কোভিড-১৯। বিশ্ব জুড়ে সম্ভবত সর্বাধিক উচ্চারিত শব্দযুগল। চীনের উহান শহর থেকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিস্তার হওয়া এই রোগটিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবশেষে প্যান্ডেমিক (বিশ্বব্যাপী মহামারি) হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। সার্স কোভ-২ নামক ভাইরাসের মাধ্যমে এই রোগটি সংক্রমিত হয়ে থাকে।
মহামারির আকার ধারণ করা কোনো রোগের বিস্তার ঠেকাতে সামাজিক সুরক্ষা বলয় যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটিই করোনা ভাইরাস পদে পদে মানব সভ্যতাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। তথ্য গোপন, স্বৈরশাসকদের একগুঁয়ে মনোভাব, ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার, বিজ্ঞানীদের অবমূল্যায়ন, ব্যর্থ রাষ্ট্রযন্ত্র, একেবারেই ভঙ্গুর স্বাস্থ্যসেবা এসবই যেন চোখের পলকে আপামর জনসাধারণের কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী এই বিপর্যয়ে।
এসবের পাশাপাশি মহামারিকে কীভাবে ঘৃণার রাজনীতিতে ন্যাক্কারজনক উপায়ে ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষমতালোভী শাসকগোষ্ঠী স্বার্থ হাসিল করতে মরিয়া হয়ে উঠতে পারে, তা দেখিয়ে দিচ্ছে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পীয় রাজনীতি সামাজিক ব্যবস্থায় আরও একটি ফল্ট লাইনকে অত্যন্ত প্রকটভাবে চিত্রায়িত করছে- বর্ণবৈষম্য।
গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে লুইসিয়ানায় রোগের প্রাদুর্ভাবকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে শ্বেতাঙ্গরা মানবতার চরম স্খলনের মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গদের এক অন্ধকার পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছিল। গুটিবসন্ত ও পীতজ্বরের প্রকোপ দেখা দিলে বর্ণবাদী শাসকদের মাঝে অমানবিক চিন্তাভাবনা দানা বাঁধতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তারা কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সুস্পষ্ট দমনমূলক নীতি অনুসরণ করে তাদের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন ও অসহনীয় করে তোলে। নিকারসন নাম্নী একজন কর্মকর্তার স্বীয় স্বীকারোক্তিই ছিল অনেকটা এরকম,
“একজন কৃষ্ণাঙ্গকে আমার সামনে দিয়েই নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তার অবস্থা যথেষ্টই করুণ ছিল। একটি বিষয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম যে, সে সুস্থ হয়ে আর ফিরে আসতে পারবে না। মানুষজন যখন ধরাধরি করে তাকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমি পুরো দলকেই ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।”
চিকিৎসার অভাবে মরতে বসা একজন মানুষকে এই সরকারি কর্মকর্তা স্রেফ এই গায়ের রঙের কারণে ভয়ার্ত পৃথিবীর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। সে মুহূর্তে একজন মুমূর্ষু রোগীর স্বাস্থ্যসেবার চেয়ে তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ব্যক্তিটি থেকে নিজের সম্পূর্ণ সুরক্ষা নিশ্চিত করা। কেন্দ্রীয় সরকার ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণার অব্যবহিত পরেই ১৮৬৬ সালের বসন্তে আফ্রিকান আমেরিকান জনগোষ্ঠীর উপর এই পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করা হয়।
এবারে মূল আলোচনায় যাওয়া যাক। ডোনাল্ড ট্রাম্প ঠিক কীভাবে করোনা ভাইরাসকে একটি রাজনৈতিক চেহারা দিতে চাচ্ছেন? কেন তার অতি সাম্প্রতিক ঘটনাবলীকে মোটেই ভাঁড়ামি বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না? চীনের সাথে দোষারোপের খেলায় তিনি কেন এতটা মত্ত হয়ে উঠেছেন? নিজভূমের লাখো কোটি জনগণের জীবন শঙ্কার মুখে রেখে তিনি কেন নির্বিকার চিত্তে গণমাধ্যমে বলেন যে, তিনি কোনো দায় নেবেন না?
