পৃথিবীতে যা কিছু আছে, যত জীবন যত জীবিকা, যতগুলো সম্পর্কই আছে, সবকিছুর একটি ধ্রুব গন্তব্য বোধ করি ‘সুখ’। মান্না দে’র সেই গানটির মতনই আর কী! “সবাই তো সুখী হতে চায়”। যত বয়স বাড়তে থাকে ততই আমরা সুখের সংজ্ঞাকে জটিল থেকে জটিলতর করে ফেলি আর নিজেরাও সে সংজ্ঞার জালে আটকা পড়ি। সুখের সমীকরণের মান কারো জন্যই সমান নয় তাই। একটি ছোট শিশুর কাছে যা সুখ, উঠতি বয়সের কিশোর তাকে সুখ ভাবে না। ছাপোষা চাকুরিজীবী যাকে সুখপাখি মনে করে হন্যে হয়ে খাটছেন, পুঁজিবাদীর ডাইনিং টেবিলে সেই সুখ গলে পঁচে মরে। ষাটোর্দ্ধ অবসরপ্রাপ্ত এক বৃদ্ধা যেখানে সময় পার করে দেন দূরে থাকা সন্তানের অপেক্ষায়, প্রথম প্রেমে পড়া যুবতীর কাছে সুখ কিন্তু একদম ভিন্ন!
আচ্ছা এমনও তো হতে পারে, যে সুখের পেছনে মানুষ ব্যয় করে প্রতিটি মুহূর্ত, তার সমস্ত জীবন; কেউ কেউ এই সুখকেও কি ভয় পেতে পারে? হ্যাঁ, এরকমও কিছু মানুষ আছেন যারা পারতপক্ষে এড়িয়ে চলেন সুখকর অনুভূতি কিংবা অভিজ্ঞতা। তারা জীবনের যেটা যেমন চলছে তেমনটাই চলতে দিতে চান, সুখের চেয়ে স্বস্তি অনেক বেশি মূল্য পায় তাদের দৃষ্টিতে। তাহলে কি সুখ ভালবাসেন না? তাহলে কি তারা সুখী হতেই চান না? তারাও সুখ ভালোবাসেন, সুখী হতে চান প্রচন্ডভাবে। কিন্তু, ঐ যে বললাম না, ভয় পান! আর ভয় তো ভয়ই, সে কি কোনো যুক্তি মেনে চলেছে?
সুখের পরিমাণ না বাড়িয়ে দুঃখের মাত্রাটা একটু কমিয়ে রাখবেন, এই হচ্ছে তাদের মূলনীতি। কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের অতিরিক্ত কাছে আসা থেকে কিছু সুখ পাওয়ার চেয়ে তারা আসন্ন দুঃখ বা হতাশা থেকে দূরে থাকাটাকেই শ্রেয় বলে মনে করেন।
এই ভয় বা আতঙ্কটির বেশ সুন্দর নামও আছে! চেরোফোবিয়া (cherophobia) বলা হয় এই সুখভীতিকে। আনন্দসংবাদকে কোনো শোকসংবাদেরই পূর্বাভাস বলে মনে করেন এরা! এই ধারণাটি পাশ্চাত্যের চাইতে প্রাচ্যেই বেশি প্রচলিত। আমাদের লোকসংস্কৃতিতেও কিন্তু এর বেশ ভাল একটি উদাহরণ পাই খনার বচনে। খনার বচনে বলা আছে, “যত হাসি তত কান্না, বলে গেছে রাম সন্না”। কে এই রাম সন্না কে জানে! কিন্তু তার এই ভাবনাটি কিন্তু আজকের এই ‘চেরোফোবিয়া’র সাথেই মিলে যাচ্ছে। তাহলে কি রাম সন্নাও চেরোফোবিক ছিলেন? হয়তো বা হ্যাঁ!
সুকুমার রায়ের ছোটদের জন্য রচিত লেখাগুলোর সাথে তাদের পরিচয় আছে তারা হয়তো জেনে থাকবেন, তিনি ‘রামগড়ুরের ছানা’ নামে একটি বিশেষ ধরনের প্রাণীর কথা বলেছেন। এই রামগড়ুরের ছানারা ছানা হলে কী হবে! কিছুতেই মুখে হাসি ফুটতো না এদের। সন্দেহ হচ্ছে, এদেরও মনেও মনে হয় চেরোফোবিয়া ছিলো!
