আমরা জীবজগতে বিদ্যমান প্রাণীদের বিভিন্ন আকার ও আকৃতির হতে দেখি। কিছু আছে অতিকায় ক্ষুদ্র আবার কিছু আছে অতি বৃহৎ। এসব প্রাণীর স্বাভাবিক আকার-আকৃতি ও ওজন থাকে, যা আমরা সচরাচর দেখে থাকি। কিন্তু আজ এমন কিছু প্রাণীর কথা বলা হবে যারা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি ওজন ও বৃহদাকারের। এসব অতিরিক্ত আকার-আকৃতি সম্পর্কে জানলে অবাকও হতে হয়, কারণ এমন বৃহদাকারের প্রাণী সচরাচর কেউই দেখে অভ্যস্ত নয়।
১. লাইগার হারকিউলিস
পশুরাজ কিংবা বনের রাজা হিসেবে পরিচিত সিংহের স্বাভাবিক ওজন কিন্তু বাঘের স্বাভাবিক ওজন থেকে বেশি নয়। আফ্রিকান সিংহের ওজন মাত্র ২৩০ কেজির মতো। অপরদিকে বাঘের ওজন হয়ে থাকে ২৭০ কেজির একটু বেশি। অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সিংহের ওজন ৪১৮ কেজিরও উপর! এটি ৪ ফুট উঁচু ও ১০ ফুট লম্বা। ঘন্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে এটি। অতিকায় এই সিংহ আবার একই সময়ে ৪৫ কেজি পর্যন্ত মাংসও খেতে পারে!
একে দেখতে কিন্তু একইসাথে সিংহ ও বাঘের মতো লাগবে। আসলে এটি সিংহ ও বাঘের সংকরায়নের মাধ্যমে প্রাপ্ত নতুন জাত। গিনেজ বুকে স্থান পাওয়া সিংহটির নাম হারকিউলিস। পুরুষ সিংহ (Lion) ও স্ত্রী বাঘের (Tiger) সংকরায়নের মাধ্যমে জন্ম হয় হারকিউলিসের। একে দেখতে চাইলে যেতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যারোলিনার মারটিল বিচ সাফারি পার্কে। সাধারণত পুরুষ সিংহ ও স্ত্রী বাঘের সংকরায়নকে লাইগার (Liger) বলা হয়। অপরদিকে পুরুষ বাঘ ও স্ত্রী সিংহের সংকরায়ন করা হলে তাকে বলা হবে টাইগন (Tigon)। তাই হারকিউলিসকে বড় সিংহ না বলে বড় লাইগার বলাই যুক্তিযুক্ত হবে। বর্তমান বিশ্বে ১০০টির মতো লাইগার রয়েছে, যার অধিকাংশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ায় পাওয়া যায়।
২. বিশ্বের বৃহত্তম শূকর
বিশ্বের সবচেয়ে বড় শূকরটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল চীনের লিয়াওনিং প্রদেশের কৃষি জাদুঘরে। আকার-ওজনে এটি এতই বড় ছিল যে, একে দেখা মাত্রই অবাক হয়ে যেত দর্শনার্থীরা।
সাধারণত একটি শূকর লম্বায় ২.৯৫-৫.৯ ফুট এবং ওজন ৫০-৩০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় শূকরটি ৮ ফুটেরও অধিক লম্বা ছিল, যার ওজন ছিল ৯০০ কেজি! ২০০৯ সালের ৫ফেব্রুয়ারি শূকরটি স্বাভাবিকভাবেই মারা যায়।
৩. নারকেল কাঁকড়া
কাঁকড়ার সাথে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। বিশ্বের সকল সমুদ্রেই কাঁকড়ার বসবাস আছে। তাছাড়াও পুকুর, নদী, খাল-বিল, জল-স্থলেও বিচরণ করে ক্রাস্টেশিয়ান উপপর্বের এই প্রাণীটি। কাঁকড়ার দৈর্ঘ্যে রয়েছে অনেক ভিন্নতা। কয়েক মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের পি কাঁকড়া যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ৪ মিটার লম্বা পা-যুক্ত জাপানী স্পাইডার কাঁকড়া। তবে ওজনে চমকে দেয়ার মতো কাঁকড়াটি হচ্ছে নারকেল কাঁকড়া। ৪.১ কেজিরও অধিক ওজনের নারকেল কাঁকড়া ২০১৪ সালের ৬ মে গিনেজ বুকে নাম লেখায়!
