বিপরীত লিঙ্গের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। আর যেকোনো আধুনিক সমাজেই নারীদের প্রতি পুরুষদের আকর্ষণের বিষয়টি অপেক্ষাকৃত বেশি লক্ষ্য করা যায়। নাটক-সিনেমা থেকে শুরু করে গল্প-উপন্যাস, কিংবা গান-কবিতা, সকল ক্ষেত্রেই পুরুষরা যে নারীদের প্রতি কতটা আকৃষ্ট, এবং তারা নারীদেরকে কতটা কামনা করে, সেই বিষয়টি ঢালাওভাবে দেখানো হয়ে থাকে।
তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি ধারণা গড়ে উঠেছে যে, পুরুষদের জন্য বুঝি নারীসঙ্গই পরম প্রার্থনীয়। কেবল নারীদের সাথে থাকলে, বিশেষ করে সেই নারীদের সাথে আবেগিক ভালোবাসা ও শারীরিক যৌনতা থাকলে, পুরুষরা সবচেয়ে বেশি ভালো থাকে, জীবনটাকে সবচেয়ে ভালো করে উপভোগ করতে পারে।
কিন্তু সম্প্রতি মেন অ্যান্ড ম্যাসকুলিনিটিজ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে দাবি করা হয়েছে, কোনো নারীর সাথে রোমান্টিক সম্পর্কের চেয়ে, কোনো পুরুষ বন্ধুর সাথে যৌনতাহীন কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই একজন পুরুষকে সবচেয়ে বেশি মানসিক সন্তুষ্টি ও প্রশান্তি দিয়ে থাকে। দুজন পুরুষের মধ্যকার এই ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের নাম ব্রোমান্স।
ব্রোমান্সের ধারণাটি খুব নতুন কিছু নয়। জর্জ ওয়াশিংটন অন্য পুরুষদের কাছে গভীর আবেগপূর্ণ চিঠি লিখতেন। আব্রাহাম লিংকনও এক পুরুষ বন্ধুর সাথে এক বিছানা ভাগ করেছেন বহু বছর। তখন পর্যন্ত পুরুষদের মধ্যকার এই ঘনিষ্ঠতাকে খুব স্বাভাবিক চোখেই দেখা হতো। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সেই স্বাভাবিক সম্পর্কটিই দেশে দেশে ট্যাবুতে পরিণত হয়। এর প্রধান কারণ হলো সমকামী মানসিকতার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া। ওই সময়টা থেকে আধুনিক বিশ্বে সমকামীরা প্রকাশ্যে নিজেদের যৌন প্রবণতার কথা ঘোষণা দিতে শুরু করে বলে, সমলিঙ্গীয় ঘনিষ্ঠতাকে সাধারণ মানুষ সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে।
পুরুষদের ক্ষেত্রে এর প্রকোপটা পড়ে সবচেয়ে বেশি। দুজন নারীর মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠতা থাকলেও তা নিয়ে কিন্তু কেউ তেমন একটা মাথা ঘামায় না। কিন্তু দুজন পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক যৌন আকর্ষণ যদি না-ও থাকে, তাদের মধ্যকার সাধারণ যেকোনো ঘনিষ্ঠতা, যেমন হাত ধরাধরি করে হাঁটাকেও মানুষের চোখে অস্বাভাবিক বলে মনে হতে থাকে, এবং তারা ভাবতে থাকে, এই দুজন পুরুষ সমকামী নয় তো! বরং একজন পুরুষ যদি একাধিক নারীর সাথেও ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে, কেউ কেউ ভেবে থাকে, “এটাই তো সত্যিকারের পুরুষালী আচরণ!”