একটু লক্ষ্য করলেই হয়তো দেখবো আমাদের আশেপাশের লোকজনের মধ্যেই রয়েছে কিছু চেরোফোবিক! কেউ নিজে থেকে বুঝতে পারছে আবার কেউ বা নিয়মিত ভুগে যাচ্ছে এই চেরোফোবিয়া কিংবা সুখভীতিতে। কেউ কখনো ইচ্ছে করে কোনো ফোবিয়ার ভেতর ঢুকে পড়ে না, কিছু বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলেই একসময় ব্যক্তির মধ্যে জন্ম নেয় দ্বন্দ্ব এবং তা থেকে ক্রমশ একটি ভীতি, যাকে আমরা এখানে বলছি ‘চেরোফোবিয়া’।
চেরোফোবিয়ার কী কারণ হতে পারে?
অবশ্যই প্রথম থেকেই কারো মধ্যে চেরোফোবিয়া জেগে ওঠে না। অতীতের কোনো আঘাত কিংবা কোনো আনন্দের অব্যবহিত পরে আসা দুঃখের অভিজ্ঞতা যে কারো মধ্যেই জন্ম দিতে পারে এই জটিলতার, এই সুখভীতির। ২০১৭ সালের মার্চে বেরোলো মধ্যপ্রাচ্যের লেখক ইসমাইল এম তাহেরের ‘cherophobia: the fear of being happy’ নামের বইটি। এতেও পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে চেরোফোবিয়ার জন্মের কথা বলা আছে, তবে সেই সাথে চেরোফোবিয়া থেকে বেরোনোর অনেক আশার কথাও আছে।
মূলত একটি প্রেমের গল্প বর্ণিত হয়েছে বইয়ে। প্রেমের ক্ষেত্রে চেরোফোবিয়া এক প্রকার ঋণাত্মক প্রভাবকের কাজ করে, কারণ অনুভূতিকে দমিয়ে রাখতে চেরোফোবিকদের জুড়ি মেলা ভার! মাত্রাতিরিক্ত সুখ থেকে একসময় বেদনা জন্ম নেয়, চেরোফোবিকরা এই বেদনাকে এড়াতে গিয়ে সুখকে মাত্রা ছাড়াতে দিতে চান না। এদের এই অসম্ভব সতর্কতা মেনে চলেন। সহজ কথায়, চেরোফোবিকেরা সে কাজটাই সবচেয়ে কম করেন যা তারা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন! সে মানুষটির বেশি কাছে আসতেই ভয় পান, যার কাছে সবচেয়ে বেশি আসতে চান! তাতে নিজেকে সুখ থেকে দূরে রাখার সাথে সাথে আরো কিছু মানুষকেও অজান্তেই দূরে সরিয়ে দেন প্রাপ্য সুখ থেকে।
সুখ নিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের ধারণাটির সাথে এর একটি সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছি।
একবার এক লোক এসে বুদ্ধকে বললো, “আমি সুখ চাই”। বুদ্ধ তার জবাবে বললেন, তুমি প্রথমে ‘আমি’কে বাদ দাও, এটি হচ্ছে অহমবোধ। এরপর তুমি বাদ দাও ‘চাই’ শব্দটিকে। এ হলো জগতের সকল কামনা-বাসনা। সবশেষে তোমার কাছে যা রইলো, তাই ‘সুখ’।
কোনো কিছু না চাইলেই যে ভালো থাকা যায়, বুদ্ধ তাই বিশ্বাস করতেন। চেরোফোবিকেরাও কি এ বিশ্বাসেই বাঁচে? নাকি তাদের ভীতি আরো বেশি আগ্রাসী?
