প্রতিদিন সূর্য ওঠে এক নতুন আশার আলো নিয়ে। আবার অস্ত যায় এক নতুন সকালের সংকেত দিয়ে। কিন্তু নতুন দিনে কতটুকু স্বপ্ন পূরণ হয়! কাল রাতের সেই রেশ কি সত্যিই কেটে যায়? নাকি অতীত দিনের জন্যই হাহাকার থেকে যায়?
তেমনি এক নতুন ভোরের মতো ১৯২২ সালে জারের পতনের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল সোভিয়েত জনগণের জন্য এক আশার বার্তা। কিন্তু সোভিয়েত জনগণের চোখে বহুদিনের লালিত যে স্বপ্ন, তা কতটুকু পূর্ণ করতে পেরেছিল সেই নতুন রাষ্ট্র?
বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়ার যে মহান ব্রত নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম, তা ছিল সোভিয়েত জনগণের জন্য নতুন একটি সূর্যোদয়ের হাতছানি। ১৯২২ সালে সমাজতন্ত্রের যাত্রায় হাঁফ ছেড়ে নতুনভাবে বাঁচতে শুরু করে জনগণ, ভেবেছিল, এবার তাদের সকল দুঃখ ঘুচবে, অবসান হবে শ্রেণী সংগ্রামের। কিন্তু সমাজতন্ত্রের যে মূলমন্ত্র, বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়ার প্রত্যয়, তা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি এই রাষ্ট্র।
হ্যাঁ, বলা হচ্ছে সোভিয়েত জনগণের জন্য কাল রাতের ন্যায় আবির্ভূত হওয়া স্থবিরতার যুগ, বা এরা অফ স্টাগনেশন (Era of Stagnation) সম্পর্কে।
কী ছিল এই এরা অফ স্টাগনেশন?
‘এরা অফ স্টাগনেশন’ বা ‘স্থবিরতার যুগ’ (রাশিয়ান: Период застоя) শব্দবন্ধটি ব্যবহৃত হয় মূলত ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত চলাকালীন সোভিয়েতের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক নীতিগুলোর স্থবিরতা বর্ণনা করতে।
এই যুগের সূচনা হয়েছিল লিওনিড ব্রেজনেভের শাসনামলে (১৯৬৪-১৯৮২)। তাই একে ‘ব্রেজনিভিয়ান স্থবিরতা’ও বলা হয়। যদিও ব্রেজনেভের সময়কালে এই শব্দটি ব্যাবহার করা হতো না। তিনি তার শাসনামলকে ‘সমাজ উন্নয়নের যুগ’ (period of social development) হিসেবেই আখ্যায়িত করতেন।
১৯৮০ সালে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ তৎকালীন চলমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থবিরতা বর্ণনা করতেই এই শব্দযুগল প্রথম ব্যবহার করেন। এই সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থবিরতা ইউরি আন্দ্রোপভের (১৯৮২–১৯৮৪) ও কনস্ট্যান্টিন চেরনেঙ্কোর (১৯৮৪–১৯৮৫) শাসনামলেও অব্যহত ছিল। ‘এরা অফ স্টাগনেশন’-এর সময়কাল ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ধরা হয়। যদিও এর শুরুর সময়কাল, কারণ ও তাৎপর্য নিয়ে নানা মতভেদ প্রচলিত রয়েছে।
সামাজিক স্থবিরতা (Social Stagnation)
আব্রাম টের্ৎজ ও নিকোলাই আরজাক ছদ্মনামে বিদেশে সোভিয়েত জীবনের ব্যঙ্গাত্মক রচনা প্রকাশের দায়ে মস্কোর একটি আদালতে সোভিয়েতবিরোধী আন্দোলন এবং অপপ্রচারের অপরাধে আন্দ্রেই সিনিয়াভস্কি এবং ইউলি ড্যানিয়েলকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। সিনিয়াভস্কি–ড্যানিয়েল ট্রায়ালটিতে প্রথম সোভিয়েত লেখকদের প্রকাশ্যে তাদের সাহিত্যকর্মের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়, এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরেও বহু সোভিয়েত বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের আপিলের সুযোগ প্রদান করা হয়নি। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, সিনিয়াভস্কি–ড্যানিয়েল ট্রায়ালের মাধ্যমেই ১৯৬৬ সালে সামাজিক স্থবিরতার সূচনা হয়। আবার কেউ কেউ মনে করেন, ১৯৬৮ সালের প্রাগ বসন্তের দমন-পীড়নের সময় থেকেই এই সামাজিক স্থবিরতার সূত্রপাত হয়।