চলমান বিশ্ব পরিস্থিতির প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের মনোভাব মূলত ১৮৬৬ এর যুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক আচরণেরই নামান্তর। প্রকৃতপক্ষে দু’টি উপায়ে ট্রাম্প এই বিষয়টিকে সামাল দিচ্ছেন, বলা বাহুল্য উভয়ই সম্পূর্ণভাবে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির রাজনীতির প্রকৃষ্টতম উদাহরণ। প্রথমত, ট্রাম্প মূল সমস্যাটির মূলে নজর দিচ্ছেন না; অর্থাৎ বেইজলাইন নেগলেক্ট। দ্বিতীয়ত, তিনি দেশের ও বিশ্বের এই আশঙ্কাজনক অবস্থাকে নিজের ক্ষমতায় টিকে থাকার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছেন।
লুইসিয়ানার গুটি বসন্ত-পীতজ্বর কেন্দ্রিক রাজনীতি প্রায় দু’ শতাব্দী পর ভিন্ন রূপে ফিরে এসেছে বললে বোধ করি অত্যুক্তি করা হবে না। পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্রপ্রধান তিনি হয়তো সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে যথেষ্ট পরিমাণে করোনা পরীক্ষা ও সেলফ কোয়ারেন্টাইন বা স্বেচ্ছা গৃহবাসকে উৎসাহিত করতে পারতেন। কিন্তু, তিনি অত্যন্ত অপদার্থ ও অযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে দোষ চাপানোকেই বেছে নিলেন। সবচেয়ে সহজ অথচ ভীরু ও কাপুরুষোচিত সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি; গণহারে তিনি দুষতে থাকলেন বিদেশীদের এবং সকল ফ্লাইট নিষিদ্ধ করে দিলেন।
এরই সূত্র ধরে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এবং রিপাবলিকানরা সম্ভাব্য সকল ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্বের অবতারণা করতে শুরু করেছেন। এখানেই শেষ নয়, তারা এ-ও দাবি করছেন যে ডেমোক্র্যাটরা মূলত স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নয়ন জোরদার করার লক্ষ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন, যা কি না তাদের করোনা ভাইরাস নিয়ে তীব্র দুশ্চিন্তার কারণ। অর্থাৎ, সোজা ভাষায় রিপাবলিকানরা করোনা ভাইরাসকেই রাজনৈতিক বলে আখ্যা দিতে পাগলপারা হয়ে আছেন এবং ডেমোক্র্যাটদেরকে দুষছেন ভাইরাস সন্ত্রাসবাদের প্রচার ও প্রসারের প্রত্যক্ষ মদদদাতা হিসেবে।
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প দোষ চাপানোর চেষ্টা করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার প্রশাসনের উপর। এ সময় তিনি বলেন,
“করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত কোনো কিছুর দায়িত্ব আমি নিতে পারব না। অতীতের বেশ কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, উদ্ভূত পরিস্থিতি, অযৌক্তিক নিয়ম-কানুনের কারণেই এই জটিল সমস্যা সামাল দেওয়াটা এত কঠিন হয়ে পড়েছে।”
যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে মুহূর্মুহূ ও সার্বক্ষণিক সমালোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে পর্যাপ্ত পরিমাণে করোনা স্ক্রিনিংয়ের অভাব। এই বিষয়টিকে আমলেই নিচ্ছেন না ক্ষমতাসীন ট্রাম্প সরকার।