চেরোফোবিক ব্যক্তিদের মতে, স্বস্তিই তাদের সুখ। কোনো নতুন সম্পর্কের ঝুঁকি না নেয়া, কোনো দায়বদ্ধতায় নিজেকে জড়িয়ে ফেললে যদি তারা নিজের কিংবা অপরের প্রত্যাশার মতো না হতে পারেন তবে কী হবে, এসব চিন্তা মাথায় সবসময় জেঁকে বসে থাকে। এক পা বাড়াবার আগে যদি সামনে গর্ত থাকবে ভেবে নেয়া হয়, তবে তো আর পথ পেরোনো যায় না, ‘সুখ’ নামের ঐ ধ্রুব গন্তব্যে পৌঁছুনোও যায় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’তে যে মকররাজের কথা বলা আছে, যে নিজেই নিজের চারপাশে গড়ে তুলেছে মাকড়সার জাল আর বন্ধ করে দিয়েছে সকল আলো-বাতাস আসা যাওয়াকে ঠিক তেমনি চেরোফোবিকেরাও তাদের জীবনের দরজা-জানালা বন্ধ করেন দেন কখনো-সখনো উঁকি মারতে চাওয়ার ঐ সুখের ভয়ে!
মজার জিনিস হচ্ছে চেরোফোবিকেরা প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী হন। তারা আগেই ভেবে নেন সমস্যা হবে, কী কী ধরনের সমস্যা হবে এগুলো ভেবে নেয়াকে ওরা নিজেদের দূরদর্শিতা মনে করেন এবং বিশ্বাস করেন যে এক্ষেত্রে তারাই ঠিক। অপরকে আসন্ন আঘাত থেকে বাঁচাচ্ছেন ভেবে চেরোফোবিকেরা আশ্বস্ত হন। এককথায় বলা যায়, তারা বর্তমানের কোনো সুখ গ্রহণ করতে পারেন না একটি অদেখা ভবিষ্যতের কল্পিত সমস্যা নিয়ে প্রতিনিয়ত মাথা ঘামিয়ে।
নৈরাশ্যবাদ থেকে এই ভীতির উৎপত্তি হতে পারে। সুখ একটি ইতিবাচক ধারণা এবং একে গ্রহণ করতে হলে নিজের মধ্যে ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য ধারণ করাও খুব জরুরি। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সুখকে দেখলে কখনোই চেরোফোবিয়া থেকে বের হওয়া যাবে না। অবশ্য চেরোফোবিক নিজের অবস্থা থেকে বেরোতে চান কি না তাও তো একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়! কেউ কেউ তো মনে করেন, এই-ই ভালো। এরা খুব সুন্দর করে ‘ভালো’র সংজ্ঞা বদলে দিয়ে ভালো আছেন দাবি করতে থাকেন এবং মনের জানালা সুখকে প্রবেশ করতে না দেবার জেদে নাছোড়বান্দা এরা!
কী অদ্ভুত কিন্তু সত্যি, তাই না?
চেরোফোবিকদের প্রতি
সবশেষে এই সুখ নিয়ে ভয় পাওয়া চেরোফোবিকদের যে কিছু বলতেই হয়। মানবজন্ম বড় ভাগ্যের জন্ম, এই জন্মে সমস্ত সুখকে-দুঃখকে হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করাতেই আনন্দ। এ থেকে কী ক্ষতি হবে, কী হারিয়ে যাবে তার হিসেব না কশে বরং এই মুহূর্তের আনন্দটুকু গ্রহণ করুন, দিনশেষে খারাপ থাকবেন না! কবি মহাদেব সাহার ভাষায় যদি বলি,
“বেঁচে আছি এই তো আনন্দ,
এই আনন্দের জন্য আমি সবকিছু মাথা পেতে নেবো,
যে কোনো দুঃখ, যে কোনো শাস্তি-
শুধু এই ভোরের একটু আলো দেখার জন্য
আমি পথের ভিক্ষুক হতে রাজি
এই যে গোলাপ ফুলটির দিকে
যতোক্ষণ খুশি তাকিয়ে থাকতে পারি
এই সুখে আমি হাসিমুখে সব দুঃখ- মাথা পেতে নেবো”
এছাড়া কবি ওমর খৈয়ামও প্রতি মুহূর্তের সুখকে প্রাধান্য দিয়ে প্রতি মুহূর্তে বাঁচতে বলে গেছেন। তাই সকল আসন্নকে গ্রহণ করুন, আপনিও মাথা পেতে নিন জীবনের গন্ডুষভরা মুহূর্তগুলোকে। ভুলে যান চেরোফোবিয়া! একটু হাসুন, ভালো থাকুন।
তথ্যসূত্র
- blurb.com/b/7814356-cherophobia
- en.wikipedia.org/wiki/Aversion_to_happiness