নামের সাথে এই কাঁকড়ার কাজেরও মিল রয়েছে। এরা পা দিয়ে ঘষে ঘষে নারকেলের মালা পর্যন্ত ফাটিয়ে ফেলে! এদের প্রধান খাবার হচ্ছে পঁচা নারকেল। তবে নারকেল না থাকলে অন্যান্য খাবারও খায় তারা। পুরুষ নারকেল কাঁকড়া সারাজীবন স্থলে থাকে। কিন্তু স্ত্রী কাঁকড়াকে ডিম পাড়ার জন্য সাগরে যেতে হয়। ভারতের আন্দামান ও প্রশান্ত মহাসাগরে দেখা মিলবে বিস্ময়কর বিশালাকারের এই কাঁকড়ার।
৪. বৃহত্তম ব্যাঙ
ব্যাঙ উভচর শ্রেণীর অ্যানিউরা বর্গের মেরুদণ্ডী প্রাণী। এরা বর্ষাকালে প্রণয়ের জন্য ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাকে পুরো এলাকা মাতিয়ে রাখে। সারা বিশ্বে ৪,৮০০ প্রজাতির ব্যাঙের সন্ধান পাওয়া যায়।
এই বিশাল সংখ্যক ব্যাঙ আকার-আকৃতি ও বর্ণে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। আমাদের দেশে সচরাচর সোনা ব্যাঙ বা কোলাব্যাঙ, কুনোব্যাঙ ও গেছোব্যাঙ দেখা যায়। সেগুলোর আকার ও ওজন খুব একটা বেশি নয়। এদের মধ্যে সোনাব্যাঙের শরীরের দৈর্ঘ্য ১৭ সে.মি. এবং পা ২২ সে.মি. পর্যন্ত হতে পারে।
আমরা সচরাচর যে ব্যাঙগুলো দেখি সেগুলো আমাদের অবাক করে না। কিন্তু কারো সামনে যদি ৩ কেজি ওজনের একটি ব্যাঙ ধপাস করে লাফিয়ে পড়ে, তবে কি তিনি অবাক হবেন না? অবিশ্বাস্য নয়, সত্যিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাঙের ওজন ৭ পাউন্ড বা ৩ কেজি! ব্যাঙটির দৈর্ঘ্য ১৩ ইঞ্চি। মধ্য আফ্রিকায় প্রাপ্ত বৃহত্তম ব্যাঙের নাম হচ্ছে গোলিয়াথ ব্যাঙ (বৈজ্ঞানিক নাম: Conraua goliath)।
৫. বৃহত্তম ক্যাটফিশ
উত্তর থাইল্যান্ডের মেকং নদীতে ২০০৫ সালে জেলেদের জালে আটকা পড়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বাদু পানির স্ত্রী ক্যাটফিশ। জায়ান্ট মেকং ক্যাটফিশ প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত মাছটি লম্বায় ছিল প্রায় ৯ ফুট! এর ওজন ছিল ২৯৩ কেজি।
থাইল্যান্ডের মৎস্য বিভাগ মাছটির বংশবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পিটুইটারী গ্রন্থি সংবেদী ঔষধ প্রয়োগ করেছিলেন। মৎস্য কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন, ডিম সংগ্রহের পর সেটিকে পুনরায় ছেড়ে দিবেন। কিন্তু মাছটির বংশবৃদ্ধি তো দূরে থাক, একে বাঁচানোই সম্ভব হয়নি। পরে গ্রামবাসীকে মাছটি খাওয়ার জন্য দিয়ে দেওয়া হয়।
৬. বৃহত্তম খরগোশ
খরগোশ বা শশক স্তন্যপায়ী প্রাণী। এরা তৃণভোজী এলাকায় থাকতে পছন্দ করে। আমাদের দেশে সচরাচর শখ করে খরগোশ পোষা হয়। তবে বাণিজ্যিকভাবে মাংসের জন্যও খরগোশ পালন করতে দেখা যায়। আমাদের দেখা খরগোশগুলো সাধারণত ১৪-২৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। আর এদের ওজন হয় ১-৫.৫ কেজির মতো।
খরগোশের সর্বোচ্চ ওজন বলা হয় ৫.৫ কেজি। কিন্তু এই স্বাভাবিক আকারের চেয়েও বৃহৎ একটি খরগোশের দেখা পেতে হলে আপনাকে যেতে হবে ইংল্যান্ডের ব্রম্সগ্রুভ শহরে। খরগোশটির নাম হচ্ছে ডারিয়াস এবং এর পালনকারী হচ্ছেন অ্যানেট অ্যাডওয়ার্ডস। পেশায় তিনি একজন প্রাণী সংকরায়নবিদ।
ডারিয়াসকে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় খরগোশ বলা হয়। এটি লম্বায় ৪ ফুট এবং ওজন ১৯ কেজি! এই খরগোশ বছরে ২ হাজারটি গাজর ও ৭০০টি আপেল খায়। খরগোশটি পালন করতে অ্যানেটের বাৎসরিক খরচ হয় ৫ হাজার মার্কিন ডলার।
৭. গরু
আমরা এবার পরিচিত হব বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু গরুটির সাথে। ২০১৪ সালের ২৪ মে তারিখে গিনেজ বুকে নাম লেখানো সর্বোচ্চ গরুটি ছিল হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান জাতের গাভী, নাম ছিল ব্লসম। আমাদের দেশীয় দুগ্ধ খামারে সাদাকালো লোমযুক্ত শরীরের যে গরুগুলো দেখা যায়, সেগুলোই হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান জাতের গরু।
স্বাভাবিকভাবে হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান জাতের গাভী ৫৯ ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট হয়। কিন্তু ব্লসমের অবাক করা উচ্চতা ছিল ৭৪.৮ ইঞ্চি! যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী প্যাট্রিশিয়া মিডস হ্যানসন ছিলেন গরুটির মালিক। গরুটি তার কাছে ছিল বন্ধুর মতো। সেটি নানাভাবে প্যাট্রিশিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করত। ২০১৫ সালের মে মাসে পায়ের আঘাতজনিত কারণে ১৩ বছর বয়সে মারা যায় গরুটি।
প্রাণীজগত খুবই বিচিত্র। এখানে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস যেমন রয়েছে যাদের খালি চোখে দেখা যায় না, তেমনি রয়েছে বিশাল আকৃতির প্রাণীও। বিচিত্রতা রয়েছে তাদের আচার-আচরণ এবং খাদ্যাভ্যাসেও। হিংস্রতা যেমন আছে, তেমনি ভালোবাসায় তারা আমাদের অশ্রুসিক্তও করেছে। জীবজগতের বিচিত্রতা সম্পর্কে জানতে হলে ভালোবাসতে হবে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ, তাদের সাথে মিশতে হবে মানবিক মন নিয়ে।