শতাব্দীর অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। শুধু শতাব্দীই নয়, মানবজাতির সামগ্রিক ইতিহাসের সেরা বিজ্ঞানীর তালিকাতেও উপরের দিকে থাকবে তার নাম। পদার্থবিজ্ঞানে বেশ কিছু বিপ্লব এসেছিল তার প্রচেষ্টায়। তার দেয়া আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে শত বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। যতবার করা হচ্ছে ততবারই এটি নির্ভুল হিসেবে আরো শক্ত অবস্থান গড়ে নিচ্ছে।
বিজ্ঞানে মাঝে মাঝে যুগান্তকারী তত্ত্ব আসে। ‘যুগান্তকারী’ শব্দটি বলার জন্য বলা নয়। আসলেই এর অর্থ যুগ পাল্টে দেয়া কিছু। বিজ্ঞানে নতুন কোনোকিছু প্রতিষ্ঠা করতে গেলে প্রচলিত অন্যান্য সূত্রের মাধ্যমে তাকে প্রমাণিত হতে হয়। ইতিমধ্যে সঠিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত আছে এমন সূত্র যদি নতুন তত্ত্বকে ভুল বলে রায় দেয় তাহলে নতুন সূত্র বা নতুন তত্ত্বটি বাতিল বলে গণ্য হবে।
তবে মাঝেমধ্যে এমন কিছু ঘটে যেখানে নতুন কোনো সূত্র পূর্বের সূত্রকে বাতিল করে নিজে সঠিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিজ্ঞানে এধরনের ঘটনাকে বলে প্যারাডাইম শিফট। আইনস্টাইনও ছিলেন এমন একটি প্যারাডাইম শিফটের মালিক।
তবে এত অনন্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভুলের ঊর্ধ্বে ছিলেন না। ব্যক্তিজীবনে তো অনেক ভুল করেছেনই, পাশাপাশি বিজ্ঞানেও ভুল করেছিলেন। তার কয়েকটি নমুনা দেখব এখানে।
১. মহাজাগতিক ধ্রুবক
আইনস্টাইন বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রদান করলেন। কিন্তু এ তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা আছে। সকল ক্ষেত্রে কাজ করে না। দরকার আরো বিস্তারিত একটি তত্ত্ব যেটি সমগ্র মহাবিশ্বকে যেকোনো পরিস্থিতিতে ব্যাখ্যা করতে পারবে। লেগে পড়লেন তিনি। প্রায় ১০ বছর পরিশ্রম করে তৈরি করলেন সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। এ তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসে যে মহাবিশ্ব প্রসারণশীল। এ কেমন কথা? তখন পর্যন্ত সকলের ধারণা ছিল মহাবিশ্ব সদা স্থিতিশীল। সবসময় যেরকম দেখছি মহাবিশ্ব আগেও সেরকম ছিল, ভবিষ্যতেও সেরকমই থাকবে।
তখনো এডউইন হাবলের পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন হয়নি। তখনো সকলে ধারণা করত মহাবিশ্ব স্থির। এই ধারণা থেকে বের হতে পারেননি আইনস্টাইন। তাই তিনি কৌশলী একটি কাজ করেন। তার সূত্রে একটি ধ্রুবক বসিয়ে দিলেন। তিনি চাইছিলেন সূত্রটাও ঠিক থাকুক, আবার মহাবিশ্বের প্রকৃতিও স্থির থাকুক। ধ্রুবক বসানোর পর সমীকরণের মানে দাঁড়ায়- মহাবিশ্ব স্থির।
কিন্তু পরবর্তীতে পদার্থবিজ্ঞান খুব দ্রুত বেগে এগিয়ে যায়। বিজ্ঞানীদের বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ এবং গাণিতিক বিশ্লেষণ বলে, মহাবিশ্ব আসলে প্রসারিতই হচ্ছে। দেখা যায় আইনস্টাইনের সূত্র প্রথমে যে ইঙ্গিত দিয়েছিল সেটিই সঠিক। আইনস্টাইন তার সূত্রকে সঠিক করতে গিয়ে যা করেছেন তা-ই ছিল মূলত ভুল। এর জন্য স্বয়ং তিনিই পরবর্তীতে আক্ষেপ করেছিলেন। বলেছিলেন এটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল– The biggest blunder।
পরবর্তীতে পরিস্থিতি আরো উল্টোদিকে মোড় নেয়। আশির দশকে কয়েকজন বিজ্ঞানী দেখান, এই ধ্রুবককে সাথে নিয়েই মহাবিশ্বের প্রসারণকে ব্যাখ্যা করা যায়। এখন? ধ্রুবক বসানোর ব্যাপারে আইনস্টাইন কি সঠিক ছিলেন? যুক্তি বলছে, না। কারণ আইনস্টাইন ধ্রুবক বসিয়েছিলেন মহাবিশ্বকে ‘স্থির’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য। গাণিতিকভাবে চলে এসেছে, তাই তিনি রেখেছেন, এমন নয়। আবার তিনি নিজেই পরবর্তীতে ধ্রুবকের ব্যাপারে আক্ষেপ করেছিলেন। এ হিসেবে ধ্রুবককে সাথে নিয়েও যদি মহাবিশ্বের প্রসারণ ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে তা আর যা-ই হোক, অন্তত আইনস্টাইনের কৃতিত্ব নয়।
২. কোয়ান্টাম মেকানিক্স
