ইরাকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবারও উত্তাল হয়ে উঠেছে। গত ২৯-৩০ আগস্ট ইরাকের প্রভাবশালী ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক নেতা মুক্তাদা আল-সাদরের সমর্থকরা বাগদাদের সুরক্ষিত গ্রিন জোনের ভেতর অবস্থিত রিপাবলিকান প্যালেসে ঢুকে পড়ে। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী মিলিশিয়াবাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষে অন্তত ৩৪ জন নিহত হয়।
গত কয়েক বছরের মধ্যে এটাই ছিল ইরাকের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট। অনেকেই আশঙ্কা করছিল, ইরাক হয়তো আবারও একটা গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সংকটের উৎস কোথায়? কী কারণে ইরাকিরা একেবারে পার্লামেন্ট এবং রিপাবলিকান প্যালেস দখল করে ফেলার মতো আন্দোলন করছে? আর এতে মুক্তাদা আল-সাদরের ভূমিকাই বা কী?
ইরাকের বর্তমান এই সংকটের শুরু গত বছরের অক্টোবরে। সেসময়ের পার্লামেন্ট নির্বাচনে মুক্তাদা আল-সাদরের দল সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আসন পেয়ে বিজয়ী হয়। কিন্তু মোট ৩২৯ আসনের মধ্যে তার ৭৩টা আসন সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে তাকে কিছু কুর্দি এবং সুন্নি দলের সাথে জোট গঠন করতে হয়।
২০০৫ সাল থেকে ইরাকের প্রতিটি সরকারই ছিল সমঝোতার সরকার। অর্থাৎ বিজয়ী দল অন্য সবগুলো দলের সাথে আলোচনার মাধ্যমে মন্ত্রীত্ব এবং ক্ষমতা ভাগাভাগি করে সরকার গঠন করত। কিন্তু এবার মুক্তাদা আল-সাদর সিদ্ধান্ত নেন, এই প্রক্রিয়া থেকে তিনি বেরিয়ে আসবেন। তিনি শুধু তার জোটকে নিয়েই সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার গঠন করবেন।
তার এই সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ ছিল, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি নিজেকে ইরান-বিরোধী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে আসছিলেন। বাস্তবে অবশ্য মুক্তাদা আল-সাদর শুরু থেকে ইরান-বিরোধী ছিলেন না। ২০০৩ সালে মার্কিন আগ্রাসনের পর তিনি যখন প্রথম রাজনৈতিক ময়দানে আবির্ভূত হন, তখন ইরানের সাহায্য নিয়েই তিনি আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। এরপরেও বিভিন্ন সময় তিনি ইরানের সাহায্য নিয়েছেন, ইরানে গিয়ে পড়াশোনা করেছেন, এমনকি এখনও তার পরিবারের অনেক সদস্য ইরানেই আছে।
কিন্তু ২০১২-১৩ সালের দিক থেকে ইরাকের ইরানপন্থী প্রধানমন্ত্রী নূরি আল-মালিকির বিভিন্ন আগ্রাসী নীতির কারণে ইরাকি জনগণের মধ্যে ইরান-বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে জঙ্গি সংগঠন আইএসের উত্থানের পর এই মনোভাব আরও বৃদ্ধি পায়, যেহেতু আইএসের উত্থানের পেছনে অনেকেই মালিকির কট্টর ইরানপন্থী এবং সাম্প্রদায়িক নীতিকে দায়ী করে।
জনগণের এই ইরানবিরোধী মনোভাব বুঝতে পেরেই মুক্তাদা আল-সাদর ধীরে ধীরে ইরানের বলয় থেকে বেরিয়ে আসেন, এবং মালিকি-সহ অন্যান্য যেসব ইরানপন্থী নেতা দীর্ঘদিন ইরাক শাসন করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে নিজেকে ইরাকের ত্রাতা হিসেবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করেন।
২০২১ সালের অক্টোবরে মুক্তাদা আল-সাদরের দলের বিজয়ের পেছনেও তার ইরান-বিরোধী অবস্থানের অবদান ছিল। সে কারণেই তিনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করা নূরি আল-মালিকিসহ অন্যান্য ইরানপন্থী নেতাদের জোট সিএফ (কোর্ডিনেশন ফ্রেমওয়ার্ক)-কে বাদ দিয়ে নিজেই সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার গঠনের চেষ্টা করেন। কিন্তু সিএফের সদস্যদের বিরোধিতায় এবং অনাস্থায় তার সরকার গঠনের সকল প্রচেষ্টা একে একে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
