আমেরিকান বিপ্লবের পর থেকে বর্তমান সময় অবধি ৪৪ জন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি ৪৫ বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনেকগুলো ‘প্রথম দিক’ দিয়ে পরিপূর্ণ। যেমন- প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন। এছাড়াও প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুই দফায় নির্বাচিত হওয়া একমাত্র প্রেসিডেন্ট ছিলেন গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড। তিনি ১৮৮৪ সালের নির্বাচনে জিতলেও ১৮৮৮ সালে পরাজিত হন। অতঃপর ১৯৯২ সালের নির্বাচনে তিনি পুনরায় জয়লাভ করেন। সেই হিসেবে ক্লিভল্যান্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২২ এবং ২৪ তম প্রেসিডেন্টের খেতাব অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি প্রথম এবং একমাত্র সাবেক সেনাপ্রধান হয়েও দুবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে অন্যান্য অনেক ‘প্রথম দিক’ রয়েছে যা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মার্কিনীদের পরিবর্তনকে চিহ্নিত করে। এমন অনেক ব্যক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন কিংবা নির্বাচিত হয়েছেন যা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তবে তাদের মধ্যে সবাই কিন্তু প্রধান দুটো দলের প্রতিনিধি ছিলেন না। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে হোয়াইট হাউসের পথে পা বাড়িয়ে তাদের অনেকেই শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের আগ্রাসন রুখে দিয়েছিল। আজ আমরা আলোচনা করবো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস-প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এমনই কিছু ‘প্রথম দিক’ নিয়ে।
রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন প্রাপ্ত প্রথম নারী
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নারী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনোনয়ন লাভ করেন ওহাইওর রাজনীতিবিদ ভিক্টোরিয়া ক্ল্যাফলিন। ১৮৭২ সালে সমঅধিকার পার্টির হয়ে তিনি নির্বাচনে লড়েন। সেবার তার রানিংমেট হিসেবে ফ্রেডরিক ডগলাসের নাম ঘোষণা করে দলটি। এতে কৌশলগতভাবে ডগলাস ইতিহাসের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পান। যদিও শেষপর্যন্ত ডগলাস মনোনয়ন গ্রহণ করেননি। তিনি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ইউলেসেস গ্র্যান্টের পক্ষে আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা প্রদান করেন। শেষপর্যন্ত গ্র্যান্ট এই নির্বাচনে জয়লাভ করেন।
তবে ভিক্টোরিয়া ক্ল্যাফলিনের নির্বাচনী ইশতেহারে চমকপ্রদ কিছু সংস্কারের বিষয় ছিল। তিনি ৮ ঘন্টা কর্ম দিবস, নারীদের ভোটাধিকার এবং শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বাতিলের মতো বিষয়গুলোকে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন। এমন প্রগতিশীল সংস্কারের ঘোষণা দেয়ায় সেবারের নির্বাচনে তাকে নিয়ে বেশ আশাবাদী ছিলেন সমর্থকরা। তবে অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের মতো একটি বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে নিজেকে বিতর্কিত করেন ভিক্টোরিয়া ক্ল্যাফলিন। তখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা সাংবিধানিকভাবে ভোটাধিকার অর্জন করেননি। এই পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের পূর্বেই কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের ভোটাধিকার অর্জনের বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন তিনি। এতে তার কৃষ্ণাঙ্গ রানিংমেট ডগলাস স্বাভাবিকভাবে রিপাবলিকান প্রার্থীকে সমর্থন জানান। সেই সাথে প্রথম নারী হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পথে এগিয়ে থাকা ভিক্টোরিয়া ক্ল্যাফলিনের পরাজয় নিশ্চিত করেন।