এভাবেই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী ও আদর্শের পরিবর্তন, এবং পুরুষালী আচরণের সংজ্ঞা পাল্টে যাওয়ার ফলেই, দুজন পুরুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হঠাৎ করেই স্বাভাবিক থেকে অস্বাভাবিকে পরিণত হয়েছে।
তবে আশাজাগানিয়া বিষয় এই যে, দুজন পুরুষের মধ্যকার ঘনিষ্ঠতা তথা ব্রোমান্স এখন আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। উচ্চশ্রেণীর সমাজেও এখন ক্রমশই ব্রোমান্সের ধারণাটি ‘কুল’ হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেছে। এর পেছনে বড়সড় ভূমিকা রয়েছে বারাক ওবামা-জো বাইডেনের মতো বিখ্যাত দৃষ্টান্ত, কিংবা দ্য ফোর্টি ইয়ার ওল্ড ভার্জিনের মতো চলচ্চিত্রসমূহের।
পুরুষদের কাছে ব্রোমান্স আসলেই কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নির্ধারণের জন্য ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ উইনচেস্টারের গবেষকরা বেছে নিয়েছিলেন কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়া ৩০ জন বিষমকামী (যারা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে) পুরুষকে। এই ৩০ জন পুরুষের মধ্যে একজন বাদে বাকি সবাই ছিল শ্বেতাঙ্গ, সকলেরই অন্তত একটি স্পোর্টস মেজর ছিল, এবং তারা সকলেই ইতিপূর্বে কিংবা গবেষণা চলাকালীন কোনো নারীর সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল।
গবেষকরা আবিষ্কার করেন, ৩০ জন পুরুষেরই অন্তত একজন ‘ব্রোমান্টিক’ বন্ধু রয়েছে, যাদের সাথে তাদের ‘বাঁধনহীন’ সম্পর্ক বিদ্যমান, অর্থাৎ তাদের সাথে সকল গোপন কথা শেয়ার করা, ভালোবাসা প্রকাশ করা কিংবা একই বিছানায় শোয়া, সবই তারা করেছে। এমনকি ৩০ জনের মধ্যে ২৯ জনই বিছানায় শুয়ে তার পুরুষ বন্ধুটির সাথে কাডলও (আলিঙ্গন) করেছে।
গবেষকরা স্বীকার করেন, মাত্র ৩০ জন পুরুষের উপর গবেষণা চালিয়েই সমগ্র পুরুষজাতির ব্যাপারে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়, সেজন্য আরো বড় পরিসরে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তারপরও তারা তাদের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত সেক্স রোলস নামক জার্নালে প্রকাশ করেছেন। সেখানে তারা পুরুষদের প্রকৃত রোমান্স (যে সম্পর্ক তারা কোনো নারীর সাথে গড়ে তোলে) ও ব্রোমান্সের মধ্যকার কিছু পার্থক্য তুলে ধরেছেন।
গবেষকদের মতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষরা তাদের প্রেমিকার তুলনায় ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে কম ‘জাজড’ অনুভব করে। অর্থাৎ প্রেমিকা যেমন তাদের যেকোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন বা আপত্তি তোলে, পুরুষ বন্ধুরা তা করে না। যেমন- একজন অংশগ্রহণকারী বলেছেন, “টিম জানে আমি টেইলর সুইফট ও বিয়ন্স শুনতে পছন্দ করি। কিন্তু এই কথাটা আমি আমার প্রেমিকাকে বলিনি। কারণ তাহলে সে আমাকে জাজ করবে। আমার মনে হয় তার সাথে থাকার সময় আমাকে আরো পুরুষালী আচরণ করতে হবে।”