নয় মাস চেষ্টার পরেও সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়ে বিরোধী জোটের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য গত জুলাই মাসে মুক্তাদা আল-সাদর তার দলের সদস্যদেরকে পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু তারা পদত্যাগ করার পর বিরোধী জোট সমঝোতার পথে না এসে বরং শূন্য হয়ে পড়া আসনগুলোতে অক্টোবরের নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করা নেতাদেরকে নিয়োগ দিয়ে পার্লামেন্টে নিয়ে আসে, এবং নতুন এই সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের মতো প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়।
ফলে আগস্টের শুরুর দিকে মুক্তাদা আল-সাদর তার সমর্থকদেরকে পার্লামেন্ট ঘেরাও করার নির্দেশ দেন। তারা গ্রিন জোনে প্রবেশ করে, পার্লামেন্টে ঢুকে পড়ে, এবং নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। সেই অচলাবস্থা না কাটতেই আগস্টের শেষ সপ্তায় হঠাৎ করেই মুক্তাদা আল-সাদরের দলের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা, কাজেম আল-হায়েরি, যিনি বর্তমানে ইরানে অবস্থান করছেন, তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে বসেন। শুধু তা-ই না, পদত্যাগের বার্তায় তিনি তার সমর্থকদেরকে মুক্তাদা আল-সাদরকে অনুসরণ না করে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে অনুসরণ করার নির্দেশ দেন।
স্বাভাবিকভাবেই মুক্তাদা আল-সাদর এতে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হন। এবং এই ঘটনার পেছনে তিনি ইরানকেই দায়ী হিসেবে সাব্যস্ত করেন। তার দৃষ্টিতে ইরাকি শিয়াদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা হ্রাস করে, তার প্রতিপক্ষ মালিকির জোটকে বিজয়ী করার জন্যই ইরান এই করেছে।
ঐ ঘটনার পর পরই সাদর নিজেও রাজনীতি থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন। এবং এর পরেই তার সমর্থকরা গ্রিন জোনের ভেতর এবং রিপাবলিকান প্যালেসে ঢুকে পড়ে, বিরোধী জোটের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। মাত্র দুই দিনের মধ্যেই ৩৪ জন নিহত হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সাদর নিজেই অনশনের হুমকি দেন এবং তার সমর্থকদেরকে আন্দোলন বন্ধ করার জন্য এক ঘণ্টা সময় বেধে দেন।
মুক্তাদা আল-সাদর অবশ্য এ ধরনের পদত্যাগের ঘোষণা আগেও কয়েকবার দিয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, তার এবারের পদত্যাগের ঘোষণাও আসলে প্রতিপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই দেওয়া হয়েছে। পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, তার সমর্থকরা ক্ষেপে গেলে কীরকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। এবং এরপর আবার হুমকি দিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে তাদের আন্দোলন বন্ধ করিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, একমাত্র তারই ক্ষমতা আছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার।
ইরাকের বর্তমান এই সংকট তাই ইরাক বনাম আমেরিকা সংকট না, অথবা শিয়া বনাম সুন্নি সংকটও না। এটা মূলত শিয়া বনাম শিয়া সংকটই, যেখানে একপক্ষে আছে ইরানের প্রতি অনুগত রাজনীতিবিদরা, যারা স্ট্যাটাস কো ধরে রাখতে চায়। আর অন্যদিকে আছে মুক্তাদা আল-সাদর, যে পুরোপুরি ইরান-বিরোধী না হলেও ইরানের প্রভাবের বলয় থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসে এককভাবে ইরাকের রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগ করতে চায়।
এই মুহূর্তে ইরাকের রাজপথে দৃশ্যত কোনো সংঘর্ষ নেই। কিন্তু যে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে এই সংকটের শুরু, সেটার কোনো সমাধান এখনও হয়নি। যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শীঘ্রই কোনো সমঝোতা না হয়, অথবা যদি পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন না দেওয়া হয়, তাহলে এরকম বা এর চেয়েও ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়তো শীঘ্রই আবারও ঘটতে পারে।