প্রথম সাত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে করোনা পরীক্ষার সংখ্যা ছিল ১১,০০০ এর মতো, যা কি না দক্ষিণ কোরিয়ায় একদিনে সম্পন্নকৃত পরীক্ষা সংখ্যার প্রায় কাছাকাছি। শেষ অবধি উদ্ভূত পরিস্থিতিকে জাতীয় দুর্যোগ বলে ঘোষণা দেওয়ার আগ পর্যন্ত ট্রাম্প একদিকে অতীতের দিকে আঙুল তুলে গালমন্দ করে গেছেন আর অন্যদিকে শুধু ভবিষ্যতে আশার আলো দেখিয়ে গেছেন এই বলে যে, সামনের দিনে এরকম আবারও ঘটলে আমেরিকা কতটা সফলতার সাথে তা মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে। অথচ সুকৌশলে তিনি এড়িয়ে গেছেন বর্তমানে তার করণীয় কাজ কী, সে বিষয়টি।
কোভিড-১৯’কে ঘিরে ডোনাল্ড ট্রাম্প মূলত একটি বিকল্প পৃথিবী বাস্তবায়নের স্বপ্নে বিভোর। যে পৃথিবীতে যুক্তি নেই, আছে উদ্ভট কথাবার্তা; দায়িত্বজ্ঞান নেই, আছে লাগামহীন বক্তব্য; মানবিক কোনো পরিকল্পনা নেই, আছে রাজনীতি আর ক্ষমতার লোভ। তার মূল বক্তব্য হলো, করোনা ভাইরাসকে ঘিরে গণমাধ্যমের সকল বিবৃতিই বস্তুতপক্ষে তাকে গদিছাড়া করার চক্রান্ত।
করোনা ভাইরাস ইস্যুতে যখন সারা বিশ্ব সরগরম, তখনই মার্চের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ওভাল অফিসে এক বিবৃতিতে করোনা ভাইরাসকে ‘চীনের চাল’ বলে আখ্যা দিলেন। সাথে তিনি এ-ও যোগ করলেন যে, মেক্সিকোর সাথে আমেরিকার সীমান্তে দেয়াল তুলে দেওয়া যে কোনো সময়ের চেয়ে অতীব জরুরি। ২৫টিরও বেশি দেশ থেকে সকল ফ্লাইট নিষিদ্ধ করলেন তিনি। তার এই দু’টি সিদ্ধান্ত মূলত অভিবাসী আইনের প্রতি তার চরম বিতৃষ্ণারই বহিঃপ্রকাশ। নিজের গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতি তার অদম্য আত্মবিশ্বাস (!) প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন,
“একটি বিদেশি ভাইরাসকে ঠেকাতে গিয়ে আমরা যে ধরনের আগ্রাসী ও সর্বাঙ্গীন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি, ইতিহাসে তার নজির সম্পূর্ণ বিরল।”
আমেরিকার সব সমস্যাকেই কোনো না কোনোভাবে অভিবাসীদের সাথে সম্পর্কিত করার প্রবৃত্তি ট্রাম্পের জন্য নতুন কিছু নয়। বিদ্যমান নানা জটিল ইস্যুকে তিনি অন্যান্য বিভিন্ন দেশের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের ফলাফল হিসেবে দেখানোর এক আশ্চর্য প্রতিভা নিয়ে রাজনীতির ময়দানে বহাল তবিয়তে টিকে আছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যেই করোনা সংক্রমণকে কোনো সুনির্দিষ্ট অঞ্চল বা জাতীয়তার সৃষ্টি বলে অভিহিত না করতে সকলের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে। এমনকি ডেমোক্র্যাটরা সকলেই ট্রাম্পের এই দোষারোপমূলক আচরণকে স্পষ্টত বর্ণবৈষম্য বলে আখ্যা দিয়েছেন। তবে এসবের প্রতি ট্রাম্প বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেন বলে মনে হয় না।
ট্রাম্পের শুভবুদ্ধির উদয় না হলে যুক্তরাষ্ট্র হতে চলেছে কোভিড-১৯ এর পরবর্তী উপকেন্দ্র। রাজনীতি, ক্ষমতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বর্ণবৈষম্য, হিংসা, দোষারোপের খেলা ইত্যাদি সবকিছু থেকে সাধারণ মানুষ বাঁচুক, এ-ই শুধু আশা। পৃথিবীর ক্রান্তিকালে মানুষ নতুন করে আরও একবার মানুষ হতে শিখুক, এ-ই শুধু স্বপ্ন!