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনোনীত ব্যক্তি
১৮৮০ এবং ‘৯০ এর দশকে কৃষ্ণাঙ্গ নেতা হিসেবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিলেন ফ্রেডরিক ডগলাস। তখন তিনি নিজেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় উপস্থাপন করতেন। তবে কয়েকটি সম্মেলনে ডগলাসের ভবিষ্যত নির্ধারিত হয়ে যায়। ১৮৮৪ সালে লিবারেল পার্টির হয়ে মনোনয়ন প্রস্তাব করেন তিনি। দলটির সম্মেলনে মাত্র ১টি ভোট পান তিনি। অতঃপর ১৮৮৮ সালে রিপাবলিকান পার্টির হয়ে মনোনয়ন প্রস্তাব করেন ডগলাস। সেবারের সম্মেলনে রিপাবলিকান দলের মধ্য থেকে মাত্র ১টি ভোট পান তিনি। অন্যদিকে, রিপাবলিকানদের হয়ে মনোনয়ন পাওয়া বেঞ্জামিন হ্যারিসন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পর পর দুবার অপদস্থ হয়ে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করতে পারেননি ফ্রেডরিক ডগলাস।
তবে কৃষ্ণাঙ্গদের ভাগ্যাকাশে নক্ষত্রের উদয় ঘটেছিল প্রায় ১ যুগ পরে। ১৯০৪ সালে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান হিসেবে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন পান জর্জ এডউইন টেইলর। একজন প্রাক্তন দাসের পুত্র টেইলর ছিলেন একাধারে সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদ। এছাড়াও তিনি ১৮৯২ সালে রিপাবলিকান জাতীয় সম্মেলনে বৃহত্তর বিকল্প প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছিলেন। মূলত রিপাবলিকান পার্টির সম্মেলনের মধ্যদিয়ে জর্জ টেইলর খ্যাতি অর্জন করেন। অতঃপর ১৯০৪ সালে লিবারেল পার্টির জাতীয় সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনীত হন তিনি। যদিও সেবার থিওডোর রুজভেল্টের বিপক্ষে পরাজিত হয়েছিলেন জর্জ টেইলর।
প্রথম ক্যাথলিক প্রেসিডেন্ট
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে শ্বেতাঙ্গ মার্কিনীদের মধ্যে ক্যাথলিকদের প্রতি বিরোধীতা ছিল অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। মদের উপর নিষেধাজ্ঞাসহ আরো বিভিন্ন কাজে ক্যাথলিক অভিবাসীরা পক্ষপাতিত্বের সাথে আবদ্ধ ছিল। আর এই কারণে ১৯২০ এর দশকে দক্ষিণ এবং পশ্চিম ইউরোপ থেকে আগত প্রায় সকল ক্যাথলিক অভিবাসীদের উচ্ছেদে K.K.K (Ku Klux Klan) সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিত শ্বেতাঙ্গ নেতারা। তবুও থেমে থাকেনি ক্যাথলিকদের অগ্রযাত্রা, যা একসময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অবধি পৌঁছায়। গুরুত্বপূর্ণ কোনো দল থেকে মনোনয়ন পাওয়া প্রথম ক্যাথলিক রাজনীতিবিদ ছিলেন অ্যাল স্মিথ। ১৯২৮ সালে ডেমোক্রেট পার্টির হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। সেসময় ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে চলা নিষেধাজ্ঞা এবং অভিযানের ঘোর বিরোধী নেতাদের একজন ছিলেন নিউ ইয়র্কের তৎকালীন এই গভর্নর। যদিও দুর্ভাগ্যবশত রিপাবলিকান প্রার্থী হারবার্ট হুভারের কাছে পরাজিত হন স্মিথ।
অতঃপর ১৯৬০ সালে ডেমোক্রেট পার্টির হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন ক্যাথলিক রাজনীতিবিদ জন এফ. কেনেডি। তবে দলের বেশিরভাগ নেতাই তার জয় নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। সেসময় বিরোধীরা ভাবতেন ক্যাথলিকদের দুই রকম আনুগত্য ছিল। প্রথমটি ভ্যাটিকান সিটির প্রতি, আর দ্বিতীয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি। শ্বেতাঙ্গ রাজনীতিবিদ তথা রিপাবলিকানরা মনে করতেন জন এফ. কেনেডি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে পোপের নির্দেশে দেশ পরিচালনা করবেন। সেই সাথে তিনি জন্মনিয়ন্ত্রণ আইন বাতিল করবেন বলেও অনেকে আশঙ্কা করছিলেন। তবে ভার্জিনিয়ার প্রাইমারিতে জয়লাভের পর ডেমোক্রেট নেতারা তার উপর আস্থা ফিরে পায়। সেই সাথে মনোনয়ন পেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ক্যাথলিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি।