এছাড়া গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, পুরুষরা তাদের যেকোনো সমস্যা বা আবেগ পুরুষ বন্ধুর সাথে শেয়ার করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, এবং পুরুষ বন্ধুদের কাছে তারা নিজেদের যেকোনো স্পর্শকাতর শারীরিক সমস্যার কথাও তুলে ধরতে পারে। যেমন- অংশগ্রহণকারী ৩০ জনের মধ্যে ২৮ জনই বলেছে, খুব ব্যক্তিগত কোনো বিষয়ে আলাপ করার থাকলে, প্রেমিকার চেয়ে তারা ঘনিষ্ঠ পুরুষ বন্ধুটিকেই আগে বেছে নেবে। যেমন একজন বলেন, “আমার অন্ডকোষে যদি পিন্ড সৃষ্টি হয়, সেটি আমি আমার প্রেমিকাকে না জানিয়ে (পুরুষ) বন্ধুকে জানাব।”
ব্রোমান্স ও রোমান্সের মধ্যে পার্থক্য কী, এমন প্রশ্নের জবাবে একজন বলেন, “এক্ষেত্রে তিনটি বিবেচ্য বিষয় রয়েছে: যৌন আকর্ষণ, আবেগিক সংযোগ ও ব্যক্তিত্ব। ব্রোমান্সের ক্ষেত্রে কেবল শেষ দুটির প্রয়োজন হয়, কিন্তু রোমান্সে যৌনতা আবশ্যক, সেই সাথে বাকি দুটির যেকোনো একটি প্রয়োজন হয়।”
এই গবেষণা থেকে শেষ পর্যন্ত গবেষকরা এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, আবেগিক ঘনিষ্ঠতার দিকটি বিবেচনা করলে, পুরুষরা বিপরীত লিঙ্গের সাথে রোমান্টিক সম্পর্কের চেয়ে, সমলিঙ্গের কোনো বন্ধুর সাথে ব্রোমান্টিক সম্পর্কেই বেশি সন্তুষ্টি খুঁজে পায়।
গবেষকরা আরো মনে করেন, পুরুষরা যে এখন আবার নিজেদের মধ্যে সম্পর্কে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করছে, এবং সমাজের তোয়াক্কা না করে এমন সম্পর্ক স্থাপন করছে, এটি খুবই ইতিবাচক ও প্রগতিশীল একটি পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে পুরুষরা দীর্ঘ মেয়াদে অনেক লাভবান হতে পারবে, বিশেষ করে নারীদের সাথে যদি তারা আবেগিক ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলার ব্যাপারে সফল না হয়।
তবে চিরাচরিত নারী-পুরুষ সম্পর্ক যে এতে করে প্রভাবিত হবে না, সে কথাও জোর দিয়ে বলার উপায় নেই। ব্রোমান্টিক সম্পর্ক বর্তমান সময়ে আবার যে হারে বেড়ে চলেছে, সেই সাথে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি পুরুষদের আগ্রহ কমছে, এবং নারীবিদ্বেষ বাড়ছে, তাতে ব্রোমান্সের তোড়ে রোমান্স ভেসে যাওয়ার আশঙ্কাও করছে অনেকে।
ব্রোমান্স নাকি রোমান্স – কোনটি বেশি জরুরি, সেই বিতর্কে আমরা না হয় না-ই গেলাম। একদম নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে এ কথা বলাই যায় যে, একজন পুরুষের জন্য যেমন পুরুষ বন্ধুর প্রয়োজন আছে, তেমনই প্রয়োজন আছে তাকে জানে ও বোঝে এমন একজন নারীরও। একজন পুরুষ যত সহজে আরেকজন পুরুষের সমস্যাগুলো বুঝতে পারবে ও তাকে মানসিক সমর্থন দিতে পারবে, কোনো নারীর পক্ষে সেটি কখনোই সম্ভব না। ঠিক যেমন পুরুষের পক্ষে নারীর সকল সমস্যা বোঝা অসম্ভব। তাই কোনো নারীর কাছ থেকে সেটি আশা করাও উচিত না। আবার একজন পুরুষকে জীবনযুদ্ধে সফল হতে, সব বাধা পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে একজন নারী যে অনুপ্রেরণা জোগায়, তার সকল প্রয়োজনে পাশে থাকে, সেটিরও কোনো তুলনা হয় না। জৈবিক চাহিদার কথা যদি বাদও দিই, একজন পুরুষের জীবনের পূর্ণাঙ্গ মানসিক পরিতৃপ্তির জন্যও একজন জীবনসঙ্গিনী তথা নারীর বিকল্প নেই। তাই আমাদের আশা থাকবে, সকল পুরুষই তার জীবনে মনমতো রোমান্স ও ব্রোমান্স দুই-ই পাক। সুস্থ ও ভালো থাকুক সকল সম্পর্ক।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/