লিওনিড ব্রেজনেভের ক্ষমতা গ্রহণের পর নিকিতা খ্রুশ্চেভের উদার সংস্কার কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। তিনি সোভিয়েতের গুপ্ত পুলিশ ও কেজিবিকে স্ট্যালিন যুগের কিছু ক্ষমতা পুনরায় প্রদান করেন, যা খ্রুশ্চেভ ক্ষমতায় এসে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তখন বিরোধী রাজনৈতিক মতবাদকে কঠোর হাতে দমিয়ে রাখা হয়েছে। তাই জনগণের অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা ও মতপ্রকাশের মতো কোনো স্বাধীনতা ছিল না। সবকিছুর সাথে তাল মিলিয়ে দুর্নীতির মাত্রাও দিন দিন অসহনীয় আকারে বাড়তে থাকে।
বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন নিয়ে গড়ে ওঠা সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সমতানীতির উপর বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। ব্রেজনেভ ও আন্দ্রোপভের শাসনামলে সরকারি মদদেই কিছু বুর্জোয়া শ্রেণী তৈরি হয়েছিল। সোভিয়েত সমাজ অতীতের জারের শাসনামলের মতো দু’ভাগে বিভক্ত হয় পড়েছিল। এর একদিকে ছিল সুবিধাভোগী ধনীক শ্রেণী, অন্যদিকে ছিল অসহায় দুঃস্থ জনগণ। শ্রেণীবৈষম্য ক্রমশ বৃদ্ধির ফলে তা জনমনে ক্রোধ ও অসন্তোষ বাড়ায় বহুগুণে।
আন্দ্রোপভ ক্ষমতা লাভের পর মন্ত্রী ও পার্টির অন্যান্য নেতাদের বিরুদ্ধে এক দুর্নীতি দমন অভিযান পরিচালনা করেন। এতে করে অনেক মন্ত্রী তার মন্ত্রিত্ব হারান। তার শাসনামল ছিল সংক্ষিপ্ত। চেরনেঙ্কো ক্ষমতা গ্রহণের পর শ্রমিক সংগঠন ও শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার করেন। কিন্তু তাদের কেউই চলমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি।
রাজনৈতিক স্থবিরতা (Political Stagnation)
অনেকে মনে করেন, সোভিয়েত ইউনিয়নে রাজনৈতিক স্থবিরতা শুরু হয় জেরান্টোক্রেসি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। জেরান্টোক্রেসি (Gerontocracy) মূলত প্রজাতন্ত্রের নিয়মের এমন একটি রূপ, যেখানে একটি জাতি তুলনামূলক একজন বয়োজ্যেষ্ঠ শাসক দ্বারা শাসিত হয়।
সত্তরের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে জেরান্টোক্রেসির চর্চা অধিক লক্ষণীয় ছিল। লিওনিড ব্রেজনেভ ছিলেন এর অন্যতম দৃষ্টান্ত, যিনি ১৯৮২ সালে ৭৫ বছর বয়সে ক্ষমতায় থাকাকালে মারা যান। তিনি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তার সরকারের অন্যান্য পদে ক্ষমতায় থাকা নেতারাও অগ্রাধিকার লাভ করেন অনেকটা তুলনামূলক বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়ার ভিত্তিতে। তার শাসনামলের শেষ দুই বছর শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় তিনি নামেমাত্র সোভিয়েত নেতা ছিলেন। শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় তার পরবর্তী সত্তরোর্ধ্ব দুই উত্তরসূরী ইউরি আন্দ্রোপভ ও কনস্ট্যান্টিন চেরনেঙ্কোও স্বল্প সময় ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
সত্তরের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে বৃদ্ধি পাওয়া জেরান্টোক্রেসি চর্চার সমাপ্তি হয় ১৯৮৫ সালে, একজন তুলনামূলক কম বয়সী নেতা মিখাইল গর্বাচেভ ক্ষমতায় আসীন হওয়ার মাধ্যমে। জেরান্টোক্রেসির সমাপ্তি হলেও রাজনৈতিক স্থবিরতা সোভিয়েতের রাজনৈতিক অঙ্গন ছেড়ে পলায়ন করেনি। বরং তা শেষ পরিণতির পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত চলছিল।
অর্থনৈতিক স্থবিরতা (Economic stagnation)
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে, অর্থনৈতিক স্থবিরতা শুরু হয় ১৯৭৫ সালের দিকে, যদিও অনেকেই মনে করেন, ১৯৬০ এর দশকেই তা শুরু হয়ে যায়।
১৯৬৪ সালে লিওনিড ব্রেজনেভ সোভিয়েত নেতা হিসেবে নিকিতা খ্রুশ্চেভের স্থলাভিষিক্ত হন। তার শাসনামল শুরু হয় উচ্চতর অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধির মধ্য দিয়েই। তবে ধীরে ধীরে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল।
