বর্তমানে মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছে। আধুনিক সময়ে যে প্রযুক্তিটি পৃথিবীকে একেবারে মানুষের মানুষের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে, সেটি হচ্ছে মোবাইল ফোন। যোগাযোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ব্যবহৃত ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র এটি। বর্তমানে এমন কোনো কাজ নেই, যা মোবাইল ফোন দিয়ে সম্পন্ন করা যায় না।
মোবাইল ফোনে ইন্টারনেটের সংযুক্তি ছিল যুগান্তকারী ঘটনাগুলোর একটি। মোবাইল ফোন হচ্ছে এমন একটি যন্ত্র যার সঠিক ব্যবহার যেমন আপনার জীবনকে সহজতর করতে পারে, একইসাথে এর অপব্যবহার হতে পারে আপনার মূল্যবান সময় নষ্টের কেন্দ্র। আমাদের জীবন এমন এক পর্যায়ে পৌছেছে যে, চাইলেই আমাদের জীবন থেকে মোবাইল ফোনকে আলাদা করা সম্ভব নয়, উচিতও নয়।
‘নোমোফোবিয়া’ (Nomophobia) হচ্ছে ‘নো মোবাইল ফোন ফোবিয়া’ (No Mobile Phone Phobia) শব্দগুলোর সংক্ষিপ্ত রূপ। সাধারণত কোনো জিনিসের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি কিংবা কোনো পরিস্থিতি উদ্ভবের ফলে যখন মানসিক অস্বস্তির তৈরি হয়, তখনই সেটিকে ‘ফোবিয়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়৷ নোমোফোবিয়ার ক্ষেত্রেও বিষয়টি একইরকম। মোবাইল ফোনের হারিয়ে যাওয়ার ফলে, নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হবার ফলে কিংবা মোবাইল ফোনের চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ার ফলে আপনার মধ্যে বিশেষ কিছু লক্ষণ দেখা যেতে পারে। এসব লক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে আপনাকে ‘নোমোফোবিয়া’য় আক্রান্ত ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা দেয়া যেতে পারে। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, লক্ষণগুলোর উদ্ভব ঘটে মোবাইল ফোনের বিশেষ কিছু পরিস্থিতি থেকে। আমাদের জীবনের জন্য অপরিহার্য অনেক সেবা গ্রহণের জন্য মোবাইল ফোনের উপর নির্ভর করতে হয়। যেমন- বর্তমানে বিদ্যুৎ বিল প্রদানের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন আপনার মোবাইল ফোন হারিয়ে গেলে বা যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে স্বাভাবিকভাবেই আপনার মধ্যে অস্বস্তি বা শঙ্কা দেখা দেবে।
এখান দেখা যাক কী কী লক্ষণ নোমোফোবিয়ায় আক্রান্তের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। রোগটির দুই ধরনের লক্ষণ রয়েছে– মানসিক এবং শারীরিক। মানসিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মোবাইল ফোন থেকে দূরে সরে গেলে হঠাৎ মনে ভয়, দুশ্চিন্তা কিংবা হতাশা ভর করা। হঠাৎ মোবাইল ফোন চোখের আড়ালে চলে গেলে আতঙ্কিত হয়ে যাওয়া। দীর্ঘ সময় মোবাইল ফোন চালাতে না পারলে মানসিক চাপ অনুভব করা। সাধারণত কোনো ভীতিকর পরিস্থিতিতে মানুষ যেসব শারীরিক লক্ষণ প্রকাশ করে থাকে, এই রোগের ক্ষেত্রেও সেগুলোই প্রকাশ পায়। যেমন- হঠাৎ কাঁপতে শুরু করা কিংবা স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হওয়া। এছাড়াও জ্ঞান হারিয়ে ফেলা অথবা কোনো আবহাওয়াগত কারণ ব্যতিরেকে ঘামতে থাকাও এই রোগের শারীরিক লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম। মূলত, একজন আক্রান্ত মানুষের শারীরিক লক্ষণগুলো নোমোফোবিয়ার মানসিক পরিস্থিতির জন্য উদ্ভূত হয়ে থাকে।
