরোপুরি বা সাময়িকভাবে বাতিল করেছে। কিন্তু তাদের তো ব্যবসা করতে হবে। এক্ষেত্রে তারা তাদের লোকাল ইন্ডাস্ট্রিগুলোর উপর নির্ভরশীল। ফলে লোকাল মার্কেটের উৎপাদন তুলনামূলক বেড়ে যাবে সন্দেহ নেই। অপরদিকে গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতিও হবে। এই অবস্থা করোনা-পরবর্তী কয়েক মাস, এমনকি বছর পর্যন্ত হয়তো কার্যকর থাকতে পারে।
অনলাইন সেলিং এবং শপিং
বর্তমান সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অনলাইনভিত্তিক ক্রয়-বিক্রয় বা ই-কমার্স। অধিকাংশ মানুষই ফ্যাশন প্রোডাক্ট, যেমন পোশাক সরাসরি রিটেইল শপ থেকে কেনাকাটা করতে পছন্দ করেন। অনলাইনে ফ্যাশন প্রোডাক্ট কেনাকাটায় মানুষের আগ্রহ তুলনামূলকভাবে কম। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির ৮০ শতাংশ লেন-দেন হয় মূলত রিটেইল মার্কেট থেকে।
কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে দেখা যায়, প্রায় সব রিটেইল আউটলেটগুলো বন্ধ হয়ে আছে বা সীমিত সময়ের জন্য খুলছে। আবার মানুষ করোনার ঝুঁকি নিয়ে রিটেইল শপে কেনাকাটা করতে যেতেও সাহস পাচ্ছে না বা যেতে চাচ্ছে না। এক্ষেত্রে অনলাইন শপিংই তাদের একমাত্র ভরসা। যারা রিটেইল শপ থেকে পণ্য কিনতো, তারা এখন অনলাইন থেকেই পণ্য কেনাকাটা করছে।
এর ফলে দু’ধরনের ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত, যেসব ব্র্যান্ড বা কোম্পানির অনলাইন ই-কমার্স সাইট আছে, অর্থাৎ অনলাইনভিত্তিক শপিং সিস্টেম আছে, তাদের ক্ষেত্রে রিটেইল আউটলেটের থেকে কম হলেও কেনাকাটা চলছে। অন্যদিকে যেসব ব্র্যান্ড বা কোম্পানি কেবল রিটেইল আউটলেটের উপর নির্ভরশীল ছিল, সেগুলোর পণ্য সব ইনভেন্টরিতেই আটকে আছে।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে করোনা পরবর্তী সময়েও অনলাইনে কেনাকাটার অভ্যাস আগের থেকে কিছুটা হলেও বেড়ে যাবে। এবং যেসব কোম্পানি এখনও তাদের ই-কমার্স সাইট তৈরি করতে পারেনি, তারাও ই-কমার্স সাইটের দিকে ঝুঁকে যাবে। মানুষের অভ্যাস একবার পাল্টে গেলে সাথে অনেক কিছুই পাল্টে যায়।
কোনো ব্র্যান্ড বা কোম্পানির অনলাইন ই-কমার্স সাইট থাকার আরো অনেক সুবিধা আছে। এই সুবিধা কোম্পানি এবং কাস্টমার উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কাস্টমারের জন্য সুবিধা এই যে, সে সরাসরি ব্র্যান্ডের সাইট থেকে প্রোডাক্ট অর্ডার করতে পারছে। এখানে কোনো তৃতীয় পক্ষের ঝামেলা নেই। পণ্যের গুণগত মানও সেক্ষেত্রে যথাযথ থাকার কথা। অন্যদিকে কোম্পানির সুবিধা এই যে, কোম্পানি সরাসরি কাস্টমারের থেকে ফিডব্যাক পাচ্ছে। এতে ফ্যাশন ফোরকাস্টিং এবং প্রোডাক্ট কোয়ালিটি ডেভেলপমেন্টের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে।
মোট কথা, ব্র্যান্ড বা কোম্পানির অনলাইন ই-কমার্স সাইট কোম্পানি এবং কাস্টমারের মধ্যে একধরনের ইন্টারফেস তৈরি করতে পারবে।
বিগত দশকে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি ছিল অন্যতম অর্থনৈতিক সফলতা। উত্তরোত্তর বৃদ্ধি, এশিয়ান মার্কেটে শক্তিশালী অবস্থান এবং অনলাইন শপিং ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে নিয়ে গেছে অন্যতম উচ্চতায়। ইউরোমনিটর ইন্টারন্যাশনাল-এর হিসেব মতে, ২০১৯ সালে রিটেইল মার্কেটে গ্লোবাল ফ্যাশনের মূল্য ছিল ১.৭৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৮ সালের থেকে প্রায় ১৪ শতাংশ বেশি।
যদিও করোনা মহামারির কারণে সেই সফলতা সাময়িকভাবে হুমকির সম্মুখীন। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে, ফ্যাশন হচ্ছে এমনি এক জিনিস যা একেবারে হারিয়ে যায় না, নতুন রূপে আবার ফিরে আসে। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন সঠিক দিক-নির্দেশনা এবং প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার।