১লা ফেব্রুয়ারি, ২০২১। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আটক করেন প্রেসিডেন্ট উ উইন মিন্ট, প্রধানমন্ত্রীর সমপদমর্যাদা সম্পন্ন স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি, নভেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)-র মুখপাত্র মনয়া উ অং শিন। হান থার মিন্টকে। আটক হন ইয়াঙ্গুন বিভাগের মুখ্যমন্ত্রী, তানিনথারি অঞ্চল নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যানসহ এনএলডির বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসের নির্বাচনের ফলাফল বাতিল ঘোষণা করে সামরিক বাহিনী। স্থগিত করে জাতীয় ও আঞ্চলিক আইনসভার সকল সভা, এক বছরের জন্য জারি করে জরুরি অবস্থা। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন ইউ মিন্ট সুই, নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ আর বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব চলে যায় সামরিক বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং এর কাছে।
সামরিক বাহিনীর এই কায়দায় অভ্যুথান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করা মিয়ানমারের নাগরিকদের জন্য নতুন কোন ঘটনা না। একই ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটেছে তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে। রাজনৈতিক সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা নিয়েছে সামরিক বাহিনী, নাগরিক অধিকার হরণ করে ক্রমাগত চলে গেছে কঠোর স্বৈরশাসনের চক্রে।
মিয়ানমারে যত সামরিক অভ্যুত্থান
স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর সাত দশকের মধ্যে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় সামরিক শাসনের অধীনে থেকেছে মিয়ানমার, সামরিক বাহিনীর মাধ্যমেই পরিচালিত হয়েছে দেশ। মিয়ানমার (তৎকালীন বার্মা) ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে উনবিংশ শতাব্দীতে, স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৪৮ সালে। স্বাধীনতার পরে মিয়ানমার শাসনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করে সংসদীয় গণতন্ত্র। সরকারে ছিল এন্টি-ফ্যাসিস্ট পিপলস ফ্রিডম লীগ (এএফপিএফএল), প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান ইউ নু।
১৯৬২ সালে ইউ নুর সরকারকে উৎখাত করে সামরিম বাহিনী, দেশের সর্বময় কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন জেনারেল নে উইন। আশির দশকের শেষদিকে সামরিক শাসনবিরোধী বিক্ষোভ হয় মিয়ানমারে, পাঁচ হাজার মানুষের রক্তের উপর দিয়ে ক্ষমতায় আসে নতুন স্বৈরশাসক। সেই জায়গা থেকে মিয়ানমারের গণতন্ত্রের পথচলা শুরু হয় এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে।
২০১৫ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে অং সান সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি, বিজয় পায় ২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচনেও। নতুন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের প্রাক্কালে ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী, একবছরের জন্য জারি করে জরুরি অবস্থা।
অনেকের মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, কাছাকাছি সময়ে স্বাধীন হওয়া মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ ভারতে যেখানে গত সাত দশকে একটিও সামরিক অভ্যুত্থান হয়নি, সেখানে মিয়ানমারে কেন বারবার বাধাগ্রস্থ হয়েছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা? গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার পরিবর্তে রাষ্ট্র কেন বারবার চলে গেছে উর্দিধারীদের অধীনে?
স্বাধীনতার রাজনৈতিক ইতিহাস
সুদূর প্রাচীনকাল থেকে রাষ্ট্রকাঠামোর উপস্থিতি ছিল বার্মাতে, ছিল নিরাপত্তা নিশ্চিতে সামরিক বাহিনী। হাজার বছরের সভ্যতার অগ্রগতিতে মানুষের নিরাপত্তার ধারণার সাথে অঙ্গা-অঙ্গিভাবে জড়িয়ে ছিল সামরিক বাহিনী, মানুষের কাছে তৈরি করে গ্রহণযোগ্যতা। উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় ও নেপালি গোর্খাদের দ্বারা বার্মা জয় করে ব্রিটিশরা, উপনিবেশ রক্ষা আর নিরাপত্তার জন্য গঠন করা হয় ব্রিটিশ বার্মা আর্মি। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া স্বত্বেও ব্রিটিশ বার্মা আর্মিতে প্রতিনিধিত্ব ছিল না বামারদের, সেনাবাহিনী গঠিত হয় কারেন, কাচিন আর চিন নৃগোষ্ঠীর সেনাদের নিয়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে একদল স্বাধীনতাকামী প্রতিষ্ঠা করে বার্মা ইন্ডিপেনডেন্স আর্মি (বিআইএ)। পরবর্তীকালে বার্মা ইন্ডিপেনডেন্স আর্মি বার্মার স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃস্থানীয় সংগঠন রূপে আবির্ভূত হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের বদলে এই সামরিক গোষ্ঠীটিই নেতৃত্ব দেয় স্বাধীনতা অর্জনে, স্বাধীনতা পরবর্তীতে তাদের নিয়েই গঠিত হয় বার্মার সামরিক বাহিনী।
অতীত থেকে নিরাপত্তার ধারণার সাথে জড়িয়ে থাকা আর আধুনিক যুগে এসে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সামরিক বাহিনীর বিপুল গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয় বার্মিজ সমাজে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সামরিক বাহিনী ভূমিকা রাখতে শুরু করে বার্মার নীতি নির্ধারণে। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত কয়েক দফায় প্রধানমন্ত্রী থাকা ইউ নুকেও চলতে হয়েছে সামরিক বাহিনীর সমর্থন নিয়ে। পরবর্তী পাঁচ দশক মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছে সামরিক বাহিনী, কঠোরভাবে দমন করেছে বিরোধী মতকে।
অর্থাৎ, স্বাধীনতা থেকে শুরু করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাতামাদৌ কখনোই রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে যায়নি, স্বীকার করেনি তাদের কর্তৃত্ব। গত নভেম্বর থেকে অং সান সু চির সাথে এই রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে একটি সংঘাত চলছিল সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের, দ্বন্দ্ব ছিল সু চির সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব কমানোর চেষ্টা নিয়েও। সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্বে হুমকি হয়ে এসেছিল এনএলডির ভূমিধ্বস বিজয়, রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতাও। কর্তৃত্বের এই দ্বন্দ্ব মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতি
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের উপর ভিত্তি করে এডমন্ড এবং ভারবা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। সংকীর্ণ, সাবজেক্ট এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে জনগোণ তাদের নাগরিক অধিকারের ব্যাপারে সচেতন থাকে না, সাবজেক্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সচেতন থাকলেও সুযোগ পায় না রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের। পরিপক্ক রাজনৈতিক সংস্কৃতি বুঝাতে অংশগ্রহণমূলক সংস্কৃতিকে বুঝানো হয়।
স্বাধীনতার পর থেকেই মিয়ানমারে একটি সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা চলছে। সামরিক বাহিনী তাদের শাসনামলে কঠোরভাবে দমন করেছে বিরুদ্ধ মতকে, কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রমকে। গড়ে উঠতে দেওয়া হয়নি কার্যকর সিভিল সোসাইটি, গড়ে উঠেনি রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধারণ করার মানসিকতা। এর পাশাপাশি, নাগরিকদের একটা বিশাল অংশ সমর্থন করেছে সামরিক বাহিনীর শাসনকে, নৈতিক বৈধতা দিয়েছে সামরিক বাহিনীর সকল কাজকর্মকে।
এর পাশাপাশি মিয়ানমারের রাজনীতিতে রয়েছে নৃতাত্ত্বিক বিভাজন। ১৩৫টি স্বীকৃত নৃগোষ্ঠীর মধ্যে মিয়ানমারে সংখ্যাগরিষ্ঠ নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বামাররা, মোট জনসংখ্যার যারা ৬৮ শতাংশ। কারানরা ৭ শতাংশ, শানরা ৯ শতাংশ। আছে রোহিঙ্গারা, আছে মনরা। এর বাইরে কয়েক মিলিয়ন ভারতীয় বংশোদ্ভুত আছে সেখানে, আছেন চীনা বংশোদ্ভূতও। এই নৃগোষ্ঠীর মধ্যে যেমন ঐতিহাসিকভাবেই রাজনৈতিক সংঘাত আছে, তেমনি আছে স্বার্থের দ্বন্দ্বও। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বিভাজন সুযোগ করে দিয়েছে সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতায় টিকে থাকার।
এর বাইরে, স্বাধীনতার প্রথম দশক এবং গত দশকের পুরোটাই একধরনের গণতান্ত্রিক শাসনের অধীনে ছিল মিয়ানমার। এ সময়ের গণতন্ত্র থেকেও কিন্তু আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। প্রথম দশকের পুরোটাই ছিল এন্টি-ফ্যাসিস্ট পিপলস ফ্রিডম লীগ (এএফপিএফএল)-এর একদলীয় শাসনের মতো, গত দশকেও এনএলডির কোনো গ্রহণযোগ্য বিকল্প হাজির করতে পারেনি মিয়ানমারের রাজনীতি। গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য যে শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার, তা মিয়ানমারে এই দুই সময়ের গণতান্ত্রিক শাসনেও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
মিয়ানমারের নাগরিকদের গণতন্ত্রের জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে একজন ব্যক্তির রাজনৈতিক ইচ্ছার উপর, যা রুদ্ধ করেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশ হওয়ার প্রক্রিয়াকে, বাধাগ্রস্ত করেছে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থগুলো পূরণের প্রক্রিয়াকে। ফলে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বিশাল অংশের সমর্থন গেছে সামরিক বাহিনীর দিকে। তাদের সাথে দেশের রক্ষণশীল অংশের সামরিক বাহিনীর প্রতি সমর্থন স্বৈরতন্ত্রের দিকে ধাবিত করেছে মিয়ানমারকে।
তাতামাদৌর সাংগঠনিক শক্তি
একটি দেশে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজন হয় শক্তিশালী কিছু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের, প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতার। সংবিধান, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন, সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামো, সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের প্রক্রিয়া, সিভিল সোসাইটি, এ রকম আরো কিছু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু, মিয়ানমারে এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই কার্যকর না। সংবিধানের রচয়িতা সামরিক বাহিনী, রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে সামরিক বাহিনী, সিভিল সোসাইটি তোষামদি করে চলে সামরিক বাহিনীকে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অসীম ক্ষমতা উপভোগ করে রাষ্ট্রযন্ত্রে, তাদের ক্ষমতাকে জবাবদিহিতায় আনার মতো নেই কোনো প্রতিষ্ঠান। ফলে, মিয়ানমারের রাষ্ট্রকাঠামোতে একটিই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান আছে, সেটি সামরিক বাহিনী তাতামাদৌ।
পাঁচ কোটি মানুষের দেশ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ। ২০১৯ সালের হিসাবে সেনাবাহিনীতে কর্মরত আছে সাড়ে পাঁচ লাখ, বাকি অর্ধলক্ষ বিমান বাহিনী ও নৌ বাহিনীতে। শক্তিশালী এই সামরিক বাহিনীর রয়েছে সুস্পষ্ট চেইন অব কমান্ড, অন্যান্য দেশের মতো তাদের কাছেই রয়েছে রাষ্ট্রীয় অস্ত্রের মজুত। এর পাশাপাশি, মিয়ানমারের তেল, গ্যাস আর মাইনিং কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণ সামরিক বাহিনীর কাছে, সু চির সরকারের শাসনামলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। জাতীয় আর প্রাদেশিক আইনসভায় তাদের সংরক্ষিত প্রতিনিধিত্ব ছিল ২৫ শতাংশ। একটি একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই বিপুল ক্ষমতার চর্চা বার বার সেনাবাহিনীকে উৎসাহিত করেছে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করতে।
বৈদেশিক শক্তির প্রভাব
প্রাচীনকালে রাষ্ট্রকাঠামো ছিল নগরকেন্দ্রিক, মধ্যযুগ ছিল সাম্রাজ্যবাদের। আধুনিককালে আমরা যে জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোতে বসবাস করি, তার শুরু হয় আটলান্টিক রেভ্যুলুশনের মাধ্যমে। রাষ্ট্রক্ষমতা সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে রাজনীতিবিদদের হাতে যাওয়ার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া ইউরোপে চলে অষ্টাদশ আর উনবিংশ শতাব্দীজুড়ে, এশিয়াতে এই প্রক্রিয়া শুরু হয় বিংশ শতাব্দীতে। যেসব দেশ ইউরপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর উপনিবেশ শাসনের অধীনে ছিল, তাদের শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের সূচনা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিউপনিবেশায়নের মাধ্যমে। তবে, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের সামরিক বাহিনীই ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের এমন পরিবর্তনকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি, বারবার সুযোগ খুঁজেছে রাজনৈতিক সংকটের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতা দখলের। বিংশ শতাব্দীজুড়ে লাতিন আমেরিকা আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এরকম কয়েকশো সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে।
সবসময়ই, সামরিক বাহিনীর এই ক্ষমতা দখলের চেষ্টাতে মদদ জুগিয়েছে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোও। মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সময়ে যে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, সেটা আসলে একই সাথে অনেক পরাশক্তির স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছে।
প্রথমত, তাতামাদৌ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই চীনের সাথে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে, চীনও মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের রক্ষা করেছে বৈশ্বিক চাপ থেকে। কিন্তু, মিয়ানমারে চীনের ভূমিকা বেশ জটিল। চীন একদিকে যেমন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সামরিক সরঞ্জামের উৎস, অন্যদিকে চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে আর্থিক ও সামরিক সহযোগিতা দানের। ফলে, তাতামাদৌকে আঞ্চলিক বাস্তবতা মেনে নিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হয়েছে রাশিয়ার মতো অন্যান্য পরাশক্তিগুলোর সাথে।
সাম্প্রতিক সময়ে সু চির সরকার এই ভারসাম্যের নীতির বাইরে গিয়ে অনেক বেশি চীনঘেষা নীতি নিচ্ছিলেন। এটি সামরিক বাহিনীকে অনেকটাই প্রভাবিত করেছে কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচনের ফলাফলের বাতিল করে ক্ষমতা দখলে।
দ্বিতীয়ত, সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্বের প্রভাবশালী অনেক রাষ্ট্রনায়ক, নিন্দা জানিয়েছে ওয়াল্ড ব্যাংক, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও। চীন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে বৈশ্বিক চাপ থেকে সুরক্ষার ব্যাপারটি অনেকটা নির্ভর করবে চীনের উপর। ফলে, মিয়ানমারের রাজনীতিতে প্রভাব বাড়বে চীনের।
এই সামরিক অভ্যুত্থান থেকে লাভবান হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের একটি সুযোগ যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এসেছে, সুযোগ এসেছে মিয়ানমারে ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ব্যাপারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপের। এটি সামনের দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চলে নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় গুরত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে আবির্ভূত হবে।
গণতন্ত্র কতদূরে মিয়ানমারে?
অং সান সু চির আহ্বান সত্ত্বেও, সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে বড় ধরনের কোনো বিক্ষোভ হয়নি, ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি সামরিক বাহিনীকে ব্রিবতকর অবস্থার ফেলার মতো কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ। বরং, সু চির জনগণকে প্রতিবাদের আহ্বান জানানো অনেকটা কাগুজে বক্তব্যের মতোই লেগেছে। এর পাশাপাশি, বৈশ্বিক পরাশক্তিদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এটিকে সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থান হিসেবে আখ্যায়িত করেনি, জাতিসংঘে পাস হতে দেয়নি নিন্দা প্রস্তাব। এগুলো আগামী দিনের মিয়ানমারে গণতন্ত্রের জন্য খুব একটা আশাবাদী হওয়ার মতো রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ না।
তবে, এরমধ্যেও কিছু কিছু জায়গায় ক্ষুদ্র পরিসরে বিক্ষোভ হয়েছে, বিক্ষোভ করেছে ছাত্ররা, বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরাও। কিছু কিছু জায়গায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে দেখা যাচ্ছে সিভিল সোসাইটিকে। কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা নিন্দা জানিয়েছে এই সামরিক অভ্যুত্থানের, নিন্দা জানিয়েছনে গণতন্ত্রকামী বিশ্বের অনেক নেতা। এগুলো আবার গণতন্ত্রের জন্য আশাবাদী হওয়ার মতো ঘটনাপ্রবাহ।
তবে, ভবিষ্যতে মিয়ানমারে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের জন্য নাগরিকদের বেশ কিছু উত্তরের সন্ধান করতে হবে। অং সান সু চির পরে কে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবে? ৭৫ বছর বয়সী সু চি যদি রাজনৈতিকভাবে হার মেনে নেন সামরিক বাহিনীর কাছে, তখন মিয়ানমারের গণতন্ত্র কোন দিকে যাবে? ভবিষ্যতে সামরিক বাহিনী পূর্ণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের আধীনে আসলেও, কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসিকে স্বৈরতন্ত্রের দিকে ধাবিত করবে কিনা? করলে সেই স্বৈরশাসন থেকে মিয়ানমারের নাগরিকদের ‘এক্সিট পয়েন্ট’ কোন রাজনৈতিক গোষ্ঠী হবে?