তার শাসনামলে সোভিয়েত ইউনিয়নের বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তার নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। এর মূল কারণ ছিল বহির্বিশ্বে সোভিয়েত সামরিক বাহিনী প্রেরণ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যার ফলে সামরিক ব্যয় অনেক বৃদ্ধি পায়। এর পরিমাণ ছিল তখনকার সোভিয়েতের মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ৫০%। বিশেষজ্ঞ রিচার্ড কফম্যান বলেছিলেন, সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির তথ্যমতে, সোভিয়েত সামরিক খাতে ব্যয় করা হতো ১১৫ বিলিয়ন রুবল থেকে ১২৫ বিলিয়ন রুবলের মধ্যে, যা ছিল প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। অথচ তৎকালীন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বাৎসরিক বাজেট ধরা হতো ৩০০ বিলিয়ন ডলার। তার শাসনামলেই সোভিয়েত সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন সম্ভব হয়।
সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মৌলিক শিল্পখাতে ব্যয়ের পরিমাণ অনেক কমে যায়। মৌলিক শিল্পখাতগুলোর তেমন গুরুত্ব না দেওয়ায় আধুনিক কলকারখানা সেখানে তেমন গড়ে ওঠেনি। যা ছিল, সেগুলো ১৯৩০-এর দশকে তৈরি। নজরদারির অভাবে এত বছর পর তা জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। যা ছিল, তাতেও তেমন উৎপাদন সম্ভব ছিল না। এতে দ্রব্যমূল্য ক্রমশ বেড়েই চলছিল। সত্তরের দশকে উৎপাদিত সমস্ত ভোগ্যপণ্যের সাকুল্যে খুচরা মূল্য ছিল প্রায় ১১৮ বিলিয়ন রুবল।
সামরিক ব্যয়ের সাথে আরো যুক্ত হয় মহাকাশ গবেষণা প্রতিযোগিতা, যার ফলে অর্থনীতি স্থবির হতে শুরু করে। উপরন্তু, ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশ করলে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতিতে এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ইউরি আন্দ্রোপভ ও কনস্ট্যান্টিন চেরনেঙ্কোর সময়েও আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্ব বজায় থাকে। আফগান যুদ্ধের প্রভাবস্বরূপ দেশের প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করে, যা আর কখনও পুনরোদ্ধার সম্ভব হয়নি। তিনি সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীকে আধুনিকায়ন করেন। এজন্য সোভিয়েত অর্থনীতিকে সেই সিদ্ধান্তের মাশুলও গুনতে হয়েছে।
দেশের অর্থনীতিতে ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট নিরসনে ব্রেজনেভ কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি। দারিদ্র্যের হার ছিল ক্রমবর্ধমান, বেকারত্বের হার বাড়ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে, মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ছিল ঊর্ধ্বগতিতে। তার সময়কালে এই অর্থনৈতিক দুরবস্থা কোনো আমলেই নেওয়া হয়নি, বা সমাধানের চেষ্টাই করা হয়নি। তাই তার শাসনামল ‘স্থবির অর্থনীতির যুগ’ নামে পরিচিত লাভ করে। তার সময়ে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক স্থবিরতা আর কখনোই কাটেনি।
এরপর ক্ষমতা আসা দুই সোভিয়েত নেতা ইউরি আন্দ্রোপভ ও কনস্ট্যান্টিন চেরনেঙ্কোর শাসনামলেও অর্থনৈতিক সমস্যা নিরসন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুনরোদ্ধার ও পুনর্গঠনের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা কেবল সোভিয়েতের অর্থনৈতিক বিপর্যয়কেই বাড়িয়েছে। আর সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলাকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। সোভিয়েত জনগণ পড়ে ছিল এক ঘোরের মধ্যে। তারা এই কালো রাত্রি হতে মুক্তির সন্ধান খুঁজছিল; যার পরবর্তী ঘটনা কারো অজানা নয়, সোভিয়েত ভাঙন।