ব্যাপারটা বেশ অবাক করার মতো। আইনস্টাইন নিজেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সে অবদান রেখেছিলেন। তার ১৯০৫ সালে তার দেয়া ফটো-ইলেকট্রিক ইফেক্ট এর মাঝে অন্যতম। তিনিই ফোটনের অস্তিত্বের প্রমাণ করেছিলেন। তিনিই দেখিয়েছিলেন, আলোকরশ্মি তরঙ্গ হিসেবেও আচরণ করতে পারে আবার কণা হিসেবেও আচরণ করতে পারে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বে ফটো-ইলেকট্রিক ইফেক্টের শক্তিশালী প্রভাব আছে। তার উপর, এ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেই তো আইনস্টাইন নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।
কিন্তু তিনি নিজেই ছিলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিপক্ষে। নিলস বোরের ধারণা, হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব, শ্রডিংগারের বিড়াল প্রকল্প ইত্যাদি নিয়ে তিনি ছিলেন ঘোর নেতিবাচক।
হাইজেনবার্গ বলছেন, কোনো কণার ভর জানতে পারলে তার বেগ জানা যাবে না, আবার বেগ জানলে ভর জানা যাবে না। অন্যদিকে শ্রডিংগার বলছেন সাব এটমিক পর্যায়ে একটি বিড়াল একইসাথে জীবিত ও মৃত থাকতে পারে। পর্যবেক্ষণ করার আগে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না এর প্রকৃত অবস্থা কী। এই ব্যাপারগুলো আসলেই গোলমেলে। আইনস্টাইনের ধারণা ছিল মহাবিশ্ব এত উদ্ভট হতে পারে না। তাই আজীবন এর বিরুদ্ধচারণ করে গেছেন। অথচ তিনি নিজের অজান্তেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন।
৩. ব্ল্যাক হোল
অবাক হলেও সত্য আইনস্টাইন ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিলেন। ১৯১৫ সালে তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রদান করলেন। তার তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন জার্মান পদার্থবিদ কার্ল শোয়ার্তশিল্ড। তিনি আইনস্টাইনের তত্ত্ব ব্যবহার করে স্থান-কালের নতুন এক আচরণের ধারণা দেন। এটি দেখে আইনস্টাইন খুব পুলকিত হয়েছিলেন। কিন্তু পাশাপাশি বিরোধিতাও করেছিলেন।
আইনস্টাইন বলছেন, যদি শোয়ার্তশিল্ড প্রস্তাবনা সঠিক হয় তাহলে একটা দিক থেকে অসঙ্গতি দেখা দেবে। যদি কোনো নক্ষত্রকে অতি ক্ষুদ্র কোনো স্থানে সংকোচিত করা হয় তাহলে শোয়ার্তশিল্ড সূত্রানুসারে প্রকৃতির নিয়মাবলী এখানে অসার হয়ে যাবে। স্বাভাবিক কোনো নিয়ম এখানে কার্যকর হবে না। নক্ষত্রের ঘনত্ব ও মহাকর্ষীয় টান হয়ে যাবে অসীম। প্রকৃতি এত ভারসাম্যহীন হতে পারে না। তাই নতুন প্রস্তাবনাটি সঠিক হতে পারে না।
কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায় শোয়ার্তশিল্ড সঠিক। প্রকৃতির নিয়ম ওলটপালট করে দেয়া জিনিস আসলেই আছে। বর্তমানে এদেরকে আমরা বলি ব্ল্যাক হোল।
আইনস্টাইন এমনকি মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তের ব্যাপারেই নেতিবাচক ছিলেন। মহাকর্ষ তরঙ্গ তৈরি হতে পারে খুব শক্তিশালী মহাজাগতিক সংঘর্ষে। তিনি বলেন, মহাকর্ষ তরঙ্গ এতটাই ক্ষীণ হবে যে মানুষের পক্ষে কখনোই একে শনাক্ত করা যাবে না। অথচ তিনি ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। তার এই ভবিষ্যদ্বাণীর প্রায় ১০০ বছর পর বিজ্ঞানীরা খুব সূক্ষ্ম প্রক্রিয়ায় মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করেছেন। দেরি করে হলেও বিজ্ঞানীরা আইনস্টাইনের নেতিবাচকতাকে ভুল প্রমাণ করেছেন।
মূলত কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নন, সেরা সেরা বিজ্ঞানীর অনেকরই কিছু না কিছু ভুল আছে। এই যে আমাদের কালের সেরা বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকেই দেখুন। তিনিও জীবনে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে এরকম হয়। তবে সেগুলো ছাপিয়েও একটি বিষয় সকলের দৃষ্টিগোচর হওয়া উচিত। আইনস্টাইন এতই বড় মাপের বিজ্ঞানী ছিলেন যে, বর্তমানে তার করা ভুলগুলো নিয়েও আলোচনা হয়, গবেষণা হয় হয়। এমনকি বইও লেখা হয়। আর সেসব আলোচনা, সমালোচনা, বই, প্রবন্ধ ইত্যাদি আগ্রহ নিয়ে অনেকে পড়েও। সোজা কথা নয় কিন্তু!
তথ্যসূত্র
কিউরিওসিটি, বিগ থিংক, ফোর্বস, ডিসকভার ম্যাগাজিন, এনসাইক্লোপিডিয়া অব এস্ট্রোনমি অ্যান্ড এস্ট্রোফিজিক্স
Featured Image: RTBF