ঠিক কী কারণে নোমোফোবিয়া তৈরি হয়, তা নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। তবে মোবাইল ফোনের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে সবাই একমত হয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, মোবাইল ফোনের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতার ফলে একধরনের আসক্তি তৈরি হয় মানুষের মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগ শুরু হওয়ার পর মোবাইল ফোনের উপর মানুষের আসক্তি চরমে ঠেকেছে। হঠাৎ যখন একজন মোবাইল ফোনে আসক্ত ব্যক্তি অনুধাবন করেন যে তিনি মোবাইল ফোন হারিয়ে ফেলেছেন কিংবা সেটি আর ব্যবহার করতে পারবেন না, স্বাভাবিকভাবেই তার মধ্যে বেশ কিছু মানসিক পরিবর্তন আসবে, যেটি তার জন্য মোটেও সুখকর নয়। আমাদের দেহের একটি অতি প্রয়োজনীয় হরমোন হচ্ছে ডোপামিন৷ এটিও নোমোফোবিয়ার পেছনে বেশ কিছুটা দায়ী।
এই রোগের পরিসংখ্যানগত দিকেও একটু চোখ বোলানো যাক। পুরো বিশ্বে বর্তমানে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাতশো কোটিরও বেশি। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় একানব্বই শতাংশ মানুষের মোবাইল ফোন রয়েছে। আমেরিকায় মোট মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর প্রায় ৬৬ শতাংশ ব্যক্তিই তাদের মধ্যে নোমোফোবিয়ার লক্ষণগুলো বিদ্যমান থাকার কথা স্বীকার করেছেন। বাসায় মোবাইল ফোন রেখে আসা ৫০ শতাংশ ব্যক্তি মানসিক অস্বস্তিতে ভুগে থাকেন। এমনকি ২৬ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষেত্রে চালকেরা দুর্ঘটনায় সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করে থাকেন বলে পরিসংখ্যান দেখা গিয়েছে। ৬৯ শতাংশ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী ঘুম থেকে উঠে কোনো কাজ করার আগে সবার প্রথমে মোবাইল ফোনে হাত দেন।
নোমোফোবিয়া এখনও পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত কোনো রোগ নয়। তাই এই রোগ নির্ণয়ের জন্য যেসব বিশেষ কোনো স্বীকৃত পদ্ধতি নেই। ২০১৫ সালে আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষার্থী এই রোগ নির্ণয়ের জন্য একটি প্রশ্নমালা তৈরি করেছিলেন। প্রায় তিনশো শিক্ষার্থীর উপর সেই প্রশ্নমালা প্রয়োগ করে সেই শিক্ষার্থীর সফলও হয়েছিলেন। সাধারণত যেসব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, তারা যেকোনো ফোবিয়ার স্বাভাবিক লক্ষণগুলোর মাধ্যমেই রোগীর এই রোগ চিহ্নিত করে ফেলতে পারবেন। উপরে যেসব লক্ষণের কথা বলা হয়েছে, সেসব হঠাৎ দেখা দিলেই একজন মানুষ নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত, এমনটা বলা যাবে না। তবে যদি লক্ষণগুলো ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা বিদ্যমান থাকে, সেক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হওয়াই ভালো।
নোমোফোবিয়া এখনও কোনো স্বীকৃত মানসিক রোগ না হলেও প্রযুক্তির অতিব্যবহারের ফলে যে মানসিক অসুস্থতা তৈরি হচ্ছে– একে অস্বীকার করার কিছু নেই। তরুণদের মাঝে এই রোগের লক্ষণগুলো সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। চাইলে কিছু কৌশল অবলম্বন করে নিজের চেষ্টায়ও নোমোফোবিয়া থেকে দূরে থাকা যায়। গভীর রাত পর্যন্ত মোবাইল ফোনে সময় না দেয়া, অল্প সময়ের জন্য বাসায় মোবাইল ফোন রেখে দিয়ে বাইরে অবস্থান করা, কিংবা দিনের একটি সময়ে সবধরনের প্রযুক্তি থেকে দূরে থাকার মতো কাজগুলো নোমোফোবিয়া থেকে দূরে রাখতে পারে একজন মানুষকে। প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে এটি যেন মানুষের জীবনকে আরও সহজতর করে তুলতে পারে, জীবন যেন হয়ে ওঠে আরও বেশি উপভোগ্য ও স্বাচ্ছন্দ্যময়। কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহারে যখন জীবনে জটিলতা তৈরি হয়, তখন সেটির প্রভাব হয়ে ওঠে ভয়াবহ। এরকম পরিস্থিতির যেন উদ্ভব না ঘটে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।