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে ডেমোক্রেট পার্টির মনোনয়ন চেয়েছিলেন যিনি
১৯৬৯ সালে রিপাবলিকান প্রার্থী রিচার্ড নিক্সন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আর একই সময় প্রথম নারী হিসেবে কংগ্রেসে সদস্যপদ লাভ করেন শিরলে চিশোলম। এর ৩ বছর পর শিরলে চিশোলম ডেমোক্রেট পার্টির হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়ে আবেদন করেন। তখনও তিনি নিউ ইয়র্কের হয়ে কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। এর আগে ডেমোক্রেটদের হয়ে একাধিক কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ নেতাকে মনোনয়নের জন্য সম্মেলনে প্রার্থী হতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে শিরলে চিশোলম ছিলেন প্রথম।
কিন্তু শেষপর্যন্ত তার উপর আস্থা রাখতে পারেনি ডেমোক্রেট পার্টির নেতারা। তাকে উপেক্ষা করে সিনেটর জর্জ ম্যাকগোভের্নকে মনোনয়ন দেয় দলটি। যদিও ম্যাকগোভের্ন নিজেও নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেননি। রিচার্ড নিক্সনের বিপক্ষে পরাজিত হন তিনি। শিরলে চিশোলম কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি মনোনয়ন পাবেন না। তবে তিনি একটি ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন- তার এই সাহসী ভূমিকা এবং মনোনয়ন প্রার্থনার বিষয়টি ভবিষ্যতে আরো অনেক কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করবে।
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং দক্ষিণ এশিয়ান বংশোদ্ভূত নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী
চলতি বছরের আগস্টে, ডেমোক্রেট পার্টির সম্মেলনে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন গ্রহণ করেন দক্ষিণ এশিয়ান বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গ নারী কমলা হ্যারিস। ভারতীয়-জ্যামাইকান বংশোদ্ভূত ৫৫ বছর বয়সী কমলা হ্যারিস বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে নির্বাচিত সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে জন্ম নেওয়া ডেমোক্রেট রাজনীতিবিদ কমলার বাবা-মা দুজনই ছিলেন অভিবাসী। তার মায়ের জন্ম ভারতে আর বাবা জ্যামাইকায়। দুজনের ছাড়াছাড়ির পর মায়ের কাছে থাকা কমলা বড় হয়েছেন ভারতীয় ঐতিহ্য ধারণ করেই। সংবাদ সংস্থা বিবিসি জানায়, আত্মজীবনীতে নিজের নামের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “এর অর্থ পদ্মফুল, যা ভারতীয় সংস্কৃতিতে তাৎপর্যের প্রতীক। একটি পদ্ম নদীর তলদেশে বেড়ে ওঠে। একসময় এর ফুলগুলো পানির উপরে উঠে যায়। তবে, শেকড় নদীর তলায় দৃঢ়ভাবে থাকে।“
গত বছরের শুরুর দিকে কমলা হ্যারিস ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে ২০ হাজারেরও বেশি সমর্থকের সামনে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট পার্টির হয়ে মনোনয়ন চাওয়ার ঘোষণা দেন। যদিও পরবর্তীতে ডেমোক্রেট পার্টি থেকে জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দেয়। এছাড়াও কমলা হ্যারিস এখন অবধি তৃতীয় নারী হিসেবে মেজর পার্টির হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার ঘটনায় প্রায় সকল আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন তিনি। আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের বিপরীতে লড়বেন তিনি।